এক পা দুপা
সিজনঃ ২
পর্বঃ ৯

রিসিভ করতেই অপরিচিত কারো গলা। চমকে ওঠে শিল্প। বলে, “কে?”
“আমাকে চিনবেন না। ডায়ালে আপনার নাম্বারই প্রথমে দেখলাম। যার ফোন তিনি হাসপাতালে আছেন। আপনি এখানে আসুন জলদি।” ডায়ালে শিল্পের নাম্বার থাকা অসম্ভব কিছু না। রোজ দুবার করে ফোন করে শিল্প তবে কোনবারই রিসিভ হয় না। তনুর সামনে যাবার ইচ্ছে থাকলেও তার এগ্রেসিভ হবার ভয়ে যায় না। ফোনের কথা শুনে শিল্পের মুখ ভয়ে কালো হয়ে গেলো।
“কি হয়েছে?”
“তেমন কিছুই না, উনি ভালো আছে। আপনি আসুন জলদি।” এড্রেস জেনে রেখে দিলো ফোন শিল্প। তাড়াহুড়ো করে উঠতে নিলে আটকালো আমিনুল।

“আরে ভাই কি হয়েছে? আজ আবার কি অঘটন ঘটলো?”
“ভাই হাত ছাড়েন, এমডির রুমে যাইতে হবে। আমার ওয়াইফ অসুস্থ।”
“আরে মিয়া আপনার বউ দেখি অঘটন ঘটন পটীয়সী। সেদিনও ছুটি নিলেন আজও।”
“বাজে কথা বলবেন না, অসুস্থতা কেউ ডেকে আনে না।”
“রাগছেন কেনো আমি তা বলেছি। আচ্ছা কি হয়েছে বলেন তো।”
“কিছু হয়নি হাত ছাড়েন তো।”
“আরে বলেন না, যদি কিছু করতে পারি।”
“ধুর বাল৷ ছাড়েন তো।” হাত ঝাড়া দিয়ে সরে আসে শিল্প। আমিনুল একটু আহত হয়। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে এমডির রুমের দিকে হাঁটতে থাকে।

ছুটি নিতে ভালোই ঝক্কি পোহাতে হয় শিল্পকে। ছুটি পেতেই সে দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে আসে। ঝড়ের গতিতে হাসপাতালে এসে পৌঁছায়। রৌদ্রময় দিনে ঘামের জলে স্নান করেছে যেন শিল্প। তনুর নাম্বারে ফোন করতেই সেই অপরিচিত মানব রিসিভ করলো। তনু এমার্জেন্সিতে আছে। খুব দ্রুত শিল্প সেখানে পৌঁছালো।
লোকটি একজন ডাক্তার, সহাস্যে এগিয়ে এলো তড়িঘড়ি করে এগিয়ে আসা শিল্পের দিকে।
“তনু কোথায়?”
“আমিই আপনাকে ফোন করেছি, আসুন উনি ভেতরে আছেন।”

শিল্প ডাক্তারের পেছনে ভেতরে গিয়ে দেখলো তনু বেডের উপর বসা। পা মুড়িয়ে বসে রীতিমত নখ কামড়াচ্ছে। এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। কেমন চোরের মতো হাবভাব।
“তনু।” শিল্পকে দেখে তনুর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। চঞ্চল হয়ে উঠলো তার অস্থিরচিত্ত মন। দোলাচালে শিল্পের সামনে এসে দাঁড়ালো।
“আপনি এসেছেন, চলুন বাড়ি চলুন।” শিল্পের হাত ধরে টানতে শুরু করলো।
“তোমার কি হয়েছে তনু? এখানে কেনো তুমি?”
“উনি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। ওনাকে স্পটে থাকা লোকেরা নিয়ে এসেছে এখানে।”
“কোথায় সেটা? তুমি কোথায় গিয়েছিলে তনু?” পরের বাক্য তনুর উদ্দেশ্যে ছিল।
“কলেজ স্ট্রিটের আগে বাম দিকের একটি রাস্তায় তাকে পাওয়া গিয়েছে।”
“তুমি ওখানে কি করছিলে তনু?”
তনু কোনো উত্তর দেয় না। আগের মতো নখ কাটতে থাকে দাঁত দিয়ে আর এদিক সেদিক তাকাতে থাকে। শিল্প বিরক্ত হয়।
“কথা বলছো না কেনো?”
“বাসায় চলো।” তনু আবার তুমি করে বলছে। নরম হয়ে এলো শিল্পের গলার সুর।
“কি হয়েছে তনু, ওদিকে কেনো গেছিলে?”
“কোথায় গেছিলাম আমি? না তো আমি তো বাসায় ছিলাম। এখানে কিভাবে যে এলাম।” তনুর চেহারায় সত্যতা। সে সত্যি বলছে এমন ভাব কিন্তু কিভাবে সম্ভব, তাহলে এখানে তনু পৌঁছালো কিভাবে? কলেজের স্ট্রিটের কাছে পাওয়া গেলো কেনো? শিল্প তনুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু তনু তাকায় না।
আবারো তনুর ফোন বেজে উঠলো। ডাক্তারের হাতেই ছিল ফোন। শিল্পের দিকে বাড়িয়ে দিলো সে। শিল্প দেখলো নুযহাতের কল করেছে।
“তনু, নুযহাত ফোন করেছে।”
“কে নুযহাত?” চোখমুখ কুঁচকে বলে তনু। তার মাঝে বাচ্চা বাচ্চা ভাব ফুটে উঠেছে। শিল্প বাকবিতন্ডায় গেলো না।
“হ্যাঁ নুযহাত।”
“ভাইয়া, তনু কোথায়? ও কি আপনার সাথে আছে? বাসা থেকে এমারজেন্সি আসায় চলে আসতে হয়েছে। বাবা হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। দিকবিদিকশুন্য হয়ে বাড়ি চলে এসেছি। তনুকে জানাতে পারিনি।”
“আস্তে আস্তে বলো। সমস্যা নেই তনু আমার সাথে আছে।”
“আল্লাহ বাঁচিয়েছেন।”
“তোমার বাবা এখন কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
“তনুর কি আজ তোমার সাথে দেখা করার ছিল?”
“হ্যাঁ, আপনি বলেছিলেন তনুকে সময় দিতে তাই আর কি।”
“আচ্ছা, ধন্যবাদ তোমাকে। রাখছি বোন হ্যাঁ।”
“আচ্ছা।”

শিল্পের কপালে ভাঁজ পড়লো। সেভাবেই তনুর দিকে তাকালো। আবারো প্রশ্নেরা ঝাপটে ধরলো। তনু যদি কলেজেই যায় তাহলে উল্টো পথে হাঁটলো কেনো? সেখানে সজ্ঞা বা কেনো হারালো? তনুকে কি এখন জিজ্ঞেস করবে? কিন্তু ও যে অস্বীকার করলো? শিল্পের শরীরের সাথে লেগে আছে তনু। বাড়ি যাবার চিন্তায় মাথায় আসলো তার।
“ডক্টর তনুর কি কোনো সমস্যা হয়েছে? না মানে জ্ঞান হারানোর কারণ।”
“তেমন বিশেষ কোনো কারণ নেই। তবে উনি স্ট্রেস নিতে পারেন না। এমন কোনো ঘটনা হয়তো ঘটেছিল যা উনি সহ্য করতে পারেননি।”
“আমরা কি এখন বাড়ি ফিরতে পারি?”
“দুঃখিত, আপনাদের যেতে দিতে পারছি না। আপনার সাথে ওসি শাহেদ কথা বলবেন।”
“ওসি?”
“জ্বি, আপনি অপেক্ষা করুন।”
“কি বিষয়ে কথা বলবেন?”
“সেটা তিনি এসে বলবেন, আপনারা অপেক্ষা করুন।”
“চলুন বাসায় যাবো।” হঠাৎ করে তনু শিল্পের হাত নাড়িয়ে বললো।
“দুঃখিত আপু, আমি আপনাকে যেতে দিলেও বাইরে বসা কনস্টেবল আপনাকে যেতে দিবে না। আপনারা অপেক্ষা করুন।” ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন এমারজেন্সি থেকে।

শিল্পের কপালে চিন্তার ভাঁজ গাঢ়তর হলো। সে এখানে প্রবেশের আগে বাইরে একজন পুলিশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। ভাবেনি তাদের জন্যই উনি অপেক্ষা করছে। ব্যাপার কি হলো বোঝা যাচ্ছে না। কোন গোলকধাঁধায় আটকে পড়বে ওরা আল্লাহ মালুম।
শিল্প আবার তনুর দিকে তাকালো। তনু ওর দিকেই তাকিয়ে আছে দেখে একটু অবাক হলো।
“কিছু বলবে?”
“বাসায় যাবো না?”
“যাবো তো একটু অপেক্ষা করি।”
“পুলিশ কেনো আসবে?”
“জানিনা তো। তোমার কি কিছু মনে নেই? কোথায় ছিলে তুমি? সে-রকম কিছু, শরীর খারাপ বা কিছু।” তনু কিছুসময় তাকিয়ে থাকলো কিন্তু আশানুরূপ কোনো উত্তর দিতে পারলো না।
“বাসায় যাবো, চলো না।”

———-

আধাঘণ্টা যাবত বসে আছে শিল্প। কিন্তু ওসির আগমণের নাম নিশানা দেখা যাচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালগুলো সকাল সন্ধ্যা সবসময়ই রোগীর চাপে ব্যস্ত থাকে। এমারজেন্সির অবস্থা বলার মতো না। ক্ষণে ক্ষণে রোগীর আগমন ঘটছে। রোগীদের অবস্থা সমীচীন নয়। একজন বাইক এক্সিডেন্ট রোগী এডমিট হয়েছে যার পা আধা ঝুলে আছে। লিগামেন্ট ছিঁড়ে শেষ, হাড়ও যুক্ত নেই। কি বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। রক্ত অনবরত প্রবাহিত হচ্ছে যেন পাইপর ফুটো দিয়ে পানির ফুয়ারা। লোকটির আর্তনাদ, আহ্, কানে বাজছে। অল্পবয়সী একটা মেয়েকে নিয়ে আসা হলো। সুইসাইড এটেম্প করেছে মেয়েটা। বেশভূষা, বাবা মায়ের বাহ্যিক সৌন্দর্য বা আচরণ যায় হোক দেখে বলা বাহুল্য তাঁরা অবস্থা সম্পন্ন পরিবার। কি অবস্থা মেয়েটার। আশংকা বিষ গিলেছে। ডাক্তারের অনবরত প্রচেষ্টা চললো সময় নিয়ে তবে শেষ রক্ষা আর হলো না। অভিমান করে চলে গেলো অল্পবয়স্ক মেয়েটি। বাবা মায়ের আর্তনাদে কম্পিত হতে শুরু করলো হাসপাতালের জানালা, দরজা, ইট, কাঠ সবটা। বললো, “কেনো করলে? কেনো এরূপ করলে? শোন মেয়ে তুমি বড্ড ভুল করলে।”
জড়বস্তুর কথা কারও কানে যায় না, কোনদিন যায়নি আজও যাবে না।

শিল্পের অস্বস্থি লাগছে। তনু তার কাঁধে মাথা রেখে তন্দ্রারত। মেয়েটাকে ভিষণ ক্লান্ত লাগছে। ওসি শাহেদ এখনও এসে পৌঁছায়নি। কনস্টেবলকে চার-পাঁচ বার জিজ্ঞাসা করা হয়ে গেছে। প্রতিবারই সে পাঁচ মিনিটের দোহাই দেখিয়েছে। দুঃখের বিষয় তাঁর পাঁচ মিনিট সময়টুকু আধাঘন্টা অতীত হবার পরও ফুরালো না। শিল্প নিজেও অসুস্থ বোধ করছে। ভয়, দ্বিধা, কৌতুহল সব মিলিয়ে সে বিধ্বস্ত। আর কতো, এ পথের শেষটা কি আর মিলবে না?

শিল্পের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ওসি শাহেদের আগমণ ঘটলো। আগমণবার্তা আগেই কনস্টেবল জানিয়েছেন। ওসি আসতেই শিরদাঁড়া সোজা করে বসতে নিলো শিল্প কিন্তু তনু কাঁধে তন্দ্রারত থাকায় সে প্রচেষ্টায় ব্যাঘাত ঘটলো।
ওসি শাহেদ শিল্প তনুকে দেখে হাসলেন। প্রাপ্তবয়স্ক শাহেদকে হাস্যজ্জ্বল মুখে প্রিন্স চার্মিং থেকে কম লাগছে না। হতাশা হীন প্রাণচ্ছ্বল দীপ্তি ছড়ানো মানবটির সামনে শিল্প আজ ম্লান, ভঙ্গুর পুরুষ। তবে বলা বাহুল্য শিল্প এখনো হেরে যায়নি।
অভিনব কায়দায় বসলেন চার্মিং পুরুষ শাহেদ। স্বল্প হেসে প্রশ্ন করলো, “উনি কি ঘুমাচ্ছে?”
দৃঢ় প্রতিয়মাণ দীপ্ত পুরুষের সামনে মৃয়মান হয়ে এলো শিল্পের কন্ঠ। স্বল্প স্বরে বললো, “অনেকসময় বসে আছি। ও একটু অসুস্থ। তাই হয়তো ঝিমুনি ধরেছে।”

“আমাদের কি আর টাইম টেবল আছে ভাই। হুকুমের গাধা, খেটে যাও। যায় হোক অপেক্ষা করলেন বেশ সময় নিয়ে নিশ্চয় বিরক্ত। তা চা কফি কিছু নিয়েছেন না বসেই আছেন।” ওসি শাহেদের কথায় শিল্প চোখ ঘুরিয়ে হাসপাতাল দেখলো। তনু তখনো বন্ধ চোখে ঘন নিঃশ্বাস নিবারনে ব্যস্ত।
“আপনার মনে হয় এটা চা নাস্তা খাবার জায়গা।”
ওসি কথাটা শুনেই প্রাণখুলে হাসলেন। বললো,
“জায়গার তফাত আপনাদের, আমাদের তো মৃত্যু আর চোর নিয়েই খেলা।”
“আপনি যদি বলতেন আমাদের বসিয়ে রাখার কারণ তবে আমরা বাড়ি যেতে পারতাম। এখানে সত্যি আমার সাফোকেট ফিল হচ্ছে। দম আঁটকে আসছে।”
“এখনই এ অবস্থা হলে কেমনে হবে মন শক্ত করুন। আর বাড়ি তো যেতে পারবেন না।”
“পারবো না মানে! কেনো পারবো না?”
“কারণ আপনার ওয়াইফ একটা মার্ডার কেসের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। শি এটেম্প আ মার্ডার।”
“ওয়াট!”

শাহেদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির বানে শিল্প তালমাতাল বোধ করলো। তার চমকে ওঠা হোক বা শরীরের বাড়ন্ত কম্পন, তনুর তন্দ্রারত ভাব কেটে গেলো। পিটপিট করে তাকালো সে। শিল্প একবার তনুর মাসুম পবিত্র চেহারা আর একবার রহস্য ভরা শাহেদের চেহারার দিকে তাকাচ্ছে। ঠিক ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের তিনচারবার না, না, না বলার মতো। শিল্প শুধু না টুকু বলেনি তবে ঘাড় ফেরানো টা গননা করা সম্ভব।

শিল্পের বিষ্ময় ভাব আর তনুর ঘুমের রেশ কাটতে না কাটতে কনস্টেবল সেখানে এলেন। খবর নিয়ে, তাঁকে সাধুবাদ জানানোর কিছু নেই, তাঁকে শিল্প ধিক্কার জানাচ্ছে মনে মনে। তাঁর আনা এক লাইনের খবর শিল্পের হার্টবিট দ্বিগুণ হারে বাড়িয়ে দিয়েছে।

“স্যার, ভিক্টিম আর বেঁচে নেই।”

চলবে…
মেহবুবা তানজীম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here