#কৃষ্ণচূড়ার_দিনে
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

|৫|

— মা, আমি বিয়েতে রাজি।

কথাটা শ্রবণ হওয়া মাত্র রিপা বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকান মেয়ের দিকে। কাঠ কাঠ গলায় বলেন, “রাজি মানে? এতক্ষন না তুই ‘বিয়ে করবো না, বিয়ে করবো না’ বলে দুনিয়া উল্টিয়ে ফেললি। হুট করে কোন জ্বীন ভর করলো তোর উপর?”

রুপ থমথম মুখে বলে, “বিয়ের জন্য রাজি না হলেও দোষ, হলেও দোষ। মানে, মানুষের মন কি চেঞ্জ হতে পারে না? আজিব!”

রিপা বেগম সন্দিহান কন্ঠে বলে উঠেন,”তো এইটার কি গ্যারান্টি আছে যে, আবার মিনিট দুই-এক না যেতে তোর মন চেঞ্জ হবে না?”

রুপ দ্রুত পায়ে রিপা বেগমের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলে, “হবে না! আই প্রমিস। আমি সত্যি সত্যি এইবার বিয়েতে রাজি।”

“কাহিনী বুঝলাম না, নদীর স্রোত উল্টাদিকে কিভাবে বইছে? এতক্ষন তো বলছিলি অন্য কথা, এখন আবার অন্য। তোর মতিগতি তো আমার ভালো ঠেকছে না।”

রিপা বেগমের কন্ঠে তীক্ষ্ণতা৷ রুপ ভাবলো, সে হয়তো একটু বেশি বেহায়াপনা করে ফেলেছে। তার নিজেকে একটু সংযত রেখে, টেকনিকালি তার মাকে সামলানো উচিৎ। রুপ জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট দু’টো ভিজিয়ে নিয়ে মিনমিনে স্বরে বলে,

-আমি তোমাকে আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়েছি। এখন তোমার মত যদি পরিবর্তন হয়ে থাকে তাহলে বিয়ে দিলে, না-হলে না দাও। তোমার ব্যাপার। তবে, পরবর্তীতে আমার থেকে ‘হ্যাঁ’ আশা করবা না। এই ‘হ্যাঁ’ শুধুমাত্র এইবারের জন্যই।

কথাটা বলেই রুপ উল্টা ঘুরে নিজের রুমের দিকে হাটা দিল। রুপ জানে, এই কথাতেই তার কাজ হয়ে যাবে। রিপা বেগম রুপের যাওয়ার দিকে বিভ্রান্তি দৃষ্টিতে তাকান, পিছন থেকেই বলেন, “তুই কি সত্যি রাজি? আমি কি তাহলে বিয়ের কথা আগে বাড়াব?”

রুপ পিছনে না ঘুরেই উত্তর দিল, “হ্যাঁ!”
অতঃপর আর এক মূহুর্ত বিলম্ব না করে গটগট করে চলে যায় রুমে। দরজা দিয়ে, বালিশের মাঝে মুখ গুঁজে। ইতিমধ্যে তার মেদহীন গালে ছড়িয়ে পড়েছে রক্তিমার ছটা, প্রণয়িনী মনে জেগেছে তার কৃষ্ণমানটিকে ঘিরে অকথিত স্বপ্ন। যে মানুষটি কয়েক প্রহর পূর্বেও বিরল বস্তু ছিল, সে মানুষটাই এখন সম্পূর্ণ তার? আজ থেকে একান্ত মানুষের খাতায় তার নাম সবার উপরে, কথাটা ভাবতেই রুপ লজ্জায় মিইয়ে যায়।

______________

শ্রাবণের মধ্যভাগ। নীলাভ আসমান ঢাকা পড়েছে বিষন্নতায়। বাতাসের প্রখরতায় দোল খাচ্ছে জানালার ধারে শুভ্র রঙের পর্দাগুলো। দক্ষিণানিল গায়ে হিম পরশ বুলাচ্ছে, মোহনীয় ঘ্রাণের অবাধ্য বিচরণ চলছে রুমের কোনায় কোনায়। রুপ একপলক তাকালো ফুল দিয়ে সজ্জিত রুমটির চারদিকে। আজ রুপ ও তনয়ের বাসররাত। ঘন্টাখানিক পূর্বেই তারা বিবাহ নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। এই দিনটা নিয়েই কত স্বপ্নই না বুনেছে রুপ। অবশেষে দিনটি পূর্ণতা পেতে চলেছে। তবে, রুপের মধ্যে খুশিভাবটা এতটা পরোক্ষ করা যাচ্ছে না। মুখটা বিষন্নতায় ঘেরা, উদ্বিগ্ন ভাব স্পষ্ট মানুষটিকে দেখার।
রুপ পা ভাঁজ করে বসলো, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলো রুমটি। অকস্মাৎ তনয়ের একটি ছবির উপর গিয়ে স্থির হলো তার দৃষ্টি। পরক্ষনেই উদ্বিগ্নতা আরও দৃঢ় হলো। সেই রাতের পর আজ দেড় মাস হতে চললো, তনয় তখনও ধরা দেয়নি রুপের নিকট৷ বিয়েটা তাদের ঘরোয়া ভাবেই হয়েছে। যার দরুন, কোন অনুষ্ঠানের ছুতো দিয়েও সে দেখতে পারেনি তার কৃষ্ণমানবটিকে। কবুল বলার সময়ও তাদের অবস্থান পৃথক পৃথক ছিল৷ রুপ ছিল ভিতরের রুমে বসা আর তনয় ছিল ড্রয়িংরুমে। কিঞ্চিৎ পরিমাণও দেখা মিলেনি তার। উপরন্তু, মানুষটিও কোন প্রকার যোগাযোগ বা দেখা করার চেষ্টা করেনি, যা রুপের মন বারংবার বিষিয়ে তুলছে। প্রশ্ন জাগছে মনে, “আদৌ মানুষটা তাকে পছন্দ করে তো?”
কিঞ্চিৎ প্রহর গড়াতেই রুমের দরজা খুললো, প্রবেশ করলো কৃষ্ণমানব। রুপ সে প্রান্তে একনজর তাকিয়ে মাথা নুয়ে নিল, মন ভর্তি অভিমানিনী মেঘ নিয়ে। তনয় ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো রুপের দিকে, রুপ তখনও স্থির। তনয় রুপের সামনে এসে বসতেই রুপ অভিমানে পিছনের দিকে কিছুটা পিছিয়ে যায়। তনয় তা দেখে ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকায়,

— কোন সমস্যা মিস রুপকথা?

রুপ অভিমানী সুরে বলে, “আপনি পুরো মানুষটাই তো সমস্যা।”

তনয় কিঞ্চিৎ হেসে বলে, “তাহলে তো দেখছি বিরাট সমস্যা।”

তনয়ের হাসি আর কথা শুনে রুপের মাথায় আগুন ধরে গেল। সে সোজা হয়ে বসে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে, “আমি মজার মুডে নই।”

তনয় রুপের দিকে হালকা ঝুঁকে দুরন্তপনা সুরে বলে, “তাহলে কোন মুডে আছেন বলুন, আমি মুড সুইচ করে নিচ্ছি।”

রুপ দ্রুত পিছনের দিকে মাথা এগিয়ে নিয়ে বলে, “আপনাকে যতটা ভদ্র ভেবেছিলাম ততটা আপনি নন।”

তনয় সটান হয়ে বসে বলে, “সেটা আপনার ভাবনার দোষ, আমার না।”

“একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো, আপনি কি সত্যি আমাকে পছন্দ করে বিয়েটা করেছেন?”

তনয় ভ্রু কুটি কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “কেন বলুন তো?”

“বিয়ের ঠিক হওয়ার পর একবারও আমার সাথে দেখা বা যোগাযোগ করা চেষ্টা করেছেন? সেই রাতের পর, আজ আমাদের দেখা, কথা বলা।”

তনয় ঠোঁট নাড়িয়ে ভাবুক ভঙ্গিতে বলল,”অহ আচ্ছা।”

তনয়ের এমন ভাব দেখে রুপ তেতে উঠল, “অহ আচ্ছা মানে কি? উত্তর দিন!”

“পছন্দ হলে যে দেখা বা যোগাযোগ করা বাধ্যতামূলক তা তো জানতাম না। ”

“মজা নিচ্ছেন?”

তনয় হেসে বললো, “কিছু মূহুর্তের মধুরতা দ্বিগুণ করতে, বিরহের বড্ড প্রয়োজন পড়ে মিস রুপকথা।”

“মানে?”

তনয় রুপের দিকে হালকা ঝুঁকে মুখটা ওর কানের কাছে নিয়ে এসে বলে,”শুনেছি, দূরত্ব ভালোবাসা বাড়ায়। তাই, বিয়ের আগে নিজের জন্য ভালোবাসাটা বাড়িয়ে নিলাম। কারণ, এরপর এর কোন সুযোগ নেই।”

রুপের শরীর কাঁপছে, অভিমানি মেঘ সরে যাচ্ছে আপন গতিতে। অনুভূতিরা সাড়া দিচ্ছে প্রখরভাবে। তনয় সরে এসে বসলো, বলল,

— ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে, যান ফ্রেশ হয়ে নিন।

রুপ কথা বাড়ালো না, সম্মতি জানিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তার রাগ এখন পুরোই পরে গিয়েছে। তনয়ও উঠে দাঁড়ালো, এগিয়ে গেল আলমারির দিকে। আলমারি খুলে ভিতর থেকে একটা প্যাকেট বের করলো, অতঃপর সেটা নিয়েই এগিয়ে আসলো রুপের দিকে। রুপের হাতে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, “ফ্রেশ হয়ে এইটা পড়বেন।”

রুপ একবার প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে পুনরায় তনয়ের দিকে তাকালো। এই নিমিত্তে, দৃষ্টি নত করে চুপচাপ এগিয়ে গেল ওয়াশরুমের দিকে।

রুপ ওয়াশরুম থেকে বের হতে হতে তনয়ও চেঞ্জ করে নিল। রুপ ফ্রেশ হয়ে আসতেই তনয় নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো রুপের দিকে। রুপের পড়নে তখন তনয়ের দেওয়া শুভ্র রঙের পোশাকটি। তনয় তা দেখে মিষ্টি হেসে বলল, “মাশাআল্লাহ!”

কথাটা শোনামাত্র রুপের গাল দু’টিতে ছেঁয়ে গেল রক্তিমার প্রলেপ। তনয় কয়েক কদম এগিয়ে এসে বলে, “লজ্জা পড়ে পেয়েন, এখন চলেন।”

রুপ মাথা তুলে তাকায়, প্রশ্নবোধক চাহনি তার চোখে মুখে। অস্ফুটস্বরে সে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায়?”

“আঁধার রাত্রি বিলাস করবো আপনার।”

রুপ একবার জানালার বাহিরে তাকিয়ে বলে, “কিন্তু আকাশের অবস্থা ভালো না। যেকোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে।”

” নামুক! আজ না-হয় প্রেমবর্ষনে মাতাক শহর।”

________________

নিস্তব্ধ রাস্তার ধারে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে চলেছে দু’জন মানব ও মানবী। একে অপরের হাত মুঠোয় বন্দী। বাতাসের বেগে উড়ছে মানবীর ওড়নার শেষপ্রান্ত। সামনেই একটি টং দোকান পড়তে তনয় বলল,

— চা খাবেন?

রুপ সম্মতি দিয়ে বলল, “খাওয়া যায়।”

“আচ্ছা,দাঁড়ান। আমি গিয়ে নিয়ে আসছি।”

কথাটা বলেই তনয় এগিয়ে গেল দোকানটির দিকে। মিনিট দুই-একের মাঝেই দু-হাতে দু’টি চায়ের কাপ নিয়ে ফিরলো সে। এককাপ রুপের দিকে এগিয়ে বললো, “সাবধানে খাবেন।”

রুপ লাজুক হেসে বলে, “আচ্ছা।”

দুইজনের এক কিনারা দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে আর নিরলস আকাশ দেখছে। মাঝে সুর তুলছে কথার। হঠাৎ, নৈঃশব্দ্যে নেমে পড়লো এক পশলা বৃষ্টি। তনয় দ্রুত চায়ের কাপটি পাশের বেঞ্চিতে রেখে দিল, পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট বের দোকানির হাতে ধরিয়ে দিল। ভাঙতি টাকা দোকানিকে রাখতে বলে, রুপের হাত ধরে দৌড়ে ঢুকে পড়লো সামনে অবস্থিত পার্কে। তনয় রুপের হাত ধরেই এগিয়ে গেল পার্কটির ভিতরে, একটি গাছে নিচে এসে আশ্রয় নেওয়ার পূর্বে রুপ কিছু একটার সাথে বেজে পড়ে যেতে নেয়। তনয় ওর হাত ধরে থাকায় টেনে ধরে কিন্তু সুবিধা করতে না পেরে দুইজন একসাথেই সিক্ত ঘাসের উপর পড়ে যায়। ঘটনাক্রমে বুঝে উঠতে তারা একসাথেই হেসে উঠে। রুপ বলে,

— তখন হাতটা ছেড়ে দিলেই পারতেন, আমার সাথে আপনিও এখন ব্যথা পেলেন।

তনয় রুপের চোখের দিকেই তাকিয়ে বলে, “হাতটা তো ছাড়ার জন্য ধরিনি।”

রুপ তখন কিছু না বলে লজ্জায় মাথা নুয়ে ফেলে। মিনমিনে স্বরে বলে, “উঠুন! ভিজে যাচ্ছি দু’জনেই।”

তনয় বলল, “ভিজে যখন গিয়েছি তখন উঠে লাভ কি? এর চেয়ে বরং বৃষ্টিস্নাত উপভোগ করুন।”

রুপ আর কথা বাড়ালো না, চোখ বন্ধ করে উপভোগ করতে থাকলো পরিবেশটা। এই প্রথম বৃষ্টি বিদ্বেষী কন্যা, প্রেমে পড়লো বৃষ্টি মায়ায়। জীবনের একুশটি বর্ষা তিক্ততা মনে হলেও, বাইশ তম বর্ষাটি যে তার নিকট সবচেয়ে প্রিয়তম আর সুখকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টির কলধ্বনিতে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে পরিবেশ। মেঘের মৃদু মৃদু ডাক ঝংকার তুলছে কর্ণকুহরে। ভেজা মাটি ও বুনোঘাসের সুবাস তীব্রতর হতেই রুপ লম্বা নিঃশ্বাসে তা ভরে নেয় অন্তরে। তনয় খুব সপ্তপর্ণে রুপকে নিজের বাহুতে ভরে নিল, তার কপালের আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। শীতল হাতটি গলিয়ে দিল রুপের মেদহীন গালে। ধীর কন্ঠে বলল,

— কৃষ্ণচূড়ার আগুন রঙ্গে,
পুড়ছে প্রেমিকের মন।
পুড়বে জেনেই অনল পানে,
পতঙ্গের আস্ফালন।
[সংগ্রহীত]

রুপ লজ্জায় মুখ লুকায় তনয়ে বুকে। বৃষ্টিস্নাত যুগলের প্রণয় প্রহর দেখে বিস্তৃত কৃষ্ণচূড়া গাছটি বোধহয় বিমুগ্ধ হলো। নিভৃতেই ছায়া রূপক খানিকটা হেলে পড়লো তাদের উপর। নব্য সূচনার অভ্যর্থনা জানালো তাদের ঝরা রক্তিমা পুষ্পে।

[সমাপ্ত]

যারা শুরু থেকে গল্পটা পড়েছেন তারা আজ একটু রেসপন্স করবেন। গল্পের খারাপ-ভালো দিকগুলো ধরিয়ে দিলে খুশি হবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here