গল্পের নামঃ #প্রণয়
#পর্বসংখ্যা_১৭
লেখনীতেঃ #ফারিহা_জান্নাত

শায়েলা রহমান পৃথিশার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন।কিছুক্ষণ পর তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে বললেন, “তোমার মতো মেয়েরা এসব ছাড়া আর কি বা করতে পারে!সারাটা রাত একটা অজানা-অচেনা ছেলের সাথে থাকতে তোমার লজ্জা করলো না!”
পৃথিশা সদ্য ঘুম থেকে উঠা ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে শায়েলা রহমানের দিকে একপলক তাকালো।তারপর তাকে পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। শায়েলা রহমান হতবুদ্ধি হয়ে পৃথিশার চলে যাওয়া দেখলো।তারপর ধীরে ধীরে পা ফেলে মারুফের কাছে গেল।

মারুফ আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় হেলান দিয়ে বসার সাথে সাথেই শায়েলা রহমান হম্বিতম্বি করে তার রুমে প্রবেশ করলেন।মারুফ কিছু বলার আগেই শায়েলা রহমান বলেন, “ওই মেয়ে তোর ঘরে কি করছিলো? মেয়েটার নূন্যতম লজ্জাবোধ-টুকু নেই।একটা অবিবাহিত ছেলের সাথে একা রুমে কীভাবে থাকলো!”
মারুফ অবাক স্বরে বলল, “তুমি না কালকে বিছানায় পড়ে ছিলা,এখানে আবার আসলা কেমনে?”
শায়েলা রহমান বিরক্তি স্বরে বললেন, “আরে রাখ ওসব।আমি যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দে।মেয়েকে কে?”
মারুফ ভাবলেশহীন হয়ে উত্তর দিলো, “আমার বউ!”
শায়েলা রহমান চোখ বড় বড় করে তাকালেন মারুফের দিকে।মারুফের কথার অর্থ বোধগম্য হয় নি তার!
শায়েলা রহমান অবাক হয়ে বললেন, “কি সব আজেবাজে বকছিস?ওই মেয়ে তোর বউ হতে যাবে কেন?তুই বিয়ে-ই বা কবে করলি?”
মারুফ সিরিয়াস হয়ে বলল, “কাকী বিয়ে আমি অনেক আগেই করেছি।যেদিন এখানে এসেছি সেদিনই করেছি।আর ও কোন লজ্জাহীন মেয়ে নয়,আমি অসুস্হ ছিলাম তাই ও এখানে ছিল।আশা করি এরপর থেকে না জেনে এমন কোন কথা বলবে না তুমি!”
শায়েলা রহমান ফের প্রশ্ন করলেন, “তোর মা জানে এসবের বিষয়ে?”
মারুফ চোখ বন্ধ করে হেসে বলল, “মা নিজেই আমাদের বিয়ে দিয়েছে কাকী।”

তাদের কথার মাঝেই চা নিয়ে উপস্হিত হলো পৃথিশা।ছোট টেবিলে চা রেখে জানালার পর্দাগুলো দুই পাশে ছড়িয়ে দিলো।এর ফলে এক ফালি রোদের রশ্মি এসে ঘরে ছড়িয়ে পড়লো।
পৃথিশার ঘোমটা দেওয়া মুখটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে শায়েলা রহমান বললেন, “বিয়ে যখন করবিই তখন ভালো মেয়ে পেলি না,এমন কালো মেয়েকেই বিয়ে করতে হলো!”
মারুফ রেগে কিছু বলার আগেই পৃথিশা বলে উঠল, “কালো রঙে এত সমস্যা থাকলে নিজের চোখের মণি-টা রেখে দিয়েছেন কেন?চোখের মণিটা ফেলে দিন না,তাহলেই তো আর কোন কালো জিনিস দেখতে হবে না।”
শায়েলা রহমান রেগেমেগে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।
পৃথিশা মলিন হেসে মারুফের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো।কিছুক্ষণ পর তার কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর আছে কিনা।তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে।

মারুফ এতক্ষণ পৃথিশার কার্যকলাপ খেয়াল করছিলো।
পৃথিশাকে মাথা বাঁকাতে দেখে বলল, “মাথায় কি ব্যাথা করছে?”
মাথা থেকে হাত সরিয়ে পৃথিশা বলল, “তেমন কিছু না।সারারাত হেলান দিয়ে থাকায় মাথাটা ব্যাথা করছে একটু!”
মারুফ চায়ের কাপটা রেখে বলল, “একটু ঘুমালেই ঠিক হয়ে যাবে।আর না কমলে গরম গরম এক কাপ চা খেয়ে ফেলবি তাহলেই কমে যাবে!”
পৃথিশা কিছু একটা ভেবে মুখ ফুলিয়ে বলল, “আমি কি আপনার বোন হই?”
মারুফ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “বোন হতে যাবি কেন?”
পৃথিশা ছোট ছোট চোখ করে বলল, “তাহলে আমাকে তুই বলেন কেন?তুমি বলতে পারেন না?”
মারুফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেসে বলল, “আচ্ছা তুমি করেই বলব এখন থেকে, খুশি?”
পৃথিশা হাসিমুখে মাথা নাড়লো।

চায়ের কাপ নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই মারুফ বলে উঠলো, “কালকে হলুদ মনে আছে তো?”
পৃথিশা পিছন ফিরে বলল, “মনে থাকবেনা কেন শুনি?”
মারুফ পৃথিশার কাছে এসে বলল, “হাত দুটো যেন মেহেদী দিয়ে ভরা দেখতে পাই আগামীকাল।”
বড় বড় চোখ করে হ্যাঁ বলে পমথিশা তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

___________

নিজের বাসায় কলিংবেল বাজানোর আগেই দরজা খুলে বের হলো পৃথিশার চাচাতো ভাই কর্ণ।তিনি পৃথিশার থেকে প্রায় দশ বছরের বড়। এক বাসায় থাকলেও বুঝ হবার পর দুজনের কেউই কখনো কারো সাথে কথা বলেনি।পৃথিশা তার দিকে একপলক তাকিয়েই বাসার ভেতর চলে গেল।
বাসায় তোড়জোড় চলছে।একেকজন একেক কাজে ব্যস্ত।সুমিতা বেগম রান্নাঘরে রান্না করছেন।রহমান সাহেব কয়েক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে মাত্র বাসায় ফিরলেন।পৃথিশার বড় চাচী সুমিতা বেগমের সাথে রান্নায় ব্যস্ত।পৃথিশা ড্রয়িংরুমের ফ্যান ছেড়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে পৃথিশা রহমান সাহেবের দিকে এগিয়ে গেলো।
গরমে তার কাহিল অবস্হা!
পৃথিশা শাসানোর স্বরে বলল, “আপনাকে এসব করতে কতদিন নিষেধ করেছি আব্বু।তাও কেন আপনি আমার কথা শোনেন না!”
রহমান সাহেব মেয়ের কথায় হেসে দিলেন। বললেন, “মাফ চাইলাম আম্মাজান।কিন্তু আপনি কি জানেন কিছুদিন পর আবার আম্মার বিয়ে!তাই তো আমার এত উৎসাহ!”
পৃথিশা তার বাবার কথা শব্দ করে হেসে দিলো।রহমান সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন।কিছুদিন পর চাইলেও যখন তখন তিনি এই হাসি দেখতে পারবেন না ভাবলেই বুক ভর হয়ে আসে।তিনি চাইলেও পৃথিশাকে ছোট থেকে সবকিছু দিতে পারেননি,কিন্তু তাতে পৃথিশা কোন অভিযোগ করেনি।
রহমান সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “যান আম্মুজান ফ্রেশ হয়ে আসেন,একসাথে খাব।”
পৃথিশা মাথা নেড়ে রুমে চলে যায়।

ফ্রেশ হয়ে বের হতেই সুমিতা বেগমের সামনে পড়ে। তিনি তখন ডাইনিং টেবিলে খাবার বাড়ছিলেন।
সুমিতা বেগম খাবার বাড়তে বাড়তে পৃথিশাকে বলেন, “কি রে ছেলেটার জ্বর কমেছে?”
পৃথিশা ধপ করে নিজের বাবার পাশের চেয়ারটায় বসে বলে, ” হে মা ভোর রাতের দিকে কমে গেছিলো।তুমি খেয়েছ?না খেলে আমাদের সাথে বসে পড়ো।”
সুমিতা বেগম মেয়ের মাথায় হাত রেখে হাসলেন।রহমান সাহেব এসে খেতে বসলে পৃথিশা নিজেই পরোটা,ডাল তার প্লেটে তুলে দেয়।তারপর নিজেই ছোট ছোট করে পরোটা ছিড়ে ডালে ভিজিয়ে নিজের বাবার মুখে তুলে দেয়।রহমান সাহেব চোখের পাতা বারবার ঝাঁপটিয়ে পানি বন্ধ করবার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। সুমিতা বেগম রান্নাঘরের দরজার পাশ থেকে উঁকি দিয়ে তৃপ্তি নিয়ে বাবা-মেয়েকে দেখছে!

___________

দুই হাত ভর্তি মেহেদী নিয়ে বসে বসে ঝিমুচ্ছে পৃথিশা।মারুফের কথায় আজকে বিকালে হাতে মেহেদী দিয়ে গিয়েছে একজন আর্টিস্ট।কিন্তু মেহেদী দিতে দিতপ বেশ রাত হয়ে গিয়েছে যার ফলে এখন পৃথিশার জেগে থাকতে হচ্ছে।ঘুমে চোখ ছোট ছোট হয়ো আসছে পৃথিশার।কিন্তু এই হাত নিয়ে ঘুমাতেও পারছে না।
বালুশে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে আছে পৃথিশা।হুট করে বারান্দাশ খট খট শব্দ হতেই সজাগ হয়ে গেলো সে।সর্তকিত চোখে সেখানে তাকাতেই দেখলো কেউ রেলিং বেয়ে উঠে আসার চেষ্টা করছে।
ছোটবেলা থেকেই পৃথিশা এসব ভুত-জ্বীন অতিরিক্ত ভয় পায়। এই রাতের বেলা নিজের বারান্দায় এমন কিছু দেখে ভয়ে তার রক্ত হিম হয়ে আসলো।
চারপাশ না দেখে চিৎকার করতে গেলেই এক জোড়া বলিষ্ঠ হাত তার মুখ চেপে ধরে।চোখগুলো বড় বড় হয়ে যায় তার।
মারুফ হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “আরেহ্,চিৎকার করার কি হলো?”
মারুফের কন্ঠস্বর শুনে পৃথিশার মনে হলো তাকে কেউ আকাশ থেকে টুপ করে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। মারুফের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তার হুশ ফিরলো।
অনেকটা চেঁচিয়েই বলে উঠলো, “ইন্না-লিল্লাহ! আপনি এখানে কেন?আম্মু বা আব্বু দেখলে কি বলবে?বাসায় মেহমান এসেছে তো!আপনাকে দেখে ফেললে তো সর্বনাশ!”
মারুফ ভ্রু কুঁচকে পৃথিশার দিকে তাকালো।বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি ভুত নাকি রাক্ষস যে আমাকে দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
পৃথিশা মারুফের কথায় ধ্যান না দিয়ে ব্যস্তিব্যস্ত স্বরে বলল, “আপনি এখানো কেনো এসেছেন?”

মারুফ পৃথিশার দিকে এগিয়ে গেলো।শুকিয়ে যাওয়া মেহেদীর হাত দুটো নিজের কাছে টেনে নিয়ে শীতল কন্ঠে বলল, “তোমাকে দেখার জন্য!”
মারুফের শীতল কন্ঠ আর তুমি বলে সম্বোধন করা শুনে লজ্জাবতী গাছের ন্যায় নুয়িয়ে গেলো পৃথিশা। মারুফ মনে হয় পৃথিশার অবস্হা আঁচ করতল পেরেছে।
পৃথিশার লজ্জা আরও বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য বলল, ” মেহেদী পড়া হাত দু’টো দেখতে সুন্দর লাগছে।”
মুখে রক্তিম ভাব দেখা গেলো পৃথিশার, ঠোঁটে সরু হাসির রেখা।নিজের অধরদ্বয় পৃথিশার কপালে ছুঁয়িয়ে মারুফ আগের মতো বারান্দা দিয়ে নেমে গেলো।একটিবারও পেছন ফিরে তাকালো না।যদি তাকাতো তাহলে চড়ুই পাখির ন্যায় হলুদ কামিজে আবৃত লজ্জায় আরক্ত হওয়া একটি মেয়েকে দেখতে পেতো!

_______

সকাল থেকেই পৃথিশাদের বাড়িতে আজ মেহমানের সম্ভার।পুরটো বাড়ি মানুষো গিজগিজ করছে।পৃথিশার গাঁয়ে হলুদ উপলক্ষ্যে সবার আগমন। ছাদে প্যান্ডেল বেঁধে গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে।আজকে গাঁয়ে হলুদ হবে আর আগামীকাল কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে।

বিকেল হতেই পুরো বাড়িতে সাঁজ-গোজের ধুম পড়ে গেলো।পৃথিশাকে লাল পাড়ের হলুদ শাড়িতে আবৃত করা হলো।তার পুরো গাঁ জুড়ে ফুলের গহনা।দুই হাতে এক ডজন হলুদ কাঁচের চুড়ি।তাকে ছাদে নিয়ে যাওয়ার গোধুলীর আলোয় হলুদ পরীর মতো লাগলো সবার কাছে।
মারুফের গায়ে হলুদ হবে না কারন হলুদে তার এলার্জী।তাই এটা নিয়ে কেউ বাড়াবাড়ি করেনি।
পৃথিশা ছাদে বসিয়ে রেখে সবাই নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত হয়ে গেলো।পৃথিশা গোমড়া মুখে সবাইকে তাকিয়ে দেখছে।
হুট করে নিজের হাতে ঠান্ডা কিছুর ছোঁয়া পেতেই দেখলো মারুফ হাতের উল্টোপিঠে হলুদ লাগিয়ে দিয়েছে।পৃথিশার তার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই মারুফ গম্ভীর কন্ঠে বলল, “হাতে আমার নাম লেখো নি?”
পৃথিশা মিটিমিটি হেসে নিজের দুইহাত এগিয়ে দিয়ে বললো, “খুঁজে বের করেন তো দেখি!”
মারুফ কিছুক্ষণ খুঁজার পর ডান হাতের একদম কোণায় দেখল ডিজাইন করে তার নামের প্রথম অক্ষর লিখা।নিজের নাম খুঁজে পেতেই তার মুখে হাসি খেলে গেলো।মারুফের হাসি দেখে পৃথিশা বুঝলো সে নাম পেয়ে গেছে।নিজেও মারুফের হাতে হাত ঠেকিয়ে হেসে দিলো!

চলবে,,
প্রতিক্রিয়ার আশায় রইলাম।ভুলক্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here