এক_কাপ_ঠান্ডা_কফি
#পর্ব_১২
লেখা_সাইফুল_ইসলাম

গতকাল রাতে মংলা থেকে ফেরার পথে সাজুর উপর যখন হামলা হয়েছে তখন থেকেই সাজু বেশ চিন্তা করতে লাগলো। আব্দুল কাদেরের কথা অনুযায়ী মংলায় তখন তাদের দলীয় আর কেউ ছিল না। কিন্তু সাজু সেই সময় মংলা ত্যাগ করে আসার পরে বেশ কয়েকবার পিছনে একটা বাইক দেখতে পেয়েছে। সাজু মনে মনে ভাবলো যে তার বাগেরহাট যাবার কথা দারোগা ছাড়া আর কেউ জানে না। তখন ছোট্ট একটা সন্দেহ মনের মধ্যে উঁকি মারে।

দ্বিতীয় সন্দেহ আসে সাজুর এই খুলনা থেকে ঢাকা যাবার কথা দারোগা সাহেবের কাছে সে কল দিয়ে বলেছে। এমনকি কোন গাড়িতে করে যাচ্ছে সেটাও জিজ্ঞেস করেছিল ভদ্রলোক। মিথ্যা বলা সাজুর স্বভাব নয়, আর যদি না বলে তবে দারোগা হয়তো বুঝতে পারবে সাজু সন্দেহ করে। তাই সাজু বলে দেয় তার বাসের নাম, আর ঠিক সেই তথ্য ধরেই দারোগা হয়তো খুনির সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছে।

তৃতীয় সন্দেহ আসে সন্দেহের মাধ্যমে। রামিশার বাগেরহাট যাবার কথা গতকাল রাতে সাজুর ফোনে মেসেজ এসেছিল তখনই সাজু দারোগার কাছে বলেছিল। সে বলেছিল, ” চট্টগ্রাম থেকে আমার এক বন্ধু আসবে তাকে নিরাপদে রাখার জন্য মংলাতে ভালো কোনো হোটেল আছে? ”

দারোগা সেটা কারো কাছে বলেছে কিনা সেটা সাজু জানে না। রাব্বির কাছে তার চুক্তিকারী মেসেজ দিয়ে জানিয়েছে সেটা সাজুর জানার কথা নয়। কিন্তু সাজু যখন আন্দাজ করতে পারে যে রামিশার উপর বিপদ হতে পারে। তারপর রামু আর কল রিসিভ করে নাই। তখন থেকেই সাজুর সন্দেহ আরো বাড়তে থাকে।

এরপরই সাজু ভাই ওই দারোগা সাহেবের আত্মীয় স্বজনের খোঁজ নেবার জন্য একজনের সঙ্গে কথা বলে। সেই লোক মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে যতটুকু তথ্য বের করতে পেরেছে তারমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল।

সাজু ভাই অসুস্থ হয়ে লন্ডনে যাবার আগে নয়নের মায়ের সেই নয় বছর আগের খুন হবার রহস্য বের করেছিল। সেই মামলায় আসামি ছিল মিনহাজ নামে নয়নের মামাতো ভাই। আর এই দারোগা হচ্ছে সেই মিনহাজের মামা, সম্ভবত নিজের ভাগ্নে দোষী হবার জন্য সাজুকে দায়ী করেছে।

[ নয়নের মায়ের মৃত্যুর রহস্যের গল্প সাজু ভাই সিরিজের গল্প “সরি আব্বাজান-২” এর মধ্যে জানানো হয়েছে। যারা ওই রহস্যটা জানেন না তারা পড়ে নিতে পারেন। ]

|
|

ওসি সাহেবের নাম্বারে কল করা সেই ক্ষমতাসীন লোকটা সাজুর কথা শুনে খানিকটা চুপ থেকে আবার বললেন,

– আপনার সন্দেহ পুরোপুরি সত্যি। যারা ওই মেয়ে খুন করেছে তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দারোগা আপনাকে শেষ করতে চাইছে।

– সাজু বললো, কিন্তু আপনি এতকিছু জানলেন কীভাবে? আর এসবের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কি সেটা বুঝতে পারছি না।

– আলাউদ্দীন নামের এক সন্ত্রাসী দিয়ে আপনার উপর আক্রমণ করা হয়েছে। আপনি আজকের রাতটা একটু সাবধানে থাকবেন, তাছাড়া আহত শরীর নিয়ে রাতে বের হবার দরকার নেই।

– কিন্তু আমাকে বের হতে হবে।

– কেন?

– চট্টগ্রাম থেকে আমার এক বন্ধু আসার কথা ঢাকায়, সে কুমিল্লা আসার পরে তার উপর হয়তো কোনো আক্রমণ হয়েছে। আমি সেই থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি কিন্তু আমি ব্যর্থ।

রামিশা যে রাব্বির কাছে রয়েছে সে কথা লোকটা জানে না। যদি জানতো তাহলে হয়তো কিছু একটা বলতে পারতো৷
সাজু অনেক কথাই এই অপরিচিত লোকটার সঙ্গে বলতে চাচ্ছে না। কিন্তু যতটুকু বলছে সেটা ওই ওসি সাহেব তাকে স্যার বলেছিল সেজন্যই বলা।

– সাজু সাহেব?

– বলেন।

– আমি আগামীকাল দিনের মধ্যে আপনার জন্য একটা লাইসেন্স করা পিস্তলের ব্যবস্থা করে দেবো। আর যেকোন একটা গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে আপনাকে যোগ দিতে হবে। কারণ আপনি এখন যে মামলার মধ্যে আছেন সেটা খুব বিপদের একটা কাজ।

– একদিনের মধ্যে কি সেটা সম্ভব?

– সেই দায়িত্ব আমার, আমি আগামীকাল সকালে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবো। আপনি আজ রাতটা সাবধানে থাকবেন।

– একটা কথা বলতে ভুলে গেছি।

– বলেন সাজু সাহেব।

– আপনি বলেছিলেন আলাউদ্দীন নামের একজন আমার উপর হামলা করেছে। কিন্তু ঘটনা সেরকম নয়, আমার ধারণা আমাকে গুলি করেছে রাব্বি নামে এক সন্ত্রাসী।

মোবাইলের অপর প্রান্তে নীরবতা। সে হয়তো ধারণা করেনি সাজু সরাসরি রাব্বিকে সন্দেহ করবে। কিন্তু আব্দুল কাদের যে সবটা স্বীকার করেছে তাতে সন্দেহ করাই স্বাভাবিক। সেজন্য সেও চায় আব্দুল কাদের মারা যাক, কিন্তু লোকটা যখন জানতে পেরেছে আব্দুল কাদেরকে মারার কথা নিয়ে রাব্বির সঙ্গে মতবিরোধ আছে। তাই নিজে থেকে রাব্বিকে কিছু বলে নাই।

– রাব্বি বা যে কেউ হোক সেটা আপনি ঠিকই বের করবেন। আপনাকে সবদিক থেকে সহোযোগিতা করবো আমি, আপনি চিন্তা করবেন না।

– এতে আপনার লাভ?

– লাভের হিসাব সবসময় চলে না সাজু সাহেব। আমি আগামীকাল আপনাকে কল দেবো তবে সেটা আপনার ব্যক্তিগত নাম্বারে।

কলটা কেটে গেল। সাজু কাউকে না ডেকে চুপ করে বেডে বসে আছে। দারোগা সাহেবের বিষয়টা তাকে বেশ ভাবাচ্ছে, তার সামান্য সন্দেহ ছিল। মিনহাজের মামা তাই নিজের ভাগ্নের জন্য হয়তো প্রতিশোধ নিতে পারে।
কিন্তু এই আগন্তুক লোকটা কে হতে পারে সেটা তার মনের মধ্যে জট পাকিয়ে দিচ্ছে।

ওসি সাহেবের সঙ্গেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেল সাজু ভাই। পুতুল তার মামার সঙ্গে বাসায় চলে গেছে, কালকে তার পরীক্ষা আছে। সাজুর মোবাইল সাজুর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললো,

– আমার সঙ্গে গেলেই পারতেন। শুধু শুধু নিজের বিপদ কেন ডেকে আনছেন?

– আমি জানি না রামিশা এখন কেমন আছে, তাই তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।

– একটা কথা বলি?

– হ্যাঁ।

– রামিশা কল দিয়েছিল, তখন আপনার কাছে ডাক্তার ছিল। আমি রামিশা আপুর সঙ্গে কথা বলেছিলাম।

– কি বলেছে? আর আপনি এতক্ষণ সেটা বলেন নাই কেন?
সাজু বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে গেল।

– সরি সাজু ভাই। আমি ভুলে গেছিলাম, আর এরপরই পুলিশ এসে গেছে।

– ঠিক আছে আমি দেখছি, তোমার সঙ্গে পরে দেখা হবে।

সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিল সাজু ভাই। ওসি সাহেব বলেছিল তাদের সঙ্গে কুড়িল বা বাড্ডা পর্যন্ত যাবার জন্য। সাজু তাদের সঙ্গে না গিয়ে আলাদা হয়ে গেল এবং আগামীকাল সকাল বেলা তাদের থানায় যাবে সেই আশ্বাস দিল। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এবং মাহিশার লাশ যেখানে পাওয়া গেছে সেটা ভালো করে দেখা দরকার।

সাজু ভাই রামিশার নাম্বারে পরপর তিনবার কল দিল কিন্তু রিসিভ করেনি সে। চতুর্থ কল দিতে গিয়ে নাম্বার ওয়েটিং পেল।
” কারো সঙ্গে কথা বলছে নিশ্চয়ই। ” মনে মনে বললো সাজু ভাই।

সাজুর মোবাইল থেকে রামিশার নাম্বার নিয়ে রেখেছিল পুতুল। খুব কৌশলে মোবাইলের ফিঙ্গার লক সাজুর আঙ্গুলের ছাপ দিয়েই খুলে ফেলে। সাজু তখন অচেতন ছিল। তারপর রামিশার নাম্বার নিজের মোবাইলে সেভ করে রাখো।
সাজুর কাছ থেকে বেরিয়ে রামিশার নাম্বারে কল দেয় পুতুল।
পরপর তিনবার কল দেবার জন্য রামিশা ধারণা করেছিল এটাও সাজু ভাই দিয়েছে। কিন্তু নতুন অপরিচিত নাম্বার দেখে একটু ভাবতে লাগলো। সাজু ভাই কি অন্য নাম্বার দিয়ে কল দিচ্ছে?
এমনটা চিন্তা করে সে কলটা রিসিভ করে চুপ করে থাকে। তারপর মেয়ে কণ্ঠ শুনতে পেয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,

– কে আপনি?

– আমার নাম পুতুল, সাজু ভাইয়ের মোবাইল দিয়ে আপনার সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম।

– ওহ্।
সামান্য ভাবলো রামিশা। সাজু ভাই তাহলে এখনো মেয়েটার সঙ্গে আছে নিশ্চয়ই। কল রিসিভ হচ্ছে না তাই একে দিয়ে ওকালতি করাচ্ছে।

– আপু..?

– বলেন।

– আমি তখন মিথ্যা বলেছিলাম। আসলে সাজু ভাইয়ের সঙ্গে আমার মাত্রই গতকাল পরিচয় হয়েছে। যদিও অনেক আগেই তাকে চিনতাম কিন্তু দেখা হয়েছে গতকাল।

– আশ্চর্য। গতকাল দেখা হয়েছে আর তাতেই আপনি নিজেকে তার স্ত্রী বলে পরিচয় দিচ্ছেন।
অবশ্য সত্যি সত্যি যদি গতকালই বিয়ে হয়ে থাকে সেটা ভিন্ন কথা। তো আমাকে কল দিয়েছেন কেন?

– সরি বলতে।

– কেন?

– সাজু ভাই অসুস্থ শরীর নিয়ে এখন আপনাকে খুঁজতে বের হয়েছে। আমি জানি সে খুঁজে বের করতে পারবে।

– অসুস্থ মানে? কি হয়েছে তার?

– পাটুরিয়া ফেরির মধ্যে তাকে কারা যেন গুলি করেছিল। কাঁধে লেগেছে গুলি।

– বলেন কি?
রামিশার কাঁদো কাঁদো কণ্ঠ।

– তারপর আমিই তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি ঢাকায় আর তখন থেকে মোবাইল আমার কাছে ছিল। আপনার সঙ্গে এভাবে কথা বলার জন্য আমি লজ্জিত।

– সাজু ভাই এখন কোথায়?

– উত্তরা থেকে সে একা বের হয়ে গেছে। তার উপর আবারও কেউ আক্রমণ করতে পারে কিন্তু সে আপনাকে খুঁজতে চলে গেছে।

– ঠিক আছে আপনি কলটা কাটেন আমি এখনই সাজু ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছি।

– একটা কথা ছিল।

– তাড়াতাড়ি বলেন।

– আমি যে তখন আপনাকে ওসব বলেছিলাম সেটা তাকে বলবেন না। সাজু ভাই তাহলে হয়তো আমার সঙ্গে আর কথা বলবে না।

– ঠিক আছে বলবো না। আপনি ওকে আহত অবস্থায় ঢাকায় নিয়ে এসেছেন সেজন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। মেলা মেলা ধন্যবাদ।

কল কেটে দিয়েছে রামিশা। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাস্তায় দিকে তাকিয়ে রইল পুতুল। রামিশা তাকে বলে গেল মেলা মেলা ধন্যবাদ, এটা নিশ্চয়ই সাজু ভাইয়ের বলা কথা। কারণ একমাত্র সাজু ভাই শুধু ধন্যবাদ না দিয়ে মেলা মেলা ধন্যবাদ বলে।

সাজুর মোবাইল বেজে উঠলো। স্ক্রিনে তাকিয়ে রামিশার নাম্বার দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করলো সাজু ভাই। রামিশা বললো,

” সাজু ভাই আপনি কোথায়? ”

★★★

একটু আগে মিরপুর ১০ নাম্বারে রামিশাকে বাইকে করে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে রাব্বি। তাকে এখন দ্রুত কিছু কাজ করতে হবে, গাবতলি থেকে ভালো একটা পিস্তল নেবে। তারপর সাভারে গিয়ে আলাউদ্দীনের সাঙ্গপাঙ্গ ধরে তাদের থেকে বের করতে হবে আলাউদ্দীনের অবস্থান।
কিন্তু রাব্বি জানে না যে সাজু ভাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে আছে আলাউদ্দীন নামের সেই সন্ত্রাসী। সাজুকে সমান তালে এখনো অনুসরণ করে যাচ্ছে ওই খুনি আলাউদ্দীন।

রাত আটটা।
মাহিশার লাশ কিছুক্ষণ আগে নিয়ে আসা হয়েছে বাড়িতে। একটু পরেই দাফন করা হবে। যেহেতু মৃত্যুর কয়েকদিন পার হয়ে গেছে তাই লাশ আর বেশিক্ষণ রাখা যাবে না। আগেই কবর খুড়ে রাখা হয়েছে, মসজিদের ইমাম সাহেব এলেই জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।

মংলা থানার দারোগা সাহেবও উপস্থিত হয়েছেন। মাহিশার বাবার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেছেন। সাজুর নামে মামলার কথা শুনে ভদ্রলোক একটু চমকে যাবার অভিনয় করলেন। একটু পরে তার মোবাইলে একটা কল এলেই তিনি মোবাইল নিয়ে খানিকটা দুরে চলে যায়।

– দারোগা বললো, হ্যা বলেন।

– আমাদের দ্বিতীয় ভাড়াটে খুনি এখন সাজুর প্রায় কাছাকাছি বসে আছে। তারা নাকি এখন একটা রেস্টুরেন্টে আছে।

– সেখানে গুলি করা কি ঠিক হবে?

– ঠিক বেঠিক আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। সাজুর সঙ্গে একটা মেয়ে আছে, সেই মেয়েটা সহ যদি খুন করা হয় তাহলে কি সমস্যা হবে?

– কোন মেয়ে? বিকেলে যে মেয়েটা ছিল?

– না এটা অন্য কেউ। একটু আগেই নাকি তাদের দেখা হয়েছে, আর তারপর তারা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসেছে।

– ঝামেলা না হলে কাজটা করে ফেলুক।

– সাজু আপনার পরিকল্পনা জেনে গেছে।

– মানে?

– সাজু বুঝতে পেরেছে তাকে আপনি খুন করতে চান, আপনি নাকি আপনার ভাগ্নের জন্য এমন করছেন।

– দারোগা বললো, ওহ্ শিট, এক্ষুনি ওদেরকে মেরে ফেলতে বলুন। সাজু যদি বেঁচে থাকে তাহলে আমি শেষ হয়ে যাবো। আর আমি শেষ মানে আপনিও শেষ, বুঝতে পারছেন। সামনে কিন্তু আপনার নির্বাচন, আর এবার কিন্তু আপনাকে জিততেই হবে। আর এই সাজুকে বাঁচিয়ে রাখলো আপনি আমি দুজনেই খুব বিপদে পড়বো।

– ঠিক আছে, বিকেলে বেঁচে গেলেও এবার আর বাঁচতে পারবে না। খুব কাছ থেকে গুলি করার কথা বলে দিচ্ছি। রেস্টুরেন্টের পাশেই কাপড়ের কাপড়ের মার্কেট, আমার লোক খুন করে ওখান অনায়সে পালিয়ে যাবে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here