এক পা দুপা
সিজনঃ ২
পর্বঃ ৪
তনুকে বাড়ি পৌঁছে অপেক্ষা না করেই ফিরে এলো শিল্প। বাড়িতে ফিরতেই সবাই তাকে আঁকড়ে ধরলো, কেনো তনুকে নিয়ে আসলো না? এতোদিন পর মেয়েটা সুস্থ হলো। শিল্প প্রচন্ড ক্লান্ত, এখনই তাকে গুরুত্বপূর্ণ কাজের উদ্দেশ্যে বের হতে হবে। তবে মনে হচ্ছে না সে একটু রেস্ট করতে পারবে।
“তোমার না রেস্টুরেন্ট যাবার কথা?” করিম সাহেব সবাইকে থামিয়ে নিজে বললেন।
“ছিল কিন্তু যাচ্ছি না।”
“তোমার কি হয়েছে বলো তো? তনু মাকে বাড়ি নিয়ে আসলে না? নিজেও কাজে গেলে না? কি হয়েছে?”
“তেমন কিছু না বাবা আসলে একটা ক..কাজ… মানে ওই আরকি পেয়েছি।”
“কি কাজ?”
“সেসব পরে জানাবো। তার আগে চার পাঁচদিনের জন্য একজায়গায় যেতে হবে। সেখানে সফল হলেই কাজ পেয়ে যাবো।”
“কিন্তু কোথায় যেতে হবে?” নাজমা বেগম মুখ খুলতেই রেগে গেলেন করিম।
“তোমাকে কথা বলতে বলেছি। চুপ থাকো আমি কথা বলছি।” নাজমা কুঁকড়ে গেলেন, সরে গেলেন সেখান থেকে। দাঁড়ালেন একটু আড়ালে।
“তনুকে আনলে না কেনো?”
“তনু এখনো পুরোপুরি সুস্থ না। এখানে ওর ভালো সেবা করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া সবচেয়ে বড় সমস্যা ও কিছু কিছু ঘটনা ভুলে গিয়েছে। সকালে ডাক্তারের সাথে যখন কথা বলতে গিয়েছিলাম তিনি বলেছেন এখন তনুকে সেই এক্সিডেন্ট স্পট থেকে দুরে রাখা ভালো বা যেসবে সেসব মনে পড়ে সেসব জায়গা থেকে। একটু সুস্থ হবার সময় দেওয়া জরুরী। কারণ এই বাড়িতে এলে এর অতীত মনে পড়ার সম্ভাবনা আছে।”
“মানে তনুর কিছু মনে নেই!”
“তেমন কিছু না বাবা। ওর সব মনে আছে কিন্তু বাচ্চার কথা, সেই এক্সিডেন্টের কথা মনে নেই। নয়তো নিশ্চয় এতো স্বাভাবিক আচরণ করতো না।”
“সেটা আমিও ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম তনুর জ্ঞান ফিরলে আমাদের সাথে কথায় বলবেনা। অথচ কতোটা স্বাভাবিক ছিল তনু। আমি সত্যি অবাক হয়েছিলাম।”
“সময়ের সাথে ঠিক হবে হয়তো। এখন চাপ না দেওয়া উত্তম। এইজন্যই আমিও তেমন সামনে যাচ্ছি না। আমি আগেই কিছু সন্দেহ করেছিলাম।”
“তাহলে এখন কি করতে চাইছো?”
“তনু ওখানেই থাক। কিছুদিন আমরা প্রচ্ছন্ন থাকি, একটু সুস্থ হলেই নাহয় ফিরবে। কোমা থেকে ফেরা সহজ নয়।”
“হুম।”
“বাবা এখনই আমি বের হবো। ঢাকা যেতে হবে। যদি আমাকে ফোনে না পাও তবে চিন্তা করবে না। সময়মতো আমিই সব জানাবো।”
“কিন্তু কোথায় যাচ্ছ? কি কাজ?”
“সব জানাবো বাবা, কাজটা শুধু ঠিকঠাক হোক।” শিল্প তাড়াহুড়ো করে নিজের রুমে চলে গেলো। নাজমা আড়াল থেকে জলদি রান্নাঘরে গেলেন। ছেলেটা সকাল থেকে না খাওয়া। যেই ছেলে আগে না খেয়ে থাকতে পারতো না সেই ছেলে আজ দুবেলা ঠিকমতো খায় না।
করিম চিন্তিত মুখে সোফায় বসলেন। আজ ছেলের চোখে অন্যরকম কষ্টের দেখা পেয়েছেন। ঠিক কি হয়েছে ঠাহর করতে পারছেন না। কিন্তু ছেলের কিছু তো হয়েছে। সকালেও তাকে এতোটা নিশ্চল দেখেননি। কেমন ছাড়াছাড়া ভাব, যেন বাঁচতে হচ্ছে তাই বাঁচছে।
গোসল করে কয়টা কাপড় গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ে শিল্প। মা জোর করে কয়েক লোকমা ভাত খাইয়েছে। আসার আগে ডাল চালের খবর নিয়েই বেরিয়েছে। তার ফিরতে ফিরতে সেসবে কোনো সমস্যা হবে না।
——–
আজ তিনদিন তনু বাড়ি ফিরেছে। তিনদিনে একবারও শিল্পের দেখা মিলেনি। নিজের মাঝের অস্থিরতা কাউকে দেখাতে পারছে না তনু। না দেখাতে চাইছে। দেখালেও লাভ হবেনা, কেউ তাকে কিছু বলবে না। তবে নিবেদিতার অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করছে তনু। তার মা আর আগের মতো নেই। আগে গম্ভীর, একা একা থাকা মানুষটা এখন তনুকে একমিনিটও একা ছাড়তে নারাজ। স্কুলে যাবার আগে হোক পরে এমনকি রাতেও তনুর সাথে থাকছে সে। মায়ের এতো কনসার্ন খারাপ লাগছে এমন না। বরং সে বেশ উপভোগ করছে।
“তনু তুমি কি তৈরি হয়েছ?” নিবেদিতা ঘরে প্রবেশ করলেন। আজ তনুকে নিয়ে একটু বের হবেন। কিছু কেনাকাটা করবে, একটু ঘুরবে।
“হ্যাঁ, মা। কোথায় যাবে বলো তো? ভালো লাগছে না।”
“বাসায় এভাবে থাকলে ভালো লাগবে নাকি। একটু ফ্রেশনেশ দরকার।”
“মা ওনার কি খবর? উনি কি ফোন করেছেন? আসছেন না যে?”
“কাজে আছে ছেলেটা এজন্যই খবর নিতে পারছে না হয়তো। চলে আসবে।”
এই উত্তরই শুনে আসছে তনু। কিন্তু শিল্পের কোনো খবর সে পায়নি। তনু আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। নিবেদিতা তাড়া দিলো। বোরকার মুখোশ লাগিয়ে বের হলো মায়ের সাথে। লতিকা বাড়িতে থেকে গেলো, সে বিশেষ বাইরে যেতে পছন্দ করে না।
প্রথমেই দোকান ঘুরে ঘুরে নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনলো। কেনাকাটা শেষে রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো উদ্দেশ্যহীন। এই প্রথম মায়ের সাথে ঘুরতে বেশ লাগছে তনুর। বিশাল এক বিলের সামনে এসে থামলো রিকশা। ছোট একটা ব্রিজ। বিলে বেশি পানি নেই যদিও, তবু রোদে ঝলমল করা, বাতাসে তীরে এসে ধাক্কা লাগা ছোট সমুদ্রের ফিলিংস এনে দিচ্ছে। একটা গাছের নিচে বসলো মা মেয়ে।মাটিতে জুতা রেখে তাতেই আসন গেঁড়েছে। তারপর এদিক সেদিকের গল্পতে কেটে যায় মসৃণ সময়গুলো। মায়ের কাঁধে মাথা রেখে আবোল তাবোল গল্প করতে থাকলো তনু। দুরে একপাল হাঁস, কিছু পানিতে কিছু শুকনোতে। খোলা আকাশে হরেক পাখি। বিলে কিছু নৌকাও আছে, সামান্য কিছু ভাড়া পরিশোধ করে অনেকেই নৌকা ভ্রমণ করে। অপরাহ্নে লোকজন বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে প্রেমিক প্রেমিকা যুগলের বাইক ভ্রমণ। ব্রিজের ওপর চটপটি ফুচকার দোকান বসেছে। তনু সেদিকে এক দুবার তাকালো।
“ফুচকা খাবে আমার মা?” তনু অতি উৎসাহে মাথা নাড়ালো। নিবেদিতা মেয়েকে নিয়ে বসলো দুটো চেয়ারে। একপ্লেট ফুচকা আর একপ্লেট চটপটি অর্ডার করলো। দোকানে বেশ ভিড়। খাবার হিসেবে এই এক দোকান। অর্ডারকৃত খাবার আসতেই মা মেয়ে ভাগাভাগি করে শেষ করলো খাওয়া।
পশ্চিমে সূর্য ডুবন্ত প্রায়, তনুরা বাড়ির পথে রওনা দিলো। তনুর সারাজীবন আজকের কথা মনে থাকবে। মায়ের সাথে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় পার করলো আজ।
বাড়ি ফিরে দুজনেই বেশ টায়ার্ড। বাইরে খাওয়ার ফলে রাতে আর বিশেষ কিছু খেলো না কেউ। লতিকার জন্য বাইরে থেকেই খাবার এনেছেন নিবেদিতা।
একরাশ ভালোলাগা আর সুন্দর স্মৃতি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো তনু।
——-
শুভ্র শ্বেত কাপড়ের নিচে অমসৃণ শরীরে শুয়ে আছে শিল্প। দুতিনদিনে চেহারা যেন আরো গর্তে চলে গেছে। দেবে যাওয়া বন্ধ চোখ, উষ্কখুষ্ক চুল, অপুষ্টিতে ভোগা শরীর। মনের ভেতরে আঁকড়ে ধরা নিদারুণ নিষ্ঠুর বর্তমান। চোখের কার্ণিশ বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো বিনা দ্বিধায়।
দুর থেকে দুটি লোকের ভাঙা ভাঙা কথা ভেসে আসছে।
“ছেলেটা কতোদিনে সুস্থ হতে পারে? মনে হচ্ছে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছে।”
“উনি ভীষণ দুর্বল। দুর্বলতা অভারকাম করাটাই আসল।”
“আমার জন্য বিরাট সমস্যায় পড়লো ছেলেটা। নিশ্চিত বাড়ির লোক চিন্তা করছে।”
“এতো ভাবলে তো হবেনা। সে-ও প্রতিদান নিয়েছে।”
“তবুও ছেলেটির সুস্থতা জরুরি তার ওয়াইফ অসুস্থ।”
আর কোনো কথা শোনা গেলো না। ধিরে ধিরে মিলিয়ে যেতে শুরু করলো টাইলসে বুটের থকথক শব্দজোড়া।
———–
সকালে ঘুম ভাঙতেই তনুর অস্থিরতা শুরু হলো। হঠাৎ করেই কিছু মনে পড়েছে। অস্থিরতায় গলা শুকিয়ে এলো, দম বন্ধ হবার জোগাড়। গা ঘামে ভিজে গেছে। তনুকে ডাকতেই এসেছিল লতিকা। হঠাৎ তনুর এমন অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায় সে। নিবেদিতাকে ঘর থেকেই চিল্লিয়ে ডাকে। তনুকে গ্লাস ভরে পানি এগিয়ে দেয়। তবুও তনু শান্ত হয় না। নিবেদিতা আসতেই বলতে থাকে, উনি কোথায়? মা আসতে বলুন ওনাকে। ওনার সাথে বোঝাপড়া আছে।
কোনোভাবে উনিশ বিশ বুঝিয়ে শান্ত করা যায় না তনুকে। সে অসুস্থ শরীরে কাঁদতে শুরু করে। শরীর সয় না হেলে পড়ে বিছানায়। তবুও কাঁদতে থাকে। নিবেদিতা ডাক্তারকে ফোন করে। খুব রিকুয়েষ্ট করে বাড়ি আসতে। সোহানকেও ডাক পাঠান। সোহান দোকান থেকে হন্তদন্ত ছুটে তনুর কাছে আসে। সোহানের কাছেও তনু জানতে চায় শিল্পের কথা। সোহান বলতে পারেনা কারণ সে জানেই না।
ডাক্তার এলে তনুকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে যায়। উত্তেজিত হতে বারণ করে।
সোহান বাইরে গিয়ে শিল্পের ফোনে কল করে, নট রিচেবল দেখায়। সোহান করিম সাহেবের কাছে ফোন করে জানতে পারে শিল্পের ঢাকা যাবার কথা। ঢাকায় সম্ভাব্য সকলের কাছে কল করতে থাকে। কেউ বিশেষ কোনো খবর দিতে পারেনা। অবশেষে শিল্পের ভার্সিটির এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু জানতে পারে।
শিল্পের খবর জানতে চাইলে বলে, “শিল্পের খবর তো জানি না। ওর সাথে বছরখানেক দেখা নাই।”
“ওহ্। আসলে ও ঢাকা গেছে, ফোনে কানেক্টেড না। ভাবলাম যদি দেখা হয় আপনার সাথে।”
“নারে, ওর সাথে দেখা হয়নি। তুইও তো আসিস না এদিক।”
“যাওয়া হয়না ভাই। ব্যস্ত জীবন।”
“সেই। একটা খবর শুনেছিস?” উৎসাহী কন্ঠ ফোনের ওপাশে।
“কি?”
“আরে তিয়াসা আছে না, শিল্পের এক্স। দুদিন আগে মারা গিয়েছে…শুনছিস?” হঠাৎ এমন ঘটনা শুনে থমকে গেছে সোহান। মুখ দিয়ে কিছু বের করতে পারলো না। ফোনের ওপাশে উত্তরের অপেক্ষা না করেই বক্তব্য চালিয়ে যেতে থাকে।
“রোড এক্সিডেন্ট, সাসপেক্ট করা হচ্ছে সুইসাইড। একদম পিসে দিয়ে গেছে ট্রাক। ইশ অল্প বয়সী মেয়েটা। কতো হাসিখুশি ছিল। ওদের জুটিটা বেস্ট ছিল কিন্তু ভার্সিটিতে।”
“হুম ভাই, আমি পরে কথা বলছি।” বলেই ওপাশ থেকে কোনো কথা না শুনেই ফোন কেটে দেয় সোহান। কোনদিকে না তাকিয়ে হাঁটতে থাকে দোকানের দিকে।
চলবে..
মেহবুবা তানজীম