#কৃষ্ণচূড়ার_দিনে
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

|৩|

আঁধার রাত্রিতে ডুবিত নগরী, বর্ষনের ধারা তখনও বইছে। পিনপতন নীরবতার মাঝে অকস্মাৎ অকস্মাৎ গর্জে উঠছে মেঘ, আকাশে ভাসমান পুঞ্জমেঘের ফাঁকে ফাঁকে দেখা মিলছে ক্ষণপ্রভার আলো৷ কিঞ্চিৎ পরিমাণ আলো বারান্দার তীর সীমানায় এসে গড়াগড়ি খেয়ে পুনরায় ফেরত যাচ্ছে। ড্রয়িংরুমের এক কোনে টিমটিম করে জ্বলছে চার্জার লাইটটি, যেকোন সময় হয়তো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। দীর্ঘসময় অযত্নে ফেলে রাখার দরুন এই দোষা। সোফার ধার ঘেষে আঁটসাঁট হয়ে বসে আছে রুপ, বার বার হাঁচি দিয়ে উঠছে সে। আবছা আলোয় ফুটে উঠেছে তার রক্তিমা মুখটি। জড়তা ও সংশয়ে কুঁকড়ে মরছে সে, তার বাইশ বছরের জীবনে এতটা অপ্রীতিকর ও লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পূর্বকালে কি ইহকালেও পড়েনি কখনো। রুপ পারছে না তো মাটি দুইভাগ করে তাতে লুকিয়ে পড়তে।
রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছে, তনয় ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় চা বানাচ্ছে। কিছু সময়ের ব্যবধানেই চা তৈরি হয়ে যায়। তনয় চায়ের ট্রে-টা টেবিলের উপর রেখে একটা কাপ তুলে এগিয়ে দেয় রুপের দিকে, “নেন!”

রুপ কোন রকম ভণিতা না করে নিঃশব্দে চায়ের কাপটা নিয়ে নেয়। কিছুক্ষণ নীরব বসে থেকে আনমনে কিছু ভাবতে থাকে সে। আনমনা হয়েই ছোট এক চুমুক বসায় পেয়ালাতে, তাপমাত্রা মাত্রাতিরিক্ত হওয়ায় পরমুহূর্তেই জিহ্বা পুড়ে যায় তার। দহনযন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে চাপা চিৎকার করে উঠে রুপ। দ্রুত চায়ের কাপটা কাছ থেকে সরাতে নিলে নড়বড়ে যায় খানিকটা, একাংশ চা ছিঁটকে পড়ে ধবধবে সাদা মেঝেতে। তনয় তৎক্ষনাৎ বলে উঠল,

— আরেহ আস্তে!

রুপ এইবার সম্পূর্ণই মিইয়ে যায়, একের পর এক কান্ড ঘটিয়ে ফেলার দায়ে লজ্জায় নাক কাটা যাচ্ছে তার। যার নিকট সে নিজের প্রতিচ্ছবি মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ করতে চেয়েছিল, তার সামনেই নিজের ইজ্জত একদন ফালুদা করে বসে আছে। এরচেয়ে বেদনাদায়ক অনুভূতি কি পৃথিবীতে আর দুটো আছে? রুপ দুই হাতের মুঠোর মাঝে শাড়ির আঁচলটা মোচড়াতে মোচড়াতে বলে, “সরি!”

তনয় শান্ত কন্ঠেই বলে, ” শান্ত হন মিস রুপকথা। মাঝে মধ্যে হয় এমন, ব্যাপার না।”

রুপ প্রত্যুত্তর না করে গোপনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। এমন সময়, চার্জার লাইটটি ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে একবারের জন্য ঘুমিয়েই পরে। ফেলে দেয় দুইটি মানব ও মানবীকে আঁধারের রাজ্যে। রুপ ও তনয় দুইজনই হতবিহ্বল দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালো, অবশেষে এইটাই হওয়া বোধহয় বাকি ছিল। তনয় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

— আমি ফ্ল্যাশলাইট চালাচ্ছি দাঁড়ান।

রুপ চটজলদি বলে উঠলো,

— না থাক, অন্ধকারই থাকুক। আলো ভালো লাগছে না।

রুপ চাইছিল না, তার অস্বস্তি ভাবটা তনয় ধরে ফেলুক। উপরন্তু, তার এখন যেই অবস্থা চোখ তুলে তাকানোটাই দায় সমান তাই সে ইচ্ছে করেই বললো আলো না জ্বালাতে। তনয়ও কথা না বাড়িয়ে ছোট করে বলল, “আচ্ছা।”

সময়ের সাথে সাথে অন্ধকারাচ্ছন্নটা খানিকটা কেটে গেল, অন্ধকারের নিজস্ব আলোয় ফুটে উঠলো দুটো মানুষ অবয়ব। মাঝে মধ্যে ক্ষণপ্রভার কিঞ্চিৎ আলো রুমে বিচরণ করে যেতেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে দুইজনের ভাবভঙ্গি। তনয় চায়ের কাপে ছোট একটা চুমুক দিয়ে বললো,

— বললেন না তো চা কেমন হয়েছে?

কথাটা শুনে খানিকটা ভড়কালো রুপ, পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “জি, ভালোই।”

— শুধু ভালো?

রুপ এইবার হেসে বললো, “না, অনেক ভালো।”

তনয় প্রত্যুত্তর না করে কিঞ্চিৎ হাসলো। মূলত এই গুমোট পরিবেশকে স্বাভাবিক করতেই চায়ের প্রসঙ্গটা তুলা। রুপও বিষয়টা আঁচ করতে পেরেছিল বিধায় অন্য কিছু ভাবলো না। অন্যথায় যে কেউ ভাবতো, “এই মানুষটা কেমন? যেচেই নিজের প্রশংসা শুনতে চাইছে?”
চা খাওয়া শেষে রুপ একটু ভালোবোধ করলো, এতক্ষণ প্রচন্ড শীত করছিল তার। রুপ বারান্দার দিকে তাকালো। থাইগ্লাসটা স্বচ্ছ এখন, ওপাশের দৃশ্য স্পষ্ট। দেখা যাচ্ছে বিস্তৃত আকাশটি। মিনিট দুই-এক গড়াতেই ডেকে উঠছে মেঘ, ক্ষণপ্রভার আলোয় দেখা যাচ্ছে দূরে অবস্থিত কৃষ্ণচূড়া গাছটি। আগুনের রক্তিমায় রঞ্জিত কয়েকটা কৃষ্ণচূড়ার গোছা বাতাসের দোল খেয়ে এসে পড়লো তাদের তীর সীমানায়। রুপ উঠে দাঁড়ালো, কোন দিক খেয়াল না করে এগিয়ে গেল বারান্দার দিকে। তনয় পিছন থেকে বেশ কয়েকবার রুপকে জিজ্ঞেস করলো সে কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু রুপ প্রত্যুত্তর করলো না। অগত্যা, তনয়ও উঠে দাঁড়ালো, পিছু নিল রুপের। রুপ থাইগ্লাসের দরজাটা খুলে বারান্দায় প্রবেশ করলো, রেলিং না থাকায় বৃষ্টির ছাঁটা আসছে বেশ। ভিজিয়ে দিচ্ছে রুপকে। রুপ সেদিকে তোয়াক্কা না করে চট করে সাদা মেঝের উপর ছড়ানো রক্তিমা ফুলের একটি গোছা হাতে তুলে নিল। সে আরও একটা গোছা তুলতে যাবে তার আগেই তার বা হাতে টান পড়ে। নিজেকে সামলাতে না পেরে পিছিয়ে আসে সে, তখনই এক শক্তপোক্ত হাতের মালিক তাকে আগলে নেয়। রুপ কিছু বুঝে উঠার আগেই মানবটি তাকে টেনে নিয়ে আসে বারান্দা থেকে,লাগিয়ে দেয় দরজটা। পরক্ষণেই মানবটি সরে দাঁড়ায়। অতঃপর গলা খেঁকিয়ে বলে,

— আপনি পাগল মিস রুপকথা? একবার বৃষ্টিতে ভিজে কি মন ভরে নি আবার চলে গিয়েছেন বৃষ্টিতে ভিজতে? এতক্ষন যে শীতে মৃগী রোগীর মত কাঁপছিলেন তা কি ভুলে গেলেন?

শেষের কথায় রুপ একটু অপমানিতবোধ করলেও কিছু বলল না। নিম্ন স্বরে বলল,

— বৃষ্টিতে ভিজতে না, ফুল আনতে গিয়েছিলাম।

কথাটা বলেই ডান হাতটা উঁচু করে ফুলটা দেখালো রুপ। অন্ধকারে তা স্পষ্ট বুঝা না গেলেও তনয় বেশ অবাকই হলো। সে ঠিক শুনেছে কি-না তা নিশ্চিত করতে আবার জিজ্ঞেস করলো, “ফুলের জন্য?”

রুপ মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ!”

তনয় দীর্ঘশ্বাস ফেললো, এই মেয়ে যে আস্ত ফুল পাগল তা বুঝা হয়ে গিয়েছে তার। আগে হাতে ছিল কদম, এখন কৃষ্ণচূড়া। তনয় কিছুটা সময় চুপ থেকে বলল, “ফুল বুঝি আপনার বেশি প্রিয়?”

রুপ উৎফুল্ল কন্ঠেই উত্তর দিল,” অনেক! ”

— কদম ফুলগুলো কে দিয়েছে? বিএফ?

রুপ এক মূহুর্তের জন্য থমকালেও, পরমুহূর্তে চট করে বলে উঠল,

— আমার কোন বিএফ নাই, কদমগুলো আমি নিজেই পেরেছি।

কথাটা শুনে নিজের অজান্তেই তনয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ফুটে উঠলো ঠোঁটের কোনে সরু হাসি। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে আবার জিজ্ঞেস করলো,

— পেরেছি বলতে গাছ থেকে?

— হু! ওই যে চৌরাস্তার মোরে একটা কদম গাছ আছে না, সেখান থেকে।

তনয় এইবার হেসে বলে, “তার মানে চুরি করেছেন?”

কথাটা শুনে রুপ থতমত খেয়ে যায়, সাথে ভড়কেও যায়। তনয় যে তাকে এমন কিছু বলবে তা সে কল্পনায়ও ভাবে নি। উপরন্তু, এইটা প্রশ্নের উত্তর কি দিবে তাই তো ভেবে পাচ্ছে না রুপ। সে ইতস্তত করে বলল,

— না মানে.. এইটা চুরি না।

তনয় ঠোঁট চেপে হেসে বলে, “তাহলে কি? ফুলগুলো নিশ্চয়ই বলে নেন নি। আর না বলে কোন কিছু নেওয়া তো চুরিই তাই না?”

তনয় যে এমন কথার প্যাঁচ জানে তা রুপ আগে জানলে কখনও এর সাথে কথা বাড়াতো না। সে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো তনয়ের দিকে। কিন্তু অন্ধকার হওয়ায় না বুঝতে পারলো তনয়ের ভাবভঙ্গি, না দেখতে পেলো ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা হাসিটুকু। দেখলে হয়তো বুঝতো সবটাই দুরন্তপনা। রুপকে জ্বালানোর কলাকৌশল। অবশ্য, তনয় নিজেও রুপের প্রতিক্রিয়া উপভোগ করতে পারছে না। রুপ ইতস্তত করেই বললো, “জানি না।”

তনয় নিঃশব্দে হেসে বলে, “তাহলে আপনি মানছেন আপনি চুরি করেছেন?”

রুপ কিছু বললো না, চুপচাপ নিজের শাড়ির আঁচলটা মুঠোয় পুরে তার উপর অত্যাচার চালাতে লাগলো। কিছুটা সময় নীরবে কাটতেই কর্কশ শব্দে তনয়ের মুঠোফোনটা বেজে উঠে। চমকে উঠে দুইজনই। তনয় তৎক্ষনাৎ পকেট থেকে ফোনটা বের করে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো মুঠোফোনে পর্দায়, সেখানে ভাসছে ইংরেজিতে লেখা “মা” নামটি।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here