#কমরেড_শায়লা (ষষ্ঠ পর্ব)

-বাঁচাও বাঁচাও…
নাকের উপর একটি তেলাপোকা নিয়ে রুমের এপ্রান্ত হতে ওই প্রান্তে আমার তথাকথিত স্বামী ওরফে ছ্যাঁচড়া চিৎকার করতে করতে ছোটাছুটি করছে। তার নাক গভীর ভালবাসায় আঁকড়ে ধরে রাখা
তেলাপোকাটা সম্ভবত ফিনিশ পাউডার খেয়ে হালকা নেশাগ্রস্থ অবস্থায় আছে।

আমি জিভ বের করে একটা চুকচুক শব্দ করলাম। এই ছ্যাঁচড়া না একজন ডাক্তার? মানুষ কেটে বেড়ায়? সন্দেহজনক! ছ্যাঁচড়ার ডাক্তারী সার্টিফিকেট আজ, এই মুহূর্তে প্রশ্নবিদ্ধ!
আমি এখন ফেসবুক লাইভে আছি। ছ্যাঁচড়ার এই শাস্তি প্রাপ্তির দৃশ্য আমার “পুরুষ হটাও” গ্রুপের পাঁচ হাজার কমরেড সরাসরি দেখতে পাচ্ছে। মন্তব্যে ভেসে যাচ্ছি আমি।
-কমরেড শায়লার জয় হোক!
-অত্যাচারী স্বামীর নাক গুড়িয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও।
-স্বামী ছ্যাঁচড়ার চামড়া,তুলে নিব আমরা!
-অবসান হোক সকল অত্যাচারী নারী বিদ্বেষী পুরুষের।
-এই ভিডিও ভাইরাল করো,করতে হবে!
-জয় হোক বাংলার সকল সাহসী তেলাপোকার!
একজন প্রস্তাব দিয়েছেন তেলাপোকাকে আমাদের গ্রুপের সদস্য করে কমরেড তেলাপোকা উপাধি প্রদানের জন্য।
আমি ভেবে দেখলাম বিষয়টা খারাপ হয়না। ছয় পায়ে নাক আঁকড়ে ধরার স্টাইল দেখেই বোঝা যাচ্ছে তেলাপোকাটা বিশেষ কমান্ডো প্রশিক্ষন প্রাপ্ত! হয়তবা তারো এই পৃথিবীকে কিছু বলার আছে,তেলাপোকাটা হয়ত ঠিক আমাদের মতই এই পৃথিবীর তাবত পুরুষ তেলাপোকা জাতির অত্যাচারে অতিষ্ঠ! বাংলার সকল অত্যাচারী পুরুষকে এভাবে নাকানি চুবানি খাওয়ানর জন্য তেলাপোকাটাকে আমরা সসম্মানে প্রতিপালন করতে পারি। কমরেড তেলাপোকা নামে একটা আইডিও খোলা যায়! সেখানে প্রোফাইল পিকচারে থাকবে কমরেড তেলাপোকার ভি সাইনযুক্ত সেলফি ।

এসবই ভাবছিলাম আর বিছানার পাশে সুবিধাজনক জায়গায় দাঁড়িয়ে পুরো দৃশ্যটা ভিডিও করছিলাম। আচমকা খেয়াল করলাম দুই চোখ ট্যারা করে ছুটতে ছুটতে ছ্যাঁচড়া ঠিক আমার দিকেই আসছে!
-মাননীয়া স্ত্রী, বাঁচান আমাকে… প্লিজ.. ইয়া আল্লাহ…

আমি ভ্যাবাচেকা খেলাম। প্রস্তুত হয়ে এক পাশে সরে যাওয়ার পূর্বেই ছ্যাঁচড়া আমার গায়ের উপর এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
এমনিতেই খানিক আগে ফিনিশ পাউডারের উপর হোঁচট খেয়ে শরীরের কলকব্জা নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল,তাল সামলাতে না পেরে আমি বিছানার উপর পড়লাম। ছ্যাঁচড়া পড়ল ঠিক আমার উপর। আমার এবং ছ্যাঁচড়ার নাকের মাঝখানে এখন দূরত্ব শুধু একটা তেলাপোকা!
তাকিয়ে দেখি আতংকে ছ্যাচড়ার মুখটা সাদা হয়ে গেছে। তার ঘনঘন নিঃশ্বাস এসে পড়ছে ঠিক আমার নাকের উপর! নিঃশ্বাসের ভকভক গন্ধে এক মুহর্তেই অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম আমি। নিজের অজান্তে ডান হাতে ঠাস করে প্রচন্ড একটা থাপ্পড় বসালাম ছ্যাঁচড়ার নাকে।
থাপ্পড়ের সাথে সাথে কমরেড তেলাপোকা উড়ে গিয়ে কোথায় যেন পড়ল। সেই সাথে ছ্যাঁচড়া হাত দিয়ে তার অশ্লীল নাকটা চেপে ধরে যন্ত্রণাকাতর শব্দ করতে করতে আরেকপাশে সরে গেল!
আমি হাউমাউ করে উঠে বসলাম। আমার সাহসী কমরেড তেলাপোকা! এ আমি কী করলাম! এ কী হলো! এ আমি কী করে বসলাম!

এক অত্যাচারী দুষ্ট চরিত্রের পুরুষেরর জন্য আমি আজ বাংলার এক কমরেড তেলাপোকাকে আঘাত করেছি।

দাঁত কিড়মিড় করলাম আমি, কষ্টে চোখ ভিজে যাচ্ছে। আমি কী করে এক সংগ্রামী কমরেডকে এভাবে আহত করলাম!
ইতিউতি করে গৃহকোন তন্ন তন্ন করে আমি কমরেড তেলাপোকা কে খুঁজতে লাগলাম,
আমার আহত সাহসী কমরেডকে বাঁচানর জন্য যা করতে হয় করব আমি!
খুঁজতে খুঁজতে এক মিনিট পর আবিষ্কার করলাম আমার থাপ্পড় খেয়ে কমরেড তেলাপোকা টেবিলে রাখা পানির গ্লাসে গিয়ে পড়েছে। গ্লাসের পানিতে চুপচাপ ভাসছে সে। আমি শংকিত হলাম। বেচারা হার্ট এটাক করেনিতো? হাতে পায়ে ফ্রাকচার হয়নিতো? তেলাপোকার অবশ্য হাত পা আলাদা করা যায়না যদিও!
আহারে, তার সহযোদ্ধা এক কমরেডের কাছ হতে এমন একটা থাপ্পড় সে নিশ্চয়ই আশা করেনি!
-আমি আসছি কমরেড তেলাপোকা। একটু অপেক্ষা করো!
বিড়বিড় করে বললাম আমি।
মানুষের হৃদপিন্ড বন্ধ হয়ে গেলে মুখে মুখে লাগিয়ে শ্বাস প্রদান করা হয়,বুকে ঘন ঘন চাপ দিয়ে হার্ট চালু রাখা হয়,এটাকে সিপিআর বলে। এখন আমাকে ইউটিউবে সার্চ দিতে হবে, “হাউ টু পারফর্ম সিপিআর অন ককরোচ!”
কী উপায়ে সিপিআর দেয়া যায়? আঙুল দিয়ে একটা চাপ দিলোইতো কমরেড তেলাপোকার পেটের নাড়িভুঁড়ি সমেত সবকিছু বের হয়ে আসার কথা!

ভাবতে ভাবতে আমার চোখ ভেসে যাচ্ছে, সহযোদ্ধা কমরেড তেলাপোকার জীবনাশঙ্কায় আশঙ্কিত আমি। আর পাশে আমার তথাকথিত স্বামী ছ্যাচড়াটা ক্যাঁ কোঁ করছে নাকে সামান্য একটা থাপ্পড় খেয়ে। মন চাইলো উজবুকটাকে আরেকটা ঘুষি মারি!
চোখমুখ শক্ত করে আমি কমরেড শায়লা আমারই আরেক কমরেডকে উদ্ধার করতে প্রস্তুত ঠিক সেই মুহূর্তে ছ্যাঁচড়া বলে উঠল
-মাননীয়া আমার পালসটা একটু দেখবেন? আমার বোধহয় প্রেশার ফল করেছে। আমাকে একটা স্যালাইন বানিয়ে দিন!

শুনেও পাত্তা দিলাম না আমি। একজন অত্যাচারী পুরুষের জীবনের চেয়ে একজন কমরেড তেলাপোকার জীবনের মূল্য অনেক অনেক বেশি।

ডেস্কে গ্লাভস রাখা ছিল। গ্লাভস পরে গ্লাসের পানি হতে সাবধানে উদ্ধার করে দেখি কমরেড তেলাপোকার কোন নড়াচড়া নাই, থেতলে গিয়ে অনেক আগেই সম্ভবত তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে গেছে। আমি এক মুহর্ত চুপ থেকে পরক্ষনেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। কমরেড তেলাপোকা আপনার এই আত্মত্যাগ আমি, আমরা বৃথা যেতে দেব না। কখনোই না!

-মাননীয়া ঔষুধের বক্সে স্যালইন আছে। আমাকে একটা স্যালাইন বানিয়ে দিন প্লিজ। আমার মাথা ঘুরাচ্ছে!

স্যালাইন! একজন কমরেডের মৃতদেহ সামনে রেখে আমি কী করে তার আমার শত্রুকে শরবত থুড়ি স্যালাইন পান করাই?

আমি শীতল চোখে তাকালাম ছ্যাচড়ার দিকে। ছ্যাঁচড়া আমার দৃষ্টির সামনে কুঁকড়ে গেল।
-ঠিক আছে ঠিক আছে আমি নিজেই স্যালাইন বানিয়ে নিচ্ছি!

রুম লাগোয়া বারান্দায় ফুলের টব আছে। ফুল গাছের নিচে কমরেডকে শুইয়ে দিয়ে আমি স্যালুট ঠুকলাম।
আমার সাথে সাথে স্যালুট ঠুকল “পুরুষ হটাও” গ্রুপের বাকী পাঁচ হাজার সদস্য। কমরেড তেলাপোকার মহাপ্রয়াণে সবাই আজ ব্যথিত।
হোক সে তেলাপোকা, তবু সেতো আমাদের জন্যই আজ নিজের ক্ষুদ্র তেলাপোকা জীবনকে উৎসর্গ করেছে।
স্যালুট ঠুকে পিছন ফিরে দেখি ছ্যাঁচড়া মনযোগ দিয়ে আমার কার্যকলাপ দেখছে।
চোখে চোখ পড়তেই হতচকিয়ে গেল।
-আমি দুঃখিত। তেলাপোকাটা আপনার আত্মীয় ছিল আমি বুঝতে পারিনাই।
জবাব না দিয়ে আমি কঠিনমুখ করে রুমে ঢুকলাম। কাঁদতে কাঁদতে নাকে সর্দি হয়েছে, ঝাড়তে হবে।

নাক ঝেড়ে এসে দেখি ছ্যাঁচড়া আমার অধিকৃত গৃহাংশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দ্রুত কাছে গেলাম।
ঠান্ডা মাথায় তাঁকে জরিপ করলাম। বেটা হাসিহাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে।

-রুমের এই পাশটা আমার। আপনি এখানে কেন! এ অংশে আপনার আসা নিষেধ জানেন না আপনি?

-মাননীয়া আপনার কষ্টে আমি ব্যথিত! আপনাকে সান্ত্বনা দিতেই আমার আপনার অধিকৃত অংশে আগমন।
-আপনি আমাকে মাননীয়া ডাকা বন্ধ করবেন দয়া করে! আপনার উদ্দেশ্য কী আসলে? আপনি কী চান?
চোখে মুখে সন্দেহ ফুটিয়ে আমি তাকিয়ে রইলাম। এই ছ্যাঁচড়ারআসল উদ্দেশ্যটা জানতে হবে আমার। সে আমাকে পটাতে চায় কেন? সে কি আসলে কোন ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের সদস্য? আমাদের গ্রুপের ভবিষ্যত গোপন কার্যক্রম জানতে চায়? নাকি তারো কোন “নারী খেদাও” টাইপ গ্রুপ ট্রুপ আছে!
ছ্যাঁচড়া জবাব দিল
– আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনই আমার উদ্দেশ্য মাননীয়া। আপনি আজ আমার জীবন বাঁচানর জন্য নিজের আত্মীয় এক অবোধ তেলাপোকাকে মেরে ফেলেছেন! এ আমি জীবনেও ভুলবনা। যেভাবে আমার জীবন বাঁচিয়েছেন, আপনাতে আমি বাঁধা পড়ে গেছি। আরেকটু হলেই আমার কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়ে যেত!

বলেই সে চোখেমুখে প্রেম প্রেম ভাব ফুটিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। ঠোঁটে কেমন অগোছালো একটা হাসি।
দুইমিনিট ধরে বেটার সাথে ঠান্ডা মাথায় কথা বলছিলাম কিন্তু এহেন প্রেম প্রেম ভাবওয়ালা দৃষ্টি আর এই হাসি! এবার আর আমার সহ্য হলো না।
কোনমতে বাম ঠ্যাংটা উপরে তুলে তায়াকোয়ান্দোর স্পেশাল লাথিটা মেরে দিলাম। একদম চোয়াল সই করে। উড়ে গিয়ে দরজার কাছে ফ্লোরে যেয়ে পড়ল ছ্যাঁচড়া। থ্যাপ করে একটা শব্দ হলো! সম্ভবত মিশন সম্পন্ন।

#কমরেড_শায়লা (ষষ্ঠ পর্ব)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here