#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-১৮)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

কমিউনিটি সেন্টারের সাজানো দুর্দান্ত হয়েছে। এইখানের কালার থিমটাই হচ্ছে মূল আকর্ষণ। একপাশে কালো আর সোনালী রঙের ঝলকানি তো একপাশে সাদা গোলাপীর প্রেম প্রেম পরিবেশ, আবার একপাশে নীল আর হলুদের অন্য রকম ছোঁয়া। বর বধূর আসনের পেছনটা লাল আর রুপালী রঙ। এটাই মূল আকর্ষণ। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে এই দৃশ্যটা মেহজার কাছে। সে যখন শুরুতে ওয়েডিং প্ল্যানারদের থেকে এই আইডিয়া সম্পর্কে জেনেছে তখন সে ছিঃ করেছিল একপ্রকার। কিন্তু এখন! এখন তো সে চোখ ফেরাতেই পারছেনা। অসাধারণ লাগছে।

মেহজা হেঁটে গিয়ে গোলাপী আর সাদার সেই প্রেমময় পরিবেশের একটি সোফায় বসে পড়ে। এদিকটায় মানুষ খুব কম। কম বললে ভুল হবে। আপাতত কেউ নেই। তাছাড়া সকল অতিথিকে দেড়টায় আসতে বলা হয়েছে। বিল্ডিংয়ের কিছু পরিবার এসেছে এখনও অনেকেই বাকি আছে। তারা আগেই এসেছে কারণ রাদিফ আর রিমি তৈরি হবে। তারপর ফটোসেশন হবে অনেক ব্যাপার সেপার আছে। একসময় নিজের বিয়ে নিয়ে কতটা আনন্দই না কাজ করত মেহজার। শাড়ি নয় লেহেঙ্গা পড়বে, লাল নয় পার্পেল পড়বে, স্টিলেটো নয় প্লাটফর্ম পড়বে! কিন্তু হলো কী? সে এক রাতে দাওয়াত খেতে গিয়ে সেই রাতেই বিয়ে করে নেয় তাও আবার একপ্রকার মেরে ধরে বিয়ে দিয়েছে। বাসর নিয়েও ছিল কতটা উত্তেজনা, চাঁদ দেখবে তারা স্বামী-স্ত্রী, তারপর একটা কড়া লিকারের দুধ চা খাবে। শীতের রাতে তাদের বাসর হবে। চারিদিকে কুয়াশা থাকবে আর ঠান্ডা থাকবে আর সে তার প্রিয় মানুষটির বুকে মুখ লুকোবে। তা আর হলো না! বিয়ে বাসর সবই হয়েছে কিন্তু একটাও তার পছন্দ হয়নি। শুধু মানুষটাই পছন্দ হয়েছে আর বাকিসব বিশ্রী। মেহজা সোফায় হেলান দিয়ে গা এলিয়ে শুয়ে থাকে। তখন গাউনটা পরিবর্তন করে সে পাতলা সিল্কের শাড়ি পড়েছে। কেন পড়েছে সে জানেনা তবে তার মনে হয়েছে এমনটা করা দরকার। বেটা ইরফানকে কিছুটা নাঁচানো যাক! মেহজার ঘুম আসছে আরাম করে হেলে শোয়ার ফলে ঘুমটা নাড়া দিচ্ছে। আশপাশটা আরেকবার দেখে নিয়ে ভাবে ঘুমালে মন্দ হয়না।

ঘুম ঘুম চোখে মেহজা দেখতে পেল কেউ তার উপর ঝুকে আছে। মস্তিষ্কে ব্যাপারটি ছড়িয়ে পড়তেই সে সটান করে উঠে বসে। আকস্মিক উত্তেজনায় তার বোধ শক্তিটাও সে হারিয়ে ফেলে। ইরফান মেহজার হাব ভাব দেখে ভ্রুঁ কুঁচকায়। হালকা বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,

“ঘুমানোর কি আর জায়গা পাও নি? পাব্লিক প্লেসে ঘুমিয়ে কী বোঝাতে চাও মানুষকে? যে তুমি কত জোরে নাক ডেকে ঘুমাও! ঘুমানোর সময় তো তোমার দিকে তাঁকানও দায়। বিভৎষ লাগে তোমাকে ঘুমন্ত অবস্থায়।”

“বিভৎষ লাগে তোমাকে ঘুমন্ত অবস্থায়” এই কথাটিই মেহজার কর্ণগোচর হয়নি। রাগে মাথা দপদপ করা শুরু করেছে তার। ইরফানের কলার চেপে ধরে বলে,

“বিভৎষ লাগে আমাকে? যদি তা-ই হয় তাহলে এমন ঝুকে আছেন কেন? বিভৎষ চেহারাটার দিকে তাঁকিয়ে আছেন কেন?”

“চোখ চলে যাচ্ছে। বাই দ্যা ওয়ে! কলার ছাড়ো মেহজা। এটা একধরণের অসভ্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়।”

“না ছাড়ব না। কি করবেন না ছাড়লে! আমি বিভৎস! আমি!”

ইরফান ছোট্ট একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে। কলারে থাকা মেহজার হাতগুলো নিজে থেকে ছুটিয়ে নেয় তারপর মেহজার চুলের এক অংশ তার হাতে নিয়ে ঘ্রাণ শুকে। তারপর দুইহাত দিয়ে তার মাথাটা উঁচু করে কপালে একটি পবিত্র স্পর্শ এঁকে বলে,

“ঘুমালে মোহনীয় লাগে তোমায়। সুন্দর বা মায়াবী এমন কিছুই আমি বুঝিনা। আমি বুঝি তোমাকে দেখতে আমার ভালো লাগছে। আর সেটিও খুব বেশিই।”

মেহজা মৃদু হাসে। ইরফানকে অবাক করে সে ইরফানের ঠোঁটে নিজের ঠোঁটটি ছোঁয়ায়। তারপর সেখান থেকে চলে আসে। হাতে থাকা মোবাইলের স্ক্রিনে দেখে একটা বেজে গেছে। সে কম করে হলেও ত্রিশ পঁয়ত্রিশ মিনিট তো ঘুমিয়েছেই।

এতক্ষণ মেহজা আর ইরফানের একান্ত মুহূর্তগুলো দূর থেকে দেখে তানজীব। তার বিশ্বাসই হচ্ছেনা সে এমন কিছু দেখেছে। মেহজা নিজ থেকে ইরফানকে স্পর্শ করেছে। মস্তিষ্ক মেহজাকে নানান কথা বলছে কিন্তু মন বারবার বলছে এটা ভুল। এমন কিছুই সে দেখেনি মেহজা এমন কিছুই করবেনা। তাছাড়া ইরফান তার থেকেও বয়সে ছোট মেহজাকে এভাবে! না! কিছু ভালো লাগছেনা তার। এলোমেলো পায়ে হেঁটে গোল রাউন্ডের টেবিলগুলোর একটিতে গিয়ে বসে। অতিথিরা আসছে, গল্প করছে, যার যার মত করে আনন্দ করছে। সে পারছেনা এসবের কিছুই করতে। তার চোখ তো আর ভুল দেখেনি। মেহজাকে সে ভালোবাসে না এমনটা নয়। সে মেহজাকে পছন্দ করে এবং ভালোওবাসে। তবে সেটা কতটা গভীর তা সে জানেনা। তার মা তো এই মাসের শেষেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে ভেবেছিল। আর এখন কীনা সে মেহজাকে অন্য কারো সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলেছে!

“আরে মি. ইরফান ইয়াজিদ যে!”

সিনানের হঠাৎ আগমনে ইরফান কিছুটা অসন্তোষ হয়। তবু হালকা হেসে বলে,

“সিনান সাহেব! আপনি কখন এলেন?”

“মিনিট দশ হয়েছে বটে। আপনার কী খবর ভাই? দিনকাল কেমন যায়?”

“এইত যাচ্ছে ভালোই। আলহামদুলিল্লাহ্! আপনার?”

“আমারও আলহামদুলিল্লাহ্ ভালোই। তা মেহজাকে দেখেছেন কোথাও?”

“মেহজা! দেখেছি তো। আমার সাথেই ছিল এতক্ষণ একটু আগেই সে ওদিটায় গেছে। ফ্রেন্ড সার্কেলকে রিসিভ করতে গেছে হয়তো।”

“তাই নাকি! আগে বলবেন তো!”

একপ্রকার ছুটেই সিনান গমন করে ইরফান দেখানো পথে। ইরফান কিছুটা হকচকিয়ে যায় সিনানের উল্লাসিত মুখ দেখে। সেও পিছু নয় সিনানের লোকটির পেশা অনুযায়ী তার হাব ভাব একেবারেই ব্যাতীক্রম। সে নাকি মেজর না কি! যাই হোক! আস্ত মেয়েবাজ এই সিনান লোকটি— এসব ভাবতে ভাবতে সেও উপস্থিত হয় সেই জায়গায় যেখানে মেহজা তার বান্ধবীদের নিয়ে গল্প করছে। সিনান গিয়েই কিছুটা চিৎকার করেই বলে,

“হাই লেডিস্!”

সবাই কিছুটা চমকায় হুট করে অপ্রত্যাশিত কারো গলার আওয়াজে। অনা আর প্রথি সাথে মেহজার কলেজের আরো দুটি মেয়েও এসেছে আজ। অনার চোখে সিনান পড়তেই সে ফোঁস করে ওঠে বলে,

“আপনি এখানেও?”

“হ্যাঁ। কেন? থাকতে পারিনা বুঝি।”

“না। আপনি এই পরিবেশের সাথে বেমানান।”

“বেমানান মানে কী বলতে চাইছ তুমি? আমি কী মানুষ না! গরু ছাগল যে মাঠে ঘাস খাব পার্টি এটেন্ড করতে পারব না।”

“হ্যাঁ, গরু ছাগল না হলেও আপনি একটা ব ল দ। তাই আপনি আসতে পারেন না।”

“এই মেয়ে লিসেন! বয়সে আমি তোমার থেকে অনেক বড় তাই সে দিক থেকে সম্মান করবে আমাকে কিন্তু তুমি সেটা করছ না উল্টো অপমান করছ! আর তাছাড়া এটা তোমার পরিবার বা তোমার আত্নীয়র বিয়ের অনুষ্ঠান না। তুমি যেমন গেস্ট আমিও তেমন গেস্ট। তোমার কোনো অধিকার নেই আমাকে কিছু বলার। গট ইট!”

“আপ….

“জাস্ট বিকজ তুমি মেহজার ফ্রেন্ড তাই বেঁচে গেলে। অন্যকেউ হলে একেবারে বুঝিয়ে দিতাম আমি কে।”

অনার চোখের কোণে পানি জমে। মুখ লুকিয়ে সে জায়গাটি থেকে প্রস্থান করে। মেহজা অসহায় দৃষ্টিতে সিনানের দিকে তাঁকিয়ে দৌঁড়ায় অনার পেছনে। হুট করে ঝগড়া হবে তার জন্য সে একদমই প্রস্তুত ছিল না। কিছু বলতেও পারেনি কারণ সিনান তার জায়গায় সঠিক ছিল। কিন্তু এখন তো তার কলিজার বান্ধবীটা মনে কষ্ট পেয়েছে। আঘাতপ্রাপ্ত সই এর কাছে গিয়ে তাকে আস্থা দিতে হবে। দুঃখীত বলা লাগবে। মেহজা জানে অনা বড্ড সেনসিটিভ মেয়ে। বড্ড সেনসিটিভ!

ইরফান অবাক নয়নে চেয়ে আছে সিনানের দিকে। সিনানের চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগে তার সম্পর্কে যা ধারণা ছিল তা হুট করেই ভুল প্রমাণ করে দিল সিনান নিজেই। সে এমন স্ট্রিক্ট তা বাহির থেকে দেখলে কেউ বলতেই পারবেনা। ছোট্ট একটি কথাতে সে এতটা রেগে গেল? নট গুড! ওহ্! ইরফানের মনে পড়ল সে নিজেও তো শর্ট টেম্পার্ড!

তানজীবের ফোন কল আসায় সে করিডোরে গিয়ে দাঁড়ায়। কথা বলে পেঁছনে ফিরতে নিলেই কারো সাথে ধাক্কা খায়। অপর পাশের ব্যক্তিটি পড়ে যাবে বুঝতে পেরে তার মেদহীন কোমন আকড়ে ধরে। তারপর সেই অনাকাঙ্খিত চেহারা দেখে বলে,

“মিস ঈশিতা!”

“ডক্টর তানজীব!”

দুজনেই চেয়ে আছে একে অপরের দিকে বিস্মিত নয়নে। আদৌ সম্ভব! আবার কীভাবে দেখা হতে পারে তাদের!

#চলবে।
(শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে গেছে। গল্প তো শখের বসেই লিখি বলুন! তাই বলে পড়ালেখা তো না করলে হবেনা। এই কয়দিন আমি খুবই চাপের মধ্যে ছিলাম। তাই গল্প দিতে পারিনি। এখন থেকে দুইদিন পর পর দিব। কেউ কিছু মনে করবেন না আমার পরিস্থিতি বুঝেন প্লিজ! পরবর্তী পর্ব বড় হবে ইনশাআল্লাহ্! আজ একটু মানিয়ে নিন। অনুরোধ রইল।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here