গল্পের নামঃ #প্রণয়
#পর্বসংখ্যা_১৪+১৫
লেখনীতেঃ #ফারিহা_জান্নাত

শায়েলা রহমান রাগারাগি করে এক পাতা ঘুমের ঔষধ খেয়ে ফেলেছিল।খাওয়ার মিনিটখানেকের বিছানায় নেতিয়ে পড়ে ।রিনা খাতুন তার এ অবস্হা দেখে ভয় হসপিটালে নিয়ে এসেছেন। ওয়াশ করা হয়েছে কিন্তু ঔষুধের প্রভাবে চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। পৃথিশা খবর শুনেই বাড়ি না গিয়ে দৌড়ে হসপিটালে এসেছে।অথচ মারুফের কোন হেলদেল নেই।তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কিছুই হয়নি। পৃথিশা শায়েলা রহমানকে একপলক দেখেই ডাক্তারের কাছে গিয়েছে কথা বলতে।মারুফ হসপিটালে এক কোণার চেয়ারে বসে মোবাইল দেখছে।

পৃথিশা মারুফের কাছে গিয়ে রাগী স্বরে বলল, “আপনার কি কোন কিছুর খেয়াল নেই? খালা বলল আপনার জ্বর তাও আপনি হসপিটালে বসে আছেন কি জন্য?যান এখনি বাড়ি যান।”
মারফ পৃথিশার দিকে একবার তাকালো।সারাদিনের ক্লান্তিটা মুখে ফুটে উঠেছে।হিজাবের বাহির দিয়ে ছোট ছোট কয়েকটা চুল মুখের উপর পড়ছে।মারুফ ধীরস্বরে পৃথিশাকে বলল, “তুই যাবি না?”
পৃথিশা নরম স্বরে মারুফের কাছে এসে বলল, “আপনার কি খুব বেশি খারাপ লাগছে?গলা এমন শোনাচ্ছে কেন?”
মারুফ দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে বলল, “মাথার বাম পাশটা খুব ব্যাথা করছে।মনে হয় মাইগ্রেনের ব্যাথাটা আবারো বেড়েছে।”
পৃথিশা মারুফের জড়তা কপালে হাত দিলো। চমকে উঠে হাত সরিয়ে নিলো,মারুফের গায়ের তাপমাত্রা অনেক বেশি। পৃথিশা তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে একটা নাপা বের করে পানি এনে মারুফকে জোর করে খায়িয়ে দিলো।

শায়েলা রহমানের কেবিনে ঢুকে দেখলো রিনা খাতুন চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছে। পৃথিশা তাকে গিয়ে হালকা করে ধাক্কা দিলে তিনি হুড়মুড়িয়ে জেগে উঠেন। ভীত গলায় বলেন, “কে কে?”
পৃথিশা আশ্বস্ত স্বরে তাকে বলল, “আমি খালা।”
রিনা খাতুন শান্ত হয়ে বললেন, “ওহ্ তুই।কিছু বলবি?বাড়ি যাচ্ছিস না কেনো এখনো?রাত তো বেশি হয়ে যাচ্ছে।”
পৃথিশা ইতস্ততভাবে বলল, “ওনার তো অনেক জ্বর খালা।তুমি যাবে না বাসায়?”
রিনা খাতুন চিন্তিত গলায় বললেন, “কি করে যাই বল তো?শায়েলা তো কি এক কান্ড ঘটিয়ে বসলো।অনামিকা-টাও সকাল থেকে লাপাত্তা,পরে ফোন করে বলল সে নাকি তাদের বাড়ি চলে গিয়েছে। ওর সঙ্গে তো কাউকে থাকতে হবে,আর আমি ছাড়া তো আর কেউ নেই। আর মারুফের কি খুব বেশি জ্বর।”
পৃথিশা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ অনেক জ্বর।আমি এজন্য একটা নাপা খায়িয়ে দিয়েছি কিন্তু মনে হচ্ছে না কমবে।তার উপর আবার না খাওয়া।আমার উচিত ছিল তাকে কিছু খাওয়ানো তারপর ঔষুধ খাওয়ানো।কিন্তু উনি তো হসপিটালের কিছু খেতে চান না।”
রিনা খাতুন চিন্তিত স্বরে বললেন, “হুম তাই তো।আচ্ছা আমি দেখি কি করা যায়।তোরা দুইজন বরং বাসায় চলে যা।এখানে এত রাত করে থাকার দরকার নেই।বেশি রাত হয়ে গেলে ঝামেলা হবে।”

পৃথিশা সম্মতি জানিয়ে চলে গেল।মারুফের কাছে গিয়ে দেখল সে এখনো আগের মতো হেলান দিয়ে বসে আছে।কপালের রগগুলো ফুলে উঠেছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে মাথায় প্রচুর যন্ত্রণা হচ্ছে।
একরাশ মন খারাপ পৃথিশা তাকে গিয়ে বলল, “আপনার খুব খারাপ লাগছে তাই না?চলুন তাড়াতাড়ি উঠুন বাসায় যেতে হবে।খালা তো বলল তিনি এখানেই থাকবে।আপনিও তো আবার কিছু মুখেও দেননি। উঠুন তাড়াতাড়ি!”
মারুফ ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো।পৃথিশা রিনা খাতুনকে বলে বেরিয়ে গেলো। হসপিটালটা বাসা থেকে বেশ খানিকটা দূরে।

ময়মনসিংহের চড়পাড়া মোড়! বলা যায় সবচেয়ে জ্যামপূর্ণ একটা রাস্তা।সারাক্ষণ অটো-রিকশা গুলোর মধ্যে ধাক্কধাক্কি লেগেই থাকে।বাম পাশে থাকা মিষ্টি আর ফাস্ট ফুডের দোকানগুলো মানুষের ভিড়টা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
রাস্তার এক পাশে এক অটোওয়ালা আর রিকশাওয়ালার ঝগড়া লেগেছে।রিকশার চাকার সাথে অটোর চাকা লপগে যাওয়ায় দুইজনই ক্ষেপে ঝগড়া শুরু করেছে।

মারুফকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে পৃথিশা রিকশা ডাকতে গেলো।অন্যমনষ্ক থাকায় রাস্তা পার হতে গিয়ে বড় ট্র্যাকের নিচে চাপা পড়তে যাচ্ছিল।মারুফ দৌড়ে এসে পৃথিশাকে টান দিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে আনলো। ভয়ে পৃথিশার এখনো কাঁপছে,আরেকটু হলেই সে মারা পড়ত ট্রাকের তলায়।
মারুফ পৃথিশার হাত ঝাঁকিয়ে রাগী স্বরে বলল, “এ্যাই মেয়ে,এখনো ছোট বাচ্চার মতো রাস্তা পার হচ্ছিস কেন? আরেকটু হলেই তো…”
পৃথিশার ছলছল চোখ দেখে আর কিছু বলতে পারলো না মারুফ। চুপ হয়ে গেলো,এই জিনিসটার প্রতি সে সবসময়ই দুর্বল।পৃথিশাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “আচ্ছা সরি।এবার হাঁটা শুরু কর।”
পৃথিশার হাত বাচ্চাদের মতো শক্ত করে ধরে রাস্তা পার হলো মারুফ।পৃথিশা চুপচাপ মারুফের হাত আঁকড়ে ধরে তার পিছন পিছন যেতে থাকলো।

🍁
পৃথিশা নিজের বাসায় এসে ঢুকতেই তার ছোট চাচী মুখ বেঁকিয়ে বললেন, “তা এত রাতে কই থেইকা ফুর্তি করে আসলা? চাকরির নাম দিয়া কি কি কইরা বেড়াও তলে তলে হুম?”
পৃথিশা সোফায় গা এলিয়ে দািয়ে বলল।মুখের নিকাবটা খুলে জোরে শ্বাস নিয়ে বলল, “চাচী! আপনি আগে পান খাওয়া মুখটা ভালোমতো ধুয়ে আসেন,ঠোঁট-দাঁত লাল হয়ে আছে পুরা যেন কারো রক্ত চুষে আসছেন।আর দাঁতটাও ব্রাশ করবেন প্লিজ,কথা বললেই মুখ দিয়ে পানের গন্ধে বের হচ্ছে।”

পৃথিশার চাচীর মুখ পুরোপুরি চুপসে গেলো।বিড়বিড় করতে করতে তিনি চলে যান।কিছুক্ষণ পর আবারো পৃথিশার দাদীকে নিয়ে ফেরত আসেন।পৃথিশা তখন ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করছিলো।
পৃথিশার দাদী চিৎকার করে বললেন, “ওই ছেমড়ী ফ্রিজ থেকা কি নেস?”
পৃথিশা ঠান্ডা পানির বোতল থেকে পানি নিয়ে মুখ ধুয়ে বোতলটা তার দাদীর সামনে ধরে বলল, “পানি নেই।পানি খাবেন?”
পৃথিশার দাদী পৃথিশার হাত থেকে বোতলটা নিয়ে বললেন, “তুই ফ্রিজের পানি ক্যান নিতাছোস?ফ্রিজ কি তোর নাকি?”

পৃথিশা শান্ত স্বরে বলে,
— “দাদী! আমি আপনাকে অনেক সম্মান করি,অনেক।এইযে এই সংসারটা আপনি নিজে ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছেন।আপনারই এসবে সবচেয়ে বেশি অধিকার,আমার কিংবা আম্মু-চাচীর থেকেও বেশি। বয়সের ভাড়ে সংসারে এখন তোমার কাজ-কর্ম কমে গেলেও গুরুত্ব কমে যায়নি।দাদা মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত বাসার অনেক খরচ দাদা নিজের পেনশনের টাকা দিয়ে করতো।দাদা মারা যাওয়ার পর বড় চাচা,ছোট চাচা আর আব্বু সংসার সামলায়। এতজন মানুষের খরচ চারটি খানি কথা নয়।মাঝে-সাঝেই হিমশিম খেতে হয়।সংসারে ছোট চাচা একটু বেশিই খরচ করে,যার কারনে তুমি ছোট চাচীকে একবারে মাথায় তুলে রাখো।এটাতে আমার সমস্যা নেই,তোমার যা ইচ্ছা তুমি তাই করবে। আমার চাকরি হওয়ার পর বাসার কারেন্ট বিল,পানি বিল সহ আরও কিছু অংশে আমি টাকা খরচ করি। ফ্রিজ টা কারেন্ট দিয়েই চলে,আমি কি একবারো বলেছি আমার টাকায় চলা ফ্রিজের খাবার তোমরা খাবে না?আমি তো বলিনি।পরিবারের সব সদস্যই ফ্রিজ ব্যবহার করতে পারবে, তাহলে তুমি কেন বললে আমি ফ্রিজ থেকে কিছু নিতে পারব না।আমি কি এই পরিবারের সদস্য না?
দাদী ছোট থেকে, একেবারে ছোট থেকে তুমি প্রতিনিয়ত আমার বিরোধিতা করতে।কেন করতে?তার উত্তর হলো আমি মেয়ে,আমি ছেলে হতে পারিনি তাই আমার কোন মূল্য নেই।ছোটবেলায় যখন তুমি ভাইয়াকে আদর করতে,তাকে খায়িয়ে দিতে আমিও আগ্রহ নিয়ে তোমার কাছে যেতাম।কিন্তু তুমি আমাকে বকা দিয়ে তাড়িয়ে দিতে।আমার বান্ধবীরা এসে তাদের দাদী-নানী নিয়ে গল্প করত।আমি চুপচাপ বসে শুনতাম।ছোটবেলায় ভাবতাম একদিন তুমি ম্যাজিকের মতো আমার সাথে সবার দাদীর মতো আচরণ করবে।আমায় আদর করবে,খায়িয়ে দিবে।কিন্তু তুমি পাল্টাও নি দাদী। আগের মতোই আছো।
চাকরি পাওয়ার পর মনে হয়েছিলো তুমি আমাকে এবার অন্তত একটু ভালোবাসবে।কিন্তু তোমার আচরণ আমাকে আবারো আশাহত করেছে দাদী।অনেক কষ্ট পেয়েছি আমি এবার,অনেক।মাঝরাতে চিৎকার করে নিজেকে বারবার প্রশ্ন করতাম কেন আমি ছেলে হলাম না?কেন আমাকে মেয়ে বানানো হলো?উত্তর পাইনি একটারও। তুমি যখন কর্ণ ভাইয়ার সাথে সকাল সকাল গল্প করো তখনও আমার মনটা দুঃখে ভরে যায়।
কিন্তু দাদী তুমি হয়তো ভুলে গেছো তুমিও মেয়ে,কোন ছেলে না।তোমার দাদী যদি তোমার সাথে এরকম ব্যবহার করতো তখন কি করতে তুমি?”

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here