#একা_বেঁচে_থাকতে_শেখো_প্রিয়
#পর্ব_৮
#Adharer_Musafir (ইফ্ফাত)
বসে বসে খুনসুটি মূলক কথা-বার্তা শুনছেন রেনু আপু।
পাশে দাঁড়িয়ে আমি সেসব দেখে মুচকি হাসছি।
ইশশ লজ্জায় রেনু আপু লাল হয়ে গেছেন।
একটু পর প্রায় বেশ কয়েকজন মহিলা রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই রেহান ভাইয়া কাজি সহ রেনু আপুর রুমে প্রবেশ করলেন।
এখনই হয়তো কবুল বলবেন রেনু আপু।
রেনু আপুর কাছে গিয়ে বসতে যাবো তার আগেই রেহান ভাইয়া আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন।
উনি আসতেই আমার পা থেমে গেলো।
না সরে আসতে পারছি আর না দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি।
চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে আছি আমি।
উনি একটু কেশে বললেন–
— উপমা, তোকে তো আজ খুব সুন্দর লাগছে। পার্লারের সব প্রডাক্ট আজকে বোধহয় তুই একাই শেষ করে ফেলেছিস।
একদম মিথ্যে কথা, আমি তাদের কোনো প্রডাক্টই লাগাইনি।
কথাটা বলে আমি নিজেই নিজের জ্বিভ কামড়ে ধরলাম।
ইশশ রুম ভর্তি মানুষের সামনে আমি এত জোড়ে কি করে বললাম কথাটা?
সবাই আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে আছে।
দিন দিন কি মাথা আমার ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে?
রেহান ভাইয়া আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন–
— চিল্লাচ্ছিস কেনো?
এইটুকুতেই এতো চিল্লাতে হয়!
তোর জন্য সবাই কেমন করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
বিয়েটা শেষ হোক তারপর চিল্লানোর মজা বোঝাবো তোকে।
কি বলবো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
কি বোকা আমি, ঘর ভর্তি মানুষের সামনে… ছিঃ ছিঃ কি ভাববে এখন সবাই!
🥀
🥀
🥀
কান্না কাটির পর্ব শেষ করে রেনু আপুর বিদায়ের জন্য সবাই নিচে দাঁড়িয়ে আছি।
খালামনি রেনু আপুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন।
রেনু আপুও শেষ বারের মতো খালামনিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন।
আমি তাকিয়ে আছি সেদিকে, আচ্ছা আমার মা-ও কি আমার বিদায়ের দিনে এভাবেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবে?
কে জানে! হয়তো কাঁদবে।
কি অদ্ভুত আমাদের জীবন,
এত বছরের সম্পর্ক এক নিমিসেই শেষ করে অচেনা একজনের হাত ধরে চলে যেতে হবে।
কিন্তু এতে কান্না কাটির কি আছে?
জন্ম জন্মান্তর থেকে এই রীতিই তো চলে আসছে।
রেনু আপুর কথা মনে হলেই তো অবাক লাগে।
ছত্রিশটা বছর এ বাড়ি চষে বেড়িয়ে আজ সব সম্পর্ক শেষ করে চলে যাচ্ছেন।
চাকরি চাপে পড়ে এতদিন বিয়ের কথাটা হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন।
নিয়তি কোথায় কেমন করে আমাদের সাথে খেলে তা বোঝা আমাদের সাধ্য নয়।
রেহান ভাইয়াকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।
এদিকে খালামনিও রেহান ভাইয়াকে খুঁজছেন।
কে জানে আবার কোন কাজের চাপে আটকে আছেন।
উনার তো আবার খাটা খাটনির অন্ত নেই।
এক কাজ শেষ করবেন তো আরেক কাজ সামনে এসে হাজির হবে।
অনেক খোঁজা খুঁজির পর উনাকে পাওয়া গেলো।
রেনু আপুকে জাপটে ধরে কাঁদছেন রেহান ভাইয়া।
উনার চোখে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার পানি আসতে দেখলাম আমি।
ভ্রু কুচকে চোখ বন্ধ করে পানি ছাড়ছেন উনি।
এত বছরের আবেগ আজ একসাথে ঢেলে দিচ্ছেন হয়তো।
আচ্ছা উনি কাঁছেন কেনো?
ওমম রেনু আপুর সাথে এতদিনের কাটানো সময় গুলোর কথা মনে পড়ছে হয়তো।
রেনু আপুর সাথে খুনসুটি করার কথা মনে পড়ছে হয়তো।
এমনটাই ভাবছেন হয়তো।
উনাদের সম্পর্ক তো আর আমাদের ভাই বোনের মতো না।
আমার মতো একাকিত্ব নিয়ে ক’জনই বা বড় হয়?
সব থেকেও নিস্ব জীবন ক’জনেরই বা হয়?
এই যা আমার পানসে জীবনের কথা মনে করে দামি মুহূর্তটা অযথাই নষ্ট করছি আমি।
ছেলেদেরকে সচারচর কাঁদতে দেখা যায় না।
না না সব ছেলে আবার এক রকম হয়না।
কেউ কেউ তো একটুতেই কেঁদে ভাসায়।
তবে ছেলেদের কাঁদলে খুব মায়া লাগে, একদম পবিত্র মনের লাগে।
দশটা মেয়েকেও এতটা পবিত্র মনে হয় না যতোটা না পবিত্র একটা ছেলেকে কান্না করার সময় মনে হয়।
রেহান ভাইয়াকেও আজকে তেমনটাই পবিত্র মনের অধিকারি লাগছে।
অবশ্য আমি স্বিকার না করলেও উনার মন একশত ভাগ পবিত্রই থাকবে।
কান্না করে চোখের অবস্থা নাজেহাল করে ফেলেছেন উনি।
বড় বড় চোখ দু’টো ফুলে ডাবের মতো হয়ে আছে।
এমন পরিস্থিতিতেও আমার উনাকে দেখে বড্ড হাসি পাচ্ছে।
হাসি লুকাতে মুখ ঘুরিয়ে পাশ ফিরতেই দেখি রাফি ভাইয়া আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
বেশ অবাকই হলাম আমি উনাকে দেখে।
উনার তো এখন রেনু আপুর কাছে থাকার কথা।
উনি আমার পাশে কি করছেন?
সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে সামনে তাকালাম আমি।
কেমন যেনো অস্বস্তি অনুভব হয় আমার রাফি ভাইয়াকে দেখলে।
🥀
🥀
🥀
রেনু আপু চলে গেছেন সেই বিকেলে।
কাল পরশু হয়তো আমরাও বাড়ি ফিরে যাবো।
রেনু আপু যাওয়ার পর রেহান ভাইয়ার সাথে দু’একবার চোখা চোখি হয়েছে আমার;
উনি সাথে সাথেই নিচে তাকিয়ে দ্রুত আমার সামনে থেকে চলে গেছেন।
আমাকে উনার ফোলা দু’টি চোখ দেখাতে লজ্জা পাচ্ছেন বোধহয়।
কিন্তু আমি তো দেখে ফেলেছি।
আচ্ছা উনি কি জানেন উনার ফোলা ফোলা চোখের দিকে তাকিয়েও আমি হাজারটা কথা বুঝে নিতে পারি!
রাতে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমি চুপি চুপি রেহান ভাইয়ার রুমের সামনে চলে এলাম।
পর্দার এপাশ থেকে রুমে চোখ বুলিয়ে দেখার চেষ্টা করছি উনি ভেতরে আছেন কিনা।
নাহ্ বোধহয় বাহিরে গেছেন।
রুমের সাথে এটাচ্ বাথরুমও নেই যে উনি সেখানে থাকবেন।
নির্ভয়ে রেহান ভাইয়ার রুমে প্রবেশ করলাম।
ঘুরে ঘুরে পুরো রুমে চোখ বুলাচ্ছি আমি।
শেষবার রেহান ভাইয়ার দাদি বেঁচে থাকতে এ রুমে এসেছিলাম।
উনি গত হয়েছেন পাক্কা তিন বছর।
রেহান ভাইয়াকে সেবারই প্রথম কান্না করতে দেখেছিলাম, আজ আবারও দেখলাম।
উনার রুমে বিশেষ কিছু কিংবা চোখ ধাঁদিয়ে দেয়ার মতো তেমন কিছুই নেই।
একটা বড় খাট, বিশাল একটা আলমিরা, টেবিলে হালকা কিছু বইপত্র আর চেয়ারে এলোমেলো অগোছালো কিছু ময়লা কাপড় এতটুকুই।
উনি যে আসলেই অগোছালো একটা মানুষ সেটা আজ এই রুমে বুঝলাম।
বিছানায় বসে পাশে থাকা টেবিল থেকে রবী ঠাঁকুরের মালঞ্চ উপন্যাসটা হাতে নিলাম।
কতদিন যে এ বইয়ের উপর হাতের ছোঁয়া লাগে নি সেটা ধুলো বালিই বলে দিচ্ছে।
উনার মতো সাদামাটা মানুষও যে সাহিত্যের প্রেমে পড়বে তা আমার ধারনারও বাইরে ছিলো।
— তুই আমার রুমে কি করছিস?
ধুলো বালি পরিষ্কার করে বইয়ের প্রথম পৃষ্টা উল্টাতেই পেছন থেকে পরিচিত কণ্ঠে আমার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো।
আপনা আপনিই কাঁপছে আমার শরীর।
চোখ বন্ধ করে শক্ত করে বইটা ধরে আছি আমি।
উনি নিঃশব্দে আস্তে আস্তে আমার সামনে আসতেই…
চলবে…