গল্পের নামঃ #প্রণয়
পর্বসংখ্যা_২২
লেখনীতেঃ #ফারিহা_জান্নাত
সবুজের বুকে চির ধরে ধূসররাঙা আঁকা-বাঁকা পথটা ক্রমশই ছুটে চলছে।মাঝে মাঝে হঠাৎ মোড় ঘুরে যাচ্ছে।সে পথেই ধাবমান হয়েছে গাড়িটি।মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে আছে পৃথিশা।স্বচক্ষে এমন সবুজের সমোরহ এই প্রথমবার দেখছে সে।প্রকৃতির মাঝে প্রশান্তির এক অদৃশ্য বীজ বুপন করেছে স্রষ্টা।নিষ্পলক নয়নে সেদিকে তাকিয়ে থেকে নিজের ভেতর প্রশান্তির শুষে নিতে থাকলো পৃথিশা।
চলন্ত গাড়িতে প্রবেশ হওয়া ঠান্ডা হাওয়াটা অন্য মাত্রার শান্তি বয়ে নিয়ে আসতে লাগলো।
গাড়িটা বাম দিকে ঘুরতেই এক অন্য রকম রূপ আবিষ্কার করা গেলো শ্রীমঙ্গলের।সবুজ আস্তরণে আচ্ছাদিত ছোট ছোট টিলার কোল ঘেষে এগিয়ে যাচ্ছে খয়েরী-বাদামী রঙের পাহাড়ি রাস্তাটা।দুপাশের ছোট-বড় পাহাড় আর টিলার ঢাল বেয়ে নেমে এসেছে হরিৎ কানন।
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে পৃথিশা বলল, “শ্রীমঙ্গলের রাস্তাগুলো এত সুন্দর কেন?”
মারুফ তার হাত ধরে বলল, “সামনে আরো অনেক কিছু দেখতে পাবে তুমি।”
সামনেই পাকা রাস্তাটা দুদিক দিয়ে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে।দুই পথেই চা বাগানে যাওয়া যায়।
কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কোন রাস্তা দিয়ে যাবো?
মারুফ কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ” শরীরের ২০৬টা হাড্ডি ওলোট-পালোট করা রাস্তাটা দিয়ে।”
ড্রাইভার হেসে মাথা ঘুরিয়ে ডান দিকে গাড়ি ঘোরালো।কাঁচা রাস্তাটার দু’পাশ গভীর অরণ্য ঝুঁকে এসেছে রাস্তাটার দিকে।পৃথিশা নিশ্চুপ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো।কিছুক্ষণ পরই আচমকা এক তীব্র ঝাঁকুনিতে ধ্যান ভাঙলো ওর।এদিককার রাস্তাটা একেবারে এবড়ো থেবড়ো। গাড়িটা যেন চলছে না ঢেউ তুলে সামনের দিকে এগোচ্ছে।একবার উত্থান তো আরেকবার পতন।এই উত্থান-পতন গাড়িতে থাকা মানুষগুলোর শরীরে থাকা ২০৬ টি হাড়কে এক এক করে স্হানচ্যুত করে দিচ্ছে।ঝাঁকুনি খেতে খেতেই একসময় মনে হয় বার্ধক্যে উপনীত হলো পৃথিশা,কোমড় ব্যাথা শুরু করে দিয়েছে।
অবশেষে সেই দুর্গম পথ পাড়ি দিলো তারা।শরীরের বিধস্ত অবস্হা নিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলো পৃথিশা।পড়নের শাড়িটার অবস্হাও নাজেহাল।জায়গায়-জায়গায় হালকা কুঁচকে গেছে।
সবুজে সবুজে ছেয়ে আছে চারদিক।চা বাগানের দিকে তাকাতেই মনে হচ্ছে বৃষ্টিতে সদ্য স্নান করা। রোদের সোনালী কিরণ পড়ায় বারবার চিকচিক করে উঠছে।একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে পৃথিশা।তার পাশে এসে দাঁড়ালো মারুফ।পৃথিশার এই নিরন্তর মুগ্ধতা বারবার মুগ্ধ করছে মারুফকে।
পৃথিশা মারুফকে প্রশ্ন করলো, “এর সবটাই কি চা বাগান?”
মারুফ বলল, “হ্যাঁ সবটাই।”
পৃথিশা অবাক হয়ে বলল, “এতটা বড়,এতটা বিস্তৃত?”
মারুফ হেসে বলল, “আরে এটা তো শ্রীমঙ্গলের একটা অংশ মাত্র।শ্রীমঙ্গলের প্রায় সবটা জুড়েই চা বাগান।”
পৃথিশা ঝুঁকে একটা কচি পাতা স্পর্শ করলো।তারপর চোখ বন্ধ করে তার ঘ্রাণ নিলো।
উচ্ছ্বসিত স্বরে মারুফকে বললো, “চা পাতার ঘ্রাণটা কি সুন্দর!আচ্ছা এটা কি পানিতে ফুটিয়ে খাওয়া যাবে?”
মারুফ হেসে বলল, “না। এখান থেকে চা পাতা বেছে তুলার পর আরও কয়েকটা উপায়ে প্রসেসিং করা হয়।তারপর সেগুলো খাওয়া যায়।
পৃথিশা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ” আচ্ছা আমরা কি সাতরঙা চা খাবোনা?”
মারুফ বলল, “খাবো তো।শ্রীমঙ্গল মানেই সাত রঙা চা।এখানে এসে এই চা না খেলে তো ঘোরাটাই স্বার্থক হলো না।”
কাঁধে ঝুলি ঝুলিয়ে ‘চা কন্যারা’ চায়ের পাতা তুলছে।চা পাতার প্রকিয়াটা বেশ ভিন্ন।দেখে দেখে দুটো দুটো কটে পাতা তুলতে হয়।পৃথিশা কিছু সময়ের মধ্যেই তাদের সাথে ভাব জমিয়ে ফেললো।তাদের মতো চা পাতা তুলার চেষ্টাও করলো।
চা বাগান থেকে বেরিয়ে ওরা নীলকন্ঠ টি কেবিনে চলে গেলো।একটা উঠোনের মতো জায়গায় রঙ-বেরঙেরর চেয়ার সাজিয়ে রাখা হয়েছে।সেখানে গিয়ে স্হির হয়ে বসলো তারা।পৃথিশা বসে বসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো সাত রঙের চায়ের জন্য।
স্বচ্ছ গ্লাসে সাত রঙের চা আসতেই পৃথিশার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো।প্রথমেই হাতে নেওয়ার চেষ্টা করতেই গরম আঁচ লাগলো।হাত সরিয়ে মনোযোগী দৃষ্টিতে চা-টা দেখতে থাকলো।কিছুক্ষণ ফুঁ দিয়ে গ্লাসটা হাতে নিলো পৃথিশা।খানিকক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখলো চায়ের গ্লাসটা।
একটা চা আরেকটা চায়ের সাথে মিশছে না দেখে পৃথিশা অবাক হয়ে বলল, “আল্লাহ!কালারগুলো তো মিশে যাচ্ছে না!এমন হচ্ছে কেন?”
মারুফ পৃথিশার দিকে তাকিয়ে হাসলো।তারপর বলল, “এটা ওনাদের সিক্রেট রেসিপি।ওনারা কাউকে দেন না এটা।এবার চা খাও,ঠান্ডা হয়ে গেলে ভালো লাগবে না।”
ধীরে সুস্হে চায়ে চুমুক দিলো পৃথিশা।মুখে পরিতৃপ্তির ছাপ ফুটে উঠলো ওর। ও বললো, “এটা মাসালা ফ্লেভারের চা মনে হচ্ছে।লিকারটা খুব হালকা হলেও ফ্লেভারটা কড়া।”
প্রথম স্তরটা শেষ করেই দ্বিতীয় স্তরে চুমুক দিতেই আবারো উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলো বলে উঠলো, “আরেহ্! ফ্লেভারটা তো দেখি চেঞ্জ হয়ে গেল সত্যি সত্যি।মালাই চা মনে হচ্ছে এখন!”
নীলকন্ঠে টি কেবিন থেকে বেরিয়ে তারা কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছাড়া জীতীয় উদ্যানের উদ্দেশ্য। সেখানে পৌঁছাতের পর দুজনে টিকিট কেটে ঢুকে পড়লো। জায়গাটা পুরোপুরি প্রকৃতির একটা জাদুঘর।জীব বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ এই উদ্যান।বাংলাদেশের অন্যতম ট্রপিকাল রেইন ফরেস্ট এটা।
ওখানে ঘোরার জন্য তিনটা ট্রেইল রয়েছে।একটা আধ ঘন্টার,আরেকটা এক ঘন্টার এবং একটা তিন ঘন্টার। মারুফ এক ঘন্টার ট্রেইলটাই নিলো।কারন আধ ঘন্টার সবকিছু সুন্দরমতো দেখতে পাবে না।আবার তিন ঘন্টার টা নিলে অনেক দেড়ি হয়ে যাবে।
বন্ধুদের সাথে এই জায়গায় আরও দুইবার আসা হয়েছিল মারুফের।কিন্তু এবারের আসাটা অন্যরকম।এবার পৃথিশা আছে তার সাথে।এমন নয় যে বন্ধুদের সঙ্গ তার মন্দ লেগেছে কিন্তু পৃথিশার পাশাপাশি থেকে এই প্রকৃতির সুন্দর লীলাভূমির সৌন্দর্য দেখার অনূভুতি কখনোই অন্যকিছুর সাথে তুলনাযোগ্য নয়।
চলবে,,
উপরের পর্যটন কেন্দ্রের বর্ণণাগুলো আমি নিজের কল্পনা হতে লিখেছি এবং তথ্যগুলো গুগুল থেকে নেওয়া।বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার এখনো হয়নি।তাই বর্ণণায় ভুলক্রুটি থাকলে সঠিক করে দেওয়ার অনুরোধ রইলো 🧡