#গল্প
বৃষ্টি_ভেজা_অরণ্য
#পর্ব_১০_(#শেষ_পর্ব)
-শাতিল রাফিয়া
রাতুলের বাবা-মা বিয়ের অ্যানাউন্সমেন্ট দেওয়ার জন্য বড় করে অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার ফ্যামিলি থেকে নিষেধ করল। আমারও এই বিষয়টা ভাল লাগছিল না। একদিন অ্যানাউন্সমেন্ট, একদিন মেয়ে দেখা, একদিন ছেলে দেখা এসব আমার অতি নাটকীয় লাগে। যদিও আমার পুরো জীবনটাই এখন নাটকীয়তায় ভরে গেছে! আর আজব ব্যাপার হলো রাতুলও চাইল না!
দুই পরিবার বসে বিয়ের ডেট ঠিক করে। এখন থেকে দুইমাস পরে। আমাদের বিয়ে নিয়ে সবাই খুব খুশি শুধুমাত্র যাদের বিয়ে হচ্ছে তারা বাদে। মানে আমি আর রাতুল বাদে।
একদিন রাতুলের বাবা-মা জোর করে আমাকে ওনাদের অফিস দেখাতে নিয়ে গেলেন।
আমি এখন ইচ্ছা করলে অফিসে যাই। না করলে যাই না। চাকরটাই তো ছেড়ে দেব। তাই যাওয়া আর না যাওয়ায় কিছু আসে যায় না। আমি টানা দুই-তিন দিন বাদ দিলে রাতে আমার কাছে সেই আননোউন নম্বর থেকে কল আসে। একটা মেয়ে ফোন করে জানতে চায় আমি অসুস্থ কি না! আমি আজকাল সেই নাম্বারটাও ধরি না।
কয়েকদিন পর আজকে অফিসে যাইনি। সকাল দশটার দিকে দুলাভাই ফোন করে।
ফোন ধরলাম – জ্বি ভাইয়া, বল।
– তুই কি অফিসে?
– উঁমহু। বাসায়।
– আমি একটা অ্যাড্রেস দিচ্ছি। আধাঘন্টার মধ্যে এখানে আয়।
– কেন?
– এত প্রশ্ন করছিস কেন?
– ভাইয়া এখন এসব ভাল লাগছে না।
দুলাভাই কড়া গলায় বলে- বৃষ্টি আই অ্যাম সিরিয়াস। কোন ধানাইপানাই না করে এক্ষুনি রওনা দে।
দুলাভাই কখনো আমার সাথে এভাবে কথা বলে না। বুঝলাম আসলেই সিরিয়াস কোন ব্যাপার।
আমি বললাম – আচ্ছা। টেক্সট করো।
ঠিকানা দেখে আমি রওনা দিলাম। একটা ক্যাফের ঠিকানা। আমি চিনি ক্যাফেটা। বাসা থেকে রওনা দিয়ে বিশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম।
পৌঁছে দুলাভাইকে ফোন দিলাম। সে ফোন কেটে দেয়। পেছন থেকে দুলাভাইয়ের গলা পেলাম।
– বৃষ্টি!
আমি ঘুরে তাকিয়ে দেখি দুলাভাই একটা টেবিলে বসেছে তার সামনে একটা মেয়ে বসা। মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তাকে আগে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। দুলাভাই হাত নেড়ে ওনাদের টেবিলে যেতে ইশারা করে।
আমি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কি হয়েছে ভাইয়া? আর উনি কে?
দুলাভাই গম্ভীরমুখে বললেন – বস।
আমি বসে দুইজনের দিকে তাকালাম।
মেয়েটা হেসে বলে- যে বৃষ্টিলেখার জন্য অরণ্য এত পাগল হয়ে গেছে তাকে সামনাসামনি দেখে খুব ভাল লাগছে!
তার কথাগুলো শুনে আমি রীতিমতো চমকে উঠলাম! দুলাভাই দেখলাম একেবারে স্বাভাবিকভাবে বসে আছে। আমি একবার দুলাভাই আর একবার মেয়েটির দিকে তাকালাম! কে এই মেয়ে?
আমি কোন মতে জিজ্ঞেস করলাম- কে আপনি? আর এসব..
মেয়েটি আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সুন্দর করে হেসে বলে- এখনো চিনতে পারনি?
আমি দুর্বলভাবে মাথা নাড়লাম।
মেয়েটি বলে- আমি মোনালিসা!
যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই! মুহূর্তে আমার মুখ শক্ত হয়ে ওঠে।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে দুলাভাইকে বললাম- এইসবের মানে কি ভাইয়া?
আমি মেয়েটিকে কঠিন গলায় বললাম- আপনি কি আপনার হবু বরের হয়ে ওকালতি করতে এসেছেন?
মেয়েটি বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে হেসেই উত্তর দেয়- না। তোমাকে সত্যিটা জানাতে এসেছি। আর সত্যি হল অরণ্য আমার হবু বর ছিল কিন্তু সেটা পাঁচ বছর আগের কথা!
আমি থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম- মানে?
– বৃষ্টি আমরা অরণ্যদের পাশের বাসায় থাকতাম। সেখান থেকে পরিচয়। সেটা আমি যখন ইন্টারে পড়ি তখনকার কথা। সেখান থেকে প্রেমের শুরু হল। অরণ্য আমাকে প্রপোজ করেছিল। আমার চাচা বিদেশে সেটেল্ড। আমাদের কাগজপত্র রেডি করছিলেন। কাগজ রেডি হয়ে গেল। ইন্টারের পর পরই আমরা বাইরে চলে যাই। আমেরিকায়। তখন আমি আর অরণ্য দুইজনই ছোট। ঠিক হল আমরা বিয়ে করব। তবে ওর আর আমার পড়া শেষ হোক, ওর জব হোক, এরপর। আমরা চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে আমি এক নতুন দুনিয়া আবিষ্কার করলাম। সেখানে আমাদের দেশের মত এত রুলস নেই, বাঁধা নিষেধ নেই! আমি ওখানে গিয়ে চোখে রঙিন চশমা পরে সব ভুলে যেতে থাকি! অরণ্যকে ভুলে গেলাম! সে ফোন করলে কথা বলতাম না! একগাদা মিথ্যা কথা বলতাম। ক্লাবে যেতাম। মা-বাবা বাঁধা দিলে পুলিশের ভয় দেখাতাম। অরণ্য অনেক চেষ্টা করেছিল। সমানে মেইল, ফোন সব করত। আমি নাম্বার চেঞ্জ করলাম। ওকে মুখের ওপর বলে দিলাম আমার লাইফে আর ইন্টারফেয়ার না করতে। আমি ওকে আর ভালবাসি না। একপ্রকার দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম! এরপর আমি এক আমেরিকান ছেলে ‘জন’কে ভালবেসে ফেলি। ওকে বিয়েও করলাম। পাঁচ ছয়মাস বেশ ভালই কাটল। এরপর আবিষ্কার করলাম জনের অন্য অনেক মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে। অশান্তি শুরু হল, ডিভোর্স হয়ে গেল! আমি আমার কর্মফল ভোগ করলাম! তবুও অরণ্যের সাথে যোগাযোগ করলাম না। ভেবেছিলাম ও যখন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, থাক। ওকে আর বিরক্ত করব না। এভাবে বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। হঠাৎই বাবা মারা গেলেন। মা-ও বেশিদিন বাঁচলেন না। চাচা-চাচীর পাশের অ্যাপার্টমেন্টে একাই থাকি। সবাই নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। আমি একটা চাকরি করি কিন্তু বাসায় ফিরলে বড্ড একা লাগে। আমি অরণ্যকে আবার প্রচন্ডভাবে অনুভব করতে শুরু করি! এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম দেশে যাব, অরণ্যের মান ভাঙাব, ওকে বিয়ে করব। সেই প্ল্যান করেই এসেছিলাম। অরণ্য আমাকে সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়েছে ‘আমি আমার জীবনে অন্য একজনকে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছি। বৃষ্টিলেখা ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। ও আমার সবকিছু! তুমি আমাকে ভালবাসনি, তাহলে ছেড়ে যেতে না! কিন্তু আমার মন পাবার জন্য বৃষ্টিলেখা অনেক কিছু করেছে! মোনালিসা তুমি ফিরে যাবে না কি করবে তোমার ব্যাপার কিন্তু আমার কাছে কোন সাহায্য আশা কর না।’
আমি অনেক জোরাজুরি করে ওকে একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করার জন্য রাজি করালাম। তুমি একটা ছবি দেখেছ। সেটা দেখেই নিজের মত যা ইচ্ছা ভেবে নিয়েছ! ছবিটা তোমার দুলাভাইয়ের কাছে আছে। চাইলে আবার দেখ। ওইদিন আমি অরণ্যকে দেখামাত্র জড়িয়ে ধরেছিলাম। ছবিতে দেখেছ ও আমার বাহু ধরে রেখেছে। তাতেই তোমার মনে হয়েছে ও আমাকে হাগ করেছে! কিন্তু না ও আমার হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম অনেক মানুষ আমাদের দেখছে। তাদের সবার সামনে অরণ্য যদি এভাবে আমাকে ছাড়িয়ে দেয়, তাহলে কি একটা লজ্জাজনক পরিস্থিতি হবে! আমি তাই তখনই তাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। আর ওইটুকু সময়ে অণু ছবি তুলেছে! অণু আমার অনেক আগেকার ক্লাসমেট! সেরকম কোন খাতিরও নেই। ওকে নিশ্চয়ই আমি পুরো কাহিনী বলব না। তাই বলেছি বিয়ে করতে এসেছি। এটা আমার বয়ফ্রেন্ড।
বাই দ্য ওয়ে, অরণ্য রেস্টুরেন্টেও আমাকে একই কথা বলেছে। আমি অনেক চেষ্টা করেছি আবার দেখা করতে, বোঝাতে! সে কোনভাবেই রাজি নয়। সে একটা নামই জপ করে গেছে- ‘বৃষ্টিলেখা, বৃষ্টিলেখা, বৃষ্টিলেখা!’ তোমার দুলাভাই আমাকে বলেছে তোমাকে সব খুলে বলতে। এরপরেও তোমার বিশ্বাস না হলে আমার ভিসা পাসপোর্ট দেখতে পার। আমি আগামী পরশু ফিরে যাচ্ছি। অরণ্যের ভালবাসা নিখাদ। ও তোমাকেই ভালবাসে বৃষ্টিলেখা।
মোনালিসার কথা শেষ হলে আমি দুইহাতে মুখ ঢেকে ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগলাম! আমি কি করেছি? আমি কি ভুল করলাম এটা!
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম – ভাইয়া আমি অরণ্যের কাছে যাচ্ছি।
দুলাভাই বলল- অরণ্যকে পরেও বলতে পারবি। আগে রাতুলের কাছে গিয়ে দেখ সে বিয়ে ক্যান্সেল করতে রাজি হয় কি না!
দুলাভাইয়ের কথা শুনে আমার হাতপা কাঁপতে থাকে! রাতুল বিয়ে ক্যান্সেল করবে না? আমি কোনমতে তাড়াহুড়ো করে রাতুলের অফিসে পৌঁছালাম। আগেও একদিন এসেছিলাম। আমাকে চেনে ওরা।
রিসিপশনে বলতেই মেয়েটি বলে- ম্যাম আপনি ভেতরে যান। আমি স্যারকে জানাচ্ছি।
তার পুরো কথা না শুনেই রাতুলের রুমের দিকে দৌড় দিলাম। ভেতরে ঢুকে দেখি রাতুল বসে আছে।
আমি ঢুকেই হড়বড় করে বললাম – এই বিয়েটা ক্যান্সেল করে দিন প্লিজ! আমি এই বিয়ে করতে পারব না!
রাতুল অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল!
আমি হাতজোড় করে বললাম – আই অ্যাম স্যরি! আমি জীবনেও আপনার কাছে আর কিচ্ছু চাইব না। কিন্তু প্লিজ বিয়েটা ক্যান্সেল করে দিন!
রাতুল ধীরে ধীরে চোখ কুঁচকে বলে- কার্ড তো ছাপানো হয়ে গেছে। এখন কি করে ক্যান্সেল করব বলুন তো!
আমি ওইখানেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম- প্লিজ! প্লিজ!
রাতুল মুচকি হেসে আমার হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলে- দেখুন তো কার্ডটা কেমন হয়েছে!
আমি তখন কার্ড দেখার মতো কোন অবস্থাতেই নেই!
রাতুল আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে- আগে খুলে দেখুন। বাকি কথা পরে শুনব!
মনে হচ্ছে কার্ডটা না দেখলে সে আমার কথাই শুনবে না!
কার্ডটা খুললাম। ওপরে যা যা লেখার সব লেখা। আমি নিচে এসে পুরো তবদা খেয়ে গেলাম। পাত্রের নামের জায়গায় লেখা- অরণ্য আহমেদ। আর পাত্রীর নাম- বৃষ্টিলেখা হক।
আমি ভাল করে খেয়াল করে দেখলাম। আমি কি সত্যি দেখছি?
আমি কোন মতে বললাম – এ..এটা..একি! অ..অরণ্য!
পেছন থেকে সেই বিখ্যাত কণ্ঠ ভেসে এল – কেন অসুবিধা আছে?
আমি তড়াক করে ঘুরে তাকিয়ে দেখি অরণ্য দাঁড়িয়ে আছে।
সে হেসে জিজ্ঞেস করে – পাত্রের নাম কি ভুল আছে? অসুবিধা আছে কোন?
আমি স্থান, কাল সব ভুলে দৌড় দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। অরণ্য আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে!
আমি হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম- কেন আমাকে সবকিছু খুলে বললে না? আমাকে এতটা কষ্ট দিতে পারলে তুমি?
অরণ্য বলে- আর তুমি তো আমাকে খুব আনন্দে রেখেছ তাই না? আমাকে একটাবার কথা বলার সুযোগ দিয়েছ? উল্টাপাল্টা যা খুশি তাই বলেছ আমাকে! আমি তোমার মত হুটহাট রাগ করি না ঠিক কিন্তু একবার রাগ করলে আমার রাগ সহজে পড়ে না! তুমি হাবিজাবি কথা বলে আমার রাগ উঠিয়ে দিয়েছিলে। তাই তো তখন কিছু বলিনি! তাই বলে তুমি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিবে?
– বিয়ের কথা শুনে আমাকে কনগ্র্যাচুলেশন্স কে জানিয়েছিল? কে বলেছিলা আমি বড়লোক দেখে রাতুলকে বিয়ে করতে চাইছি?
অরণ্য এবার হেসে বলে- আমি বলেছিলাম! প্রচন্ড রাগ আর অভিমান থেকে বলেছিলাম! যেই মেয়ে অরণ্যের মনে ঢোকার জন্য নিশা সাজে সে টাকার জন্য বিয়ে করবে না আমি জানি! স্যরি! স্যরি! স্যরি!
আমি বললাম – ইয়ু শ্যুড বি!
অরণ্য হেসে বলে- ও তাই না? কত চেষ্টা করলাম বিয়েটা ভাঙার! রাতুল নিজের নামে বানিয়ে বানিয়ে কত কথা বলল, তবুও তো বিয়েটা করেই নিচ্ছিলে!
আমি পুরাপুরি শকড হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- মা..মানে? মানে? এ..এটা তোমাদের প্ল্যান ছিল?
– হ্যাঁ। তুমি যেদিন আমাকে বকাবকি করলে, ওদিন রাতুলও ফোন করেছিল। রাতুল তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিল। তখন কথায় কথায় জানতে পারি ওর সাথে তোমার বিয়ের কথা চলছে। আমি তোমার সাথে রাগে কথা বলছিলাম না। কিন্তু তোমার বিয়ে তো হতে দেব না! নিজের মানুষটাকে তো অন্যের হতে দেব না!রাতুলকে সব খুলে বললাম। রিকোয়েস্ট করলাম এই বিয়েটা না করতে। রাতুল বেশ খুশি হয়েই মেনে নিলেন কারণ উনি এখন বিয়ে করতে প্রস্তুত নন। উনি নিজেই বললেন উনি এমন কিছু বলবেন যাতে তুমিই রাজি না হও। আমরা ভেবেছিলাম তুমি নিজের জেদটা ছাড়বে! কিন্তু বাবা! কি সাংঘাতিক জেদ তোমার! শেষে কিছুতেই কিছু করতে না পেরে তোমার দুলাভাই মোনালিসার সাথে তোমার কথা বলানোর আইডিয়া দেন। উনি আমার আপা আর দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলে, মোনালিসার সাথে যোগাযোগ করে এটা সম্ভব করেছেন!
আমি বললাম – তবুও সব তোমার দোষ!
অরণ্য হেসে বলে- এরপর যদি আমার সাথে এরকম জেদ করো না বৃষ্টি..
– কি করবে? আবার আমাকে রেখে দূরে সরে যাবে?
– পাগল? আমি তোমাকে তখন বেঁধে রাখব! বেঁধে রেখে..
– টর্চার করবে?
– হ্যাঁ! ভালবাসার টর্চার। তোমাকে এত ভালবাসব যে তোমার সব জেদ পানি হয়ে যাবে! তুমি জানো তুমি যখন অফিসে যেতে না টানা দুই-তিন দিন আমি টেনশনে আপুকে দিয়ে ফোন করাতাম?
আমি অরণ্যকে আমার জড়িয়ে ধরে বললাম – তুমি খুব খারাপ। খুব খুব খারাপ। আর এই খারাপ মানুষটাকেই আমি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালবাসি!
অরণ্য আমাকে শক্ত করে ধরে বুকের সাথে চেপে ধরে!
এতক্ষণ পর রাতুল হাসান মুখ খোলে- এই যে স্যার ম্যাডাম হ্যালো! এটা আমার অফিস!
আমি মাথা তুলে বললাম – স্যরি!
রাতুল চোখ বড় বড় করে বলে- স্যরি? আপনারা উল্টা আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন। আমার বিয়ের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না! মানে এখনও আমি তৈরি নই। আমি ডিলের ব্যাপারে শক্ত হতে পারি। কিন্তু প্রেমের ব্যাপারে ছাড় দেই!
আমি জিজ্ঞেস করলাম- কিন্তু বাসায় কি করে..
অরণ্য বলল- দুলাভাইয়েরা আর আপারা ম্যানেজ করবেন।
– কিন্তু ওনার বাসায়?
রাতুল হেসে বলে- আমি বলব আমার বাসায়। আমি বলব আমি আপনাকে বিয়ে করব না। কারণ আপনার জীবন আমি নষ্ট করতে চাই না! আপনার দুলাভাইও কথা বলবেন। আর অরণ্য আপনার আর কয়টা কার্ড লাগবে বলুন! আপনাদের বিয়েতে আমার গিফট হল কার্ড। সব কার্ড আমি ছাপিয়ে দেব!
আমি হাসতে হাসতে বললাম- এরকম আজব গিফট আমি আগে দেখিনি!
রাতুল বলে- আপনাদের লাভ স্টোরি খুব সুন্দর! অরণ্য আমাকে পুরোটা জানিয়েছে।
অরণ্য হেসে বলে- বৃষ্টি নিজেই পুরোটা জানে না!
আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম- মানে?
অরণ্য জিজ্ঞেস করে – তোমাকে আমি প্রথম কবে দেখেছিলাম বল তো?
– অফিসে!
অরণ্য মাথা নেড়ে বলল – তোমাকে ফার্স্ট দেখেছি তোমার ভার্সিটিতে।
আমি চমকে উঠে বললাম – ক্ক..কি?
– সুমি আমার ফুপাতো বোন! পুণ্যের বার্থডেতে ও আমাদের বাসায় ছিল। পরদিন আমাদের বাসা থেকে ক্লাসে গিয়েছিল। আমি তখন ওকে ড্রপ করেছিলাম। ওকে নামিয়ে দিয়ে চলে যাব, আমার হঠাৎ তোমার দিকে দৃষ্টি আটকে গেল। বলে নেই, আমি ততদিনে মোনালিসাকে একেবারেই ভুলে গিয়েছি! তোমাকে দেখে আমি গাড়ি থেকে নামলাম। তোমাকে দেখে আমি পুরো ফিদা হয়ে গিয়েছিলাম। সুমি হঠাৎ করে এসে পেছন থেকে ধাক্কা মারে! তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে ও বলে- তুমি অনেক ভাল একটা মেয়ে, একটু রাগী আর জেদী, কিন্তু মনটা খুব ভাল! এরপরের সব আমার আর সুমির প্ল্যান ছিল। সুমি নতুন নাম্বার নিয়েছিল। তোমাকে দেওয়ার সময় আমার নাম্বারটা দিয়েছিল। যাতে কখনো না কখনো ওকে করতে গিয়ে তুমি আমাকে ফোন কর।
– কিন্তু তুমি আমাকে..
– হ্যাঁ.. আমি তোমাকে ফোন করতে পারতাম। কিন্তু করিনি। তুমি যদি আমাকে ছ্যাঁচড়া ভাবো! কারণ আমি নিশ্চয়ই ফোন দিয়েই বলব না যে আমার তোমাকে ভাল লাগে! এটা বললে তুমিও কি খুশি হতে? সুমি বলেছিল তুমি এইসব ব্যাপার থেকে দূরে থাক সবসময়! তাই! আশায় থাকতে থাকতে আমি নিরাশ হয়ে গেলাম। তুমি ফোন করলে না! এরপর তোমাদের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। আমি সুমিকে বলেছিলাম পরীক্ষার পর যেভাবেই হোক, ও যেন তোমাকে দিয়ে আমাকে ফোন করায়! আমি ভেবেছিলাম একবার তুমি ফোন করলে সেই লিংক থেকে পরে তোমাকে ফোন করে সামলে নেব। অবশেষে তোমার ফোন এল! আর সুমি যখন জানাল তুমি ওকে বলেছ খুব জরুরি কথা আছে, তখনই বুঝে গেলাম তুমি এই বিষয়ে কথা বলবে। এরপরে সুমির সবাইকে নিয়ে বাইরে যাওয়াটাও আমার প্ল্যান ছিল। যখন তুমি ওকে নাম্বারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছ, বুদ্ধি করে আমার কার্ডটা সুমিই টেবিলের ওপর রেখেছিল। যখন বুঝলাম তুমি আমার কন্ঠ শুনেই আমাকে পছন্দ করে ফেলেছ, আমাকে আর পায় কে! এরপর তুমি অফিসে এলে ইন্টারভিউ দিতে। তুমি ইন্টারভিউ বোর্ডে ভাল করে ঠিক জব পেয়ে গেলে। এটা কিন্তু পুরো ভাগ্য। এখানে আমার কোন হাত ছিল না! আমি দেখতাম তুমি আমাকে ইমপ্রেস করার ট্রাই করছ! আমি কখনো বলতাম না যে ভাল কাজ করেছ কারণ তুমি যদি বুঝে যাও যে আমি তোমাকে আগে থেকেই চিনি? একদিন অবশ্য অফিসে রাগও করে ফেলেছিলাম! আর এরপর তোমার রাগ ভাঙাতে কি পরিমাণ সাধ্য সাধনা যে করতে হয়েছে! সব ভালই চলছিল। মাঝখানে মোনালিসার মেইল পেলাম। ও আসল! এরপর সবকিছু উল্টেপাল্টে গেল।
– আমাকে আগেই মোনালিসার কথা বলতে।
– মোনালিসার কথা তোমাকে বলতে চেয়েও বলতে পারিনি! কি বলতাম বলতো! তুমি যদি আমাকে ভুল বুঝে দূরে সরে যাও? যদি বল আগে কেন বলিনি?
তোমার সাথে যেরকম তোমার দুলাভাইয়ের খুব ভাল সম্পর্ক, ঠিক সেরকম আমার দুলাভাইও আমার গার্জেন। দুলাভাই অফিসের কাজে দুই বছরের কন্ট্যাক্টে বাইরে ছিল। আমি চেয়েছিলাম ভাইয়া আসলে তোমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব। কিন্তু এর মাঝেই দুইজনের রাগের জন্য ভুল বোঝাবুঝি হয়ে কি থেকে কি হয়ে গেল!
আমি এতক্ষণ সব শুনে পুরো বোকা বনে গেলাম।
হতভম্ব হয়ে শুধু একটা কথাই বলতে পারলাম- তোমরা দুই ভাইবোন মিলে কি খেলটাই না দেখালে!
বাসায় দুলাভাই আর আপা সব ম্যানেজ করল।
আপা বলল- তুই তো নাটকে আমাকেও ছাড়িয়ে গেলি!দুলাভাইকে ‘থ্যাংকস’ দিলে দুলাভাই বলে- বৃষ্টি, তুই জানিস আমি তোর দুলাভাই হলেও তোর সাথে আমার সম্পর্কটা ভাইবোনের। তুই হুট করে এই সিদ্ধান্ত নিলি, সেটা মেনেই নিতে পারছিলাম না।
খুব ধুমধাম করে বিয়ের তোরজোড় হল। সুমি আর অন্যরা দুষ্টামি করে আমাকে ‘ভাবী’ ডাকতে শুরু করে! আমার মেহেদী সন্ধ্যায় অরণ্য সবার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আমাকে প্রপোজ করে!
রাতে সে আমাকে ফোন করে।
– হ্যালো সোনা!
– বাবাহ! মুডে আছ নাকি?
– এখন থেকে তো সোনামণি, সোনা, বউ, জান, এসবই ডাকব। বাই দ্য ওয়ে, তুমি কি ওই পুরো কাহিনী শুনে রাগ করেছিলে? এই যে তোমাকে আগে থেকে চিনেও কিছু বলিনি যে?
বললাম – না তো!
ফোন রেখে আমি মনে মনে বললাম- রাগ? দেখাচ্ছি তোমাকে মজা! বিয়েটা হতে দাও! বুঝবে কত ধানে কত চাল!
প্রচন্ডরকম হইহই করে আমাদের বিয়ে হয়ে গেল।
বাসররাতে আমি অরণ্যের জন্য ওয়েট করছি। অরণ্য রুমে ঢুকে। আমার সামনে বসে।
আমাকে ডাকল – বউ!
বলে সে আমার দুইগাল ধরে সে আমার ঠোঁট স্পর্শ করতে নেয়!
আমি এই সময়টার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম! আমি তড়াক করে তার শেরওয়ানির গলা খামচে ধরলাম! একটা কলম আগেই লুকিয়ে রেখেছিলাম সেটা বের করলাম!
অরণ্য ‘আঁউ’ করে পিছিয়ে গিয়ে বলে- একি! বউ! সোনা! এসব কি? চোখে খোঁচা দিবে নাকি?
– সোনা? তোর সোনাগিরি দেখাচ্ছি!
– তুই-তোকারি করছ কেন?
– তো কি করব? আপনি-আজ্ঞে করব? তুই..তুই জানিস আমাকে তুই কত পেরেশানিতে রেখেছিলি? তোর কণ্ঠ শুনে তোকে কত খুঁজেছি! তোর জন্য না ঘুমিয়ে রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি!
– আ.. আমি তো ভেবেছিলাম সার..কত সুন্দর সারপ্রাইজ হবে..
– তোর সারপ্রাইজের খ্যাতাপুড়ি! সারারাত আমি তোর জন্য কান্নাকাটি করেছি আর তুই..তুই সব জেনেও আমাকে এত যন্ত্রণায় রেখেছিলি! তুই জানিস আমার ঘুম কত প্রিয়? তোর জন্য আমার ঘুম মাথায় উঠেছিল…
অরণ্য রসহ্যময় গলায় জিজ্ঞেস করে – তোমার ঘুমাতে ভাল লাগে?
– হ্যাঁ! কেন?
তার চোখেমুখে দুষ্টু হাসি খেলা করে!
হেসে বলল – কারণ এখন থেকে তো আর রাতে ঘুমাতে পারবে না! মানে আমি জাগিয়ে রাখব!
অরণ্যের কথা শুনে আমি লজ্জা পেলাম! কিন্তু তবুও সেটা আমি ওকে বুঝতে দিলাম না।
আমি ওর দিকে কলম বাড়িয়ে দিয়ে বললাম- কাগজে পাঁচশোবার লেখো- আমি আমার বউয়ের সাথে আর এইধরনের সারপ্রাইজ সারপ্রাইজ খেলা খেলব না। এক্ষুনি লেখো!
অরণ্য দুষ্টু হেসে জিজ্ঞেস করে – আর যদি না লিখি?
– না লিখলে আমি তোমাকে আমাকে টাচ করতেই দেব না!
অরণ্য হেসে ভ্রু নাচিয়ে বলে- আর আমি যদি জোর করে করি?
আমিও রহস্য হাসি হেসে বললাম- আমার মনে হয় না এত বড় রিস্ক তুমি নেবে!
অরণ্য হেসে আমার ঠোঁটে চুমু দিল। এরপর আমার হাত থেকে কলম নিয়ে একটা কাগজ নিয়ে বলে- বউ পাঁচশোবার একটু বেশি হয়ে গেল না?
– একবারও কম হবে না!
– প্লিজ জান! পাঁচবার লিখি?
– হোয়াট? আড়াইশোবার যাও!
– বিশবার?
– জীবনেও না!
– বউ! আজ আমাদের বিয়ে হয়েছে! আর আমাকে তুমি এরকম শাস্তি দিবে?
– অবশ্যই।
এরপর অনেক পীড়াপীড়ি করে সে এটাকে পঞ্চাশবারে নামাল!
অরণ্য এক দুই করে পয়েন্ট করে লিখতে শুরু করে। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি! আজ আমার থেকে সুখি আর কেউ নেই! আমি আমার অরণ্যকে আমার কাছে পেয়েছি! আমাদের বিয়ে হয়েছে। আজ সারাদিন অনেক ধকল গেছে! আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে। ইচ্ছা করছে অরণ্যকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকের ভেতর মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে থাকি! আমি কাগজটার দিকে তাকালাম। বারোবার লেখা হয়েছে। ভাবছি বিশবার লেখা হলেই মাফ করে দেব। যে সারপ্রাইজে দুইজন মানুষের ভালবাসা হয়, এরকম সারপ্রাইজ দেয়া তো খারাপ না! দিল না হয়! আমি বিশবার লেখা শেষ হওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকি!
[সমাপ্ত]