#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-১৩)
লেখনীতে—ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

মেহজা ফ্রেশ হয়ে এসে ইরফানের বারান্দায় গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। আশেপাশের প্রত্যেকটা ফ্ল্যাটে আলো জ্বলছে। মেহজা এই মুহূর্তে যেই বিল্ডিংটাতে আছে সেটি সবথেকে বড় বোধ হয়, গাড়ি থেকে নামার পর যে চোখ বুলিয়েছিল তখন দেখে নেয় ভালো করে। ইয়াজিদের রুম দশ তলায় কারণ এটিও ডুপ্লেক্স। বড়লোকের বিরাট কারবার বলে একটা কথা আছেনা! মেহজা নিচে ডাইনিং এ যেতে উদ্যত হলে তার চোখে আবারও সেই ফটোফ্রেমটি পড়ে। বেশি মাথা ঘামায়না সে এটা নিয়ে। আগের মতো কৌতূহলবোধ তার আর নেই।
নিচে গিয়ে দেখে ইমা সব রেডী করে ফেলেছে। ভাই-বোন দুজনেই টেবিলে বসা। তবে খাচ্ছেনা, গল্প করছে। মেহজা গিয়ে ইমার পাশে বসতেই ইমা তার প্লেটে ভাত বেড়ে দেয়। তারপর সবাই একসাথে খাওয়া শুরু করে। খাওয়ার ফাঁকে মেহজা একবার ইরফানের দিকে তাঁকায়। ইরফান হয়তো খাবারে মজা পাচ্ছেনা, জ্বরের কারণ রুচি চলে গেছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। তখন হঠাৎ ইমা ইরফানকে বলল,

“বাবু! খেতে খারাপ লাগছে বুঝি? কষ্ট করে হলেও এখন খেয়ে নে। ঔষুধ তো আর খালি পেটে খেতে পারবিনা।”

ইরফান শুধু ছোট করে “হুম” বলে। মেহজা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এসব দেখে তার নিজেরও খাওয়ার ইচ্ছা মরে গেছে। কিন্তু না খেয়েও উঠতে পারছেনা। খাবার অপচয় করা ঠিক নয় এটা মেহজাও মানে আর ইমাও বারবার বলে দিচ্ছে। ইরফান বেশ অর্ধেক খেয়ে উঠে যায়। সে আর পারছেনা খেতে। ইমা আর কিছু বলেনি। জোর করে খাওয়ালে পরে বমি হতে পারে।

ইমা আর মেহজা সব কিছু ঠিকঠাক করে যার যার রুমে চলে যায়। ইমা বারবার বলে দিয়েছে ইরফানকে ঔষুধ খাইয়ে দিতে। আর ইরফান যদি বলে খেয়েছে তো ঔষুধের পাতা চেক করতে। যদি দুটো ঘর খালি থাকে তাহলে যেন বুঝে নেয় খেয়েছে। মেহজাও ইমাকে আশ্বস্ত করে সে সব সামলে নিবে। ইমা গেলে মেহজা কিছুক্ষণ বাসাটির এদিক ওদিক দেখে নেয়। আটটি রুম আছে এর মধ্যে ছয়টির একটি হলো ইরফানের বাবা-মায়ের, আর চারটি তার চার বোনের, একটি গেস্ট রুম আর একটি ছোট খাটো জিম করার রুম, বেডরুম প্রত্যেকটার সাথে এটাচড্ বাথরুম আর নিচে উপরে দুইটা লিভিং একটা ডাইনিং আর কিচেন আর কমন বাথরুম একটি। বারান্দা তিনটি রুমেই আছে একটা ইরফানের একটি ইরার ও তাদের বাবা-মায়ের রুমে। আর এমনিতে দোতলায় এক পাশে কাঁচের দেওয়াল যেটি দিয়ে বাহিরের অনেক কিছুই দেখা যায়। খুবই খোলামালে বাসা এটি। ইরফান নিজে এই ফ্ল্যাটটি নিয়েছে। নিজের একার হিসেবে নেয়নি বাবা-মা বোনদের জন্যও ভেবেছে আবার তাদের কথা ভেবে তাদের পছন্দ মতো সাজিয়েছে। এই ব্যাপারটা মেহজার খুবই ভালো লাগে। আজকাল কয়জন তার পুরো পরিবার আলাদা হওয়ার পরেও তাদের জন্য এতকিছু করে!

রুমে গিয়ে মেহজা দেখে ইরফান শুয়ে আছে বেডের একপাশে। মেহজা প্রথমে বেড সাইড টেবিলের ঔষুধ গুলো পরখ করে নেয়। ইরফান ঔষুধ খেয়েছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে সে। মেহজা দেখে বারান্দার গ্লাসের ডানপাশে একটি লম্বা চিকন টেবিলে ইলেক্টিক কেটলী, কফি মেশিন সহ আরো অনেক সামগ্রী আছে কফি এবং চা বানানোর। মেহজা আলতো হেসে সেদিকে গিয়ে একটু কফি করে নেয়। দুধ নেই এখানে তারমানে ইরফান ব্ল্যাক কফিই খায়। কিন্তু মেহজা তো ব্ল্যাক কফি অপছন্দ করে। মগটা রেখে দিবে তখনিই পেছন থেকে ইরফান বলে ওঠে,

“নিচের ড্রয়ারে ইনটেক মিল্ক আছে। নিয়ে নাও সেখান থেকে।”

মেহজা হঠাৎ ইরফানের আওয়াজে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। পড়ে ইরফানকে তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শান্ত হয়। লোকটি ঘুমায়নি! মেহজা কোনো প্রকার নড়াচড়া করছেনা দেখে ইরফান কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে নিজেই গিয়ে দুধের প্যাকেটটা নেয়। মেহজাকে বলে,

“লিকুইড হলে হবে তো?”

মেহজা বাধ্য মেয়ের মতোই মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়,

“জ্বি হবে।”

ইরফান নিজেই এবার কফিটা সুন্দর করে তৈরি করে দেয় মেহজাকে। মেহজা সেটি নিয়ে এক চুমুক দেয়। অসাধারণ খেতে। কফিটা নিশ্চয়ই কোনো ভালো ব্রেন্ড এর, দুধ, চিনি সবকিছুই বিদেশী মনে হচ্ছে। মেহজা এখন আর কৌতূহল দমন করতে না পেরে ইরফানকে বলে,

“আচ্ছা এই কফিটা নিশ্চয়ই কোনো ভালো ব্রেন্ড এর! এতো মজার কফি আমি আর কখনও খাইনি।”

ইরফান মেহজার চঞ্চলতা দেখতে পেয়ে আনন্দিত হয়। সে পাশে থাকে ডিভাইনে গিয়ে বসে বলে,

“হ্যাঁ। এটি নাম করা কফির মধ্যে একটি। বিশ্বের সবচেয়ে আজব কফি বলে আমি মনে করি। এটার দামটাও কিন্তু চওড়া! মূলত এটি এক ধরণের পাখির মল দিয়ে তৈরি করে। ইন্দোনেশিয়াতে এই কফি পাওয়া যায়। সেখানে কফি পরিপক্ক হলে গাছ থেকে তুলে পাখিগুলোকে খেতে দেয়। তারা সেটি গোটা খেয়ে ফেলায় পরে তাদের মল থেকে সেগুলোর বীজ পাওয়া যায়। তারপর সেগুলো নিয়ে রোদে শুঁকিয়ে ভালো মতো ওয়াশ করে ব্লেন্ড করে। আর….

ইরফানকে আর বলতে না দিয়েই মেহজা মুখ বাঁকিয়ে ফেলে বলে ওঠে,

“ছিঃ আপনি আমাকে আগে বলেন নি কেন?”

“আগে বললে কী করতে!”

“কী করতাম মানে! খেতাম না ইভেন ছুঁয়েও দেখতাম না।”

“আমার আগে বলা না বলার ধার ধারো তুমি? আর তাছাড়া তুমি নিজেই খেতে নিলে তাই আমি দিলাম। আর তাছাড়া এটাতে খারাপ কীসের! এটা সম্পূর্ণ পরিষ্কার করেই তৈরি করা হয়েছে। সব হাবিজাবি তো খেতে পারো এটা খেলে কী এমন হবে? আর খেতে তো মজা। তুমি নিজেই তো বললে।”

“তা ঠিক। মজা অনেক। এটা খেলে কোনো সমস্যা হবেনা তো! এটা সত্যিই পরিষ্কার?”

ইরফান এবার চোখ গরম করে দাঁতে দাঁত চেপে মেহজাকে বলল,

“ফার্স্ট ক্লাস কফি নিয়ে ছি ছে করছো আর রাস্তায় নোংরা পরিবেশের আনহেইজেনিক খাবার তো গান্ডে পিন্ডে খাও। আমি জানিনা বুঝি!”

“কীভাবে জানেন?”

“দেখেছি তো তাই।”

“সত্যি? আপনি আমাকে দেখেন!”

“না দেখার কী আছে।”

“ওহ ফলো করেন বুঝি?”

“কেন? ফলো করার কী আছে! রাস্তায় আসা যাওয়া করতে মাঝেমাঝে দেখি।”

“আপনার অফিস তো ওখানে না।”

“ওখানে না হলে কী আমার যাওয়া যাবেনা! আমি দরকারেই যাই।”

“আমাকে দেখতে যান না তা শিউর। তবে ফুলটুসি দেখতে যান সেটা বুঝে গেছি।”

“হোয়াট! তোমার মুখের ভাষা এত বিশ্রী!”

“আগে জানতেন না?”

“চুপ করবে তুমি! অসহ্য!”

“আমি তো অসহ্য হবোই বাকি সব আপনার সহ্য হয় আমি ছাড়া। আজ আপনার সাথে ঐ মেয়েটা কে ছিল?”

“কোন মেয়ে?”

“নাটক করবেন না। আমি দেখেছি আজ আপনাকে একটি মেয়ের সাথে। অবশ্য থাকবেই তো। সে সুন্দর, স্লিম, লম্বা, বয়সেও ডিফারেন্ট নেই আমার মতো, সে নিশ্চয়ই উচ্চশিক্ষিত! কতোটা মর্ডান! ইশ! দেখলেই তাঁকিয়ে থাকার মতো।”

ইরফান কঠিন দৃষ্টিতে তাঁকায়। কোনো মানুষ নিজেকে ছোট করে কীভাবে কথা বলতে পারে! তার চোখে তো মেহজাই একজন পরিপূর্ণ নারী। মেহজাকে সে যে নজরে দেখে এসেছে এখন অব্দি আর কোনো মেয়েকে সে সেভাবে দেখেনি। কোথায় মেহজা অসুন্দর? তার মেহজা খুবই সুন্দর, মেহজা মোটা নয় মেহজা কী জানে মেহজার কোমরের মধ্যে যে হালকা ভাজটি পড়ে সেই ভাজটি ইরফানকে মুহূর্তের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ হারা করে দিতে সক্ষম। সেই ভিজে শাড়ি পরিহিত মেহজার কোমর সেদিন কতোটা আকৃষ্ট করেছিল তাকে সে কী জানে? লম্বায় মেহজা তার কাঁধ বরারবর হিল পড়লে তো তার গলার সমান হবে। একেবারে পার্ফেক্ট! তাও সে কেন এসব বলছে? সে কী হিংসা করছে! ইরফানের কাছে অন্য কোনো মেয়ের আনাগোনা কী তাকে কষ্ট দেয়। ইরফান মেহজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তারপর বলে,

“তুমি সিনানের সাথে কী করছিলে তখন?”

মেহজার এবার চরম রাগ উঠে। মেহজাকে সে এর আগেও সিনানের নাম নিয়ে কিছু বাজে ইঙ্গিত করেছিল। এবারও করছে। সে কী মেহজাকে বিশ্বাস করেনা! কেন মেহজার প্রতি তার এতো অবিশ্বাস! মেহজার এবারও পুরো কফি খাওয়া হয়না। মগটা রেখে দ্রুত গতিতে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। আর রাগে ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। ইরফান মৃদু হেসে ঘরের সব লাইট বন্ধ করে দরজাটা লক করে দেয় ভালো করে। তারপর পা বাঁড়ায় বিছানার দিকে। মেহজা ইরফানে কাজে রাগ ভুলে আতংকিত হয়ে পড়ে। সে কী করতে চলেছে মেহজা বুঝে যায়। উঠতে নিলেই ইরফান মেহজাকে ঝাপটে ধরে বলে,

“যাচ্ছো কোথায়? পানিশমেন্ট আছে তোমার! পরপুরুষের সাথে হেসে খেলে কথা বলতে পারো আর আমাকে দেখলেই রাগ দেখাও। খুব বেড়েছো তুমি। আজ তোমাকে কঠিন শাস্তি দিব। ওয়েট!”

বলেই টি শার্ট টি গা থেকে খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। মেহজাও কম কীসে ইরফানের প্রতিটা কাঁমড়ের বদলে সে পাল্টা আক্রমণ করে। কখনও নখ দিয়ে পিঠে আঁচড় দেয় তো কখনো নিজেই ইরফানকে কাঁমড়ে দেয়। এটি যেন যুদ্ধ সম!

————————-
সকালে মেহজা আগে উঠে। ঘুমন্ত ইরফানের দিকে তাঁকিয়ে সে কিছুক্ষণ মনে মনে কিছু ভাবে। তারপর দৌঁড় লাগায় বাথরুমে। ইরফান উঠে গেলে তার সামনে সে লজ্জা পাবে। তাই আগেই গোসল সেরে রেডী হয়ে সোজা ইমার কাছে ছোটে।

ইমা বিছানার চাঁদর ঠিক করছিল। মেহজার হুট করে আগমনে সে কিছুটা ভড়কে যায়। মেহজাকে কিছু বলবে তার আগেই তার দিকে নজর যায়। শান্ত স্বরে বলে

“এই শীতের ভোরে গোসল নিয়েছো কেন তুমি? হোস্টেলেও এমন কর নাকি! একজন তো জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছেই এখন তুমিও কী সেটাই চাচ্ছো?”

তখনিই ইমার চোখ যায় মেহজার ঠোঁটের পাশে। নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কটমট দৃষ্টিতে ফ্লোরের দিকে তাঁকিয়ে থাকে। সে নিজেই বোকা বনে গেল। তার মনে রাখা উচিত ছিল মেহজার সাথে তার অসভ্য ভাইটাও যে রয়েছে।

#চলবে।

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।মেহজা ইরফানের রোম্যান্সটি স্কিপ করার মতো নয়। আমি সাবলীল ভাষায় লিখার চেষ্টা করি। জানিনা কতোটা পেরেছি, তবুও চেষ্টায় আছি। আজ এমন কিছু দিতাম না আপনারাই তাদের বিরহ মানছিলেন না তাই! কেমন হয়েছে জানাবেন কিন্তু! আপনাদের রেসপন্স নেই আগের মতো তাই লিখার আনন্দ হারিয়ে ফেলছি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here