#গল্প
বৃষ্টি_ভেজা_অরণ্য
#পর্ব_৯
-শাতিল রাফিয়া
তার মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে।
সে বলে- হেই! আই নো ইউ!
আমিও মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বললাম- আপনি রাতুল হাসান!
আর তখনই বুঝতে পারলাম ‘রাতুল হাসান’ নামটা শুনে কেন সেদিন চেনা চেনা লেগেছিল।
রাতুল মাথা নেড়ে বলল – কারেক্ট! আপনার নামটা যেন কি?
– বৃষ্টিলেখা।
রাতুলের সাথে তার মা আর বোনকে দেখলাম। তার বোন আমার বয়সীই হবে বা দুই-এক বছরের বড় হতে পারে।
রাতুলের মা জিজ্ঞেস করলেন- তোমরা দুইজন আগেই একে অপরকে চেন?
রাতুল মাথা নেড়ে বলে – উনাদের অফিস আমাদের গ্রুপ থেকে একটা ডিল পেয়েছে। পাওয়ার পেছনে মেইন ক্রেডিট ওনার ছিল। শেষ মুহূর্তে এমনভাবে উনি বাজিটা ঘুরিয়ে দিয়েছে!
আমি হাসার চেষ্টা করতে করতে বললাম – না এরকম কিছু না!
রাতুল হাসান বলে- উনি বলছেন ঠিকই কিন্তু বৃষ্টি আমার কাছ থেকে ডিল নিয়ে যাওয়া এত সহজ নয়। আপনি সেটা করে দেখিয়েছেন।
আমি এবার ভাল করেই হাসলাম!
আমার মা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন – আগে থেকেই যেহেতু চেন সেটা তো আরও ভাল হল! কি বলেন আপা?
রাতুলের মা বললেন – জ্বি আপা। ওরা নিজেরা নিজেরা কথা বলে নিক। আমি বৃষ্টিলেখার ছবি আগেই দেখেছি। আমার তো শুরু থেকেই ওকে পছন্দ। ওরা কথা বলে সব ঠিক করুক।
আমি আজ রাতুলকে ভাল করে খেয়াল করলাম। মাঝারি উচ্চতা, শ্যামলা আর একদম সাধারণ চেহারা। তাকে দেখে কেউ বলবে না এত বড় কোম্পানির চেয়ারম্যানের ছেলে! রাতুল কিছুক্ষণ ধরেই উশখুশ করছিল। কিন্তু আলাদা করে কথা বলার কথা শুনে সে মহা খুশি হয়ে ওঠে!
ভাবী আমাদের আমার রুমে পাঠিয়ে দেয়।
ভাবী যাওয়া মাত্র সে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে আমার দিকে তাকাল। আমি অবাক হয়ে তার কাজকর্ম দেখছি।
রাতুল আমাকে বলে- বৃষ্টি আপনার সাথে আমার খুবই জরুরি একটা কথা আছে।
– কি কথা?
– বৃষ্টি আপনি প্রথম মেয়ে নন যাকে আমরা দেখতে এসেছি। এর আগেও আমি দশ-বারোজন মেয়ে দেখেছি কিন্তু..
– কিন্তু আপনি তাদের রিজেক্ট করে দিয়েছেন?
রাতুল মরিয়া হয়ে বলে- না! আমি রিজেক্ট করিনি! ওরা আমাকে না করে দিয়েছে!
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কেন?
– কারণটা আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন। আমি এখন আপনাকে কিছু কথা বলব।
– বলুন।
– বৃষ্টি আমার চরিত্রে দোষ আছে!
কথাটা সে এমন নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল যেন এটি খুব সাধারণ একটা ব্যাপার!
আমি কিছু বুঝতে না পেরে চোখ কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- মানে?
– মানে বুঝতে পারছেন না? আমার ক্যারেক্টার খারাপ! আমি নারী নেশায় আসক্ত! আরও খুলে বলতে হবে?
আমি অবাক হয়ে হাঁ করে রাতুলের দিকে তাকিয়ে রইলাম! এভাবে মেয়ে দেখতে এসে কেউ এইসব কথা বলে আমি জীবনে শুনিনি। আমি কি রিঅ্যাকশন দিব সেটাও বুঝতে পারছি না।
রাতুল বসে বলে- কলেজে থাকতেই আমার একাধিক মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল। ভার্সিটিতে উঠে আমি অনেকের সাথে ফিজিক্যাল রিলেশনে জড়িয়েছি, অবশ্যই স্বেচ্ছায়!
বলতে বলতে আমার দিকে তাকিয়ে রাতুল থমকে গেল!
বিব্রত হয়ে বলে- স্যরি! একটু বেশিই খোলাসা করে ফেলছিলাম! আপনি তো বুঝে গেছেন! আমি এই সংসার করা টাইপ ছেলে নই। আমার মা-বাবাও জানেন। কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা! তাদের ধারণা বিয়ে করলে আমি পাল্টে যাব! যাই হোক, আপনার সামনে আমি এখন তিনটা অপশন রাখছি।
প্রথম হল, যদি আপনি আমাকে এসব কিছু জেনেও বিয়ে করেন, করতে পারেন। আমি তখন চেষ্টা করব এসব থেকে দূরে সরে এসে আপনার সাথেই লাইফ লিড করার! আমরা ছয়মাস বা একবছর ট্রাই করতে পারি! মানে ধরুন আপনি মুভির মত ‘ওকে ভালবেসে বদলে ফেলব’ টাইপ কাজ করতে পারেন! আমি যদি সফল হই, আমরা আমাদের সংসার কন্টিনিউ করতে পারি! আর না পারলে যেটার চান্সই সবচেয়ে বেশি কারণ এতদিনে চেষ্টা করে পারিনি, যাই হোক, না পারলে আমরা সেপারেশনে যেতে পারি। ডিভোর্স দিতে পারি।
সেকেন্ড অপশন হল, আমি যদি এসব থেকে দূরে সরতে না পারি এরপরও আপনি যদি আমার সাথে থাকতে চান থাকবেন। আমার কোন অসুবিধা নেই। আমরা সমাজের চোখে হাসবেন্ড ওয়াইফ হয়ে থাকব।
আর লাস্টের অপশন হল আমাকে বিয়ে না করা।
আমি জানি এই লাস্ট অপশনই কাজ করবে। তাই প্রথমের দুইটা বাদ। তবুও বললাম তার কারণ আপনি যেন না ভাবেন যে আমি বিয়েতে মানা করেছি। আমি কিন্তু মানা করিনি। কিন্তু সব আপনাকে জানিয়ে রাখলাম! কারণ কারোর জীবন নিয়ে খেলা করার বা কারোর জীবন নষ্ট করার অধিকার কি আমার আছে, বলুন?
তার এই দীর্ঘ বক্তব্য শেষ করে সে আমার উত্তর শোনার আশায় আমার দিকে তাকিয়ে থাকে! আমি কি বলব আমি জানি না। আমি এতটা অবাক জীবনে কখনোই হইনি! সে সবকিছু এত খোলামেলা ভাবে শেয়ার করল আমার সাথে! আমার মাথাটা বনবন করে ঘুরছে! সব কেমন ভজকট পাকিয়ে যাচ্ছে!
আমি কোনমতে বললাম- আমার চিন্তা করার জন্য কিছু সময় দরকার!
রাতুল অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে- আপনি চিন্তা করবেন?! কি আজব!
– তার মানে?
রাতুল হাসতে হাসতে বলল- আপনি পুরো কথাটা শুনেছেন কিন্তু বেশিরভাগ মেয়েই আমার ফিজিক্যাল রিলেশন হয়েছে শুনেই মানা করে দিয়েছে। অনেকে তো এতটাও শোনেনি! অনেক গার্লফ্রেন্ড ছিল শুনেই বাদ! কেউ কেউ সব শুনে নিষেধ করেছে আর আপনি বলছেন আপনি ভেবে দেখবেন!
আমি কিছু না বলে বিস্মিত চোখে রাতুলের দিকে তাকিয়ে থাকি! তার কথা শুনে মনে হয় সে একটা খোলা বই, যাকে চাইলেই সবাই পড়ে ফেলতে পারে। কিন্তু পড়তে গেলে আর ভেতরে ঢোকা যায় না!
রাতুল বলে- আমি জানি আপনার উত্তর ‘না’ হবে। বাট আমার ফ্যামিলিকে দয়া করে বলবেন না যে এসব কারণে নিষেধ করে দিয়েছেন! বলবেন আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি বলে মানা করেছেন। কারণ মা আমাকে এসব শেয়ার করতে নিষেধ করেছেন। এসব শুনলে সবাই মানা করে দেয় যে তাই। আর এটা নিশ্চয়ই কোন গর্বের খবর না!
ভাবী এসে নক করে – সব কথা কি আজকেই বলে ফেলবে নাকি?
রাতুল বলে- চলুন ডাকছে। আজকের পরে আপনার সাথে আর দেখা হবে কি না জানি না। হোপ হবে। আপনি ভাল থাকবেন।
রাতুলকে বললাম – আপনি যান। আমি আসছি।
রাতুল যাওয়ার আগে আমাকে বলে- আপনাকে কিন্তু সব খুলে বলেছি। তাই বাইরে বলবেন আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি। এসব কথা দয়া করে বলবেন না। প্লিজ এই ফেভারটা করবেন।
আমি মাথা নাড়লাম। রাতুল বের হয়ে গেল। আমি থম মেরে রুমে বসে থাকলাম। কি হল এটা? আমি অবশ্য এতে একেবারেই মর্মাহত বা দুঃখিত নয়। রাতুল তার লাইফে কি করে সেটা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আমি এবার ভাবতে শুরু করলাম। আমার সাথে সবকিছু উল্টাপাল্টা হচ্ছে! আমি কি করব এখন?
কিছুক্ষণ পর আপা আর ভাবী আসে।
আপা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে- রাতুল তো রাজি! তা তোর উত্তরটা কি? আর ভেতরে এতক্ষণ কি গুজুরগুজুর করলি দুইজন?
ভাবী হাসতে হাসতে বলল- বৃষ্টি তো কথাই বলতে চাইছিলে না। আজ দেখ! কথা আর থামেই না!
উহহ! এসব আহ্লাদ এখন অসহ্য লাগছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম- ওনারা চলে গেছেন?
– না খাচ্ছে। তুই..
আপাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আমি উঠে ওখানে চলে গেলাম।
বাবা বললেন- বৃষ্টি এসেছে। তা বৃষ্টি রাতুল বলছিল তুই নাকি একটু সময় চেয়েছিস! উত্তর কি ভেবেছিস নাকি আরও সময় নিবি?
আমি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললাম- না আর সময় নেব না। আমি রাজি।
রাতুলের মা আর বোনকে অত্যন্ত আনন্দিত হতে দেখলাম! আর রাতুলকে দেখে মনে হল তার সামনে পৃথিবীর অষ্টমাশ্চর্য ঘটনাটি সে ঘটতে দেখছে!
আমি হেসে তার দিকে তাকিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম- কি হয়েছে আপনার? আপনি রাজি নন?
রাতুল তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে হড়বড় করে বলে- রাজি! অবশ্যই রাজি! আমি রাজি!
কিন্তু তার চোখমুখ থেকে বিস্ময় গেল না।
রাতুলের বোনের নাম রত্না।
রাতুলের মা বললেন – আমার মেয়েটার আগামী সপ্তাহে বিয়ে। বিয়ে মানে আকদ করে রাখব আর কি। অনুষ্ঠান পরে হবে। আমি ভাবছি ওর আকদের পরেই রাতুলের আর বৃষ্টির বিয়েটা সেরে ফেলি? একেবারে অনুষ্ঠানসহ! আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে!
বাবা বলেন- না আমাদের আর কি আপত্তি!
– ঠিক আছে। তাহলে তো কথা পাকা হয়েই গেল।
আমার ছোট খালা মিষ্টি বের করে আনলেন। আমি পুরোটা সময় মুখে একটা মেকি হাসি ঝুলিয়ে রাখলাম। আসলে আমি জানি আমার ভেতরে কেমন লাগছে, কি ঝড় চলছে!
আমাকে মিষ্টি খাওয়ানোর সময় রাতুল ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে – আপনি কি আমার সব কথা ঠিকভাবে বুঝেছিলেন?
– হ্যাঁ!
– আপনি রাজি হলেন কি করে?
আমি চোখে রহস্য ফুটিয়ে বললাম- আপনি না বললেন আপনাকে ভালবাসা দিয়ে ভাল করে ফেলতে? চেষ্টা করে দেখি তাইলে?
রাতুল হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি পাত্তা দিলাম না।
রত্না আমাকে বলে- ভাবী.. এই ভাবীই বললাম কিন্তু তোমাকে..
আমি হেসে মাথা নাড়লাম- অবশ্যই!
– ভাবী তুমি আমার আকদের শপিংসহ সব কিছুতে থাকবে কিন্তু।
আমি কিছু বলার আগেই রাতুলের মা বললেন – এক্স্যাক্টলি! আম্মু তুমি সবকিছুতে আমন্ত্রিত!
– ভাবী আমরা কাল শাড়ি কিনতে যাব। সকালে। আমি তোমাকে তুলে নিব ঠিক আছে?
– ঠিক তো আছে। কিন্তু আমার যে অফিস আছে!
রাতুলের মা বললেন – চাকরি ছেড়ে দাও বৃষ্টি! ইউনিকে চলে আসো। তোমার তো ইন্টারভিউও দিতে হবে না। এই রাতুল আজই ওর জয়েনিং লেটার রেডি কর!
আমি মনে মনে বললাম- চাকরি তো ছাড়ব। তবে আমার বিয়ের কার্ড আর রেজিগনেশন লেটার দুইটা একসাথে অরণ্যের মুখে ছুঁড়ে মেরে তারপর!
হেসে রাতুলের মাকে বললাম – হ্যাঁ আন্টি ছাড়ব। বিয়ের আগে আগে ছাড়ি?
– ঠিক আছে।
রাতুলরা চলে গেলে আপা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগল!
– বৃষ্টি তোরও বিয়ে হয়ে যাবে! এখন আর এসে তোকে পাব না!
– কি আশ্চর্য! আমিও তো আসব!
– তবুও! আমরা দুইবোন আর একসাথে শুয়ে গল্প করে রাত পার করব না!
ভাবী বলে- আসলেই বৃষ্টি! আনন্দের সাথে সাথে কষ্টও লাগছে। তুমি চলে যাবে।
একটুপরেই বাসায় উৎসব শুরু হয়ে যায়। আপা আর ভাবী লিস্ট করতে থাকে। ভাইয়া আর বাবা কি সব হিসাব নিকাশে ব্যস্ত হয়ে গেল। আর মা আর খালা সবাইকে ফোন করে করে খবর দিতে থাকে।
আর আমি ঘরে বসে দরজা বন্ধ করে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি। আমার মনে হচ্ছে আমার কাছ থেকে কি যেন হারিয়ে গেছে! নিজের জীবন নিয়ে যে জুয়া খেলছি সেটা কি ঠিক হচ্ছে?
কিছুক্ষণ পর টের পেলাম ফোন এসেছে। আননোউন নম্বর।
চোখ মুছে ধরলাম – হ্যালো।
– বৃষ্টি? আমি রাতুল!
– চিনেছি। বলুন!
– বৃষ্টি কেন নিজের জীবনটা নষ্ট করছেন? আমি কিন্তু সত্যিই শিওর না যে এই নেশা থেকে বের হয়ে আসতে পারব কি না! আপনি আরেকবার চিন্তা করে..
রাতুলকে থামিয়ে আমি বললাম – আমার জন্য আপনার নিজেকে বদলাতে হবে না। আমি চাই আপনি এসব না করুন। এটা তো আসলেও ভাল কাজ না। তবে আমার জন্য নিজেকে বদলাতে হবে না। আমি কোনদিন আপনার পার্সোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করব না।
রাতুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে – একটা পার্সোনাল কোয়েশ্চেন করি?
– করুন।
– আপনি কি ছ্যাঁকা খেয়েছেন?
আমি এবার শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম- আপনার কি মনে হয় কোন ছেলে আমাকে ছ্যাঁকা দিবে?
রাতুল থতমত খেয়ে বলে- স্যরি! আমি সেটা মিন করিনি!
আমি এবার শান্ত গলায় বললাম- রাতুল, শুনুন আমি যেরকম আপনার পার্সোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করছি না বা করব না সেরকম আপনিও প্লিজ আমার পার্সোনাল লাইফ নিয়ে কোন প্রশ্ন করবেন না! প্লিজ। আপনি শুধু আমাকে বিয়ে করে সামাজিক স্বীকৃতি দিন। আমি আপনার জীবনে কোন সমস্যার কারণ হব না।
রাতুল ধীরে ধীরে বলে- ঠিক আছে। সেটাই হবে।
– থ্যাংকস রাতুল।
– অলওয়েজ ওয়েলকাম।
আমি পরদিন অফিসে গেলাম না। রাতুল, রত্না আর ওদের ফ্যামিলির আরও দুই-তিন জনের সাথে রত্নার আকদের শপিং এ গেলাম।
বেশি বেশি করে ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করলাম। প্রত্যেকটা ছবিতে প্রচন্ড খুশি আর আনন্দিত হওয়ার ভান করলাম। অরণ্যকে সেই কবেই ব্লক করে দিয়েছি। কিন্তু অফিসের অন্যেরা দেখবে। তারা নিশ্চয়ই বলবে। আর সে না জানলেও আমি নিজে তাকে জানানোর ব্যবস্থা করব। সোনিয়া আপুকে সব ছবি শেয়ার করতে বলেছি। পরদিনও অফিসে গেলাম না।
রাতে একটা ফোন এল। আননোউন নম্বর। রাতুল নাকি?
– হ্যালো? কে?
ওইপাশ থেকে একটা নারী কণ্ঠ জিজ্ঞেস করে – আপনি কি অসুস্থ?
– কে বোন আপনি? আমি সুস্থ না অসুস্থ তাতে আপনার কি?
ওইপাশ থেকে ফোন রেখে দেয়! কে যে বেহুদা এসব!
শুক্র, শনিবার সহ টানা চারদিন ছুটি কাটিয়ে আমি রবিবার অফিসে গেলাম।
আমি পারতপক্ষে অরণ্যের রুমে যাই না। কিন্তু আজ একটা ফাইলের জন্য যেতে হল।
শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম- মে আই কাম ইন স্যার?
অরণ্য চোখ তুলে আমাকে দেখে বলে- আসুন।
আমি ফাইল নিয়ে চলে আসছিলাম কোন কথা না বলে কিন্তু অরণ্য আমাকে আটকায়।
– একমিনিট। এভাবে অফিস কামাই করে যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন..
অরণ্যকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আমি বললাম – ঠিক আছে এরপর থেকে ছুটি নিয়েই করব। নেক্সট মানথ আমার ছুটি লাগবে। আমার বিয়ে।
অরণ্য বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে!
কিছুক্ষণ চেষ্টা করে সে বলে- বি.. বিয়ে?
আমি হেসে বললাম – আপনি বিয়ে ঠিক হয়ে থাকা সত্ত্বেও মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করতে পারেন আর আমি বিয়ে করলেই দোষ?
অরণ্যের চেহারাটা থমথমে হয়ে গেল।
কিন্তু সে জোর করে হেসে বলল – কংগ্রাচুলেশনস।
– থ্যাংকস। পাত্রকে আপনি চেনেন।
অরণ্য হেসে বলে- রাতুল হাসান?
– হ্যাঁ! অসাম পার্সন!
অরণ্য বলে- অনেকেরই বড়লোক মানুষদের অসাম লাগে!
আমি কথা না বাড়িয়ে চলে আসি।
দুলাভাই অফিসের কাজে বাইরে ছিল।
ফিরে আসার পর একদিন সে আর নিশা আমাকে পাঁকড়াও করে।
– বৃষ্টি! কি হচ্ছে এসব?- দুলাভাই কঠিন কন্ঠে জিজ্ঞেস করে!
আমি নির্লিপ্ত গলায় বলি- কি হবে? আমার বিয়ে হচ্ছে।
– জীবনটা কি খেলা? নিশা আমাকে বলেছে রাতুল তোকে সব বলেছে। এরপরেও তুই এখানে কি করে বিয়ে করছিস? অরণ্যকে দেখানোর জন্য নিজের জীবনটা ধ্বংস করে দিচ্ছিস? এতটা প্রতিশোধ পরায়ণ তুই?
– আমি কারো ওপর রাগ করে কিছু করছি না।
– তুই বললেই আমি বিশ্বাস করব?
নিশা বলে- তুই কি তাহলে সত্যি ‘ভালবাসা দিয়ে ভাল করে ফেলব’ নীতি অবলম্বন করছিস?
নিশার কথা শুনে শত কষ্টের মধ্যেও আমি হেসে ফেললাম! দুলাভাই আর নিশা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে!
– আমি অরণ্যের সাথে রাগ করে বিয়ে করছি না। অরণ্যকে আমি কতটা ভালবেসেছিলাম তোমাদের ধারণাও নেই। তোমরা যতটুকু দেখেছ তার থেকেও অনেক অনেক বেশি। অরণ্যের এই কাজের পরে আমার ভালবাসার ওপর থেকেই বিশ্বাস উঠে গেছে। আমি রাতুলকে কেন আর কাউকেই ভালবাসতে পারব না। আর রাতুলও যেহেতু এই টাইপ না তাহলে আমাদের ম্যাচটাই পারফেক্ট না?
দুলাভাই চোখ পাকিয়ে বললেন – আচ্ছা ঠিক আছে। ধরে নিলাম তুই অরণ্যকে চিনিসই না। তাহলে এত তাড়াতাড়ি কেন রাতুলকেই বিয়ে করতে হবে? অন্য ছেলে..
– বললাম তো! আমি কাউকে ভালবাসতে পারব না। তাহলে অন্য ছেলেকে বিয়ে করে তার জীবন কেন নষ্ট করব? সেই ছেলে তো কোন দোষ করেনি!
নিশা জিজ্ঞেস করে – রাতুল যদি ভাল হয়ে যায়?
আমি মুচকি হেসে বললাম – যে নিজেই এই নিয়ে সন্দেহে আছে সে কোনদিনও ভাল হবে না!
দুলাভাই হাল ছেড়ে দিয়ে বলে- এটা কেমন যুক্তি বৃষ্টি? একটাবার অন্তত অরণ্যের সাথে কথা বল। ওকে এক্সপ্লেন করার জন্য একটা সুযোগ দে। হতে পারে আমরা যা ভাবছি সেসব কিছুই না। তুই কথা বলতে না চাইলে আমি..
আমি থমথমে মুখে চিৎকার করে বললাম- না! ওই ঘটনার পর কতদিন পার হয়েছে ভাইয়া? প্রায় একমাস? এই একমাসের প্রায় প্রতিদিন ওর সাথে আমার দেখা হয়েছে। এক্সপ্লেন করার থাকলে সে করতে পারত। করেনি কারণ এক্সপ্লেনেশনের কিছুই নেই। আর সে তো বলেছেই আমাকে আগেই জানাতে চেয়েছিল। জানায়নি তো! এমনকি আমার বিয়ের কথা শুনে সে আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছে! আর একটা কথা ভাইয়া। তুমি যদি অরণ্যের সাথে কথা বল, আমি জীবনেও তোমার সাথে আর কথা বলব না। আর তুমি জানো আমার কি সাংঘাতিক জেদ!
– এত জেদ ভাল না বৃষ্টি। তুই ভাল করছিস না!
আমি উঠে চলে গেলাম। আমি যা করছি, করছি। করব। অরণ্যকে আমি দেখিয়ে দেব তাকে ছাড়া আমি কতটা ভাল আছি!
ধীরে ধীরে রত্নার আকদও চলে আসে। আকদেই তারা অনেক মানুষজনকে বলেছে। আমি যে রাতুলের ফিয়োন্সে সেটা তারা আকদে বলল না। রাতুলের মা-বাবার ইচ্ছা আরেকটা বড় অনুষ্ঠান করে সেটা জানানো হবে!
মা-বাবা আর ভাইয়া-ভাবী আগেই বাসায় চলে গিয়েছিল। আমাকে রত্না আর রাতুলের মা আটকে রাখে।
বলল- নাচগান হবে। তুমিও আনন্দ করে যাও!
রাতুল বলল- আমি নামিয়ে দেব।
আমি তাকে বললাম – আপনি?
রাতুল হেসে ফিসফিস করে বলে- ভয় নেই। হবু বউয়ের সাথে আমি উল্টাপাল্টা কিছু করব না। এত খারাপও আমি নই!
রত্নার আকদে তারা বেশ নাচগান করল। আমিও নাচলাম সবার সাথে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও আপলোড করে দিলাম। সোনিয়া আপুকে আবার বললাম শেয়ার করতে। একটাই কারণ – যাতে অরণ্য দেখে।
আমার প্ল্যান কাজ করল।
অফিসে অরণ্য পরদিন বলে- আচ্ছা শুনুন আগেরবার তো আপনার প্রেজেন্টেশন দেয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। এখন বুঝতে পারছি কেন ছিল! বড়লোক ক্লায়েন্ট আপনার খুব পছন্দের সেটা তখন বললেই পারতেন! যাই হোক, আপনার ফিয়োন্সে তো আরেকবার আসতে চাচ্ছেন। ডিলটা যে পেয়েছি সেটা কিভাবে কি হচ্ছে দেখার জন্য। এবার তাহলে প্রেজেন্টেশনটা আপনি দিন। আমাদের জন্যেও ভাল। বেশি প্রশ্ন করবে না!
আমি তার কথা শুনে রাগে ফুঁসছিলাম!
এবার সুন্দর করে হেসে বললাম – আই উ্যড লাভ টু!
অরণ্যও হেসে বলল – ভালই তো নাচগান করেন দেখি। রাতুল আসলে বলব আপনাদের বিয়েতে আমাকে যেন নাচতে দেয়। ওইযে একটা গান আছে না ‘আজ আমার গার্লফ্রেন্ডের বিয়া’ সেই গানে নাচব! হা হা!
– ও তাই? আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড ছিলাম? কবে? আর কয় নাম্বার?
অরণ্য মাথা ঝাঁকিয়ে বলল – ওহ! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে হাঁটু গেড়ে বসে দামি আংটি দিয়ে প্রপোজ না করলে গার্লফ্রেন্ড হয় না!
– ভোলারই কথা! সেই কবে মোনালিসাকে করেছেন তা আপনিই জানেন। এখন তো জানলেন। তাহলে বাকি আর যারা যারা আপনার ভবিষ্যতে গার্লফ্রেন্ড হবে তাদের এভাবে প্রপোজ করবেন!
আমি চলে গেলাম অরণ্যের সামনে থেকে। তার কথাবার্তায় আমার আজকাল গা জ্বলে যায়!
সোমবারে রাতুলের আমাদের অফিসে যাওয়ার কথা। আমি শনিবার রাতে তাকে ফোন দিলাম।
প্রথমবার কেউ ফোন ধরে না। দ্বিতীয়বার সে ফোন ধরল।
– হ্যালো! বৃষ্টিলেখা!
– হ্যাঁ! আমি কি ডিস্টার্ব করলাম?
– না কিছু না! বলুন কিছু দরকার?
– হ্যাঁ। আমাকে একটা ফেভার করবেন?
– শিওর!
– সোমবার আপনি আমাদের অফিসে আসবেন না?
– হ্যাঁ।
– আমি প্রেজেন্টেশন দেব।
– ওকে ফাইন।
– কিন্তু আপনি কোন ভুল ধরবেন না। প্লিজ!
রাতুল হেসে বলল – এটা তো অনেক কঠিন ফেভার!
– আমাদের অফিসের অনেকেই জানে আপনার সাথে আমার বিয়ের কথা চলছে। এখন আপনি ভুল ধরলে সবার সামনে আমার মানসম্মান থাকবে না!
সে হাসতে হাসতে বলল- আচ্ছা যান! ধরব না।
– থ্যাঙ্কিউ। বাই!
রাতুল যেদিন আসল আমি ইচ্ছা করেই বেশ সাজুগুজু করে গেলাম।
রাতুল সবার সামনেই বলে- আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে!
– থ্যাঙ্কিউ।
অরণ্যকে দেখলাম চোখমুখ অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি প্রেজেন্টেশন দিলাম। রাতুল সত্যিই কোন ভুল ধরল না! সব সুন্দর করে শুনে গেল চুপচাপ।
প্রেজেন্টেশন শেষ করে হলে বলল- সুন্দর দিয়েছেন। শুধু একটা প্রশ্ন।
প্রশ্নটা করলে আমি বললাম – ওখানে এসে ল্যাপটপে দেখাই?
রাতুল মাথা নাড়লে আমি ইচ্ছা করেই রাতুলের একদম কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম। ওকে ল্যাপটপে দেখালাম। আড়চোখে অরণ্যকে লক্ষ করলাম। সে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে!
মনে মনে বললাম- আমি তোমাকে ছাড়াও ভাল আছি।
[চলবে]