Jahan Sultana
#কমরেড_শায়লা (২য় পর্ব)
০২/০২/২০১৯
আজ আমার আত্ম বলিদান তথা বিবাহ দিবস।
আমি ফেসবুকের “পুরুষ হটাও”গ্রুপে পোস্ট দিয়েছিলাম।
“কমরেড গন, বিবাহ আসরে কোনটি পরিধান উত্তম হবে? টপস জিন্স নাকি পাঞ্জাবী?”
অধিকাংশ সদস্য চাইছে আমি, গ্রুপ এডমিন কমরেড শায়লা, যেন পাঞ্জাবী পরিধান করেই বিবাহ কাজ সম্পন্ন করি! এ হবে এক অভিনব প্রতিবাদ!
সমস্যা হলো আমার আব্বা। বাড়িতে আত্মীয় স্বজন আসবে, লোকে কী বলবে এসব ব্যাপারে আব্বার চেয়ে আম্মারই সাধারনত বেশি মাথা ব্যথা থাকে। তারপরেও আমাকে পাঞ্জাবী পরিহিত অবস্থায় দেখলে আব্বা স্ট্রোক করতে পারে এই ভয়ে আমি এই পদক্ষেপ নিতে পারছিনা।
তবু কী ভেবে আজ সকাল দশটায় আব্বার রুম হতে আব্বার নীল রংয়ের একটা পাঞ্জাবী নিয়ে এসেছি। পাঞ্জাবী পরিধান করে এমনিতেই হালকা পাতলা ট্রায়াল দিচ্ছিলাম , সেই মুহূর্তেআম্মা রুমে ঢুকে আমাকে দেখলেন,তারপর “আল্লাহরে” বলে আরেকবার দাঁত কপাটি লেগে মূর্ছা গেলেন।
বাসা ভর্তি মেহমান। এত হৈচৈয়ের ভেতর মেঝো ফুপু আম্মার চিৎকার শুনে সোজা আমার রুমে ছুটে এলেন, ঢুকে আমাকে দেখে, “এ কী সর্বনাশ” বলে আম্মার পদ অনুসরন করতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই আব্বা রুমে প্রবেশ করলেন। আমাকে দেখে গম্ভীর হয়ে গেলেন সাথে সাথে,
-মা, পাঞ্জাবীর সাথে লুঙ্গি পরবিনা? ষোল কলা পূর্ণ হতো?
এজন্যই বলছিলাম আমার আব্বা পৃথিবীর বাকি পুরুষদের চেয়ে আলাদা। আমি জানতাম আব্বা পুরুষ হওয়া সত্তেও এই বিপ্লবে আমার পাশেই থাকবেন। চোখ ভিজে গেল আমার! পৃথিবী কি জানবেনা এক মহান পুরুষও নারীদের বিপ্পবে শামিল হয়েছিল?
আম্মার চিল চিৎকার শোনা গেল!
-শাওনের আব্বা! কীসব বলছেন? পাঞ্জাবী লুঙ্গি পরে আমাদের মাথা ন্যাড়া মেয়ে বিয়ে করবে! কী বলেন এসব?
আব্বা বিড়বিড় করলেন। হালকা পাতলা বোঝা গেল আব্বা বলছেন, যে যেমন তার সাথে সেভাবেই চলতে হবে কিছু করার নাই।
এটা হলো আম্মাকে বুঝ দেওয়া কথা। জানি, মনে মনে আব্বা আমারই সাপোর্টার। আমার চোখ ভিজে এলো। আব্বাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে মন চাইছে।
এই মুহূর্তে এই পৃথিবীতে একজনই মহাপুরুষ আছেন। মানুষটা আমার আব্বা।
*
দুপুরে আমার শিষ্যা, আমার একান্ত অনুগত ফুফাত বোন নাজমা সর্বশেষ ভাঙচুর খবর তথা ব্রেকিং নিউজ দিল। আব্বা বাড়ির সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন বিয়ের আসরে কেউ যেন আমার ন্যাড়া মাথা আর পোশাক আশাক নিয়ে কথা না বলে,না হাসে।
আমার চোখে আবার পানি আসি আসি করছে। আব্বা এত ভাল কেন? আব্বা ছাড়া আমাকে কেউ বুঝে না।
আম্মা নাকি ঠিক করেছেন আমার সাথে এ জীবনে আর কথা বলবেন না। আমার তাতে কোন সমস্যা নেই। এর আগেও ভদ্রমহিলা দুইবার সারাজীবনের মত আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করেছিলেন।
যার সাথে আমার বিবাহ হতে যাচ্ছে, বজ্জাতটার নাম হাসান। তার নাকি ইচ্ছা স্বল্প পরিসরে,স্বল্প আয়োজনে বিবাহ হবে। এজন্য কমিউনিটি সেন্টারের বদলে আমাদের গ্যারাজকে সাজানো হয়েছে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য।
এই মুহর্তে আমি মঞ্চে উপবিষ্ট হয়ে আছি। মেহমান বলতে আমাদের দুই পরিবারের নিকট আত্মীয় স্বজন। একটু পরপর এদের মাঝ হতে কেউ কেউ হা হুতাশ করছেন আমার রনাঙ্গিনী বেশ দেখে। কারো কারো চাপা হাসিও শোনা যাচ্ছে। আব্বার ভয়ে কেউ কিছু বলছেনা। আব্বাকে সবাই যমের মত ভয় পায়। নাজমা মুঠোফোন হাতে ঘুরঘুর করছে। সে ফেসবুক লাইভে আছে। গ্রুপের পাঁচ হাজার সদস্যা সরাসরি আজ আমার আত্ম বলিদান দেখবে। দেখে তারা প্রতিশোধস্পৃহায় মেতে উঠবে। আমাদের আন্দোলন বেগবান হবে। ভাবতে ভাবতে আমার চোখ টলমল করছে।
মঞ্চে আমাকে পাহারা দেয়ার জন্য ভাবীকে পাশে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ভাবী থাকতে না পেরে একসময় আমাকে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,পাঞ্জাবী পরে কেউ ন্যাড়া মাথায় বিয়ে করে! না একটু লিপস্টিক না একটু কিছু! মান সম্মান গেল আমার। বাপের বাড়িতে মুখ দেখাতে পারবনা। লাল ওড়নাটা প্লিজ মাথা থেকে নামায়োনা।
ভাইয়া পিছন থেকে বলল, পাঞ্জাবীর সাথে ম্যাচিং করা লাল ওড়না খারাপনা। থ্রিপিস মনে হচ্ছেতো! হা হাহা।
সম্ভবত আমাকে আজ সবার সামনে অপদস্থ হতে দেখে ভাইয়ার খুব আনন্দ হচ্ছে।
আমি যে এসবের তোয়াক্কা করিনা সেতো সে থোড়াই জানে।
অপেক্ষা করতে করতে একটু পরই আমি, ব্ল্যাকবেল্ট কমরেড শায়লার শিকার ইকবাল হাসান নামের ছেমড়া টা এলো। সবাই তাকে বরন করতে আগ বাড়িয়ে ছুটে গেলো। এবং সমস্বরে একটা শোরগোল শোনা গেল।
কে যেন বলে উঠল,এরকম কান্ড আগে কখনো দেখিনি!
আমার কৌতুহল হলো, হয়েছেটা কী!
ছেমড়া মঞ্চে ঢুকতেই সে কী পরে এসেছে দেখে আমি কেমন যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ধপাস আওয়াজ শুনে বুঝলাম আম্মা আবার মূর্ছা গেছেন।
তার মেয়ের হবু বর একটা জোব্বা পড়ে এসেছে।
লাল ওড়নাটায় মাথা চুলকাচ্ছে। খোলার জো নেই। ভাবী শক্ত করে হিজাবের মত করে বেঁধে গিট্টু মেরে দিয়েছে। মনে হচ্ছে ফাঁস লেগে যাবে!
আমি ওড়নার উপরেই ন্যাড়া মাথা চুলকাতে চুলকাতে ছেমড়াকে দেখছিলাম। চোখ ছোট,টিকালো নাক,চওড়া কপাল, চেহারায় হালকা ছ্যাঁচড়া ছ্যাঁচড়া ভাব!
প্বার্শদন্ডায়মান আমার ফুফাতো বোন নাজমা ফিসফিস করে বলল,আপু দেখতে মিশন ইম্পসিবলের নায়কের মত!
আমি ঝাড়ি দিলাম। মিশন ইম্পসিবল কী জিনিস এবং তার নায়ক কে আমার জানা নাই। পুরুষ হটাও আন্দোলন শুরু করার পর হতে আমি পুরুষ নির্মিত কোন সিনেমা আমি দেখিনা। এতে লক্ষ্য বিচ্যুতির হালকা সম্ভাবনা রয়েছে! কারন পুরুষমাত্রই ছলনাময়! কিন্তু হায়! কমরেড নাজমাকে পুরোপুরিভাবে সেকথা এখনো বোঝাতে পারিনি। তার এখনো অনেক ট্রেনিং বাকী! তাকে এখনো আমি পুরোপুরি কমরেড বানাতে পারিনি। সুন্দর যুবক পুরুষ দেখলে সে মাঝেমাঝেই যাবতীয় দীক্ষা টীক্ষা ভুলে যায়।
ছ্যাঁচড়াকে জরিপ করছিলাম।
গোলাপী জোব্বার উপর ডাক্তারি এপ্রন। এপ্রনের পকেটে ডাক্তারি জিনিসপত্র। কাঁধে বিপি মেশিন। গলায় স্টেথো। ভাবভঙ্গী “বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্রমেদিনী! বটে! রোসো ভায়া! তোমাকে মজা দেখাব শীঘ্রই!
কলম নিয়ে কাবিন নামায় সাইন করতে করতে হিংস্র দৃষ্টিতে ছ্যাঁচড়ার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি সমেত মুখটা এক পলক দেখলাম। তারপর দেখতেই থাকলাম। দেখতে দেখতে দাঁত কিড়মিড় করলাম।
করতে করতে মনে মনে হাতের উপর হাত দিয়ে কিল মেরে বললাম,আমি পাইলাম,ইহাকে পাইলাম।