এক_কাপ_ঠান্ডা_কফি
#পর্ব_১০
লেখা_সাইফুল_ইসলাম

গুলির শব্দ হয়নি বলেই লোকজন তেমন কোনো ছুটোছুটি করে নাই। পুতুল তাড়াতাড়ি সাজুকে ধরে ফেললো, রক্ত দেখে সে ঘাবড়ে গেছে। দুজন যুবক পুতুলকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল, তারা সবাই মিলে সাজুকে ধরাধরি করে বসালো।

খুনির নিশানা সঠিক ছিল তবে সাজু নিচু হয়ে প্যান্টের ময়লা ঝাড়ার জন্য হালকা নড়েচড়ে যায়। আর তাই তার বাম হাতে বাহুতে কিছুটা মাংস ছিড়ে গুলি বেরিয়ে গেল। কিন্তু আশেপাশে কেউ বুঝতে পারলো না এটা গুলির আঘাত।

প্রথমত কেউ কোনো শব্দ শুনতে পায়নি। আর৷ দ্বিতীয়ত গুলিটা মাংস ছিড়ে বেরিয়ে গেছে তাই সেটা কেউ আন্দাজ করতে পারে নাই। তবে সাজু ভাই ঠিকই বুঝতে পেরেছে, কিন্তু নিজেকে শক্ত রাখার জন্য চুপচাপ বসে রইল। আশেপাশে তার চোখ ঘুরতে লাগলো, রাব্বি যেহেতু একটু আগে তাকে বলেছিল সে বিপদে পড়বে। এখন তার মনে হচ্ছে ওই ছেলেটা ঠিকই বলেছে, ছেলেটার কথা সামান্য গুরুত্ব দিলে ভালো হতো। অন্তত বাসের মধ্যে বসে থাকতে পারতো, সেখানে যদি আক্রমণ করতো তাহলে নিশ্চয়ই খুনিকে বাসের ভিতরে যেতে হতো।

ফেরি ঘাটে এসে ভিড়েছে। পুতুল সুপারভাইজার কে অনুরোধ করলো ঘাটের একটা ফার্মেসির কাছে গাড়িটা একটু রাখার জন্য। ঘাট পেরিয়ে অনেকটা সামনে এসে রাস্তার পাশে একটা ওষুধের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করানো হয়েছে। পুতুল দ্রুত সেখান থেকে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা নেবার মতো ওষুধ সেভলন আরো কিছু জিনিস কিনে গাড়িতে উঠলো।
পুতুল খুলনা মেডিকেলের স্টুডেন্ট। যদিও তার পড়াশোনা এখনো শেষ হয়নি কিন্তু এতটুকু আঘাতের সেবা সে ঠিকই করতে পারবে। আর বাস মোটামুটি দুই ঘন্টার মধ্যে উত্তরা আব্দুল্লাহপুর পৌঁছে যাবে। তার টার্গেট হচ্ছে সেখান থেকে হাউজবিল্ডিং গিয়ে সরাসরি উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে যাবে।

পুতুল তার ছোট মামাকে কল দিয়ে বললো যে আধুনিক হাসপাতালে যেতে হবে। তাই সে যেন আব্দুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করে।
আঘাতের ব্যথা আস্তে আস্তে সমস্ত শরীরের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে লাগলো। ব্যথার সঙ্গে লড়াই করতে করতে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে তারা উত্তরা পৌঁছে গেল।

★★★

পুলিশের সাহায্য নিয়ে দুপুরের দিকে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে মাহিশার লাশ নিতে চলে গেল তার বাবা, দুলাভাই ও খালু। মেয়ের লাশ দেখে সেখানেই চিৎকার দিয়ে ভেঙ্গে পড়লেন মাহিশার বাবা। ওসি সাহেব যাবতীয় ফর্মালিটি মাহিশার দুলাভাইয়ের মাধ্যমে সেরে ফেললেন। তারপর কখন কীভাবে লাশ পাওয়া গেছে সবটাই তাদের কাছে বললেন।

মাহিশার লাশ যেখানে পাওয়া গেছে সেখানে সাজু ভাইয়ের ছবি পাওয়া গেছে এই কথাটা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো মাহিশার বাবা।

ওসি সাহেব যখন বললেন,
– লাশের ঘটনাস্থল থেকে যা কিছু পাওয়া গেছে তার মধ্যে একটা বিষয় হচ্ছে এক যুবকের ছবি। আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি তার বাসাও নাকি আপনাদের জেলার মধ্যে। সাজু ভাই নামেই নাকি পরিচিত সেই যুবক টুকটাক গোয়েন্দার কাজ করে।

– কি বললেন ওসি সাহেব? সাজু…?

– আপনি চিনেন তাকে?

– আমাদের বাড়িতে ওই ছেলে গতকাল রাতে গিয়েছিল। সেই তো আমাদের জানালো মাহিশা এখন আপনাদের কাছে আছে। নাহলে আমরা জানতেই পারতাম না ওসি সাহেব।

– অদ্ভুত তো। আপনাদের মেয়ের বিয়ের কথা ছিল পাঁচ দিন আগে। কিন্তু তাকে সেখান থেকে তুলে এনে তার পরদিন রাতে খুন করা হয়েছে ঢাকা শহরের মধ্যে। সেই বাসায় একটা যুবকের ছবি পাওয়া গেছে অথচ ওই যুবকই আবার আপনার মেয়ের লাশের সন্ধান দিতে আপনাদের বাড়িতে গেল?

– গতকাল রাতে উনি যখন আমাদের বাড়িতে ছিলেন তখন কে যেন কল করেছিল। তারপর সেই কলের অপরপ্রান্ত থেকেই কেউ একজন বলেছে যে মাহিশার লাশ আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাওয়া যাবে।

– নাটক নাটক।

– মানে?

– মানে হচ্ছে নিজেকে সুরক্ষিত করার জন্য অন্য কাউকে দিয়ে কল করিয়ে সাজু নামের লোকটা পার পেতে চায়। আমার কাছে পরিষ্কার মনে হচ্ছে তিনিই খুনটা করেছেন।

– বলেন কি ওসি সাহেব?
অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো মাহিশার খালু।

– দেখুন, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আমরা সাব্বির নামের একটা ছেলেকে প্রথমে সন্দেহ করি। সব প্রমাণ সেই ছেলের বিরুদ্ধে ছিল তাই তাকে সন্দেহ করা স্বাভাবিক। আজকে ভোরবেলা সেই ছেলেকে টঙ্গী রেলস্টেশনের কাছ থেকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞেসাবাদ করার সময় সে বলেছে,

তার কাজ লাশ দাফন করা বা গুম করে দেওয়া। কিন্তু সে খুন করে নাই। তবে সে যখন প্রথম মেয়েটাকে দেখে তখন নাকি জীবিত ছিল। তারপর সে তার বাবার সঙ্গে বারবার কথা বলে মেয়েটা বেঁচে আছে তাই। সে ছাড়া তখন সেই ফ্ল্যাটে অন্য কেউ ছিল এবং খুনটা নাকি সেই অজ্ঞাত লোকটা করেছে। কিন্তু আমরা তার কথা বিশ্বাস করিনি তবে ধারণা করেছিলাম ছবির এই লোকটা হতে পারে। তবে এখন আপনাদের কথা শুনে অবাক হচ্ছি কারণ সে নাকি আপনাদের বাড়িতে গিয়েছে। আবার লাশের সন্ধান দিয়েছে।

– মাহিশার বাবা বললো, আমি তো এভাবে ভেবে দেখিনি ওসি সাহেব। তারমানে ওই ছেলে আমার মেয়েকে খুন করে আবার গ্রামের বাড়িতে নিজেকে বাঁচাতে খুন তদন্তের নাটক করছে?

– অনেকটা তাই।

– হায় আল্লাহ।

– চিন্তা করবেন না, আপনার মেয়ে মারা গেছে তাই তাকে তো ফিরিয়ে দিতে পারবো না। কিন্তু সেই খুনিকে গ্রেফতার করে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা তো ঠিকই করতে পারবো।

– আমরা এখন কি করবো স্যার?

– আপাতত মামলা করে লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যান। সাজুকে প্রধান আসামি এবং সাব্বির, তার বাবা, ও সেই পলাতক ম্যানেজারকে আসামি করে মামলা করবেন। লাশ দাফন করে ঢাকায় এসে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমরা যেন দ্রুত সবকিছু শেষ করতে পারি তাই বিভিন্ন তথ্য দিয়ে আমাদের সাহায্য করবেন।

ওসি সাহেব মোবাইল বের করে মোংলা থানায় কল দিলেন।

★★★

রামিশাকে জ্ঞান ফিরিয়ে স্বাভাবিক করার জন্য যা যা করা দরকার সবটাই তাড়াতাড়ি করে ফেললো রাব্বি। মেয়েটার বুদ্ধি দেখে সে অবাক হয়েছে। তার চোখে ঠিকই ফাঁকি দিতে পেরেছিল কিন্তু শেষ মুহূর্তে জুতোর জন্য আর পারেনি।
রাব্বি এখন তাড়াতাড়ি রামিশাকে তার বাসায় পৌঁছে দেবে। তারপর তাকে যেতে হবে খুলনায়। আব্দুল কাদেরকে যেভাবেই হোক পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। নাহলে তার উপর আবারও আক্রমণ হবে, আর হাসপাতাল থেকে যদি তাকে কারাগারে নেওয়া হয় তাহলে রাব্বি তাকে আর সহজে বাঁচাতে পারবে না।

কিছুক্ষণ আগে রামিশা মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে বসেছে। তার সামনে এখন রাব্বি ও তার পরিচিত ভাবি বসে আছে। রামিশা প্রথমে সবকিছু মনে করার চেষ্টা করতে লাগলো। তারপর পিছনের কথা মনে পড়তেই সে অনুভব করলো নিজে সুস্থ আছে। কিন্তু তার সামনে দুটো অপরিচিত মানুষ বসে আছে, এরা শত্রু নাকি বন্ধু বোঝা যাচ্ছে না।

রামিশা আস্তে করে বললো,
– আমার হাতে একটা ব্যাগ ছিল সেটা কোথায়?
সেখানে আমার মোবাইল ছিল।

– রাব্বি বললো, আপনার সঙ্গে যা কিছু ছিল সবটাই সুরক্ষিত আছে। আপনি কি এখনই কারো কাছে কল দিবেন?

– আপনাকে পরিচিত মনে হচ্ছে।

– না পরিচিত হবার মতো কেউ নয়, তবে বাসের মধ্যে সামান্য কথা হয়েছিল আমাদের। আমার নাম রবিউল ইসলাম।

– আমি একজনকে কল করতে চাই।

– সাজু ভাইকে?

চমকে গেল রামিশা। মনে মনে বললো, এই লোক কীভাবে বুঝতে পেরেছে সে সাজু ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে চায়। যাদু যানে নাকি? অদ্ভুত।
কিন্তু তাকে চুপ থাকতে দেখে রাব্বি বললো,

– আপনি যখন রাস্তার পাশে পড়ে গিয়ে ভয়ের কারণে জ্ঞান হারালেন তারপর থেকে আপনার ব্যাগপত্র আমার কাছে ছিল। আপনার ফোনে সাজু ভাই নামে সেভ করা একটা নাম্বার দিয়ে অসংখ্য কল এসেছে। আমি একটাও রিসিভ করিনি।

– ওহ্ আচ্ছা।

– তাই ভাবলাম, যে লোকটা আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য এতবার কল দিচ্ছে তিনি হয়তো খুব কাছের কেউ হবে। বিকেলের মধ্যে আপনার জ্ঞান না ফিরলে আমি পুলিশের কাছে সাহায্য নিতাম।

– আমার ফোনটা একটু দেন।

রাব্বি মোবাইলটা এনে দিল। রামিশা সাজু ভাইর নাম্বারে কল দিতে লাগলো কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না।
রামিশা চেক করে দেখলো যে সর্বশেষ তাকে কল করা হয়েছে দেড় ঘন্টা আগে। তারমানে দেড় ঘন্টা ধরে আর একবারও কল করেনি সাজু ভাই।
কিন্তু কেন? রাগ করেছে?
এতবার কল দিয়ে তাকে পায়নি বলে মনে মনে খুব বিরক্ত হয়েছে নাকি?

– একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?

মুখ তুলে জিজ্ঞেসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রামু।
রাব্বি তখন মনে মনে সাজানো কিছু কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলো,

– সাজু ভাই নামের একটা লোককে আমিও চিনি কিন্তু তার বাসা বাগেরহাট। আমি তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম একবার, খুব চমৎকার মানুষ। এখন আমার কৌতূহল হচ্ছে আপনি কি সেই সাজু ভাইয়ের পরিচিত কেউ?

রামিশার সঙ্গে যে সাজু ভাইয়ের কিসের সম্পর্ক সেটা তো রাব্বি ভালো করেই জানে। কিন্তু তবুও এমন ভাবে প্রশ্ন করলো যেন রামিশা বুঝতে পারে রাব্বি কিছু জানে না।

– জ্বি ভাই, আমি বাগেরহাটের সাজু ভাইয়ের পরিচিত, আমি তার খুব কাছের কেউ। আপনি যেহেতু তার সঙ্গে দেখা করেছেনে তাই নিশ্চয়ই জানেন উনি একজন গোয়েন্দা।

– হ্যাঁ জানি। সেজন্যই তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে ছিল। আমার এক বন্ধুর বাসা বাগেরহাট, তাদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে কিছুদিন আগে সাজু ভাইর সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

– আমাকে এভাবে বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া।

– সত্যি বলতে আপনার মোবাইলে কল আসতে দেখার পর থেকে আমি একটু বেশি সচেতন ছিলাম। আপনি যেহেতু সাজু ভাইয়ের পরিচিত কেউ তাই বাড়তি যত্ন।

বিকেল পাঁচটার দিকে সাজুর মোবাইল রিসিভ হয়েছে। রামিশা বললো,

– সাজু ভাই আপনি কোথায়?

– কে আপনি?
একটা মেয়ের কণ্ঠ শুনে চুপ হয়ে যায় রামিশা।

– কথা বলছেন না কেন? কে আপনি?

– এটা সাজু ভাইয়ের মোবাইল না?

– হ্যাঁ কিন্তু কে আপনি?

– উনি কোথায়? তাকে বলেন রামিশা কল দিয়েছে তার সঙ্গে কথা বলতে চায়।

– উনি ঘুমাচ্ছেন, এখন ডাকা যাবে না।

– উনি? সাজু ভাই আপনার কে হয়?

– যেই হোক না কেন কিন্তু খুব কাছের কেউ যদি নাহয় তাহলে তো কল রিসিভ করি না তাই না।

– তার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক?

– মনে করুন স্বামী স্ত্রী।

– কি বললেন?

কলটা কেটে গেল। কোনকিছুরই বুঝতে না পেরে দুচোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো তার। রাব্বি কিছুটা অবাক হয়ে তাকালো কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না।
যদিও সে এখন আছে নতুন টেনশনে। একটু আগে সে জানতে পেরেছে সাব্বির ছেলেটা ধরা পড়েছে।

★★★

দুপুরের দিকে দারোগা সাহেবের কাছ থেকে সাজুর নাম্বার নিয়ে তার অবস্থান জানার চেষ্টা করতে লাগলো ওসি সাহেব। অবশেষে যখন তিনি জানতে পারলেন সাজু ভাই উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি। তখন বেলা পাঁচটা। নিজের ফোর্স নিয়ে তিনি রওনা দিলেন উত্তরা। মোংলা থানার দারোগার কথা শুনে কিছুটা অবাক হলেও সেটাকে সাজানো বলে মনে হচ্ছে তার কাছে। আব্দুল কাদের নামে কে যেন অন্য কারো নাম প্রকাশ করেছে। কিন্তু সে নাকি খুনিকে দেখে নাই তাই ওসি সাহেবের ধারণা ওই অজ্ঞাত লোকটা সাজু সাহেব।

হাসপাতালে পৌঁছে পুলিশ সরাসরি সাজু ভাইকে খুঁজে বের করলো। তারপর বললো,

– ভালো আছেন সাজু সাহেব?

– জ্বি, আপনারা?

– মাহিশার বাবার করা মামলার উপর ভিত্তি করে তার মেয়ে মাহিশাকে কিডন্যাপ করে ঢাকায় এনে হত্যা করার প্রধান আসামি হিসাবে আপনাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে সাজু সাহেব। ওরফে সাজু ভাই।

– মানে কি এসবের?

– অবাক হবার অভিনয় করতে হবে না, থানায় গিয়ে আপনার সঙ্গে বিস্তারিত বলা হবে। দাবার গুটির চালটা খুব ভালো করে দিয়েছেন সাজু সাহেব। কিন্তু ঘোড়ার আড়াই চালের দিকে একটু নজর রাখা দরকার ছিল।
আপনি থানায় চলুন।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here