এতোটুকুই_তো_ঝড়বৃষ্টি
পর্বঃ০৩
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
গুমসো আবহাওয়া নিয়ে হচ্ছে যতো সমস্যা।এই গরম!এই শীত!সিজন চেঞ্জ হওয়ার কারণে আশেপাশে সর্দি-জ্বরের প্রভাব যেন কিছুটা বেড়ে গেছে!মাহবুব সাহেব পায়চারি করছেন।তার মনটা অশান্ত হয়ে আছে।গতকাল সন্ধ্যায় বাহির থেকে এসে প্রেমা রুমে ঢুকে সেই যে দরজা লাগিয়েছে,আজ দুপুর পাড় হয়ে গেল অথচ মেয়েটির কোনো খোঁজ খবর নেই।এদিকে প্রিয়ম কেমন নিরূদ্বেগ!মাহবুব সাহেবের নিজের ছেলের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে।কি দরকার ছিলো মেয়েটাকে ওই ছেলের সাথে দেখা করানোর!আর দেখা যখন করেইছিস কি হয়েছে সেটা তো বলবি?তা না….কিছু জিজ্ঞেস করলেই এড়িয়ে যাচ্ছে।অন্য সময় প্রমার কিছু হলে,সবার আগে প্রিয়মই ব্যাকুল হয়ে পড়ে।এবার তার কোনো হেলদোল নেই। অবশ্য নতুন কিছু নয়,এর আগেও প্রমা হাজারবার এমন করেছে।রুনার কথা মনে পড়লেই,মেয়েটা কেমন ভেঙে পড়ে।নিজ থেকে নিজেকে একা করে দেয়।বিড়বিড় করে কি সব যেন বলতে থাকে!মাহবুব সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।স্ত্রী,ছেলে,মেয়ে সবকিছু সমেত তার ভালোই চলছিলো।চার বছর আগে রুনার অকস্মাৎ মৃত্যুতে,সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল!প্রমার অবচেতন মস্তিষ্ক রুনার আচমকা মৃত্যু মেনে নিতে পারি নি।পারবেই বা কি করে?মেয়েটা কখনো মাকে ছাড়া একবেলা খাবার খায় নি।প্রমাকে রুনা সবসময় নিজের হাতে খাইয়ে দিতো।অনুষ্ঠানে গেলেও এই নিয়মের কোনো ব্যতিক্রম হতো না।প্রমা তার মায়ের ওপর পুরোপুরি নির্ভর ছিলো।হ্যাঁ,ছিলো!রুনার মৃত্যুর পর অষ্টাদর্শী মেয়েটা যেন হুট করেই বড় হয়ে গেল।সবকিছু নিজের মতো হ্যান্ডেল করতে লাগলো।মনের কষ্ট মনের মাঝেই আড়াল করে নিলো।কাউকে কিছু জানতে দিলো না।
দরজা খোলার শব্দে মাহবুব সাহেব চমকে উঠলেন।প্রমা বেশ স্বাভাবিক।যেন সে জানতো তার বাবা,তার দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে!প্রমা তার বাবা হাত আঁকড়ে ধরে ছাদের দিকে এগিয়ে গেল।প্রমার গাল দুটোয় লালচে বর্ণ দেখা যাচ্ছে।মেয়েটা যে সারারাত কেঁদেছে,মাহবুব সাহেব চেহারা দেখেই উপলব্ধি করতে পারলেন।সেই সাথে বুকের ভেতর সূক্ষ্ম একটা ব্যথা অনুভব করলেন।
——–
-“সাজিমকে তোমার অপছন্দের কারণ কি বাবা?শুধুমাত্র বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে বলে কি তুমি তাকে রিজেক্ট করতে চাইছো!”
মাহবুব সাহেব কিছুটা বিস্মিত হলেন।প্রমা এ কথা বলছে কেন?তার কি তাহলে সাজিমকে পছন্দ!
-“বললে না যে?”
প্রমা পুনরায় প্রশ্ন করলো। মাহবুব সাহেব খানিক চুপ থেকে বললেন,
-“সরকারি বেসরকারি চাকরি কোনোটাই আমার কাছে ফ্যাক্ট না।তাছাড়া সাজিম বেশ হ্যান্ডসাম স্যালারি আর্ন করে।তার এক মাসের অর্জিত অর্থ আমার আর প্রিয়মের একত্রিত তিন মাসের বেতনের সমান।সত্যি বলতে,সাজিমের জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও আমি তাকে রিজেক্ট করে দিতাম।”
-“কিন্তু কেন….বাবা?”
মাহবুব সাহেব কোনো উত্তর দিলেন না।মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন।মেয়েকে নিজের থেকে দূর সরাতে তার যে ভীষণ ভয় হয়!সুদূর চট্টগ্রাম।বিয়ে দিলেই তো প্রমা তাকে চিরকালের জন্য ছেড়ে চলে যাবে।রুনা মারা যাওয়ার পর থেকে প্রমার জন্য যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে তিনি দ্বিধাদ্বন্দে ভুগেন।মেয়েটা যদি কষ্ট পেয়ে বসে!এছাড়া দিন শেষে মেয়ের স্নিগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে তার ভেতরে যে শান্তি লাগে,প্রমার বিয়ে হয়ে গেলেন সে যদি শান্তি পাচ্ছে হারিয়ে যায়?তখন তিনি কি করবেন?মাহবুব সাহেবের নিরুত্তরতা প্রমার মধ্যে কোনো প্রভাব ফেললো না।নিজের মতো বলতে লাগলো,
-“সাজিম নামের মানুষটা একেবারেই অনাড়ম্বর।ভীষণ সাধারণ।কিন্তু তার মধ্যে মানুষদের এপ্রোপিয়েট টাইমে প্রটেক্ট করার একটা স্পেশাল পাওয়ার আছে।তোমার মনে আছে বাবা?তিন বছর আগে ভার্সিটির ফাংশনে যাওয়া পথে আমার ছোট এক্সিডেন্ট হয়েছিল?রিকশার সাথে ধাক্কায় লেগে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলাম আমি!”
মাহবুব সাহেব মনে করার চেষ্টা করলেন।মনে পড়েছেও।প্রমা সেদিন প্রথম শাড়ি পড়েছিলো।রুনার শাড়ি।শাড়ির রঙটা অনেকটা কমলার খোসার মতো।প্রিয়ম আর মাহবুব সাহেব সেদিন প্রমার বেশ প্রশংসাও করেছিলেন।কিন্তু বিকেলে যখন প্রমা বাড়ি ফিরেছিলো,সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা শাড়ি তার গায়ে জড়ানো ছিলো।
-‘সেদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমি খুব অসহায় বোধ করছিলাম।নিজের পাশে খুব করে কাউকে চাইছিলাম!শাড়ির কুঁচি খুলে যাই পরান অবস্থা হয়েছিল আমার।আই ওয়াজ ফিলিং ভেরি এমবেরেসিং।হুট করেই কোথা থেকে একটা মেয়ে সাহায্যের জন্য এগিয়ে গেল।যথাসম্ভব উপকার করলো।আসলে সাজিম আড়ালে থেকে মেয়েটিকে আমার সাহায্যের জন্য পাঠিয়ে ছিলো।এমনকি সেই শাড়িটিও সাজিমের দেওয়া।”
মাহবুব সাহেব চমকালেন।ভীষণ ভাবে চমকালেন।এর মানে তিন বছর ধরে ছেলেটা…….।না আর ভাবতে পারছেন না তিনি!প্রমার পরবর্তী কথা শোনার জন্য কান খাঁড়া করলেন।আশ্চর্য! মেয়েটার গলা কাঁপছে কেন?সে কি কাঁদছে!!
-‘মায়ের সাথে সাজিমের একটা অদ্ভুত মিল পেয়েছি আমি।মা যেমন কোনো রেস্টুরেন্টে গেলে ওয়েটারদের সার্ভ করা খাবার খেতে পারতো না!যে মানুষগুলো খাবার এনে দিবে,তাদের সামনে রেখে সেই খাবার খাওয়া মায়ের জন্য বেশ কষ্টকর হতো।মা জানতো তাদের কাজই এটা,তারপরও মনে খারাপ লাগা কাজ করতো।মায়ের যাতে মন খারাপ না হয় সেজন্য তুমি আমাদের সবসময় বুফেতে নিয়ে যেতে।
জানো বাবা,সাজিমও ঠিক এমন।অন্য মানুষের কষ্ট সে একদমই দেখতে পারে না।নিজে কষ্টে জ্বলে পুড়ে যাবে অথচ মুখ থেকে একটা কথাও বের হবে না।”
হঠাৎ প্রমা নিশ্চুপ হয়ে গেল।মাহবুব সাহেব এতোক্ষণ মনোযোগ সহকারে প্রমার প্রতিটি কথা শুনেছেন।যতোই শুনেছেন ততোই অবাক হয়েছে!মেয়ের দিকে তাকালেন।প্রমা নিঃশব্দে কাঁদছে।চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু ঝরছে।মায়ের কথা মনে হয়েছে নিশ্চয়ই!মাহবুব সাহেব মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন।এতোক্ষণে মুখ খুললেন তিনি।
-“যেই ছেলে অন্যের কষ্ট সহ্য করতে পারে না।সে কোনোদিন আমার এই ইনোসেন্স মেয়েটাকে আঘাত করতে পারবে না।আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।”
প্রমা তার বাবার হাত চেপে ধরলো। কান্নারত গলায় বলল,
-“না বাবা,তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি কিছুই চাই না।তোমাকে আর ভাইকে ছাড়া আমি নিজেও থাকতে পারবো না।কিন্তু সাজিমকে ফিরিয়ে দিতে কেন যেন অনেক যন্ত্রণা হচ্ছে।মানুষটার মন যে একেবারে স্বচ্ছ!আমার হৃঙ্গে প্রচন্ড দহন হচ্ছে। বিষাক্ত কোনো কিট আমার হৃদয়টা খুবলে খুবলে খাচ্ছে।এ কেমন ক্লেশ….বাবা!”
মাহবুব সাহেব অসহায় চোখে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।প্রমা চোখ মুছে বাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।মাহবুব সাহেব ধীরে ধীরে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।ছাদের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয়ম পকেট থেকে ফোন বের করে কাঙ্ক্ষিত নম্বরে কল করলো।মিনিট দুই এক ফিসফিস করে কথা বলে ফোন রেখে দিলো।অতপর কিছুটা দূরে দোলনার দুলতে থাকা দুজন মানুষের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল।গাছের ডালে বসে থাকা চড়ুইটি একজন বাবা ও তার সন্তানদের এরূপ মেলবন্ধনে কিচিরমিচির ডেকে উঠলো।
——-
-“আপনার কপাল থেকে এমন পানি ঝরছে কেন?কপাল ফুটো হয়ে গেছে নাকি?ওহ মাই গড!দেখি দেখি।কিন্তু কপাল ফুটো হয়ে গেলে তো রক্ত ঝরার কথা,পানি ঝরে কেন?”
-“পানি না তো,এগুলো ঘাম।”
সাজিমের উত্তরে প্রমা কপাল কুঁচকে গেল।বিরক্তিকর স্বরে বলল,
-“আপনার কি মনে হয়?আমি ডাম্ব!পানি আর ঘামের তফাৎ বুঝি না?”
সাজিম মনে মনে বলল,”ডাম্ব তো আমি।তাই তো আপনাকে এখন অবদি মনের কথাটা বলতে পারলাম না।”
মুখে বলল,
-“সরি…আপনি ঠিক বলছে।এগুলো আসলে পানি।গাছের পাতার মতো আমার দেহে এই মূহুর্তে প্রস্বেদন হচ্ছে।”
প্রমা ঠোঁট বাঁকালো।অতপর প্রসঙ্গ বদলাতে বলল,
-“তা আপনাকে কেন ডাকা হয়েছে আপনার কোনো ধারণা আছে?”
সাজিম মাথা নাড়ালো।অর্থাৎ সে যানে না।আজ বিকেলে প্রিয়ম কল দিয়ে তাকে ডেকে এনেছে।সাজিমের হুট করেই মনে হলো,সে জানে তাকে কেন ডাকা হয়েছে।আর তার ধারণা যদি সঠিক হয়,তাহলে সে সুখে পাগল হয়ে যাবে।প্রমা হুট করে সাজিমের কোলের উপরে বসে পড়লো।গভীরভাবে গলা জড়িয়ে ধরলো। ড্রইং রুমে কেবল তারা দুজন।প্রমা সাজিমের কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-“রাতে ফ্লাইটেই চলে যে যাচ্ছেন!আরো দু’দিন কি ঢাকা শহরের মানুষদের আপন করে,তাদের সাথে থাকা যায় না?”
সাজিম নীরব।প্রমা সাজিমকে চমকে দিতে তার ডান গালে চটাস শব্দ করে চুমু খেলো।জীবনের প্রথম কোনো মেয়ে এতোটা কাছে এসেছে সাজিম।থরথর করে কেঁপে উঠলো সে।কয়েক মূহুর্ত স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো!হুশ আসতে প্রমাকে কোল থেকে ঠেলে উঠিয়ে দিলো।নিজেও সোফা থেকে হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়াল।আর এক সেকেন্ডও এখানে থাকা যাবে না এখানে।এই মেয়ে সর্বনাশী!তাকে শেষ করে দম নিবে।এক চুমুতেই তার ভেতরটা শুকিয়ে গেছে।আরো কিছু করার আগেই পালাতে হবে।এক প্রকার দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।মেঝেতে থাকা কার্পেটের সাথে পা বেজে পড়তেই নিচ্ছিলো।কোনোরকম সামলে বেরিয়ে গেল।সেদিকে তাকিয়ে প্রমা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।
চলবে
ভুল- ত্রুটি মার্জনীয়।