একা_বেঁচে_থাকতে_শেখো_প্রিয়
#পর্ব_৯
##Adharer_Musafir (ইফ্ফাত)
বিছানায় বসে পাশে থাকা টেবিল থেকে রবী ঠাঁকুরের মালঞ্চ উপন্যাসটা হাতে নিলাম।
কতদিন যে এ বইয়ের উপর হাতের ছোঁয়া লাগে নি সেটা ধুলো বালিই বলে দিচ্ছে।
উনার মতো সাদামাটা মানুষও যে সাহিত্যের প্রেমে পড়বে তা আমার ধারনারও বাইরে ছিলো।
— তুই আমার রুমে কি করছিস?
ধুলো বালি পরিষ্কার করে বইয়ের প্রথম পৃষ্টা উল্টাতেই পেছন থেকে পরিচিত কণ্ঠে আমার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো।
আপনা আপনিই কাঁপছে আমার শরীর।
চোখ বন্ধ করে শক্ত করে বইটা ধরে আছি আমি।
উনি নিঃশব্দে আস্তে আস্তে আমার সামনে আসতেই আমি তড়িৎ গতিতে দাঁড়িয়ে গেলাম।
ততক্ষণে উনি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন।
কি করবো না করবো ভাবতে ভাবতেই কিছু সময় পেরিয়ে গেলো।
উনিও কথা বলছেন না আমিও চুপ করে আছি।
কেউ আমাদের দেখে ফেললে কি হবে! কি জবাব দেবো আমি।
কেমন এক অদ্ভুত শিহরণ কাজ করছে আমার শরীরে।
এমনটা সচারচর আমার একদমই হয়না।
উনি আশে পাশে থাকলেই কেবল এমনটা হয়।
শক্ত মলাটের বইটা ধরে সেই কখন থেকে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির দিকে তাকিয়ে আঙুল নেড়ে যাচ্ছি আমি।
আচ্ছা উনি কি আজকে বোবা হয়ে গেলেন নাকি?
প্রায় মিনিট পাঁচে’ক হতে চললো অথচ উনার মুখে একটা কথাও নেই।
রেনু আপু চলে যাওয়ার শোক কি উনার এখনও কাটে নি?
নাহ্ আর ধৈর্য্য রাখতে পারছি না, আবার চলে যাওয়ার সাহসটাও যোগাতে পারছি না।
কি এক ঝামেলা, আরে বাবা কিছু তো অন্তত বলুক।
— বললি না যে! আমার রুমে কি করছিস?
যাক বাবা, অবশেষে উনার মুখে বুলি ফুটলো।
কিন্তু উনার এই পাহাড় সমতুল্য ভারি প্রশ্নের এখন কি জবাব দেবো আমি?
ভাবতে ভাবতেই দ্রুত ঘুরতে থাকা ফ্যানের নিচে থেকেও ঘাম বের হয়ে যাচ্ছে আমার।
আমতা আমতা করে মুখে কথা রেখেই উনাকে বললাম–
বই.. বই.. টা নিতে এসেছিলাম।
আমার জবাবটা বোধহয় উনার মোটেও পছন্দ হয়নি।
আমার কথা শেষ হতেই উনার শব্দ করে হাসির আওয়াজ শুনতে পেলাম।
আড় চোখে তাকিয়ে দেখি উনি আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসছেন।
কি এমন বলেছি যার জন্য এভাবে হাসতে হবে?
আচ্ছা উনার জন্মই কি হয়েছে আমাকে লজ্জা দেয়ার জন্য?
হাসি থামিয়ে উনি আমাকে বললেন–
— বইটা এই রুমেই আছে সেটা জানলি কি করে?
মহা বিপদে পড়ে গেলাম আমি।
কি জবাব দেবো এখন!
রুমে এসেছি তাতে কি এমন হয়েছে?
কোনো জিনিস চুরে করে নিয়ে যাচ্ছি কি?
এভাবে কেনো জেরা করছেন উনি!
ইচ্ছে করছে নিজের মাথার চুল টেনে টেনে ছিড়ে ফেলি, কেনো যে আসতে গেলাম উনার রুমে।
আমার হাত থেকে বইটা নিয়ে উনি পাশের টেবিলে রেখে দিলেন।
অগোছালো ময়লা কাপড়গুলো আলমিরার ভেতর গুজে রেখে চেয়ার টেনে আমার সামনে বসে পড়লেন।
দু’হাত মাথার পেছনে রেখে আমাকে বিছানায় বসতে বললেন।
এক মুহূর্তের জন্য দ্বীধায় ভুগলেও পরমুহূর্তেই আমি কথা না বাড়িয়ে উনার বিছানায় বসে পড়লাম।
দু’হাত পাশে রেখে মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছি আমি।
উনি কি বলবেন সেটাই শোনার অপেক্ষা।
এক গাল হেসে উনি আমাকে বললেন–
— তখন রেনু আপুর রুমে ওভাবে চিৎকার করে কথা বললি কেনো?
এবারও আমি চুপ করে আছি।
উনি সত্যিই একটা উজবুক।
কোথায় কি প্রশ্ন করতে হবে একদমই জানা নেই উনার।
এখন বুঝি এমন প্রশ্ন করার সময়?
ওমম এখন প্রশ্ন করার কথা–
-তোরা কবে ফিরে যাচ্ছিস?
-যাবার সময় কি আমি তোদেরকে পৌছে দেবো?
-আজকে রেনু আপুর বিয়েতে কেমন মজা করলি?
-ভালো মতো খেয়েছিস তো?
-সেদিনের চকলেট গুলি সব শেষ করেছিস তো? নাকি এখনও বাকি আছে?
তা না করে আজকে কেনো এমন করলাম সে নিয়ে পরে আছেন।
ধ্যাৎ নিজের ভাবনায় নিজেরই হাসি পাচ্ছে আমার।
চেয়ার থেকে পিঠ আলগা করে একটু ঝুঁকে এসে উনি আমাকে বললেন —
একটা কথা বলতো উপমা, তোর আমা….
সবটা কথা শেষ করতে পারলেন না উনি।
তার আগেই বাহির থেকে মা আমাকে ডাকতে থাকে।
কোথাও না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে না এখানে চলে আসে; তখন আবার যাচ্ছে তাই কথা শুনতে হবে আমাকে।
উনার দিকে তাকিয়ে দেখি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
ইশশ না জানি কি বলতে চাইছিলেন উনি!
তবে আজ হাতে একদমই সময় নেই আমার।
আর সময় নষ্ট না করে দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম আমি।
দৌড়ে দরজার কাছে আসতেই উনি বললেন–
— বইটা নিয়ে যা।
টেবিল থেকে বইটা এনে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন উনি।
একবার উনার দিকে তাকিয়ে হাত থেকে বইটা নিয়ে চলে এলাম উনার রুম থেকে।
রুমে এসে কিছুই ভালো লাগছে না আমার।
বইটা দেয়ার সময়ও উনার চেহারায় কিছু বলতে না পারার ব্যর্থতা স্পষ্ট ফুটে উঠেছিলো।
ইশশ মা আমাকে ডাকার আর সময় পেলো না?
আর একটু দেরিতে ডাকলে কি এমন মহাভারত অসুদ্ধ হয়ে যেতো?
🥀
🥀
🥀
বাবা মা খালামনি খালুজি আর রেহান ভাইয়া ডাইনিং এ বসে সেই কখন থেকে কথা বলে যাচ্ছে।
রাফি ভাইয়া রেনু আপু চলে যাওয়ার পর ফোন কানে রেখে সেই যে বাড়ির বাইরে গেলেন আর আসার নাম নেই।
এদিকে উম্মি বিছানায় বসে কানে হ্যাডফোন দিয়ে মনোযোগ সহকারে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি টিভির সাউন্ড কমিয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করছি ডাইনিং-এ সবাই কি নিয়ে কথা বলছে।
বাবার কণ্ঠ স্পষ্ট এই রুম থেকে শুনতে পাচ্ছি আমি।
খুব কড়া না হলেও কিছুটা গম্ভির গলায় রেহান ভাইয়ার উদ্দেশ্যেই কথা বলছেন।
— বয়স তো আর কম হলো না, এবার তুমিও একটা ভালো চাকরি দেখো।
রেনু তো চলেই গেলো, এবার হয়তো তোমার বাবা তোমাকে বিয়ে দেবে।
ভবিষ্যতের জন্য কিছু ভেবেছো রেহান?
যেই বেসরকারি সাংবাদিকের চাকরিটা করছো তাতে তোমার ভবিষ্যতের কতটুকু উন্নতি হবে জানিনা, তবে এই চাকরি দিয়ে বেশি দূর আগাতে পারবেনা এতটুকু আমার অভিজ্ঞতা বলছে।
যদিও তোমার জীবনের ব্যাপারে আমার হস্তক্ষেপ করা ঠিক না।
তবুও অভিভাবক হিসেবে এইটুকু পরামর্শ হিসেবে বলতেই পারি।
তোমার ভালো চাই, ভবিষ্যতে যেনো ভালো কিছু করো সেই দো’য়াই সব সময় করি।
তোমার বাবার বয়স হয়েছে, সহজ সরল মানুষ উনি।
দুনিয়া সম্পর্কে ধারনা বাকি আট দশটা মানুষ থেকে একটু কম।
তাছাড়া বাবা হয়ে ছেলেকে সব কথা মুখে বলাও যায়না।
রাফির কথাই বলি, পড়াশোনার পাশাপাশি পার্ট টাইম জব করছে।
মাসে মাসে নিজের জন্য রেখে পরিবারে কিছু টাকাও দিচ্ছে।
সেখানে তোমার চাকরির টাকাটা দিয়ে তোমার নিজেরই চলছে না।
দেখো রেহান, আমরা শুরু থেকেই তোমাদের পাশে থেকেছি সব সময়ই থাকবো।
অনেক তো হলো, এবার নিজের জন্যও একটু চিন্তা করো।
এভাবে চলতে থাকলে কোনো বাবা তার মেয়ে দিবে না।
সুন্দর করে খোঁচা দিয়ে কথা বলাটা আমার বাবার একটা বাতিক।
আমাকে এ’জীবনে যতবারই এভাবে কথা বলেছে ততবারই চুপ করে ছিলাম।
কোনোদিনই কিছু বলিনি আমি।
কিন্তু আজকে রেহান ভাইয়াকে চাকরির খোঁচা দিয়ে এতোগুলো কথা শুনিয়ে দেয়াটা আমার মোটেও পছন্দ হয়নি।
খালামনি খালুজি খুবই সহজ সরল, এক প্রকার আমার বাবা মায়ের কথাতেই উঠে আর বসে।
সহজ ভাষায় বললে অন্ধ বিশ্বাস টাইপ কিছু।
উনারা বাবার এই খোঁচা মারা কথায় আঘাত পাবেন এমন মনে করাও হাস্যকর।
উল্টো তারাও রেহান ভাইয়ার দিকে কেমন করে তাকাচ্ছেন।
মা-ও কিছু বলছেন না, বরং বাবার কথায় সায় দিয়ে যাচ্ছেন।
রেহান ভাইয়া চুপ করে আছেন।
আমি বুঝতে পারছিনা কেনো উনি কিছু বলছেন না?
উনার জীবন উনি সীদ্ধান্ত নিবেন কি করবেন না করবেন।
কিন্তু না, এই বেহায়া ছেলেটা বাবার কথা শুনে মুচকি হাসছেন।
কবি সম্রাট বলেছিলেন- মানুষ নাকি কষ্টেও হাসতে জানে, তবে সে হাসিতে কেবল নিজেকেই ব্যাঙ্গ করে বসে।
মনে চাইছে উনাকে ধরে বাবার সামনে এনে বলি- “কেনো বসে বসে গিলছেন আপনি? কিছু বলছেন না কেনো?”
রেহান ভাইয়ার বয়সটাও কম হয়নি।
ঊনত্রিশ পেরিয়ে ত্রিশ-এ এসে পরেছে।
বর্তমান হিসেবে দেখলে বিয়ের সময় প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছে।
সেদিক থেকে উনি পড়াশোনা শেষ করে সামান্য অংকের একটা চাকরি করেন মাত্র, একদিন তো শুনেছিলাম সেটাও নাকি ছেড়ে দিয়েছেন।
এক কথায় বলতে গেলে এখন উনি প্রায় বেকার।
আচ্ছা ভালোবাসাটা কি বয়সে হয়? না, একদমই না। এটাতো স্বর্গ থেকে আসা সৃষ্টিকর্তার সব থেকে সুন্দর উপহার।
তাই বলে বেকারদের কি মন বলতে কিছু নেই?
বেকার বলে যাচ্ছে তাই শুনিয়ে দেবে?
আচ্ছা উনি তো ভালো চাকরির চেষ্টা করছেন, তবুও কেনো এতো কথা শুনতে হচ্ছে উনাকে?
সব দিক থেকে অবহেলাটা কি তবে উনি বেকার বলেই?
দু’চোখে আমার পানির আভাস।
পর্দা ছেড়ে চলে এলাম রুমের বাড়ান্দায়।
ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে রেহান ভাইয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলি–
“আপনার কোনো চিন্তা নেই রেহান ভাইয়া, আমি আছি আপনার পাশে সারাজীবন।
বাবার কথায় একটুও মন খারাপ করবেন না।
বাবা এমনই, সবাইকে খোঁচা দিয়ে কথা বলেন।
নিজের চাকরির দেমাগ দেখিয়ে বেড়ান।
আমি ভালোবাসি আপনাকে; আর কারো প্রয়োজন নেই আপনার, শুনছেন আপনি?”
খুব ইচ্ছে করছে উনাকে এই কথাগুলো বলতে।
দু’চোখের পানি মুছতেই আবার চোখ ভরে যাচ্ছে আমার, কি করবো আমি?
কাকে বলে বোঝাবো আমার অনূভুতিগুলো কেমন?
🥀
সকালে নাস্তা না করেই শুয়ে আছি আমি।
মনটা আজকে ভীষন খারাপ।
বাবার কথা শুনে আমার মনেরই এই অবস্থা রেহান ভাইয়া কেমন আছেন কে জানে।
উম্মিকে দিয়ে একবার মা আমাকে নাস্তা করে যেতে বলেছে।
না করে দিয়েছি, কোনো মুখে খাবার খাবো আমি?
রেহান ভাইয়াকে বলা বাবার কঠিন কথাগুলো এখনও আমার কানে ঢোলের মতো বেজে যাচ্ছে।
ইশশ সকলের সামনে কি নিচুটাই না হতে হয়েছে রেহান ভাইয়াকে।
বিকেলের শুরুতেই মা খালামনি উম্মি আমি আজিমপুর ঘুরতে বের হয়েছি।
খালামনি রেহান ভাইয়াকে অনেকবার আমাদের সাথে আসতে বলেছেন, উনি আসেন নি।
কি এমন হতো এলে? হয়তো লজ্জা পাচ্ছেন মায়ের সামনে আসতে।
আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে উনাকে।
কাল রাতের পর আর একবারও রেহান ভাইয়াকে চোখের দেখা দেখিনি আমি।
খারাপ লাগলেও আমার আফসোস হচ্ছেনা মোটেও।
ভালোবাসাটা তো এমনই, কখনওবা প্রিয় মানুষটাকে চোখে না দেখলেও দূর থেকে তাকে অনুভব করা যায়।
আর এমন ভালোবাসাগুলোয় ঐ যে প্রবাদে থাকে না- “চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল” প্রশ্নই আসে না।
উল্টো দূরে থাকায় ভালোবাসাটা আরো গাঢ় হয়।
🥀
ঠিক সন্ধ্যে নামার আগের মুহূর্তটায় আমি ছাঁদের রেলিং ঘেষে দাঁড়ায়ে আছি।
এই সময়ের আকাশের ঐ যে রক্তিম আভাটা, তার সাথে আমার খুব সখ্যতা সেই হোস্টেলের শুরু থেকেই।
কাক আর নাম না জানা পাখিগুলো যখন রক্তাক্ত আকাশের নিচ দিয়ে নিড়ে ফিরে যায়, সে দৃশ্য বরাবরই আমার জন্য বেদনাদায়ক।
নিড় থাকা সত্বেও সদ্য উড়তে শেখা পাখি যখন অচেনা আকাশে হারিয়ে যায়, তখন নিজেকে আর একা মনে হয়না।
মনে হয় আমার মতোও কেউ আছে, মানুষ না হোক পাখি তো আছে।
সব কিছু থাকা সত্বেও যে পাখি হারিয়ে যায়, দিন শেষে নিড়ে আর ফিরতে পারে না সে পাখিকে খুব আপন মনে হয় আমার।
মনে হয় তারাও আমার মতো একা বাঁচতে শিখছে।
রক্তিম আকাশের নিচে ছাঁদের কার্ণিশে এসে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যের আলো আঁধারের খেলায় যখন আমি মনের জমানো সব আবেগ বিসর্জন দিতে ব্যস্ত, তখনই ছাঁদে কোনো মানবের অস্তিত্ত অনুভব করি।
মনে হচ্ছে কেউ একজন খুব ধিরে ধিরে পা ফেলে আমার কাছে আসার চেষ্টায় মনোযোগী।
যদিও ব্যস্ত শহর, তবুও সন্ধ্যে নামার পরের একটা ক্ষীণ ভয় মনে এসে ক্ষনিকের জন্য বাসা বাঁধলো।
দ্রুত ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য আমি চমকে উঠলাম।
যাকে আশা করেছিলাম সে তো নয় বরং…..
চলবে…