এক পা দুপা
সিজনঃ ২
পর্বঃ ১

আজ শিল্পের খুব খুশির দিন। শেষরাত্রি থেকে মসজিদে পড়ে আছে সে। শুকরিয়া সেজদা যেন শেষই হচ্ছে না। এতোদিনের সাধনা এই বুঝি ফলপ্রসূ হলো। সকাল হয়ে এসেছে। মাথার টুপি পকেটে পুরে বেরিয়ে আসতে নিলে ইমামের সাথে দেখা হয়ে যায়।

“আসসালামু আলাইকুম, চাচা।”
“ওআলাইকুমুসসালাম, বেটাকে আজ খুশি খুশি লাগছে।”
“জ্বি চাচা, আলহামদুলিল্লাহ আজ আমি খুব খুশি। চাচা দীর্ঘ দুমাস পর তনু রেসপন্স করেছে। আমি..আমি খুব খুশি চাচা।”
“আলহামদুলিল্লাহ খুশির সংবাদ।”
“জ্বি চাচা, আল্লাহ আমার ডাক শুনেছে।”
“আল্লাহ পরম দয়ালু।” শিল্প সদ্য ফুটন্ত পুষ্পের মতো ঝিলিক দিচ্ছে। বেরিয়ে পড়লো সে।

হসপিটাল যাবার পথে মিষ্টি কিনতে মন চাইলো শিল্পের, কিছু গরীব মানুষকে খাওয়াতে। পকেটে হাত দিয়ে একশো টাকার নোট বের হলো, মাত্র একশো টাকার। নিজের ইচ্ছাকে বগলদাবা করে ফিরে এলো হাসপাতালে।

“প্রভাতে কিরণ রাশি, রক্তিম নরম লাল।
পূর্ণিমা তিথির ভরা মাসে, রাতটা আমার আর প্রিয়তমার।”

কেবিনের বাইরে নিবেদিতাকে অপেক্ষমাণ দেখে সালাম দিলো শিল্প।
“আসসালামু আলাইকুম, মা।”
“ওআলাইকুমুসসালাম, তনুর কি অবস্থা?”
“মা ও ধিরে ধিরে রেসপন্স করছে। ডাক্তার বলেছেন আমরা খুব জলদি ভালো কিছুর আশা রাখতে পারি।”
“আলহামদুলিল্লাহ।” নিবেদিতার মুখ থেকে তবুও করুণ ছায়া সরলো না। কেমন উসখুস করতে দেখা গেল তাকে।
“কিছু বলবেন মা?”
“হ্যাঁ..বলছিলাম যে, হসপিটালের ফিস কতো বাকি আছে।” শিল্পের মুখের আলো নিভে গেলো।
“তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না মা। আমি আছিতো সব সামলে নিবো।”

“সামলে নিবো বললেই তো হয়না। আমার কাছে বিশের মতো আছে। এটা রাখো।” নিবেদিতা ব্যাগ থেকে টাকাগুলো বের করে দিলো। শিল্প নিতে না চেয়েও নিতে হলো। সত্যি টাকার খুব প্রয়োজন এখন।
“এ-র বেশি এখন নেই। সামনের মানের বেতন পেলে দিতে পারবো কিছু।” শিল্প মাথা নিচু করেই আছে। সেভাবেই বললো, “এতো চিন্তা করবেন না মা। আমি ব্যবস্থা করছি টাকার।”

“কোথা থেকে করবে ব্যবস্থা? তোমার বাবার ব্যবসা নিলামে উঠেছে, অন্তঃসারশূন্য অবস্থা। মায়ের গহনা একটাও নেই, যেটুকু জমি ছিলো সব বিক্রি করে দিচ্ছো। এখন কি বাড়ি বেঁচবে?” শিল্প তখনও মাটির দিকে তাকিয়ে। ঝাপসা চোখে টাইলসের চকচকে পাকা দেখছে। কি আশ্চর্য! টাইলসের ঝকঝকে ফ্লোরে ঝাপসা মুখশ্রী দেখা যায়।

“কি হলো কথা বলো।”
“আমি এখনো কিছু ভাবিনি।”
“তোমাকে কতো করে বললাম প্রাইভেট হসিপটালে এডমিট করার দরকার নেই। সরকারিতেই থাক। শুনলে না তো। প্রাইভেটের ভার বহন কি এতোই সোজা।”
“আল্লাহ আমার শক্তি মা। নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত সব খুয়িয়েও করতে চাই।” নিবেদিতা নিরাশ হলেন।
“যেমন তোমার ইচ্ছা।”
“এখন তো তনু সুস্থ হচ্ছে তাহলে কেনো চিন্তা করছেন।” শিল্পের শুষ্ক মুখে একফালি চাঁদের দেখা মিলল। নিবেদিতা দেখলেন ভেতর থেকে ভেঙে পড়া একটি ছেলের নিজেকে টিকে রাখার চেষ্টা।
“আল্লাহর কাছে সেটাই চাওয়া।” নিবেদিতা দরজা থেকে তনুর মুখের দিকে তাকালেন। মেয়েটার অবস্থার জন্য তাঁর কি কোনো দোষ নেই? অবশ্যই আছে। বিরাট দোষ, ঠিক ব্যকরণের গুরুচন্ডালী দোষের মতো, বাক্য লিখছি কিন্তু সঠিক হচ্ছে না। তেমনি সে মা হয়েছে কিন্তু সঠিক পালন করতে পারছে না, আর না পেরেছে।

নিবেদিতা চলে যেতেই কেবিনে প্রবেশ করলো শিল্প। তনুর নিথর দেহ, চারিপাশে যন্ত্রপাতিতে ভরা। টিভি স্ক্রিনে চলমান বক্ররেখা জীবনের প্রমাণ বহন করছে। টুল টেনে পাশে বসলো। তনুর শুষ্ক মুখ, শরীর বেডের সাথে লাগোয়া। মেয়েটাকে দেখলে ভেতর থেকে শুধু দীর্ঘশ্বাস আর পুরোনো পাপের ক্ষত পরিলক্ষিত হয়। মানুষ কেনো পাপ করে? কেন? পাপের ঝোলা ভরতে সময় লাগেনা, সময় লাগে খন্ডাতে।

তনুর হাত ধরে বসে থাকলো শিল্প। জানালা দিয়ে আসা রোদ ধিরে ধিরে সরে যাচ্ছে দুরে, বেলা বাড়ছে। তনুর হাতে আঙুল নড়ে উঠতেই চমকে উঠলো শিল্প। শক্ত করে ধরলো নড়ে ওঠা আঙুলটাকে, আশা করলো আরো উন্নতির। ভাবলো এই বুঝি চোখ মেললো তনু। কিন্তু না হয়তো এখনো সময় হয়নি ঘুম ভাঙার। তনুর আঙুল নিজের কপালে ঠেকিয়ে ছলছল করে উঠলো দুচোখ। বললো, “ফিরে এসো তনু, ফিরে এসো।”
দশটার পরে রাউন্ডে এলো ডক্টর। নিজের মতো করে চেকআপ করে শিল্পকে ডাকলো একটু দুরে।

“আমি ধারণা করছি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হবার সম্ভাবনা আছে আপনার ওয়াইফের। তার রেসপন্স বাড়ছে।”
“জ্বি একটু আগে ওর আঙুল নড়ে উঠেছিল।” উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো শিল্প। আজ তাকে খানিক প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে।
“হবার ছিল, বলেছিলাম আপনার ওয়াইফের ভেজিটেটিভ স্টেট। অর্থাৎ তার মস্তিষ্ক সচল আছে কিন্তু চেতনা শক্তি নেই। নিজে কিছু করার শক্তি নেই।”
“আমি প্রতিনিয়ত ওর সাথে কথা বলতাম। কোরআন পড়তাম। চেষ্টা করতাম যতোটুকু করা যায়।”
“আমি জানি আপনার চেষ্টা। আল্লাহ আপনার সহায় হোন।” ডক্টর একটু থামলেন।

“কিন্তু মি.ইউসুফ হসপিটাল ফি বাকি পড়ছে দিনদিন। আপনি পরিচিত হওয়ায় আমরা কন্সিডার করছি তবে সেটা বেশিদিন সম্ভব নয়। আপনি প্লিজ টাকার ব্যবস্থা করুন।”
“আমি চেষ্টা করছি। খুব জলদি ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
“মুখের কথায় এখানে কিছু হয়না ইউসুফ সাহেব এখানে পয়সা আগে। আজকের মধ্যে পরিশোধের চেষ্টা করুন নয়তো হসপিটাল অথরিটি কোনো ব্যবস্থা নিবেন।”
ডক্টর চলে যেতেই ক্লান্তপ্রাণ শিল্প দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। জোরে জোরে বার কয়েক শ্বাস নিলো। কবে থেকে শান্তির শ্বাস ছাড়া হয়নি। কেবিনে প্রবেশ করে রোজাকে হসপিটাল আসার কথা জানালো। সে এখন টাকার খোঁজে বের হবে। এপর্যন্ত কম মানুষের কাছে ধার করা হয়নি, যাদের কাছে ধার করেছে তাদের ঋণ আজও শোধ হয়নি। তাদের কাছ থেকে সেহেতু কোনো সাহায্য পাবার আশা নেই। শেষ জমিটুকু বিক্রি বাকি আছে তাও বায়না দিয়ে রেখেছে। বিপদের দিনে মানসম্মত খদ্দেরও অভাব। এই তো সুযোগ তাদেরও।

কিছুসময় তনুর পাশে বসে রইলো শিল্প। মাথায় হাজারো চিন্তা। তফাতে আবারো উঁকিঝুঁকি দেয় না জানি জ্ঞান ফিরলে তনুর আচরণ কেমন হবে।
রোজা আসতেই শিল্প বেরিয়ে পড়লো সোহানের দোকানের উদ্দেশ্যে। ছেলেটা আজও ঠিকঠাক কথা বলেনা তার সাথে। বন্ধুর এমন বিমুখী ভাব সত্যি এতো চাপে সহ্য করা কঠিন। তাই বলে যে সাহায্যের হাত দুরে রেখেছে তেমনটাও না।

“সোহান।” সোহান তখন খরিদ্দারের সাথে দরদামে ব্যস্ত। শিল্পকে বসার জন্য ইশারা করল খালি। শিল্প সেখানেই মাথা নামিয়ে বসে থাকলো। কথার ফাঁকে ফাঁকে একদুবার শিল্পের দিকে তাকালো সোহান। শিল্পের ভগ্নদশাও তার মন গলাতে পারেনি।
“কি বলবি বল জলদি, কাজ আছে।” শিল্পের দিকে না তাকিয়েই বললো সে। শিল্প একটু কষ্ট পেলো। বলতে গেলো কষ্টের ঘায়ে আঁচ পড়লো।

“তনুর অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। কাল রাত থেকে ও রেসপন্স করছে।”
“আলহামদুলিল্লাহ, সত্যি?” ছলছল চোখে মাথা নাড়ালো শিল্প।
“অনেক বড় সংবাদ দিলি। আল্লাহ হয়তো ক্ষমা পাবার পথ করে দিলেন।” শিল্প আবারো মাথা নামিয়ে নিলো।
“বারে বারে মাথা নামাবি না তো ভালো লাগেনা। টাকা পয়সার কি অবস্থা?” বিরক্ত হয়ে বললো সোহান।
“যা জমিয়েছি তা বাদে দেড় লাখের মতো বাকি এখনো। জমির খবর আসেনি। খদ্দের ভালো মিলছে না।”
“এখন অতো ভাবলে চলবে?”
“তাই বলে দশ লাখের জমি পাঁচ ছয়ে দিয়ে দিবো। পরে যদি টাকার প্রয়োজন পড়ে।”
“সেও কথা।” চিন্তার পড়লো সোহান।

“আচ্ছা দেখছি আমি পারি কিনা কিছু। তুই কোথায় যাবি এখন?”
“দেখি।” শিল্প উঠে পড়লো।
“চা খেয়ে যা, খেয়েছিস কিছু?” শিল্পের কানে বোধহয় কিছুই গেলো না। সে হাঁটতে থাকলো অন্তহীন।

“আপনার বন্ধু কোনদিন জানি স্টোক কইরা মরবো।” সোহান এক কর্মচারীর কথায় চমকে ওঠে।
“কি কস? কাম কর।” ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেও নিজের ভেতর অশান্তি লাগছে।

শিল্প রাস্তা ধরে হাঁটছে। হাতে স্থায়ী কোনো কাজ নেই। তাও টুকিটাকি পার্ট টাইম জব করে থাকে। স্থায়ী কোনো কাজে লাগতে পারছে না বর্তমানে। তনুর দেখাশোনা বেশি জরুরী। বাবার ব্যবসা একদম শেষ। সব শেয়ার বেঁচে দিয়েছে। কোনো পথ নেই উঠে দাঁড়াবার। নিজেও এখন অসুস্থ, হতাশাগ্রস্ত মন নিয়ে বিছানাগত। মায়ের অবস্থাও সমীচীন নয়। অপরাধবোধ গলগ্রহ আটকে আছে। না পারছে গিলতে না পারছে ফেলতে। কোনো ছিন্নভিন্ন গরীবের থেকে ভালো অবস্থায় নেই তারা। এতো কিছুর মাঝে একটা খুশির সংবাদ তনুর রেসপন্স। আর বেশি সময় গেলে চিকিৎসার খরচ ওঠানো সম্ভব হবে না হয়তো। হয়তো একদিন তনুর চিকিৎসা করার সামর্থ্য থাকবে না। সেই হয়তো দিনের কথা ভাবতে চায় না শিল্প।

আজও কাজের উদ্দেশ্যে হাঁটছে শিল্প। একটি রেস্টুরেন্টে ওয়েটার পদে। সে কাজ না করলে বাড়ির সকলকে না খেয়ে মরতে হবে। সময়ের সাথে সাথে আপনজন সবাই পিছনে সরে গেছে। পর কখনো আপন হয়না শুনেছিল কিন্তু আপনজনও যে পর হয়ে যায় তার কি।
মাথার উপর তপ্ত আকাশ ব্যতীত পায়ের নিচে শক্ত মাটি নেই। জীবনে এমন কোনদিন দেখতে হবে সে কি কখনো ভেবেছিল?

চলবে…
মেহবুবা তানজীম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here