এক পা দুপা
সিজনঃ ২
পর্বঃ ১৫
“এই রোগ ওর হলো কিভাবে? মানে একদম সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে ছিল তনু।”
“এটাই সমস্যা। ফিজিক্যাল প্রবলেম যতো জলদি আমাদের চোখে পড়ে বা যতো জলদি সেই বিষয়ে তৎপর হই ততোটা খেয়াল আমাদের মেন্টাল হেল্থের প্রতি থাকে। মেন্টাল ডিসঅর্ডার আমাদের কাছে তেমন কিছুই মনে হয় না যতোদিন না এটি বিরাট আকার ধারণ করে। তবে আপনাকে আমি এপ্রসিয়েট করছি আপনি খুব বেশি দেরি করেননি।”
“তার মানে তনু সুস্থ হয়ে উঠবে?”
“সেটা বলা মুশকিল। এই রোগের পেশেন্টদের সাধারণত সুস্থ হবার চান্স থাকে না। তারা প্রতিনিয়ত অবনতি করতে থাকে। আমি আপনাকে কোনো আশা দিতে পারছি না।” শিল্প মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো।
“তার আগের কেস হিস্ট্রি স্টাডি করে জানতে পারলাম সে মাথায় বেশ চোট পেয়েছিল। দুমাসের মতো কোমায় ছিল। তাছাড়া কোনো বিরাট আঘাত মানসিকভাবে তাকে ভেঙে ফেলেছিল। তাছাড়া আমার মনে হয় সে অনেক আগে থেকেই ডিপ্রেশনে ভুগছিল। এতো সবকিছু মস্তিষ্ক কিভাবে বহন করবে বলুন। ডিপ্রেশনে ভোগা রোগীরা সাধারণত এটেনশন সিকার হয়ে থাকে। তারা ভালোবাসা, সিম্প্যাথি খোঁজে। মেন্টালি সিক প্রতিটা রোগীর জন্য এরচেয়ে ভালো কোনো ঔষধ নেই।” শিল্প ছলছল চোখে তাকালো ডক্টরের পানে। অনেক কষ্টে মুখ দিয়ে কিছু শব্দ বের করলো সে।
“এই সমস্যার সমাধান কি ডক্টর?”
“ওইযে বললাম অতিরিক্ত কেয়ার। তাকে বুঝতে দেওয়া হবে না সে রোগী। সবসময় মেন্টালি তাকে খুশি রাখার চেষ্টা করতে হবে। ব্যপারটা কঠিন এবং খুব ধৈর্য্যের। যদি আপনার ওয়াইফের অবস্থার অবনতি হতে থাকে তবে একদিন সে সব ভুলে যাবে। তাছাড়া সে প্রথমদিকে অতীতের কথা স্মরণ রাখতে পারতো না। এখন তার ব্রেন বর্তমানের কোনো স্মৃতি ধরে রাখতে অক্ষম। বুঝতে পারছেন ইটস্ আ ব্যাড সাইন।”
“কিছুই আর করার নেই ডক্টর?” অসহায় চোখে তাকালো শিল্প। ডক্টর ভড়কালেন না। তাঁদের এসব দেখে অভ্যাস আছে। কম বছরের অভিজ্ঞতা তো হলো না। আরো কতো কঠিন কথা তাঁদের বলতে হয়। এমন আকুতিভরা দৃষ্টির সম্মুখীন হাজারবার হয়েছেন জীবনকালে।
“আমাদের যেটুকু করার সাধ্য আমরা তা নিষ্ঠার সাথে করবো। আমাদের হাতে কিছুই নেই। আরো ভয়ংকর পরিস্থিতি হবার আগে আপনারা সাবধান হোন। কিছু ঔষধ দিচ্ছি নিয়ম করে খাওয়াবেন আর আবডেট জানাতে থাকবেন। সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা রাখুন।”
হসপিটাল থেকে বেরিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটছে শিল্প। ফুটপাতে মানুষের অভাব নেই তবুও তার কাছে কেমন নিরব লাগছে। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছে সে। হাঁটতে ক্লান্তিও আসছে না তার। কোলাহলপূর্ণ কিন্তু শান্ত সরোবরে ফোনের শব্দে বাস্তবে পদার্পণ করে শিল্প। শাহেদ সাহেবের ফোন। তাকে পুলিশ স্টেশনে ডাকা হয়েছে। শিল্প নিজেও সেখানেই যেতে চেয়েছিল। রাস্তা থেকেই রিকশা ডেকে উঠে পড়লো শিল্প।
শিল্প যখন শাহেদের রুমে পৌঁছে তখন সে একটি ফাইল মনোযোগ সহকারে দেখতে ব্যস্ত ছিলো। তার নাকের ডগায় চশমা, এ মুহুর্তে তার বয়স খানিকটা বেশিই মনে হচ্ছিল। শিল্প তাকে এর আগে চশমা ব্যবহার করতে দেখেনি।
“চশমা ব্যবহার করেন দেখছি।”
“আরেহ্ আসুন আসুন। সে আরকি কিছু পড়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার করি।” শাহেদ হাতের ফাইলটা রেখে চশমাটা খুব সাবধানে বাক্সে ভরে রাখলো। তার রাখার ধরণটা এমন যেন খুব আপন কিছু আগলে রাখছে। শিল্প অবাক হলো।
“খুব প্রিয় বুঝি?” প্রশ্নে শিল্পের মুখের দিকে তাকালো শাহেদ। তারপর চশমার বাক্সটার দিকে একনজরে তাকিয়ে থাকলো। মুখে মৃদু হাসি, হাসি দুখের না সুখের বোঝা গেলো না তবে তাকে খানিক অমনোযোগী দেখালো। হতে পারে সে মনোযোগী তবে অন্য কোনো জগত নিয়ে। এক মিনিটের মতো নিঃস্তব্ধতার মাঝে কাটলো। বাইরে কোনো পাখির শব্দে ধ্যান ভঙ্গ হলো শাহদের। সে শুধু এটুকু উচ্চারণ করলো, “হুম প্রিয়, খুব প্রিয়।” তারপর হাত থেকে বাক্সটা টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিলো। শাহেদের কথা, গম্ভীরতায় শিল্প কল্পনা করলো কোনো লাল পাড়ের শাড়ি পরা রমণীকে যে রমণী গভীর স্নিগ্ধতায় চশমাটি দিচ্ছে শাহেদকে। হয়তো সে-কারণেই বহু জিনিসের মাঝে এ সামান্য জিনিসটি বহুল প্রিয়। আবার অন্য কোনো কাহিনীও থাকতে পারে। থাকা অবাস্তব কিছু নয়। প্রতিটি মানুষের জীবন একেকটি উপন্যাস, মানুষের জীবন নিয়েই তো তৈরি হয় ইতিহাস।
“তারপর বলুন কি আসলো ম্যাডামের রিপোর্টে।”
ভাবনারা অধিক ডানা মেলতে পারলো না। এবার উদাসীন হবার পালা শিল্পের। তাকে দুঃখী দুঃখী দেখালো। শুকনো মুখ যেন আরো শুকিয়ে গেলো।
“খবর ভালো না।”
“ভালো না বলতে।” টেবিলের উপর দুহাত রেখে মনোযোগী ভঙ্গিতে বসলো শাহেদ। শিল্প তখন নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব জোর করে চোখে আসা জলগুলোকে শাসন করছে।
“বলুন।” আবারো বললো শাহেদ।
“তনু মেন্টাল ডিসঅর্ডারে ভুগছে।” অনেক কষ্টে এটুকু বলতে পারলো শিল্প। মাঝে আঁটকে যাচ্ছিল তার স্বর।
“মানে!”
“ডিমেনশিয়া।” ডাক্তারের বলা প্রতিটা কথা খুব ধিরে ধিরে শাহেদের কাছে পেশ করলো শিল্প।
“ভুলে যাওয়া রোগ! এ কেমন রোগ!” শাহেদ বললো।
“রোগ তো রোগই, রোগের কাজই অস্বাভাবিকতা।”
“তা ঠিক তা ঠিক।” শাহেদ একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো। কিছু ভাবলো। তারপর বললো,
“তার মানে সে মাঝে মাঝে কিছু মনে রাখতে পারবে, আবার ভুলেও যাবে মানে কোনো সিরিয়াল থাকবে না তার চিন্তার তার মনে রাখার।”
“না, এটা শুধু তার মস্তিষ্কের কারসাজী, তা যে অংশ তাকে মনে রাখাবে তাই তার মনে থাকবে।” ক্লান্ত মুসাফিরের ন্যায় বাক্যব্যয় ঘটলো শিল্পের। এ রোগ ভয়ংকর, একটা সময় সব ভুলে যাবে তনু, সব, তাকেও ভুলে যাবে হয়তো। হয়তো কি, ভুলে তো গেছিলো, হয়তো একদিন একেবারে ভুলে যাবে। সত্যি কি অদ্ভুত। ফোনের শব্দে দ্বিতীয়বার ধ্যান ভাঙলো শিল্পের।
“হ্যালো।”
অপর পাশ থেকে জোরে নিঃশ্বাসের শব্দ। শিল্পের কপাল চিন্তায় ভাঁজ হয়ে এলো।
“কি হয়েছে কথা বলছো না কেনো?” রাকা নিজেকে সামলিয়ে বললো, “ভাই তনু রুমে নেই।” তার কন্ঠে ভয়, উদ্বেগ দেখা দিলো।
“নেই মানে!”
“মানে রুমেই ছিল কিন্তু….”
“কিন্তু কি?”
“কথা শেষ করতে দাও। কিন্তু আমি কাজ শেষে এসে দেখি ও রুমে নেই।”
“কোথায় গেছে ও?”
“জানিনা। আমি ওকে শেষবার রুমেই দেখেছি।”
শিল্প ফোন নামিয়ে রাখলো। বর্তমানে শোনার মতো আর কিছুই নেই। প্রথমে মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করলো সে।
“কি হলো?” উদ্বিগ্ন কন্ঠে জানতে চাইলো শাহেদ।
“তনু রুমে নেই।”
“মানে কি! তাহলে সে গেলো কোথায়?”
“জানিনা।”
“আরে মিয়া জানিনা বলে বসে থাকলে চলবে নাকি। চলুন খুঁজতে হবে। তার জীবনের রিস্ক আছে বহুত।”
দুজনেই বেরিয়ে পরলো খুঁজতে। বের তো হলো কিন্তু খুঁজবে কোথায়। দুনিয়া নেহাৎ ছোট নয় যদি কেউ ইচ্ছে করে হারায় অথবা ইচ্ছে করে তাকে লুকিয়ে রাখা হয়। তনুর সাথে কোনটা ঘটেছে সেটাও ভাববার বিষয়।
চলবে……..
মেহবুবা তানজীম