টাকা চু’রির অপ’বাদ নিয়ে স্বামী, শাশুড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সাইফা। শাশুড়ী একের পর এক মি’থ্যে অভিযোগ দিয়েই যাচ্ছেন। আশ্চর্যের বিষয় আশরাফুল মায়ের কথার প্রতি উত্তরে কিছুই বলছেনা।
তিনদিন আগে আশরাফুল দুটো টাকার বান্ডিল হাতে দিয়ে বলেছিলো,” টাকা গুলো রাখো। আমার যখন প্রয়োজন হবে তখন দেবে।”
সাইফা আর গুনে দেখেনি কত টাকা? যেভাবে তার হাতে টাকার বান্ডিল দিয়েছিলো, ঠিক সেভাবেই আলমারির ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলো। আজ সন্ধ্যায় হুট করে এসেই আশরাফুল বলল,
-“সাইফা টাকা গুলো দাও।”
সাইফা সরল মনে আলমারি খুলে দুটো টাকার বান্ডিল আশরাফুলের হাতে দিয়েই সন্ধ্যায় সবার জন্য চা বসানোর উদ্দেশ্যে নিচে নেমে এলো।
এরপরই চিৎকারের সুর ভেসে আসলো।
আশরাফুলের দুটো টাকার বান্ডিলে আলাদা আলাদা পঞ্চাশ পঞ্চাশ করে এক লক্ষ টাকা ছিলো। একটা বান্ডিল থেকে ত্রিশ হাজার নেই অপরটি থেকে দুই হাজার নেই। টাকা যেহেতু সাইফার হাতেই দিয়েছিলো, তাই সবার ধারণা টাকা সাইফাই সরিয়েছে। শাশুড়ী তো ফোঁড়ন কে’টে বলেই দিলো,
-“দেখ গিয়ে, বাবা- ভাইকে টাকা পাঠিয়ে বসে আছে। আর ক’বার কতটাকা পাঠিয়েছে কে জানে?”
সাইফা চুপ ছিলো এতক্ষণ। ভেবেছিলো আশরাফুল তার হয়ে মায়ের কথার জবাব দেবে। কিন্তু না, সে মায়ের কথা মান্য করে দাঁড়িয়ে রইলো। আজ প্রথম আশরাফুলের প্রতি তার ঘৃ’ণা হচ্ছে। মানুষটা তো তাকে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছে, তাহলে তার নামে এমন অপ’বাদ মেনে নেয় কি করে?
সাইফা তিক্ত কন্ঠে জোর দিয়েই সুধালো,
-“আমি এক টাকা কেনো, এক পয়সাও ধরিনি। আমার এমন চু’রি-চা’মা’রি স্বভাব নেই।আমার বাবা- ভাই আপনাদের টাকার জন্য বসে নেই। আমি এখান থেকে টাকা পাঠাবো আর তারা খাবে। তাই দয়া করে আমাকে মি’থ্যে অভিযোগ দেবেন না।”
সাইফার শাশুড়ী আনোয়ারা জাহান খেঁ’কিয়ে উঠলেন,
-“বেয়া’দব বউ পালি। আমার মুখে মুখে ত’র্ক করে। টাকা তুমি তোমার বাবা- ভাইকে না পাঠালে কি করেছো? হিসেব দাও।”
খুব একটা ঝ’গড়াঝা’টি পছন্দ নয় সাইফার। যেহেতু স্বামী তার হয়ে কথা বলছেনা, সেখানে নিজের হয়ে অবশ্যই সাফাই দিতে হচ্ছে। সাইফা শাশুড়ীর কথার প্রতিত্তোরে কিছুই বললোনা। সরাসরি আশরাফুলের দিকে মুখ করে দাঁড়ালো। চোখে চোখ রেখে কাঠকাঠ সুরে বলল,
-“আপনি নিজে গুনে টাকা হাতে নিয়েছেন? আপনিতো বলেছিলেন কারো কাছে পাওনা টাকা আপনাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলো। আপনি কি বুঝে নিয়েছেন? নাকি যার মারফতে টাকা এসেছে সে সরিয়েছে, যার অপ’বাদ আমাকে দেওয়া হচ্ছে।”
-“দেখলি, দেখলি বাবা? এই জন্যই এমন ছিঁচকে চো’রকে ঘরে রাখতে চাইনি আমি। চু’রি তো চু’রি, তার উপর সিনাজুরি। এই মেয়ে, তুমি তোমার পেটের বাচ্চার কসম দিয়ে বলো তুমি টাকা সরাও নি।”
শাশুড়ীর কথায় আৎকে উঠলো সাইফা। শেষে এসে একটা অনাগত বাচ্চা, যে কিনা এখনো ভূমিষ্টই হয়নি। তার কসম কাড়তে বলছে?
এবারে আশরাফুলের ও টনক নড়লো। সে চাইছিলো ব্যাপারটা তার মতো করে মিটিয়ে নিতে। আর যাই হোক তার নিজ সন্তানের কসম কাড়া, এটা সে মানতে পারবেনা। ঐ অনাগত বাচ্চার বাবা সে। তাই সে মাকে বলল,
-“মা, এখানে আমার সন্তান এসেছে কোথা থেকে? যে দোষ করেছে সে শাস্তি পাবে।”
কথা শেষ করেই সাইফার দিকে তাকালো। আতঙ্কিত, মলিন চাহনিতে তাকিয়ে আছে সাইফা। মনে হচ্ছে একটু পরই টুপটাপ অশ্রুবর্ষণ হবে দু’গাল জুড়ে।
আশরাফুল সাইফার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হুংকার ছেড়ে বলল,
-“তুমি আর এক মুহূর্ত আমার বাড়ি থাকবেনা। আমার মায়ের সাথে উঁচু গলায় কথা বলার সাহস করেছো তুমি। তুমি এক্ষুনি তোমার বাবার বাড়ি যাবে। এক্ষুনি মানে এক্ষুণি। মা ও আর একটা কথাও বলবেনা।”
মায়ের থেকে চোখ ফিরিয়ে আশরাফুল সাইফার ডানহাত শক্ত করে চে’পে উপরে নিজেদের ঘরে নিয়ে গেলে।
আনোয়ারা জাহান তো চুপ থাকার মতো অবস্থায় নেই। একটা ইস্যু পেয়েছেন, আজ সারারাত বক’বক করবেন।
ক্লাস শেষে আজ বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিলো প্রভাতি। প্রয়োজন সেরে বেশ খানিকক্ষণ আড্ডা দিলো। চা, কফি কিছু হলে কখন যে সময় কে’টে যায় বলাই যায়না। মেদিনীর বুকে সূর্যের পতন ঘটে চারিদিকে অন্ধকারের মেলা বসেছে। রাস্তার হরিদ্রাভ ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চকচকে রাস্তায় গাড়ি চলাচলের মনোরম সৌন্দর্য নজর কাড়ে। কখন যে সন্ধ্যে নামলো, প্রভাতি টেরই পেলোনা। বান্ধবীকে বিদায় জানিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। ভাইয়াকে কয়েকবার কল দিয়েছিলো গাড়ি পাঠাতে। কিন্তু ফোন তুলছেনা। শেষে উবার কল করে অপেক্ষা করতে লাগলো।
ইলান একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছিলো। নিয়ন বাতির আলোয় হলদে ফর্দা জৌলুশ সুন্দরী নারীকে দেখে ইলানের দৃষ্টি তাকে চিনতে ভুল করলোনা। প্রভাতিকে একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গাড়ি ঘুরিয়ে তার সামনে গিয়ে থামলো।
ফোনে দৃষ্টি ছিলো প্রভাতির। উবার এসে গেছে? এত তাড়াতাড়ি? দৃষ্টি শূন্যে তুলে সামনে তাকাতেই কালো রঙের গাড়িটি দেখে ভ্রু কুঁচকে গেলো। ইলান গাড়ির কাঁচ নামিয়ে দিয়ে স্বভাবসুলভ এটিটিউড নিয়েই বলল,
-“গাড়িতে উঠে আসো।”
প্রভাতি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। এই মুহূর্তে সে ইলানের সাথে বাসায় ফিরতে ইচ্ছুক নয়। প্রভাতিকে ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইলান বেশ কয়েকবার হর্ণ বাজিয়ে শব্দ করলো। আশেপাশের পথযাত্রী বিরক্তি চোখে তাকাচ্ছে কালো রং এর চকচকে গাড়ির দিকে। শুধু শুধু হর্ণ বাজিয়ে শব্দ দূষণ করলে মানুষ তো বিরক্ত হবেই। এবার ও আসলোনা প্রভাতি। ইলান নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। দু’চোখের পাতা এক করে জোরে শ্বাস নিয়ে জানালায় মুখ বাড়িয়ে বলল,
-“এখন কি তোমাকে কোলে করে গাড়িয়ে ওঠাতে হবে? ইডি’য়ট।”
রা’গে চোয়াল ঝুলে গেলো প্রভাতির। কড়া সুরে জবাব দিলো,
-“আপনাকে আমি বলেছি আমাকে কোলে তুলুন? সব সময় আমার ব্যাপারে এত নাক গলাতে আসেন কেনো? যেখানে যাচ্ছিলেন যান, আমার পথে এসে বাঁধা হচ্ছেন কেনো? অস’ভ্য পুরুষ।”
শেষ কথাটি বিড়বিড় করেই বলেই মুখ গুঁজে নিলো প্রভাতি। তবে ইলানের কান এড়ালোনা কথাটি। তার ঠোঁট নড়াচড়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রভাতি কি ধরনের শব্দ উচ্চারণ করতে পারে। তাছাড়া প্রভাতির মুখে অহরহ তাকে নিয়ে এই মন্তব্য শোনা যায়। অবাক হলোনা ইলান, ঠোঁটের কোনে তীক্ষ্ণ হাসি ফুটিয়ে তুললো। কাউকে ভালোবাসলে যে কি পরিমান বে’হায়া হতে হয়, তার প্রমাণ ইলান নিজেকে দিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ইলান কথা না বাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। দরজা খুলে প্রভাতির হাত শক্ত করে চে’পে ধরলো। টে’নে’হিঁ’চড়ে গাড়িতে তুলে দরজা বন্ধ করে দিলো। অসাবধানতা বশত প্রভাতি পায়ে ব্যথা পেয়ে চোখমুখ কুঁচকে নিলো। ইলান ড্রাইভিং সিটে বসে সূক্ষ্ম নজরে একবার পরখ করলো প্রভাতিকে।
-“আমার সাথে যেতে প্রবলেম কোথায় তোমার? উবারে অচেনা পুরুষের সাথে যেতে পারবে, আর আমার পাশে বসে গেলেই তোমার গায়ে ফো’স্কা পড়বে? এখন রাত, দিন নয়।”
প্রভাতি বিরক্ত হয়ে বলল,
-“আপনাকে আমার প্রচন্ডরকম অসহ্য লাগে। বিরক্তিকর লোক।”
ইলান ঠোঁটের কোনো দুর্বোধ্য হাসি। ভীষণ যত্ন করে সুর ঢেলে বলল,
-“এখন বিরক্তিতে তেঁতো লাগছে, কিছুদিন পর এই আমিটাকেই মধু মনে হবে।”
বিব্রতবোধ এড়াতে মুখ বাঁকিয়ে জানালার বাইরে চোখ রাখলো প্রভাতি। বাড়ি পৌঁছে আকস্মিক হতবাক হয়ে তাকিয়েছিলে সে। নিজেদের বাসায় যাওয়ার আগে আশরাফুলের সাথে কিছুকথা বলার প্রয়োজন বোধ করে প্রভাতির পিছু পিছু ঢুকে পড়লো ইলান।
প্রভাতি অবাক হয়ে আশরাফুলকে জিজ্ঞেস করলো,
-“ভাইয়া এই অসময়ে ভাবিকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?”
আশরাফুল গমগমে স্বরে শুধালো,
-“সাইফাকে তার বাবার বাড়ি দিয়ে আসছি। আর আসবেনা ও।”
-“কি আশ্চর্য! আর আসবেনা মানে? কি হয়েছে?”
আনোয়ারা বেগম সবার কথার মাঝেই নিজের কথার আগমণ ঘটালেন।
-“আমার ছেলের টাকা চু’রি করে বাবার বাড়িতে পাঠাচ্ছে। এমন চো’রের ঠাঁই আমার বাড়িতে হবেনা। তাই যেখানের জানমাল সেখানে পৌঁছে দিক।”
প্রভাতি ভাইয়ের দিকে ফিরলো। ভাই ভাবিকে প্রচন্ড ভালোবাসে। আর যাইহোক এতবড় অপ’বাদ সে ভাবিকে দেবেনা। তাহলে ভাবিকে তার বাবার বাড়িতেই বা দিয়ে আসছে কেনো?
ইলান যে কাজে এসেছিলো তা সম্পূর্ণ হয়নি। তবে একবার আশরাফুলকে চোখের ইশারায় প্রশ্নবিদ্ধ করলো। প্রতিত্তোরে আশরাফুল ও তাকে ইশারায় কিছু ইঙ্গিত দিলো।
সাইফা যাওয়ার আগে একবার মসৃণ হেসে প্রভাতির গালে হাত বুলিয়ে দিলো।
-“নিজের খেয়াল রেখো।”
প্রভাতি আর কিছুই বলতে পারলোনা আশরাফুল তাড়া দিলো। সাইফা ও বেরিয়ে পড়লো। বাবা মা যদি শুনে চু’রির অপ’বাদ নিয়ে মেয়ে তাদের বাড়িতে এসে উঠেছে তাহলে লজ্জায় ম’রে যাবে। আর যাইহোক সন্তানকে কখনো কু’শিক্ষা দেননি।
রাতেই আশরাফুল বাড়ি ফিরলো। ভাবিদের বাড়ির খবর কিছুই জানা হলোনা প্রভাতির। সে ভোরের অপেক্ষায় আছে। ভাইয়ার কাছে অনেক প্রশ্ন তার।
ভাগ্য খা’রাপ হলে যা হয়, সকালে ফ্যাক্টরি থেকে ফোন পেয়েছে বলে বেশ তাড়াহুড়ো করেই বেরিয়ে পড়লো আশরাফুল। প্রভাতি আর কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারলোনা। ভাবির নাম্বারে ডায়াল করে বন্ধ পেলো। আশ্চর্য হলো প্রভাতি। ভাবি তো এরকম ফোন অফ রাখেনা। তাহলে তাদের বাড়িতে কিছু হলো না তো?
প্রভাতি দুপুরের পর বান্ধবীর বাসার কথা বলে ভাবির বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। মা জানলে কখনোই যেতে দেবেনা।
ভাবির বাবার বাড়ি এসে মাথা ঘুরে গেলো প্রভাতির। এটা কিভাবে সম্ভব? এমন কিছুর জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা।
#চলবে……..
(অনেকদিন পর ধারাবাহিক লিখছি। লিখাগুলো বেশ এলোমেলো। পড়ে মন্তব্য করার অনুরোধ রইলো। ভুল ত্রুটিগুলো মার্জিতভাবে ধরিয়ে দেবেন। কেউ পর’কিয়া কিংবা স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহ এমন থিম ভাববেননা। কিছু কিছু বিষয় সাসপেন্স থাকবে। হ্যাপি রিডিং।)
#
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#সূচনা_পর্ব