#কুয়াশায়_ঘেরা
#পর্ব_০৪
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

-“স্যার, তুর্শির পোস্টমর্টাম রিপোর্টে এসেছে শি ইজ নন-ভার্জিন?”

মুনিরের কথায় ইলানের খুব একটা ভাবাবেগ হলো বলে মনে হচ্ছেনা। ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। যে তুর্শিকে মা’র্ডার করেছে এটাও হয়তো তারই কাজ। তাছাড়া মেয়েটাকে রাস্তায় ন’গ্ন অবস্থায় ফে’লে যাওয়া হয়। শরীরে সমস্ত আ’ঘাতের চিহ্নই বলে দিচ্ছে ধারালো কিছু দিয়ে কু’পিয়ে মারা হয়েছে। কিন্তু ১৬ বছরের এই বাচ্চা মেয়েটার সাথে কারো কি এমন শ’ত্রুতা থাকতে পারে তার রহস্য উন্মোচন করা গেলোনা।
তুর্শির পরপরই তার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী মনি মিসিং। তাহলে কি মনি তুর্শির ব্যাপারে কিছু জানতো?

কপালে দু’আঙ্গুল চেপ রেখে বাঁ ভ্রু উঁচু করে শিহাবকে প্রশ্ন করলো ইলান,
-“মেয়েটার বন্ধুমহলের বাইরে বাড়িতে ক্লোজ কে কে ছিলো?”

শিহাব চট করেই উত্তর দিলো,
-“স্যার, তাদের বাসারই একজন সারভেন্ট। মেয়েটা বেশির ভাগ সময়ই তুর্শির সাথে কাটাতো।”

-“তুমি, তনুশ্রী, মুনির তিনজনই তুর্শির বাড়ি যাবে। বাড়ির সারভেন্টকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। আপাতত নাজমুলকে দিয়ে আমার কাজ আছে।”

————————

তন্ময়ের ফোন পেয়েই আশরাফুল ফ্যাক্ট্রি থেকে ছুটে এসেছে। তন্ময়, রিজু, নিয়ন তিনজনকেই দেখতে পেলো। কিন্তু তার বোন নেই।
একটাই আদরের বোন। প্রভাতির জন্মের পর সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলো আশরাফুল। প্রচন্ড ভালোবাসে বোনকে। বাবা মা’রা যাওয়ার পর থেকে বোনের প্রতি ভালোবাসা যেনো আরও বেড়ে গেলো। একজন বড় ভাই থাকা মানে তুমি বাবা সমতুল্য ছায়ার আদলে আছো। আশরাফুলকে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ দেখা গেলো। চেঁচিয়ে উঠে বলল,

-“আমি তোমাদের উপর ভরসা করে প্রভাকে তোমাদের সাথে পাঠিয়েছি। আর তোমরা কি করলে? একটা মেয়ের খোঁজ রাখতে পারলেনা? চারজন তো একই সাথে বেরিয়েছিলে, তাহলে একজন মিসিং হয় কিভাবে?”

প্রত্যেকে আশরাফুলের চেঁচামেচিতে ভয়ে তটস্থ হলো। কেউ মাথা তোলার সাহস করলোনা। নিয়নের চোখে পানি। থেকে থেকে ফুঁপিয়ে উঠছে।
তন্ময় মাথা নিচু রেখেই বলল,
-“ভাইয়া আমাদের যা শাস্তি দেবেন, আমরা মাথা পেতে নেবো। কিন্তু প্লিজ আগে প্রভাকে খুঁজে বের করা জরুরি।”

এতক্ষণে আশরাফুলের হুশ ফিরলো। সে এখানে এসেছে যে কাজে তা সম্পন্ন না করে অযথাই চেঁচামেচি করছে। আশরাফুল কাউকে কিছু না বলে ফোন লাগালো ইলানের নাম্বারে। দু’দুবার রিং হয়ে কে’টে গেলো। মেজাজ বিগড়ে গেলো আশরাফুলের। প্রয়োজনের সময় কলে পাওয়া যায়না। তাই একটা টেক্সট পাঠিয়ে ছুটে গেলো জঙ্গলের ভেতর। তার দেখাদেখি তন্ময়, নিয়ন, রিজু ও পিছু নিলো। কিছুদূর গিয়েই পা জোড়া থামিয়ে ফেললো আশরাফুল। আকাশে তাকিয়ে দেখলো সন্ধ্যা নামতে বেশি দেরি নেই। পিছু ফিরে একবার নিয়নের দিকে তাকিয়ে তন্ময়কে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“নিয়নকে বাসায় পৌঁছে দাও। ওর এখানে থাকা সেফ না। নাকি এই দায়িত্ব টুকুও পালন করতে পারবেনা।”

তন্ময় মাথা নিচু রেখেই বলল,
-“পারবো ভাইয়া। আমি দিয়ে আসছি নিয়নকে।”

নিয়ন ব্যাগড়া দিয়ে বলল,
-“আমি বাসায় যাবো না। প্রভাকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত আমি কোথাও যাবোনা।”

আশরাফুলের ধমকে পিলে চমকে উঠলে সবার।
-“বড় হয়েছো তুমি। বিবেকহীনের মতো কথা বলে যাচ্ছো। এখানে আমরা সবাই ছেলে, একেকজন একেকদিকে ঢুকে পড়বো। এই মুহূর্তে তোমাকে সাপোর্ট দেওয়ার মতো মুড কারো নেই। আকাশে তাকিয়ে দেখো সন্ধ্যা নামছে। তোমার পরিবার নিশ্চয়ই টেনশন করবে? সোজা বাসায় যাও।”

আশরাফুলের ভাবনা দেখে প্রত্যেকে মুগ্ধ হলো। নিজের বোন বি’পদে আছে জেনেও অন্য আরেকটি মেয়েকে সেফ রাখার চিন্তা তার মাথা থেকে যায়নি। অথচ তারা বন্ধু হয়েও বন্ধুকে দেখে রাখতে পারেনি।

তন্ময় নিয়নকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো জঙ্গল থেকে। আশরাফুল আর রিজু ভেতরে ঢুকে পড়লো। ভেতরের দিকে আসায় ফোন নেটওয়ার্ক শূন্য হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়বার ইলানকে ট্রই করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে।

পথ যেনো শেষই হচ্ছেনা। কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে প্রভাতি বুঝতে পারছেনা। সন্ধ্যা নামছে। এতক্ষণ নিজেকে সাহস জোগাতে পারলেও এই মুহূর্তে আর সাহস ধরে রাখতে পারছেনা।
সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়লো। রক্তিমা আভা কে’টে গিয়ে অন্ধকার ঠাঁই পেলো অন্তরিক্ষে। একাকী নির্জন ঘন জঙ্গলে, গাছের ডালপালা আলো আসতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো। এতে করে জঙ্গলে আরও অন্ধকার দেখা গেলো। কয়েকবার ফোনে সবাইকে ট্রাই করে দেখেছে। জঙ্গলের ভেতরে চলে যাওয়ায় নেটওয়ার্কের দেখা পেলোনা।
গাছের শুকনো পাতা ঝরে পড়ার শব্দে গা চমচম করে উঠলো। এবার ভীষণ কান্না পেলো প্রভাতির। মনে হচ্ছে এখনই সে মা’রা যাবে। আর কখনো মা আর ভাইয়ের চেহারা দেখতে পাবেনা। ঘন লতাপাতার ঝোপ থেকে কেমন আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসছে। প্রভাতি আৎকে উঠলেও কৌতুহলের বশে সেদিকে এগিয়ে গেলো। শুকনো পাতায় পা পড়াতে মড়মড়ে আওয়াজ হচ্ছে। সাবধানে পা ফেললো প্রভাতি। ঝোপের কাছে গিয়েই থেমে গেলো। ভেতরে মনে হচ্ছে একজন মানুষকে দেখা যাচ্ছে। প্রভাতি স্বস্তি পেলো। লোকটিকে বললে হয়তো তাকে এখান থেকে বের করে দেওয়ার পথ বলে দেবে। পরোক্ষণেই সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটে গেলো। যদি লোকটি ভালো না হয়? তার সাথে জবরদস্তি করতে চায়? মুহূর্তেই মনে হলো সে তো এখানে কারো আর্তনাদে গুঙিয়ে ওঠার শব্দ পেয়ে এদিকে এসেছে। ভালো করে মনযোগ দিতেই দেখতে পেলো লোকটি কিছু একটা কু’পিয়ে যাচ্ছে। ঝট করেই প্রভাতি বসে পড়লো ঝোপের আড়ালে। পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে দৃষ্টি মেলে যা দেখলো তাতে পুরো শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। থরথর করে কাঁপছে শরীর। নিজেকে এখান থেকে টেনে নিয়ে যাওয়ার শক্তি পাচ্ছেনা। তবে এই দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখলেও আতঙ্কে নির্ঘাত তার মৃ’ত্যু হবে।

লোকটির চেহারার একপাশ আবছা অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে। স্পষ্ট নয়। দেখে বোঝা যাচ্ছে একটা মেয়েকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত কুড়াল দিয়ে কু’পিয়ে যাচ্ছে।
একপর্যায়ে প্রভাতি অনুভব করলো অতিরিক্ত ভ’য়ে তার শরীরের তাপমাত্রা তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে। বিভ’ৎস দৃশ্য দেখে বমি বমি ভাব হচ্ছে। যে করেই হোক এখান থেকে যাওয়া প্রয়োজন। কোনোভাবে নিজের শরীরটাকে টে’নেহিঁ’চড়ে দৌঁড়ে পালাতে চাইলো।

অজ্ঞাত ব্যক্তির মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠলো। এতক্ষণ পাতার মড়মড়ে শব্দ পেলেও গুরুত্ব দেয়নি। কারণ এই ঘন জঙ্গলে কোনো মানুষ আসবেনা। কিন্তু এবার স্পষ্টভাবে কারো পদধ্বনি শুনতে পেলো।
মেয়েটাকে সেখানে রেখেই ছুটে বেরিয়ে এলো। সচেতনতা অবলম্বনে মুখে মাস্ক এঁটে কালো হুডি দিয়ে মাথা ঢেকে নিলো। সামনে আসতেই দেখতে পেলো একজন মেয়ে ছুটে পালানোর চেষ্টা করছে। অজ্ঞাত ব্যক্তি তার পিছু ছুটলো। কিছুদূর যেতেই মনে হলো অনেকগুলো পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ব্যক্তিটি আর এগোলোনা। নিজেকে বাঁচাতে লুকিয়ে পড়লো।
প্রভাতি ছুটতে ছুটতে একপর্যায়ে ধপ করেই পড়ে গেলো। শ্বাস ওঠানামা করতে করতে একপর্যায়ে শ্বাসকষ্ট দেখা দিলো। চোখজোড়া নিভু নিভু হয়ে আসছে। তখনই দেখতে পেলো কয়েকজোড়া পা তার দিকে এগিয়ে আসছে। কষ্ট করে চোখের পাতা টেনে খুলে দেখার চেষ্টা করলো পায়ের মালিকগুলোকে।
আশরাফুল ফোনের ফ্ল্যাশ তাক করে প্রভাতিকে দেখতে পেয়ে আর দেরি করলোনা। বোনকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। এতক্ষণ যেনো প্রভাতি প্রাণ ফিরে পেলো। সে নিশ্চিন্ত মনে আশরাফুলের বুকে শরীরের ভর ছেড়ে দিলো। জ্ঞান হারায়নি, তবে চোখ খোলার শক্তিও পাচ্ছে না। শুধু হাতের ইশারায় পেছনে দূরের ঝোপের দিকে ইশারা করলো। ইলান রিজুকে আশরাফুলের কাছে রেখেই নাজমুলকে নিয়ে সাবধানী পায়ে এগিয়ে গেলে ঝোপের দিকে।
বিধ্বস্ত, বি’ভৎস অবাস্থায় তুর্শির বান্ধবী মনি’র নিথর দেহখানা দেখেই চমকে উঠলো নাজমুল। কিন্তু ইলানের মুখভঙ্গি পরিবর্তন হলোনা। ব্যাপারটা তার উপর প্রভাব ফেলেছে কিনা বোঝার উপায় নেই। তবে চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে সে।

প্রভাতিকে বুকে নিয়ে আশরাফুল বুঝতে পারলো তার বোন কোনকিছু নিয়ে অতিরিক্ত ভ’য় পেয়েছে বলে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়েছে। প্রভাতিকে নিজের সাথে আরেকটু মিশিয়ে নিয়ে কপালে গাঢ় করে চুমু খেলো আশরাফুল। গলগল করে বমি করে আশরাফুলের শার্ট ভিজিয়ে দিলো প্রভাতি। পরপর দুবার বমি করলো। এখন এই শার্টের উপর প্রভাতিকে রাখা যাবেনা। এতে ওর গাল, চুল বমিতে ভরে যাবে। আশেপাশে পানিও পাওয়া যাবেনা এখন।

ইলান লা’শটা এখান থেকে নেওয়ার জন্য নাজমুলকে পাঠিয়ে দিলো জঙ্গল থেকে বাহিরে। নেটওয়ার্ক পেলেই তাদের টিমকে কল দিয়ে জানিয়ে দেবে।
নাজমুলকে নিয়ে একবার তুর্শির পোস্টমর্টাম করা ডক্টরের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলো ইলান। মাঝপথে দু’বার কল আসায় ধরতে পারেনি। পরোক্ষণে ফ্রী হয়ে ফোন চেইক করতেই আশরাফুলের টেক্সট দেখতে পেলো। আর দেরি করলোনা। ডক্টরের সাথে দেখা করা ক্যান্সেল করে গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো।

ইলান আশরাফুলের কাছে ফিরে আসতেই দেখতে পেলো আশরাফুলের অবস্থা বমিতে মাখোমাখো। বেচারা বউয়ের বমিতেও মাখামাখি হয়েছে, এখন বোনের বমিতেও। ইলান বলল,
-“আমি ওকে ধরছি, তুই শার্টটা খুলে ফেল।”

রিজু বলল,
-“ভাইয়া আমার ভেতরে টিশার্ট আছে। আপনি আমার শার্টটা আপাতত পরুন।”

নিজেকে পরিষ্কার করা জরুরি। প্রভাতিকে সামলাতে হবে ভেবে ইলান আর রিজুর কথায় সায় জানালো আশরাফুল।
প্রভাতির মাথাটা আস্তে আস্তে উঠিয়ে ইলানের বাহুতে ঠেকিয়ে দিয়ে আশরাফুল শার্ট খুলে ফেললো।

প্রভাতির মাথা বাহু থেকে ধপ করে বুকে গিয়ে পড়লো। তড়াক করে উঠলো ইলান। মনে হচ্ছে তার অস্বাভাবিক হৃদকম্পন হচ্ছে। প্রভাতির শরীরের তাপমাত্রায় বুকটা জ্বলে যাচ্ছে। ভেতরটা উত্তপ্ত প্রণয়ের আগুণে ঝল’সে যাচ্ছে। প্রভাতি পড়ে যেতে নিলেই ইলান একহাত নিয়ে প্রভাতির পিঠে রাখে। বুকের সাথে আগলে নিয়ে চোখ বুঝে ফেলে। এই শান্তিটুকু সে সারাজীবনের জন্য চায়। সারাজীবনের জন্য। অথচ মেয়েটা তার প্রণয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায়না।

শার্ট বদলে নিয়ে আশরাফুল প্রভাতিকে নিজের কাছে ফিরিয়ে নিলো। ঘাড় আর হাঁটুর নিচে হাত রেখে কোলে তুলে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। জঙ্গলের বাইরে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে কদম ফেললো। ইলান জানালো সে পরে আসবে। লা’শের ব্যাপারে খুলে বলতেই আশরাফুল নিশ্চিত হলো তার বোন কি দেখে ভ’য় পেয়েছে। আপাতত প্রভাতির সুস্থ হওয়ার পালা। পরে এসব জিজ্ঞেস করা যাবে।

আশরাফুল আর রিজু প্রভাতিকে নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যেতেই ইলান আশেপাশে তীক্ষ্ণ চোখে দৃষ্টি ঘোরালো। মা’র্ডারার নিশ্চিত প্রভাতিকে দেখে নিয়েছে। এমই মুহুর্তে সে প্রভাতির ক্ষ’তি করার চেষ্টা করবে। প্রভাতির সিকিউরিটি নিশ্চিত করা জরুরি। ইলান পা চালিয়ে ঝোপের আড়ালে হারিয়ে গেলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here