‘একটি মৃত্যু এবং একটি বিয়ে’

বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেদিন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেলো প্রমার।
রাস্তায় অসহ্য ট্রাফিক জ্যাম। যদিও সেটা ইটপাথরের নগরীর দৈনন্দিন ব্যাপার, তারপরও বাড়ি ফেরার পথে জ্যামে বসে থাকতে সবারই কম বেশি অধৈর্য লাগে।

প্রমা সিএনজির ভেতরে বসে ভাবছে হিমুর ইমেইলের কথা। কমপক্ষে দশ-বারোবার চিঠিটা পড়ার পরও মনে হচ্ছে কোন লাইন মিস হয়ে গেল কি না! তাই সে আবারও মোবাইল বের করে পড়ছে।
কমা দাঁড়ি সহ চিঠিটা তার মুখস্থ হয়ে গেছে এতোক্ষণে।
এদিকে মোবাইলের ব্যাটারির চার্জ কমে এসেছে। মোবাইলের ডানদিকের কোণায় ব্যাটারির সাইনে লাল বাতি জ্বলছে।
একসময় অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও সে খানিকটা জোর করেই মোবাইলটা ব্যাগের ভেতর রেখে দিলো।বিপদ আপদের কথা তো বলা যায় না। সেজন্য মোবাইলটা চালু রাখাটা জরুরী।

সিএনজির ভেতরে বসে প্রমা বাইরের পৃথিবী দেখছে।যেন হঠাৎ একদিন গুহার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোন রাজকুমারী তার সাম্রাজ্যের আনাচে কানাচে কি হচ্ছে, তার খবর নিচ্ছে।

জানজটের মাঝে কর্মব্যস্ত নগরীর রূপরেখা অন্যধারার।
সারাদিন কাজের পর সবাই ছুটছে যার যার গন্তব্যস্থলে।

প্রমার চোখ চলে গেল আকাশের দিকে। ঠিক সন্ধ্যা নামার আগে ধীরে ধীরে আকাশে মেঘগুলোকে লালচে রঙের আভা ছড়িয়ে পড়ছে। সাদা কিমুলাস মেঘের উপর ডুবন্ত সূর্যের হাল্কা লাল-গোলাপী আলোর ছোঁয়া গোলাপের পাঁপড়ির মতো বিকশিত হয়ে আছে উন্মুক্ত নীলিমায়। পাখিরা দলে দলে তাড়াহুড়া করে উড়ে যাচ্ছে যার যার আপন কুলায়।

কি আশ্চর্য! ব্যস্ত নগরীর ঝঞ্ঝাট ছাপিয়ে কই আগে তো কখনও এমনভাবে চোখে পড়েনি প্রকৃতির এই সৌন্দর্য?

হিমুর চিঠি পাওয়ার পর থেকে আজ সব বিরক্তি আর অবসাদ
যেন হাওয়ায় উড়ে গেছে। ক্ষণে ক্ষণে প্রমার হৃদয় পুলকিত হচ্ছে…
এক অজানা আবেশে ডুবে আছে সে।
প্রমা মনে মনে ভাবছে হিমুর চিঠির উত্তরে সে কি লিখবে ?
তার জীবনে কখনও এরকম প্রেমিক টাইপের চিঠি আসেনি।
একবার স্কুলে থাকতে এক ছেলে ভুলভাল বানানের একটা চিরকুট পাঠিয়ে ছিল। প্রমা অবশ্য সে ধরনের ফালতু যন্ত্রণা কখনই প্রশ্রয়
দেয় নি। নিজেরও কাউকে সেই লেভেলের ভালো লাগে নি যে চিঠি পাঠাবে।

কি করে শুরু করবে চিঠি ?
সম্বোধনটা কি হবে ?
হিমুকে নাম ধরে ডাকলে কি অভদ্রতা হবে ?

এসব আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে সিএনজি কখন যে তাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো সে খেয়ালও করে নি।
প্রমা ভাড়া দিতে গিয়ে দেখে তার ব্যাগে শুধু একটা পাঁচশ টাকার নোট। ব্যাগের কোণাকানচি ঘেটে অনেক খুঁজেও খুচরা টাকা পাওয়া গেল না।
সিএনজি চালক, রফিকের কাছেও ভাংতি নেই।

—ভাই, আমি তিনতলার ফ্ল্যাটে থাকি। আপনি একটু অপেক্ষা করেন, আমি টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি দারোয়ান ভাইকে দিয়ে।

—না না আপা। এরকম করে অনেকে উপরে গিয়া আর টাকা দেয় না। আপনি আমারে ভাড়া না দিয়া উপরে যাইবেন না।

—আমি একজন টিচার মানুষ। আপনাকে ঠকাবো না ভাই। শুধু একটু অপেক্ষা করেন।

রফিককে আর কোন কথা বলতে না দিয়ে প্রমা একরকম দৌড়ে উপরে চলে গেল তাড়াতাড়ি।

—ধুর !
রফিক মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হয়েছে।
এমনিতেই এতো দূর আসতে চায় নাই সে। এখন কে জানে এই মেয়ে না আবার উধাও হয়ে যায় ?
সে উদাসীন চোখে একটা সিগারেট বের করে ধরালো।

এদিকে ঘরে ঢুকেই প্রমা ভাংতি টাকার জন্য তার মায়ের রুমে গিয়ে দেখে মা মাগরিবের নামাজে বসেছেন। প্রমার হঠাৎ খেয়াল হলো তার মা তো আজ রোজা মানত করেছিলেন।
একটু আগে ঘরে ফেরা দরকার ছিল তার। খুব ইচ্ছে ছিল মায়ের পছন্দের নাস্তা বানিয়ে দেবে রোজা ভাঙার সময়।

প্রমা কি করবে এখন ?
এদিকে দেরি হলে সিএনজি চালক আবার চেঁচামেচি করতে পারে।
শেষমেশ সে তার আলমারির ভেতর ব্যাগে কিছু খুচরা টাকা খুঁজে পেলো। নিচে দারোয়ানকে ডাকতেই সে জানালো কেউ একজন প্রমার
সিএনজির ভাড়া দিয়ে দিয়েছে।

—কে ভাড়া দিলো আকবর ভাই?
প্রমা সন্দেহের সাথে জিগেস করলো।

—জানি না। একজন জোয়ান ভদ্দরলোক আইসা টেহা দিয়া গেসে আফা।

—কে সেই ভদ্রলোক ? আমি তাকে চিনি? আমাদের বিল্ডিংএ থাকে?
প্রমা ভীষণ অবাক হয়ে জানতে চাইলো।

—হ্যারে চিনি না আমি আফা। আগে এই এলাকায় দেখি নাই।

—কি আশ্চর্য একজন অচেনা লোক এসে আমার বিল দেবে কেন? নিশ্চয়ই কোন ভুল হয়েছে এখানে।

—হইতে পারে। জানি না আফা। আমি চোখ কান খোলা রাখুম। যদি ঐ লোকেরে আবার দেখি তয় আমি আপনেরে খবর দিমু।

—আচ্ছা আচ্ছা। ঠিক আছে।
প্রমা আর কথা না বাড়িয়ে উপরে চলে গেল।

বাড়িতে ঢুকে সে সোজা চলে গেল গোসলখানায়। সারাদিন কাজের পর সে সাধারণত রাতে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেতে যায়।

কিন্তু মন থেকে খচখচ ভাবটা যাচ্ছে না।
কে হতে পারে সে আগন্তুক? কেনই বা সে প্রমার সিএনজির ভাড়া দিয়ে দিলো ?
কেউ আবার তাকে ফলো করছে না তো?
একটা অস্বস্তিবোধ ঘুরতে লাগলো তার মনে।

~~~~##~~~~

—প্রমা মা, তোর এমন তাড়াহুড়া করে এনগেজমেন্ট হয়ে গেলো। কাউকে জানানো হয়নি বলে আত্মীয়স্বজনেরা কিন্তু খুব মাইন্ড করেছে রে।

—কে মাইন্ড করলো আবার?
প্রমা ভাত খেতে খেতে তার মায়ের সাথে কথা বলছে। এই সময়টা তাদের দুজনার খুব আপন। প্রমার মা সংসার নিয়ে নানারকম কথা বলার সময় পান তখন। মেয়েটা তার সারাদিন কাজে ভীষণ ব্যস্ত থাকে।

—কে আর? তোর মামীকে সকালে উঠে ফোন করে জানিয়ে বললাম দোয়া করতে। তখন তিনি আমাকে একচোট নিলেন।
“মেয়ের বিয়ের সব কথা শেষ করে এখন জানালেন বুবু ? আমাদের তো পর করে দিলেন আপনারা।”

—ধুর। বাদ দাও তো এসব মা। জানোই তো অরুনা মামীর কথা একটু ধারালো।কিন্তু তার মনটা খুব সরল।

—তোর খালা অবশ্য ভীষণ খুশি হয়েছেন।সে তো বিয়ের কথা শুনে ফোনে একদম কান্না শুরু করে দিলো।

—আহারে খালামনির মনটা একটু বেশিই নরম।

—আর তোর মনি ফুপীকেও জানিয়েছি।সে তো পারলে আজই চিটাগাং থেকে ঢাকা রওয়ানা হয়ে যায়।

প্রমা হেসে ফেললো। তাদের পরিবারের সবাই মনে হয় একটু বেশি ড্রামাটিক। খুব অল্পতেই মন খারাপ আবার পরমুহূর্তেই হাসি-আনন্দ। বলাই বাহুল্য তার বিয়ে উপলক্ষে পরিবারের সবাই এখন মহা উৎসাহিত!

—তোর কেমন লাগছে মা ? ছেলেটাকে কি তোর পছন্দ হয়েছে ?
সত্যি করে বল।
প্রমার মা আমতা আমতা করে বললেন।
গত রাতে আনুষ্ঠনিকতা ছাড়া সব কিছু কেমন অনাড়ম্বরের মধ্য দিয়ে হুটহাট ঠিক হয়ে গেল। মেয়ের সাথে বিয়ের ব্যাপারে খোলাখুলিভাবে কথা বলারও সুযোগ হয়নি তার।

—মা, এখনও বুঝতে পারছি না কেমন লাগছে।

—হিমুর সাথে কথা বল, ধীরে ধীরে একে অন্যকে চেনার চেষ্টা করিস। বিয়ে ব্যাপারটা তো আর ছেলেখেলা না।
মিসেস সায়রা বানু কথাটা খুব গুরুত্ব দিয়ে বললেন।

—ঠিক আছে মা। সময়ই সব বলে দেবে। আমি আগেভাগে এতো চিন্তা করতে চাই না।
প্রমা হিমুর ইমেইলে পাঠানো চিঠির কথাটা গোপন রাখলো মায়ের কাছ থেকে। সে ব্যাপারে কথা বলতে তার ভীষণ লজ্জা লাগছে।

—হিমুর খালা আজ বেশ কয়েকবার ফোন করেছিলেন তোর সাথে কথা বলার জন্য। তোর নম্বর নিয়েছেন আমার কাছ থেকে। তবে আমি বলেছি আজ তুই কাজে ভীষণ ব্যস্ত থাকবি।

—খুব ভালো করেছে মা। কাজে আজ নাকানি-চোবানি অবস্থা ছিল।

—বিয়ের পরে কিন্তু চাকুরিটা চালিয়ে যাস। মেয়েদের স্বনির্ভর থাকাটা খুব প্রয়োজন।

—হ্যাঁ মা। চাকুরি ছাড়ার কোনই কারণ নেই। আমাদের স্কুলের সব টিচাররাই তো বিয়ে-সংসার-বাচ্চা … সবকিছু গুছিয়েই চাকুরি চালিয়ে যাচ্ছে।

—আলহামদুলিল্লাহ্। আমার মেয়েটা একটা সোনার টুকরা।

—গতকাল মিস্টার হিমুর খালাও তার সম্পর্কে সে কথা বলেছে। তাদের ছেলে ‘একটা সোনার টুকরা’।
প্রমা হা হা করে হাসতে লাগলো।

—হবু বরকে মিস্টার হিমু ডাকছিস কেন ? কি অদ্ভুত!

— তাহলে কি বলে ডাকবো, প্রিয় স্বামী?

—যাহ্ ! আর ফাজলামো করা লাগবে না।
প্রমার মাও এবার মেয়ের সাথে হেসে ফেললেন।

প্রমার বাবা পাশের রুমে শুয়ে শুয়ে মা-মেয়ের কথোপকথন শুনছিলেন। মনে মনে তিনি আল্লাহর কাছে বারবার শুকরিয়া আদায় করতে লাগলেন।
তার বড়ো কন্যাটির প্রতি তিনি বিশেষরকম দুর্বল। সে অত্যন্ত লক্ষ্মীস্বভাবের একটা মেয়ে।

~~~##~~~

শ্রদ্ধেয় হিমু,
আপনাকে কি সম্বোধনটা ঠিক হচ্ছে?
আসলে আপনাকে কিভাবে সম্বোধন করবো সে কথা ভাবতে ভাবতেই অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি।
আজ আপনার ইমেইলটা পড়তে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। স্কুলের কাজে ব্যস্ততায় ইমেইল দেখার সুযোগ পাই নি।
এখন উত্তর দিতে গিয়েও দেরি করে ফেললাম। কিছু মনে করবেন না। আমি কিন্তু খুব পাংচুয়াল একটা মেয়ে।
চিঠি লেখার ব্যাপারে অবশ্য একেবারে আনাড়ি। কাউকে সেরকমভাবে কখনও চিঠি লেখা হয় নি।আর এ যুগে তো কেউ তেমন চিঠি লেখে না। টেক্সট আর মেসেন্জারেই সব কাজ চলে।
আমি আসলে কি লিখবো বুঝতে পারছি না।তাই আবোল তাবোল কিসব লিখছি।
আপনার ইমেইলে লিখেছিলেন আমার চেহারার আদলটা আপনার মায়ের মতো। আর সে কারণে আমাকে প্রথম দেখাতেই আপনার পছন্দ হয়ে গেছে। আপনার মা নিশ্চয়ই খুব অসাধারণ একজন মহিলা ছিলেন। তার সম্পর্কে খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।
আমাদের বিয়েটা এমন হুট করেই ঠিক হয়ে যাবে সেটা আমি কল্পনাতেও ভাবি নি। তবে আশা করছি ধীরে ধীরে আমরা একে অপরের সম্পর্কে আরও জানতে পারবো।

—বিনীতা
প্রমা

শেষের লাইনটা লিখে প্রমা আবার মুছে ফেললো। প্রথম চিঠিতেই এরকম আগ বাড়িয়ে পাকনামো করাটা তার ভালো ঠেকছে না।
একে অন্যকে জানার ব্যাপারটা না হয় পরে লেখা যাবে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here