এক পা দুপা
সিজনঃ ২
পর্বঃ ৫
শিল্প বাড়ি ফিরলো আরো পাঁচদিন পর। রুগ্ন দেহে তাকে রুগী ব্যতিত কিছুই মনে হবে না। অল্পদিন হচ্ছে যেন রোগমুক্তি লাভ করেছে। বাড়ি ফিরতেই বাবা মায়ের নানা প্রশ্নে বিবর্জিত হতে থাকলো। তবে সে বড়ই চুপচাপ। তেমন প্রশ্নের উত্তর করিম বা নাজমা কেউ পায়না।
“তোমার চাকরির কি গতি হলো?”
“ভালো।”
“শুধুই ভালো। ঠিক করে বলো, হলো কি হলোনা? হ্যাঁ বা না এ উত্তর।”
“হয়েছে।”
“আলহামদুলিল্লাহ। তা কি চাকরি?”
“কম্পিউটার অপারেটর।”
“এই পদে করবে!”
“নাই মামার থেকে কানা মামা ভালো।”
“তা বেশ। ছিলে কোথায় এই ক’দিন?”
“অফিসের কাজেই ছিলাম।”
“এতো রোগা হলে যে?”
“খাবার ভালো না সেখানের।”
“তোমাকে খুব অসুস্থ লাগছে। কি হয়েছে বলো বাবা আমাকে।” এপর্যায়ে বড্ড কান্না কান্না পায় শিল্পের। করিম কখনো এতো মায়া কন্ঠে কথা বলেনি। বাবা হিসেবে সে উদাসীন বলা চলে, হয়তো মায়ের উপরে কিছু বলতে পারতেন না। ঠোঁট কামড়ে কান্না উদগীরণ করে শিল্প। সবসময় বা সবার সামনে কান্না মানায় না ছেলেদের।
“তেমন কিছুই না জার্নি করেছি তাই বোধহয়।”
“তাই বলে….”
“বাবা আমার খুব ক্লান্ত লাগছে। আমি হাতমুখ ধুয়ে একটু শোব।” কথাটা বলে সেদিনের মতো না থেমে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকলো। ছেলেকে যেতে দেখে সিঁড়ির কাছাকাছি এসে ক্ষীণ কন্ঠে ডাকলেন নাজমা।
“বাবা ভাত খাবিনা।” শিল্প থামলো কিন্তু পিছু ফিরলো না।
“আমার এখন ঘুম প্রয়োজন মা, আমি একটু ঘুমাতে চাই শান্তির ঘুম।” বিষন্নতায় ছেয়ে আছে শিল্পের কন্ঠস্বর। নাজমা বুঝলেন কিন্তু এগিয়ে যেতে পারলেন না। এই অভিশপ্ত সিঁড়ি সে অতিক্রম করতে ভয় পায়।
রুমে এসে গোসল করেই শুয়ে পড়ে শিল্প। ক্লান্তিতে ঘুম আসলেও পুরোপুরি অচেতন হতে পারলো না। অবচেতন মনে ঘটতে থাকলো অতীত সব ঘটনার ফ্লাসব্যাক।
————-
কোনো এক ব্যস্ত রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে সোহান। দৃশ্যত তাকে অস্থির দেখাচ্ছে। বারেবারে উত্তরের ত্রিমুখী রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে। সেদিক থেকেই খানিক পরে শিল্পকে আসতে দেখা যায়। খুব ধিরেই আসছে সে। প্রতি ধাপ ফেলতেও যেন কষ্ট হচ্ছে।
“তোর এই অবস্থা কেনো? কই ছিলি এতোদিন? কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছিল না? শরীরের কি হাল তোর?” শিল্প সেভাবেই একটু হাসলো। কিছু মানুষের স্বভাব মানুষকে আড়ালে রেখে মৃদু হাসা। কেউ তাঁর জন্য ভাবছে বড্ড আকাঙ্খিত তাঁর কাছে।
“চল কোথাও বসি। নিরিবিলি কোনো জায়গা।” সোহার কোমড়ে হাত দিয়ে কিছু ভাবলো।
“কোনো রেস্টুরেন্ট?”
“অবশ্যই না। প্রকৃতি ছাড়া আর কোথায়।”
“তবে চ ঝিলের ধারে।”
যেতে যেতে তাদের মাঝে কিছু কথা হলো। স্বল্প কিছুই। সোহান বললো, “তনুর খবর কিছু রাখিস। এইতো কিছুদিন আগে মেয়েটা কি পরিমাণ এগ্রেসিভ হয়ে উঠেছিল। কিছু কি খবর রাখিস। নিজের মতো কোন দুনিয়ায় যে তুই থাকিস।”
“সবটাই শুনেছি আমি। অতো ভাবিস না সময় সব ঠিক করবে।”
“কচু করবে। যেখানে ক্ষিদে তোর কাজ তোকেই করতে হবে। খাবার তোকেই আনতে হবে। কেউ তোর ভাগের কাজ করে দিবে না।”
“হুম দেখা যাক কতোদুর যাওয়া যায়।”
“এইযে তোর এই গা ছাড়া ভাবের জন্য না খুব রাগ, গা একদম জ্বলে যায়।” রাগে আর কোনো কথা বলে না সোহান। জোর পায়ে সামনে এগিয়ে যায়। পিছুপিছু শিল্প সেভাবেই চলতে থাকে।
“আরে ব্যাটা একটু আস্তেধীরে চল। এতো জোর আজ পায়ে নেই।” ক্ষীণ শিল্পের স্বর। সোহান পিছু ফিরে বললো, “মর তুই।” তবে থামলো না।
সামনে একটা ঝিলের ধারে ঘাসের উপর বসে পড়লো। শিল্প ধিরে সুস্থে এগিয়ে এলো, বসলো ঘাসের উপর।
———-
তনুর দিনকাল খুব স্বাভাবিক যাচ্ছে না আজকাল। মনের ভেতর খচখচ লেগেই আছে। বিপরীতে শিল্পের খবর এখনো মেলেনি। প্রচন্ড রেগে আছে সে। সারাদিন শুয়ে বসে কাটায়। কথা বিহীন সময় কাটায় প্রায় সময়। মেয়ের এতোটা ঠান্ডা হয়ে পড়া নিয়ে চিন্তিত নিবেদিতা। নিজে অনেক চেষ্টা করছে মেয়েকে স্বাভাবিক করতে। কিন্তু সেদিনের পর থেকে মেয়ে যেন নিমিষেই বদলে গেলো। আগের তনু আর নেই। কেমন খ্যাপাটে বাঘের মতো হয়ে গেছে। কোনো কথার ঠিকঠাক উত্তর দেয় না, কেউ রুমে প্রবেশ করলেই বিরক্ত হয়। চু করে বিরক্তির শব্দ বের হয় মুখ দিয়ে। লতিকার সাথেও কথা বলে না তনু। না হয় নিবেদিতার সাথে তার পুরোনো রাগ তবে লতিকা তো কোনো দোষ করেনি।
আজও জানালা পানে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বিছানায় বসে আছে তনু। তার সমূহ আগ্রহ শিল্পের ফিরে আসা নিয়ে। কে জানে এই জলন্ত লাভা কিভাবে জ্বলে উঠবে শিল্পের সামনে। শিল্প পারবে তো সামলাতে! নাকি লাভার তাপে ভস্ম হয়ে যাবে।
“কি অবস্থা তনু, তুমি এখনো বসে আছো।” ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি সমেত তাকালো তনু। মেয়ের এহেন দৃষ্টি কষ্ট দেয় নিবেদিতাকে। মেয়ের মেন্টাল কন্ডিশনের কথা চিন্তা করে তেমন কিছু বলেনা, ভাবেও না। দোষটা তো তারই, শুরু তো সেই করেছে। সারাজীবন মেয়েকে দুরে সরিয়ে রেখেছে। ভেবেছে এভাবে মেয়েকে শক্ত করবে। কে জানতো মেয়ের মাঝে আরো দুর্বলতা, অসহায়ত্ব জেঁকে ধরবে।
“শিল্প এখনো ফিরেনি? ওর খবর জানো না?” তনুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, শিকার সন্ধানী ঈগলের মতো।
“না এখনো ফোন অফ।”
“কি হয়েছে, মরেছে নাকি!”
“তনু।” খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠলো নিবেদিতা, ধমকে কাজ হলো। তনুর চেতনা ফিরলো, কথার কম্পন পরিবর্তন হলো।
“আআমি সেভাবে বলিনি। সে একবারও আসেনি, আমার জ্ঞান ফিরেছে আর তার দায়িত্ব ফুরিয়েছে।”
নিবেদিতা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে চাইলেন।
“চলো বাইরে থেকে ঘুরে আসি মা মেয়ে।”
“ভালো লাগছে না, বাইরে যাবো না তুমি যাও। আমি আজ মেঘ দেখবো।”
নিবেদিতা বলতে চাইলেন সে তো রোজ দেখো কিন্তু বললেন না। একা ছাড়তে মন না চাইলেও সে সরে আসলেন। পাশে থাকা মানে সবসময় একসাথে একই জায়গায় থাকা নয় প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সাথে থাকা অন্তত মনোবল জোগানো। সেভাবেই নাহয় সে পাশ থাকবে।
নিবেদিতা চলে যেতেই তনু উঠে এলো। কি মনে করে আলমারি খুলে সামনে দাঁড়ালো। পুরো আলমারি কিছু খুঁজতে শুরু করলো। পেয়েও গেলো একটি অদেখা বাক্স। বাক্সের জিনিসগুলো হাতে নিয়ে মনে পড়ে গেলো কিছু অথর্ব অতীত।
———
কাল রাতে হালকা বৃষ্টি হয়েছে। হালকা বৃষ্টি বলছি কারণ, বৃষ্টির পানির সাথে স্থায়িত্বও সামান্য ছিল। ঝলমল করছে চারপাশ, নীলরঙা আকাশে গুচ্ছ সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। গাছের সবুজ পাতাগুলো যেন আরো সবুজ দেখাচ্ছে। শনশন বাতাস গরমকে ছাপিয়ে বয়ে যাচ্ছে। পাতার ফাঁকে ফাঁকে মৃদু আসা রোদ শিল্পের চোখেমুখে পড়ে হাসছে আবার লুকাচ্ছে আবার মুখ পড়ছে, হাসছে।
“আজ প্রকৃতি বেশ রং ধারণ করেছে। বল?” সোহানের রাগ আরো বেড়ে গেলো।
“তুই কি নাটক করতে এসেছিস। আমার কিন্তু খুব মেজাজ খারাপ হচ্ছে।” শিল্পের মুখ থেকে হাসি সরছে না। গাছের পাতাগুলোও তাকে দেখে ছড়া আওড়াচ্ছে, এতো হাসি কোথায় পেলে!
“হাসবি না শিল্প সত্যি রাগ হচ্ছে।”
“তুই তনুর সাথে দেখা করেছিস?”
“না, এলামই তো আজ। একটু ঘুমিয়ে তোর সাথে দেখা করতে এলাম।”
“তনু কিন্তু তোর জন্য অসুস্থ হয়ে গেছিল।”
“বললাম তো জানি। বারবার বললে তো পরিস্থিতি পরিবর্তন হবে না।”
“তুই রাগছিস কেনো!”
“রাগছিনা, শুধু এটুকু বলছি যে তনু এখনও স্ট্যাবল হয়নি। জানিনা হবে কিনা বা কবে হবে। আমার উপস্থিতি ওর মাঝে কতোটা ইম্প্যাক্ট ফেলবে তা ভাববার বিষয়।”
“আওলাঝাওলা কথা বলবি না। আজ নয় তো কোনদিন নয়। তোকে ওর সামনে আজ নয় কাল যেতেই হবে। এভাবে দুরে থেকে সম্পর্ক দুরেই থেকে যাবে কিছুই ঠিক আর হবে না।”
“হুম যাবো আজ।”
“ভালো। এখনই সময় বুঝলি সম্পর্ক শুধরে নে। যতো দিন যাবে সবটা জটিল হবে। অভিমান রাগে রুপান্তর হবে।” হঠাৎ কিছু মনে পড়লো সোহানের।
হরবর করে বললো, “তুই ক’দিন ছিলি কোথায়? কোথা থেকে টাকা পেলি। আগে সবটা আমাকে জানাতি, এখন কি আমি খুব পর হয়ে গেছি।” একটু অভিমান করে বললো সোহান। শিল্প আবারো হাসলো। তার হাসি দেখে আবারো সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো শনশন বাতাসে নড়ে ওঠা পাতাগুলো, বললো, এতো হাসি কোথায় পেলে!
শিল্প পকেট থেকে একটা খাম বের করলো, সেখান থেকে ভাজ করা একটা কাগজ বের করে সোহানের হাতে তুলে দিলো। শান্তমনে করতে থাকলো কাজগুলো, সোহানও চুপচাপ দেখছিল সব। কিন্তু পরে একটু চমকালো। প্রশ্নান্মিত চোখে তাকালো শিল্পের দিকে।
“পড়।”
“কিসের কাগজ?”
“পড়ে দেখ।”
সোহান কাগজ খুলে পড়তে আরম্ভ করলো। পড়ার মাঝে বার কয়েক শিল্পের দিকে তাকালো। শিল্প তখন মাথার উপরে লুকোচুরি খেলা পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে। সেও তাদের সাথে লুকোচুরি খেলতে আগ্রহী। পাতার ফাঁকে ফাঁকে আসা রোদ থেকে নিজের মুখ এদিক সেদিক সরিয়ে নিজেও পাতার সাথে খেলতে শুরু করেছে।
সোহান পড়া শেষ করতেই কাগজটা আধ ভাঁজ করা অবস্থায় সামনের দিকে তাকালো।
“আমি তোর ভালোর জন্যই তিয়াসা থেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম। আমার নিজের কোনো লাভ লস নেই এখানে।”
“জানি।” শিল্প এখনো পাতার সাথে খেলায় ব্যস্ত।
“তুই কি আমাকে অবিশ্বাস করছিস? ভাবছিস আমার জন্য সব ঘটেছে?”
“না। আমি আমার ভাগ্যের উপর কিছু করতে পারিনা।”
“আমি সত্যি কোনদিন তোর খারাপ চাইনি।”
“আমি জানি।”
চলবে…
মেহবুবা তানজীম