#এলোমেলো_হাওয়া
#পর্ব_১১
লেখনীতে- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি

আঁধারের কুয়াশা অবরুদ্ধ করেছে বাতাবরণকে। সন্ধ্যে নামছে। মাটির বারান্দায় দু’হাত একত্রিত করে উদাসীন চোখে গগণে চেয়ে আছে তীহা। তার মন আজ ভীষণ খারাপ। সে নিজেও জানে না,একটু একটু করে আদ্র নামক বদ লোকটি তার ভেতরে জায়গা দখল করেছে। সেই বদ লোকের সঙ্গে বদ আচরণ করবার নিমিত্তেই মনবাড়িতে হট্টগোল আজ। তীহার গুমোট সুরৎ অন্তত তাই প্রকাশ করছে। দূর থেকে আদ্র দেখল, একটা ফড়িং শাঁই করে উড়ে চলে গেল সামনে দিয়ে। আদ্র চোখ ফিরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিজেকে বড় বেশিই সস্তা করে দিয়েছিল তীহার নিকটে। সময় ফুরোয়নি। এখন থেকে তীহাকে বুঝতে হবে,এটা বৈবাহিক সম্পর্ক, এটা সংসার। কোনো মান-অভিমানের খেলা অথবা নাট্যকলা নয়। আজ অনেকদিন পর আদ্র’র সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। আশেপাশে তাকিয়ে সে পুনরায় তীহার প্রতিমূর্তি দেখল। ফের বুকচিঁড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বাতাসে মিশিয়ে দিয়ে প্রস্থান করল দ্রুত চলনে….

উনুনঘরে ধোঁয়া হামাগুড়ি খাচ্ছে। বাঁশ ভেজা ছিল,আমেনা খেয়াল করেনি। তাই দিয়ে আগুন জ্বালতে গিয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। আগুন ধরে,নিভে যায়- এমন চলতে থাকলে আগামী এক ঘন্টাও শাক ভাঁজা হবে না। আমেনা ঠোঁট উল্টে কপালের ঘাম মুছলো। পেছন ফিরে তারা বেগমকে ডাকতে নিলে দেখল, তিনি আসছেন। আমেনা পুনরায় আগুন জ্বালার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। তারা বেগম শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘরে ঢুকলেন। ধমকের সুরে বললেন, ‘এখনো হয়নি!’
আমেনা পূর্ণ চোখ মেলে তাকাল। বিরক্তির স্বরে শাসালো বাঁশগুলোকে, ‘এই তোদের জন্যে আমার বকা শুনা লাগবে এখন। তোরা ধরবি নাকী আমি ছুঁড়ে ফেলব ওই ময়লা পুকুরে? ডুবে পঁঁচবি তখন! কেউ ব্যবহার করবে না। দেখিস..’
তারা বেগমের রাগ পড়ে যায়। মেয়েটা বড় হলেও ভারী পাগলাটে ধরনের। পড়াশোনা অতি মনোযোগী,গ্রামে থাকলেও কথাবার্তায় শুদ্ধতার চিহ্ন রাখতে চায়। এই নিয়ে প্রথম প্রথম কত হাসাহাসি মানুষের! এখন অবশ্য সবারই অভ্যেস হয়ে গেছে। গ্রামগঞ্জে শুদ্ধ ভাষায় কেউ কথা বললে তাকে বিদেশি অথবা বিলেতি বলা হয়। এখন অবশ্য এই মনোভাব অনেকটাই কমেছে। দেশ উন্নত হচ্ছে।
তারা বেগম কতগুলো পাট কাঠি নিয়ে এলেন। আমেনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, ‘আগুন ধরাইতে জানে না,আইছে রানতে। দেখি সর..’
আমেনা আদুরে স্বরে বিরোধিতা করে, ‘মা,তোমার শাক ভাঁজার চেয়ে আমারটা বেশি ভালো হবে।’
ওরে বাপরে! আমার ছাও,আমারেই শিখাইতে আসছে। তুই সরবি, নাকী…’
মায়ের রণমুর্তি দেখে আমেনা সরে বসল। তারা বেগম মিনিটের মাথায় দাউদাউ আগুন জ্বালিয়ে ফেললেন। কড়াই বসিয়ে শাক ভাঁজতে বসলেন। আমেনা হাঁটুতে মুখ গোঁজ করে বাইরে তাকাল। দূরে তীহাকে নিবিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উৎসুক কণ্ঠে বলল, ‘ভাবী ওভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন?’
তারা বেগমও তাকালেন। দেখলেন,বললেন, ‘তুই যেখানে,আমিও তো সেখানে। কেমনে জানবো? যাইয়া জিজ্ঞেস কর। দেইখা তো মন খারাপ লাগতেছে।’
আমেনা চটজলদি উঠে দাঁড়াল। যেতে নিয়েও কী মনে করে যেন বসে পড়ল। তারা বেগম প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘গেলি না?’
আমেনা দু’দিক মাথা নাড়ায়, ‘বইয়ে পড়ছি। মানুষের অনেক গোপন আর ব্যক্তিগত জিনিস থাকে। সব জায়গায় গিয়ে দখলদারি করাটা অভদ্রতার লক্ষণ। আমি তো অভদ্র নই,তাই আমার যাওয়াটাও উচিত হবে না। ভাবীকে দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু ভাবছে। ভাবুক না, নিরিবিলিতে ভাবলেই তো সব অংকের সমাধান বের হবে মা।’
তারা বেগম অপলক আমেনার দিকে চেয়ে রইলেন। মেয়েটা দিন দিন বড় হচ্ছে। একসময় তাকেও বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। তখন তারা বেগম কী করে থাকবেন? আমেনা বোধহয় জানেই না,তার মা সবসময় বকলেও কতটা ভালোবাসেন ভেতরে ভেতরে। আমেনাকে পরের হাতে তুলে দেওয়ার কথা কল্পনায় আসলেও তার চোখে পানি জমে। তারা বেগম রান্নায় মনোযোগ দেন। যখন সময় হবে তখন দেখা যাবে। আগেভাগে এত ভাবাভাবির কিছু নাই।

____

তীহা সত্যিই ভাবছিল, তার করা কাজটি কী সঠিক নাকী ভুল। মন এবং মস্তিষ্ক দুটোই উত্তর দিয়েছে, ভুল। তীহা লজ্জিত,অনুতপ্ত নিজের কর্মের কারণে। আদ্রকে চিনতে এতবড় ভুল কীভাবে করল সে! আজ কতদিন বিয়ের- আদ্র তো ছোঁয়া দূর,তীহাকে মজা করেও একটা সেনসিটিভ কথা বলেনি। হ্যাঁ,ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে প্রায়শই। এটা স্বাভাবিক। আদ্র যে তীহাকে পছন্দ করে,তীহা বেশ টের পায় তা। শুধু ভয় হয় নতুন করে কোনো সম্পর্কে জড়াতে। ফের যদি কোনো ধোঁকায় পড়তে হয়! বিশ বছরের বিবাহিত জীবন ভেঙে যেতে দেখেছে তীহা,সেখানে আদ্র কেমন কী,অতীতে কী কী করেছে- তার কিছুই তো জানে না সে বলতে গেলে! একসময় ধ্যান ভাঙে আযানের মধুর ধ্বনিতে। তীহা দুর্বল হাতে মাথায় ওড়না তুলে দেয়। পশ্চিম আকাশে সূর্য নেই, আরক্ত বর্ণ লেপ্টে রয়েছে। তীহা মন দিয়ে আযান শুনল, মনে মনে জবাব দিলো। আযান শেষে আকাশের বিশাল বুকে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে প্রার্থনা করল, ‘আমাকে একটা পথ খুঁজে দাও। এই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাব,নাকী এখানেই সব শেষ করে দেব- এর ভবিষ্যৎ কী, আদ্র সাহেব কোনোদিন আমাকে কাঁদাবেন না তো! এত এত প্রশ্নের ভিড়ে উত্তরের ঝুড়িটা একদম শূন্য। আপনি সাহায্য করুন আমায়, আপনি ছাড়া কেউই সাহায্য করতে পারবে না আমাকে। অনিন্য তো ভালো আছে,তাহলে আমাকেও ভালো রাখুন। আমাকে একটা রাস্তা দেখান দয়া করে, আর কিচ্ছুটি চাই না।’

‘তীহা।’ পেছন থেকে আচমকা ডাক শুনে চমকে উঠে তীহা। ঘুরে দাঁড়াতেই আদ্রকে চোখে পড়ল। ধাতস্থ হয় সে। মৃদু দম ফেলে কম্পিত কণ্ঠে জবাব দেয়, ‘ব..বলুন।’
আদ্র কিছু বলে না,এগিয়ে আসে। সিগারেট খেতে খেতে তীহাকে নিয়ে অনেক ভেবেছে সে। তীহার জায়গাটা বোঝার চেষ্টা করেছে। তীহা ওর জীবনে যে ধাক্কাটা খেয়েছে,এটা অনেকেই খায়। কিন্তু সবাই আঁটকে থাকে না। অনেকেই বেরিয়ে আসে,আসতে চায়। তীহাও হয়তো চাইছে,কিন্তু পারছে না। কিছু কিছু অতীত চাইলেই ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যায় না। অতি গোপনে তাকে লুকিয়ে ভার বুকে বোঝার ন্যায় সঙ্গে নিয়ে চলতে হয়। তীহার অতীতটাও ওরকম। যতদিন সে বেঁচে আছে,থাকবে,ততদিন হয়তো মনে পড়বে- কেউ একজন তাকে দুমড়েমুচড়ে ছুঁড়ে ফেলে চলে গিয়েছিল। হয়তো সেই সংজ্ঞা থেকেই তার মন বলতে শিখেছে, পৃথিবীর সব পুরুষরাই সমান,একরকম। আদ্রর কিছু কিছু কাজে হয়তো সেই পুরোনো অতীত চোখে ভেসে ওঠে তীহার। তাই নিজেকে না সামলাতে পেরে পাগলামি করে বসে। আদ্র তো বড়। তার উচিত তীহাকে সময় দেওয়া। অন্তত এতটুকু সময়, যাতে করে তীহা কোনোদিন কোনো অভিযোগ না তুলতে পারে আদ্র’র নামে।

অনেকক্ষণ যাবত আদ্রকে চুপ করে থাকতে দেখে তীহা মিনমিনিয়ে প্রশ্ন করে, ‘কী হলো,কিছু বলবেন?’
‘উঁ, হুম।’ আদ্র’র ধ্যান ভাঙে।
তীহা অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে সম্মতি দিলো, ‘বলুন।’
প্রত্যুত্তরে শোনা যায় একটা হতাশামিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস। তীহা আবার চমকে, লোকটার নিঃশ্বাস এত ঘন!
আদ্র বলল, ‘আমি সরি তীহা। তোমার সাথে অনেক আজেবাজে আচরণ করে ফেলছি। রিয়েলি সরি, মন থেকে বলছি।’
তীহার বুকের ভার কমে। জমাট লাগা বরফ গলতে শুরু করল। বদ লোকটা এতটাও বদ না যতটা সে ভেবেছিল। তীহা নরম গলায় বলল, ‘ইটস ওকে। আর শুনুন..’ এক সেকেন্ড থেমে তীহা বলল, ‘আমিও সরি। আমিও কী থেকে কী করে ফেলছি…’
‘ইটস ওকে।’ আদ্র’র ঠোঁটের কিনারায় অস্পষ্ট হাসি। তীহা দেখতে পেল না। কথার ফুলঝুরি ফোঁটে। যে অভিমানে এতক্ষণ দূরে দূরে ছিল দু’জনে, সে সময়টুকুতেই কত কথা জমে গেছে! একে একে গল্প জমে ওঠে। একটু পর এক বাটি চানাচুর মুড়ি হাতে আমেনা আসে। তার একটুপর আসে তারা বেগম, তার হাতে শীতলপাটি। আকাশে এতবড় চাঁদ উঠেছে। আগামী দু-একদিনেই জোৎস্না বোধহয়। চাঁদের ঠিকরে আসা আলোয় চারিপাশ আলোকিত। একটা টিমটিম করে জ্বলতে থাকা বৈদ্যুতিক আলোও নিজের উপস্তিতির কথা জানান দিচ্ছে,যদিও তা চাঁদের আলোর সামনে ফিঁকে। চারজনে সেই আলোতে একে অপরের মুখ চেয়ে চেয়ে গল্পে মেতে উঠেছে। এক নক্ষত্রমন্ডল জমা রোষাবেশ মিলিয়ে গেছে। তার বদলে ভেতর বাড়ি ভরে উঠেছে প্রস্ফুটিত উল্লাসে…

(চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here