#কলা_পাতায়_বাঁধিব_ঘর
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৪

ক্লান্ত মধ্যাহ্ন,সূর্যের উত্তপ্ত দাপটে ঘেমে-নেয়ে একাকার। ভাদ্র মাসের প্রকৃতিতে ভ্যাপসা গরম। আবার মাঝেমাঝেই শহর তলিয়ে যায় ঝুমঝুম বৃষ্টির আগমনে। আজ বাড়িতে কিছু মেহমান আসার কথা। সেজন্যই বিশাল আয়োজন। সাথে নতুন আত্মীয়দের দাওয়াত করা হয়েছে। পুষ্পর শশুর বাড়ী থেকে তার শশুর আর ননদ রিশা আসলেও তার মা কিংবা রাউফুন আসেনি। রাউফুন না আসায় পুষ্পর মা, চাচা ফোন করেছেন। সে জানালো ব্যস্ত আছে। সে জন্য আসতে পারেনি। রিশা পুষ্পর সাথে বসেই সময় কাটিয়েছে। নাবিল এসে তাদের মাঝে উপস্থিত হয়েই পুষ্পকে জিজ্ঞেস করলো,

-“আপু দুলাভাইয়া কেনো আসেনি?”

পুষ্প আদুরে স্বরে বলল,
-“তুই বললেই চলে আসতো। তুই নাকি দাওয়াত দিসনি।”

রিশা পাশ থেকে নাবিলের গাল টিপে দিয়ে বলল,
-“ছোট্ট বেয়াই কেমন আছেন?”

নাবিল নাক ফুলিয়ে গাল ঘষে সরে দাঁড়ালো। রিশা যেনো মজা পেলো। সে আবার ও নাবিলের গাল টিপে ধরলো। নাবিল বিরক্ত হয়ে বলল,
-“এরকম গাল টিপে ধরলে আমাদের বাড়িতে আর ঢুকতে দেবোনা।”

পুষ্প চোখ রাঙিয়ে বলল,
-“এসব বলেনা।”

নাবিল গাল ফুলিয়ে রইলো। রিশা হেসে উঠে বলল,
-“ওকে বকছো কেনো?
আমিতো ঠিক করেছি ছোট্ট বেয়াইকে বিয়ে করে এই বাড়িতে এসে উঠবো। তখন দেখি বউকে কি করে ঢুকতে না দেয়?”

নাবিল বিয়ের কথা শুনে লজ্জা পেলো। মা বলেছে বিয়ের কথা বলতে নেই। তাই লজ্জা পেয়ে বলল,
-“আমি এখনো ছোট।”

রিশা মিটিমিটি হেসে বলল,
-“কিন্তু আমিতো আমার ছোট বেয়াইকেই পছন্দ করেছি। এখন কি হবে?”
কথা শেষ করে রিশা আবারও গাল টিপে দিলো। এবার নাবিল সত্যি সত্যি বিরক্ত হয়ে রেগে গেলো। গালে হাত দিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল,
-“একেবারে খাটের নিচে বেঁধে রাখবো। কতগুলো তেলাপোকা ছেড়ে দেবো তোমার গায়ে। আর আমার গাল ধরবেনা। গাল টিপে দিলে গাল শক্ত হয়ে যায়।”

রিশা হাসতে হাসতে পুষ্পর খাটে শুয়ে পড়লো। সাথে পুষ্পও হাসছে। যে নিজেই তেলাপোকা ভয় পায় বলে তার মা বোতলে তেলাপোকা সংরক্ষণ করে তাকে ভয় দেখিয়ে ভাত খাওয়ায়। আর সে কিনা রিশার গায়ে তেলাপোকা ছাড়বে। নাবিল রাগ করেই বেরিয়ে গেলো।

মেহমানরা বিকেল সময়েই চলে গেলো। সবাই রিশাকে থাকার জন্য জোর করলেও সে থাকলোনা। ক্লাস মিস দিতে চায়না। তাই বাবার সাথেই ফিরে গেলো।
সন্ধ্যার পর পুষ্প রাউফুনকে কল দেবে কি দেবেনা ভেবে দোটানায় পড়ে রইলো। শেষে সমস্ত জড়তা কাটিয়ে রাউফুনের নাম্বারে ডায়াল করলো। কল করে সে একচোট হতাশ হলো। রাউফুন কল ধরলোনা। পরপর তিনবার কল দেওয়ার পরও কল ধরলোনা। পুষ্প ফোন রেখে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। সবার সাথেই রাতের খাবার খেয়ে ঘরে আসলো।

হুট করেই আজ বিনা বার্তায় বৃষ্টি শুরু হলো। একেবারে ঝুম বৃষ্টি। এই বৃষ্টির সাথে যেনো রাউফুনের বেশ মিল পেলো পুষ্প। সেও তো হুটহাট উদয় হয়।
ঘরে ফিরেই দেখলো মুঠোফোন বেজে উঠলো তীব্র শব্দে। পুষ্প স্ক্রিন অন করে দেখলো ‘ডাক্তার’ শব্দটি ভেসে উঠেছে।
ফোন রিসিভ করেই দু’জনে সালাম বিনিময় করলো।
রাউফুন বেশ বিষ্ময়কর গলায় প্রশ্ন করলো,
-“কি আশ্চর্য! কি আশ্চর্য! তুমি আমায় কল দিয়েছো? কোনো সমস্যা হয়েছে?”

পুষ্প কিয়দংশ সময় চুপ রইলো। এরপরই ঠোঁট গোল করে লম্বা শ্বাস ফেলে জবাব দিলো,
-“আপনি আজ আসেননি কেনো?”

পুষ্প ফোনের বিপরীতে থাকা রাউফুনের অভিব্যক্তি দেখতে পেলোনা, তবে এবারও কন্ঠে একরাশ বিষ্ময় নিয়েই যে রাউফুন জবাব দিলো সেটা বুঝতে বাকি রইলোনা।
-“তুমি কি আমায় মিস করছিলে নাকি?”

পুষ্প রিনরিনে কন্ঠে বলল,
-“সবাই আপনার কথা জিজ্ঞেস করছিলো। আপনি আসেনই নি বা কেনো?”

রাউফুন বলল,
-” সেকি পুষ্প, তোমার কি আমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে? আমাকে দেখতে না পেয়ে তুমি কান্নাকাটি করোনা। আমি এক্ষুনি এসে তোমাকে দেখা দিয়ে যাচ্ছি।”

পুষ্প হাসি ধরে রাখতে পারলোনা। শব্দ করেই হেসে উঠলো। আজ আর রাউফুনকে মানসিক রোগী মনে হলোনা। ভালোলাগলো, একটু একটু নয়! অনেকটাই ভালোলাগার অনুভূতি হলো।
রাউফুন মন খারাপের ভান করে বলল,
-“তুমি তো দেখছি না কেঁদে বসে বসে হাসছো। ভাবলাম দেখা দিয়ে যাই, কিন্তু নাহ্ এখন যাওয়া ঠিক হবেনা।”

পুষ্প হাসি চেপে বলল,
-“আপনি কি সবার সাথেই এমন রসিকতা করেন?”

-“কি আশ্চর্য! তোমার চোখে রসিকতাই পড়লো? আর কিছু পড়লোনা?”

পুষ্প কথা খুঁজে পেলোনা। তাই চুপ করেই রইলো। কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর রাউফুন অস্থির কন্ঠে বলল,
-“পুষ্প, একটা সাংঘাতিক কান্ড ঘটে গিয়েছে। তুমি কি শুনবে কি হয়েছে? না শুনতে চাইলেও মনযোগ দাও, আমি বলছি।”

পুষ্প কৌতুহল দমাতে না পেরে চরম উৎকন্ঠা নিয়ে বলল,
-“বলুন কি হয়েছে? আমি শুনছি।”

পুষ্পের জবাবে প্রসন্ন কন্ঠে বলে উঠলো রাউফুন,
-“তোমার সাথে কথা বলতে বলতে আমি বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু অবস্থা। গাড়ির কথা আমার মনেই নেই। ভেবেছিলাম তুমি আমাকে দেখতে না পেয়ে কান্নাকাটি করছো। আমার কাজ হলো একবার ছুটে গিয়ে তোমাকে দেখা দিয়ে আসা। কিন্তু তুমি সব কিছুতে পানি ঢেলে দিলে আর উপরওয়ালা উপর থেকে বৃষ্টি ঢেলে আমাকে গোসল করিয়ে দিয়েছেন। এখন আমি কি করি বলোতো?”

পুষ্প ভাবলো সিরিয়াস কিছু। কিন্তু নাহ্! এই লোক সব সময় মজা করার মুড নিয়ে থাকে। মনে মনে বলল ‘একবার মাটিতে গড়াগড়ি খান’
কিন্তু মুখে বলল,
-“আপনি কি আমাদের বাসায় আসবেন? নাবিল বারবার আপনার কথা জিজ্ঞেস করেছিলো।”

রাউফুন বলল,
-“নাবিলের নাম কেনো দিচ্ছো? আমি বুঝতে পারছি তুমি আমাকে দেখতে চাইছো। ব্যাপারনা। তাছাড়া আজ রাতে আমার জ্বর আসতে পারে। জ্বরের ঔষধ খুঁজে রেখো।”

পুষ্প রাগ দেখাতে গিয়েও নিঃশব্দে হাসলো। এতটা গুরুত্ব পাওয়া কি তার ভাগ্যে ছিলো? গুরুত্বহীন জীবন পার করতে করতে এই গুরুত্ব দেওয়া মানুষটিকে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে হলো। সে নিশ্চিত রাউফুন এখানেই আসছে। লাইন কে’টে ঘরের এলোমেলো জিনিসগুলো গুছিয়ে নিলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো রাউফুনের গাড়ির। বৃষ্টি একেবারে কমে এসেছে। নিচ থেকে ধপাস করে কিছু পড়ার আওয়াজ শুনলো পুষ্প। অন্ধকারে কিছু ঠাওর করা যাচ্ছেনা। তখনই বিদ্যুৎ চমকালো। ক্ষণিকের জন্য চারপাশ দিনের আলোর মতো প্রভা ছড়িয়ে অন্ধকারে তলিয়ে গেলো। এর মাঝেই পুষ্প দেখে নিলো নিচে রেহানা খালা পড়ে আছে। সে ছুটে বাইরে গেলো রেহানা খালাকে তুলতে।

এই বাড়ির মানুষগুলো বৃষ্টির পানিতে চা খেতে খুব পছন্দ করে। রেহানা খালা একটা বালতি রেখেছেন বাইরে। বৃষ্টি কমে আসায় বের হলেন। যাতে পানিতে ময়লা না পড়ে সেজন্য ঢাকনা দিতেই বেরিয়েছেন। কে জানতো বাইরে এসে পা পিছলে পড়বেন? তা ও আবার পড়ার পরপরই বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। তাই রাগে দুঃখে বলে উঠলেন,
-“খোদা ফেলেও দেয়, আবার লাইট মে’রে ও চায়।”

পু্ষ্প এসেই রেহানা খালাকে টেনে তুললো।
-“খালা আপনি পড়লেন কিভাবে?”

রেহানা খালা প্রচন্ড রেগে বললেন,
-“এখন আবার পইড়া যাইয়া দেখাই? এই বাড়িতে আর কাম করুম না। এদের কাছে আমার গুরুত্ব নাই। রাতবিরেতে পানির জন্য বাইরে পাঠায়।”

মুখ ঝামটা মে’রেই রেহানা খালা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ভেতরে চলে গেলেন। অথচ তিনি নিজ থেকেই সবার পছন্দ অপছন্দ খেয়াল রেখে পানিতে ঢাকনা দিতে এসেছেন। সকালে সবার সাথে একদফা রাগ দেখাবেন। আবার কে কি খাবে? সবার পছন্দমতো রান্নায় বসে যাবেন। হাসলো পুষ্প। মানুষটি উপরে কত রাগ দেখায়, অথচ ভেতরে ভেতরে সে আস্ত হাওয়াই মিঠাই। যেন মুখে দিলেই গলে গিয়ে নাই হয়ে যায়।

রাউফুন ফিরেই দরজায় বেল বাজালো। পুষ্প এসে দরজা খুলেই অবাক হলো। হতবিহ্বল চাহনিতে তাকিয়ে দেখলো রাউফুনের পুরো শরীর শুকনো। তাহলে ভিজলো কখন? রাউফুন হালকা হেসে বলল,
-“আসার পথেই জামাকাপড় শুকিয়ে গিয়েছে।”

পুষ্পর তীক্ষ্ণ চোখজোড়া বলে দিচ্ছে সে কথাটি বিশ্বাস করেনি। রাউফুন একবার আগাগোড়া পুষ্পকে দেখে নিয়ে বলল,
-“সে কি পুষ্প? আমি তোমায় জ্বরের জন্য নাপা টেবলেট খুঁজে রাখতে বলেছি। তুমি সেজেগুজে কোন ঔষধ তৈরী রেখেছো? যদি আজ রাতে আমার অসুখ হয়, তবে ঔষধ ছাড়া নিস্তার নেই বলে দিলাম।”

রাউফুনের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো পুষ্প। একটা নতুন জামাইতো পরেছে। এখানে সাজগোছের কি দেখলো এই ডাক্তার? এই লোক মানুষকে লজ্জায় ফেলতে ওস্তাদ। সে আর দাঁড়ালোনা। রাউফুনকে ফ্রেশ হতে বলে খাবার গরম করতে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে এসেই রাউফুন আগে জিজ্ঞেস করলো,
-“তুমি খেয়েছো?”
পুষ্প মাথা দুলিয়ে জানালো সে খেয়েছে।

রাউফুন বলল,
-“মনে হয় অল্প খেয়েছো। আমার টেনশনে খেতে পারোনি। পাশে বসে পড়ো আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”

এবার ও রাউফুনের কথা শুনে হেসে ফেললো পুষ্প। বলল,
-“আচ্ছা আমাকে বিয়ে করে আপনার কি লাভ হয়েছে?”

রাউফুন খাবারে হাত চালাতে চালাতে বলল,
-“গোপন সূত্রে জানা গেছে তুমি নাকি খুবই ভালো আয়রন করতে জানো। আমার গাদাগাদা শার্ট আয়রন করার জন্যই তোমাকে বিয়ে করেছি।”

পুষ্প ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
-“আয়রন এর পাশাপাশি পোড়াতেও জানি।”

রাউফুন বুকে হাত দিয়ে কৌতুক করে বলল,
-“বুকে বুঝি ছ্যাকা লাগলো, কি সাংঘাতিক! কি সাংঘাতিক।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here