‘একটি মৃত্যু এবং একটি বিয়ে’
পর্ব ১
—নবরত্নের আংটিটা তোমার শাশুড়ির ছিল। তিনি মারা যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলেন প্রথম দেখাতে আংটিটা যেন অবশ্যই তার পুত্রবধূর অনামিকাতে পরিয়ে দেয়া হয়।
কথাটা প্রমার হবু খালা শাশুড়ি, মিসেস নাজমা হোসেন বেশ গর্বের সাথে বলছিলেন। তিনি মনে হচ্ছে একটু সহজ সরল স্বভাবের….প্রচুর কথা বলছেন, অকারণে হাসছেন। তার উপর আজ হয়তো একটু আলগা মাতব্বরি করার সুযোগ পেয়ে লাগামহীন কথা বলে চলেছেন।
— বুঝেছো মা, আমাদের হিমু কিন্তু একটা সোনার টুকরো ছেলে। কখনও ক্লাসে সেকেন্ড হয়নি। আহা ! আজ যদি বুবু বেঁচে থাকতেন !
কথাগুলো বলতে বলতে নাজমা হোসেন চোখের পানি মুছলেন।
এই মহিলা তো দেখা যাচ্ছে মহা ইমোশনাল! প্রতি মুহূর্তে তার অনুভূতির স্কেইল হাসি আর কান্নার মাঝে ওঠানামা করছে।
প্রমা মনে মনে ভাবলো হিমু নামটি শুনলেই একজন ছন্নছাড়া বাউন্ডুলে স্বভাবের কোন ছেলের প্রতিচ্ছবি চোখে ভেসে আসে।
সেই যে হূমায়ুন আহমেদের গল্পের হিমুর মতো, যে কিনা মাঝরাতে ঘন অরণ্যের মাঝে মাটিতে গর্ত করে বসে থাকে পূর্ণিমা দেখবে বলে।কিন্তু বাস্তবের এই হিমু তো মনে হচ্ছে প্রচন্ড বোরিং রোবট মানব আর অতিরিক্ত রকমের ‘গুডি গুডি’ গুড বয়।
প্রমাকে আজ দেখতে এসে অপ্রত্যাশিতভাবে বরপক্ষের লোকেরা পছন্দ করে ফেললো। তারা আর সময় নষ্ট করতে চাইলো না।
বাড়ি কেনার অগ্রিম বায়নার মতো তারা প্রমার হাতে সংগে সংগে আংটি পরিয়ে দিলো।
প্রমার বয়স ছাব্বিশ বছর চার মাস। যে কোন মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এই বয়সটা একটু ক্রিটিক্যাল। পঁচিশ পেরিয়ে গেলেই বিয়ের বয়স চলে গেছে বলে পাড়া প্রতিবেশি আর আত্মীয়স্বজনদের অত্যধিক কৌতূহলের পাত্র হতে হয়।
— কি ব্যাপার ভাবী, মেয়ের বিয়ে নিয়ে কি ভাবছেন? মেয়েকে কি সারাজীবন আইবুড়ো করে রাখবেন ? মেয়ের বিয়ে দিবেন না ?
— ভাবী, প্রমার তো বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে ! যা করবেন তাড়াতাড়ি করেন।
প্রমার বিয়েটা না হলে যেন পাড়ার মানুষের আর ইজ্জত থাকছে না।
অথচ প্রমা একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াচ্ছে।ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পলিটিকাল সায়েন্সে পাশ করার পর এখন চাকুরি করে মাসে সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ হাজার টাকা বেতন পায়। আর্থিক দিক থেকে প্রমা স্বয়ংসম্পূর্ণ। বরং বাবা-মায়ের সংসারে সে সবসময় সাহায্য করে আসছে।
প্রমার চেহারা হিন্দু প্রতিমার মতো কাটাকাটা হলেও তার গায়ের রংটা একটু ময়লা। পাঁড়ার ছেলেরাও একটা সময়ের পর আর তার প্রতি অনুরাগ দেখানো বন্ধ করে দিয়েছে বেশ অনেকদিন হলো।
তার বিয়ের সম্বন্ধ তেমন আসছে না। তাও যে কয়েকটা সম্বন্ধ এসেছিল প্রতিটিই কোন না কোন কারণে পিছিয়ে গেছে।
প্রমার মা মিসেস সায়রা বানু চোখে অন্ধকার দেখছিলেন।
এমন সময় ভাগ্যিস দোতালার শামীমা ভাবী কি করে যেন এক ঘটক ধরে এই সম্বন্ধটা এনেছিল।
প্রথম থেকেই এই সম্বন্ধটার সবকিছু বেশ ইতিবাচক মনে হচ্ছিল।
মা মরা ছেলেটার বায়োডাটা পড়ে মনে হলো অল্পবয়সেই সে অত্যন্ত আত্মপ্রত্যয়ী আর সফল একজন মানুষ।
ছেলেপক্ষেরও প্রমাকে দেখেই পছন্দ হয়ে গেছে, আংটি পর্যন্ত পরিয়ে দিয়েছে প্রথম দেখাতে।
মিসেস সায়রা বানু ঠিক করেছেন আগামীকাল নফল রোজা রাখবেন।
এদিকে পাত্রপক্ষ চলে যেতে যেতে বেশ রাত হলো। পাত্রের খালা মিসেস নাজমা হোসেনের কথা যেন থামতেই চায় না।
এক সময়ে পাত্র নিজেই বলে ফেললো,
— খালামণি, আজ যাওয়া দরকার। আগামীকাল সকালে আমার ডিউটি আছে। চলো এখন।
কিছুক্ষণ পর তারা সবাই চলে গেল।
গভীর রাতে বিছানায় শুয়ে প্রমা আবছা অন্ধকারের মাঝে তার বাম হাতের অনামিকার আংটিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল।
বাইরে ফাল্গুনী পূর্ণিমার চাঁদের আলো জানালা গলে প্রমার আংটিটার উপর ঠিকরে পড়ছে।
প্রমার কি আজ অনেক আনন্দিত হওয়া উচিত ?
না কি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তাই ভেবে একটা কৃত্রিম দুঃখ দুঃখ ভাব আনা উচিত ?
আসলে তার মনে কোনরকম ভাবান্তরই হচ্ছে না।
যে ছেলের সাথে তার বিয়ে ঠিক হলো সে একবার তার সাথে আড়ালে কথা বলতেও চাইলো না। শুধু একবার চোখাচোখি হলে পরে হিমু চোখ নামিয়ে ফেলেছিল। এই ব্যাপারটা একটু সেকেলে হলেও প্রমার কেন যেন ভালো লেগেছে।
তেমন কিছু না জেনেই প্রথম ইম্প্রেশনেই প্রমার মনে হচ্ছে মিস্টার হেমায়েত হোসেন হিমু একজন নিতান্তই ভদ্রলোক।
এখন দেখা যাক কি আছে তার কপালে ?
~~~~##~~~~
খুব দূর থেকে হাল্কা গানের সুর ভেসে আসছে।
প্রমার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মোবাইল চেক করে দেখলো রাত দুটো বাজে।
কোন মানে হয় ?
এরকম গভীর রাতে ঘুম ভাঙার কারণটা কি ?
গানের সুরই বা কোথা থেকে আসছে ?
প্রমার খাটে তার পাশে ছোট বোন তনিমা শুয়ে আছে, সে অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
প্রমা খাট থেকে উঠে এলো।
জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলো বাইরে জোছনার আলোয় চারদিক দিনের আলোর মতোই আলোকিত।
শুনশান নিশ্চুপ রাত।
নিচে রাস্তায় মাঝে মাঝে একটা দুটো রিক্সা টুংটাং শব্দ করে চলে যাচ্ছে।
ঘুমন্ত নগরীর রূপই আলাদা।
—ইস! এখন ছাদে গিয়ে মাদুর পেতে বসতে পারলে কি দারুণ হতো!
প্রমা নিজের ভাবনাতে হারিয়ে গেল।
হিমু নামক ছেলেটা না জানি কেমন হবে?
সে কি হোপলেস রোমান্টিক না কি রোবট টাইপের ?
গভীর রাতে সে কি কখনও প্রমাকে জোর করে সাথে নিয়ে ছাদে
মাদুর পেতে গল্প করবে ?
না কি বিরক্ত হয়ে অন্য পাশে ফিরে ঘুমোবে ?
মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের এ ধরণের স্বপ্ন দেখাটাও হয়তো অযৌক্তিক।
প্রমা একটা দীর্ঘ শ্বাস লুকালো।
অন্যমনস্ক হয়ে সে বাইরে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। একসময় প্রমা হঠাৎ লক্ষ্য করলো যে তাদের সামনের বাড়ির বারান্দায় কে যেন ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে।
কে হতে পারে এটা ?
নিজের অজান্তেই বুকটা ধক করে উঠলো প্রমার।
জ্বীন ভূত নয় তো আবার?
সে কোনভাবেই বুঝতে পারলো সামনের বারান্দায় দাঁড়ানো মানুষটা
কে হতে পারে। ওই বাড়ির কাউকেই প্রমা তেমন চেনে না। তার মা হয়তো জানতে পারে পাশের বাড়ির ছেলেটা কে ?
কিন্তু সে যে পুরুষ না মহিলা সেটাও তো বোঝা যাচ্ছে না।
কি আশ্চর্য ব্যাপার !
বিভ্রান্ত মনে প্রমা ঘুমোতে চলে গেল। সকাল ছয়টায় উঠতে হবে আবার।পরদিন স্কুলে বাচ্চাদের পরীক্ষা।
একদম সকাল সকাল পৌঁছুতে হবে।
~~~~**~~~~
সকাল থেকেই দিনটা ভীষণ ব্যস্ততায় কেটে গেছে প্রমার।
গতকাল রাতে আংটি পরানো থেকে শুরু করে মধ্যরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়া, সব ঘটনা ভুলে ছিল সে।
আজ স্কুলে বাচ্চাদের পরীক্ষা। সে কারণে সব টিচাররাই ব্যস্ত, তটস্থ।
এই স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল ম্যাম বেশ কড়া স্বভাবের।
কাজের শেষে বাড়ি ফিরবার পথে বাস মিস করে ঘামে জবজবে হয়ে প্রমা শেষমেশ একটা সিএনজি নিলো। একটু বেশি খরচ পড়ে যাবে, কিন্তু তার আর উপায় ছিল না।
সিএনজিতে বসার পর সে যেন অবশেষে একটু দম ফেলার ফুরসত পেলো।
সারাদিন পর মোবাইলে স্ক্রল করে দেখলো ফেসবুকে তেমন কেন ইন্টারেস্টিং পোস্ট নেই আজ। সারাদিনের ক্লান্তিতে প্রমা তার কোন বন্ধুদেরকে তার এনগেজমেন্টের কাহিনি বলার সুযোগ পায় নি এখনও। অথচ আজকাল নিয়মই হলো সবাই সবার আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস চেন্জ করবে, ‘এনগেজড’!
স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল ম্যাম বলেছিলেন ইমেইল চেক করতে। তিনি না কি বেশ কিছু জরুরী ডকুমেন্ট পাঠিয়েছেন।
প্রমা ইমেইল খুলে দেখলো একটা অচেনা ইমেইল আইডি থেকে মেইল এসেছে।
প্রেরকের নাম পড়ে সে একটু চমকে উঠলো।
হেমায়েত হোসেন।
হিমু নামক ছেলেটা, মানে তার হবু বর তাকে একটা ইমেইল করেছে।
প্রমা মনে মনে আশ্চর্য হলো ভেবে যে হিমু কি করে তার ইমেইল এড্রেস পেলো ?
অবশ্য আজকাল ঘটকরা হয়তো বায়োডাটাতে ইমেইল এড্রেসও যোগ করে দেয়।
প্রমার খুব ইচ্ছে হলো চিঠিটা বাড়ি গিয়ে আরাম করে পড়বে। কিন্তু পর মুহূর্তেই তার আর তর সইলো না।
কি চায় ছেলেটা এখন ?
আংটি পরিয়ে আবার ফেরত চাইবে না তো ?
প্রমা আর কিছু না ভেবে পড়া শুরু করলো।
ইমেইল বাংলা ফন্টে টাইপ করা চিঠিঃ
প্রমা,
তোমাকে ফোন না করে ইমেইল করছি কারণ এখন গভীর রাত। তুমি নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছো ? তাছাড়া আমি মানুষটাও একটু সেকেলে টাইপের।
হয়তো তা ইতিমধ্যে বুঝে ফেলেছো।
আজ কেমন হুট করেই তোমার সাথে আমার বিয়েটা ঠিক হয়ে গেল, তাই না?
তোমার সাথে একবার কথা বলারও সুযোগ পেলাম না। কিন্তু তোমাকে প্রথম দেখেই মনে হলো তোমাকে আগে কোথাও দেখেছি।
খুব চেনা চেনা, খুব আপন লাগছে।
মনে হচ্ছে তুমি আমার বহুদিনের পরিচিত কোন প্রিয় মুখ!
তারপর অনেক ভেবে চিন্তে বুঝলাম আসলে তোমার চেহারা আর আমার মায়ের চেহারার আদল অনেকটা একই রকম।
হয়তো আমার ‘ইডিপাস কম্প্লেক্স’ হচ্ছে।
‘ইডিপাস কম্প্লেক্স’ কি জানো তো ? এটা বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সৃষ্ট একটি মতবাদ। এই মতবাদ অনুসারে বলা যায় মায়ের প্রতি ছেলে শিশুর ভালোবাসার কারণে ছেলেরা মায়ের মতো দেখতে মেয়ের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়।
তোমাকে বোর করছি না তো আবার?
আসলে আমি আগে কখনও কোন মেয়েকে চিঠি লিখি নি, তাই এ ব্যাপারে একেবারেই পটু নই।
তোমার কেমন লাগছে আমার সেটা খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।
সময় পেলে কয়েক লাইন লিখে পাঠিও।
আমি অপেক্ষা করবো।
—তোমার হিমু
প্রমা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে চিঠিটার প্রথম হইতে শেষ অবধি বেশ কয়েকবার পড়লো। মনের অজান্তেই তার চোখের কোণে হীরের টুকরোর মতো কয়েক ফোঁটা পানি চিকচিক করছে।
সিএনজির ভেতরে বসার কারণে তার কান্না লুকানো সহজ হলো।
“তোমার হিমু” ….. মনের অগোচরে মিস্টার হিমু এক নিমেষে তার খুব কাছের কেউ একজন হয়ে গেলো।
(চলবে)