#একজোড়া_পায়রা
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন
#পার্ট১১
নীল আকাশে সাদা তুলোর মতো মেঘ,বাতাসে শিউলি ফুলের পাগল করা গন্ধ,সারি সারি কাশফুল জানান দিয়ে দিচ্ছে যে শরৎ এসে গেছে।আমার কাছে শরৎকালটা একটু বেশিই ভালো লাগে!বিশেষ করে নীল আকাশে তুলোর মতো সাদা মেঘের জন্য।নানু বলেছিলো মন খারাপের সময় নাকি নবী(সা) আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।এই হাদিস শোনার পর আমি শুধু মন খারাপ কেন!অকারণেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি।মনের ভেতর একটা অবর্ণনীয় প্রশান্তি কাজ করে! শরৎকালকে বরণ করে নেওয়ার জন্য ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।সবাই শাড়ি পরবে।আগে থেকেই শাড়ি,চুড়ি,মেহেদী,লিপস্টিক এগুলো আমার দুর্বলতা।কিন্তু বাড়ি থেকে বাইরে আসার পর শাড়ি কেনা হয় নি আমার।সবার শাড়ি পরার প্রস্তুতি দেখে আমারও শখ জাগলো শাড়ি পরার।কিন্তু আমার কাছে কোনো শাড়ি নেই বর্তমানে।মাকে বললাম।মা বললো খালামুনির কাছ থেকে শাড়ি নিয়ে আসতে। সেই কারণেই আজ আমার লালমাটিয়ার দিকে যাত্রা।চার বছর ধরে ঢাকা এসেছি।কখনো খালামুনির বাসায় যাই নি।কারণ তার পিন মারা কথা।তিনি এমন ভাবে আমায় কথা শোনান যেন আমি তার দেওয়া টাকা পয়সায় চলি।বেয়াদবি হবে বলে কিছু বলি না।শুধু রাতের আঁধারে নীরবে কাঁদতাম।অনেকেই বলে বাবার আত্মীয়দের থেকে নাকি মায়ের আত্মীয়রা শতগুণে ভালো।কিন্তু বিষয়টা পুরোই ভুয়া।মায়ের আত্মীয়দের কাছে পিঠে থেকে দেখেন না!খুব বেশি সময় লাগবে না এদের খোলস ছাড়তে।
ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে খালামুনির ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিই।লিফটে চার তলা।গিয়ে কলিংবেল বাজাতেই খালাতো বোন তুবা দরজা খুলে দেয়।আমাকে দেখেই মেয়েটা আমায় জড়িয়ে ধরে।খালামুনি রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত।খালু কাজে বাহিরে গেছে।খালামুনি আমায় সোফায় বসতে বলেন।আমি চুপচাপ তার কথামতো সোফায় বসি।বলেন দুপুরের খাবার খেয়ে যেতে।আমি তার কোনো প্রতিত্তোর করি না।তুবা ক্লাস সিক্সে পড়ে।তার নাকি প্লাস মাইনাসের সুত্র গুলিয়ে যায়।বই নিয়ে এসেছে আমার কাছে কোনো এক চুরামি বুদ্ধি শিখিয়ে দেবো আর সুত্র গুলো মনে রাখবে।আমি শান্ত গলায় বলি,,,
-এইগুলো মনে রাখার কোনো চুরামি বুদ্ধি আমার কাছে নাই বোন।ক্লাস সিক্সে থাকতে আমারও সুত্রগুলো ওভাবে গুলিয়ে যেতো।
-প্লিজ আপু ট্রাই করো না!নয়ের ঘরের নামতার মতো একটা বুদ্ধি বের করো না!
অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে তুবা।আমিও অসহায় কন্ঠে ওকে বলি,,
-মাফও চাই দোয়াও চাই।
এরই মধ্যে খালামুনির ডাক পরে।ফ্রেশ হয়ে গিয়ে টেবিলে বসি।তুবা ছোট মানুষ।সে অনবরত বকবক করে যাচ্ছে।আমি ধৈর্য্য নিয়ে তা শুনছি আর খাচ্ছি।খালামুনি বাসার ব্যাপারে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলেন আমি তার উত্তর দিলাম।বাড়তি একটাও কথা বলিনি।খাওয়া হয়ে গেলে খালামুনি তার ঘরে নিয়ে যান।আলমারি খুলে বলেন,,,
-কোনটা নিবি?
আমি নীল রঙের একটা শাড়ি পছন্দ করি।কিন্তু শাড়ির সাথে ম্যাচিং ব্লাউজের জন্য বাজে বিপত্তি।খালামুনি বেশ মোটা সোটা মানুষ।আর আমি দিয়াশলাই কাঠির মতো শুকনা। উনার ব্লাউজ পরলে আমার শরীরে থাকনে কি না সন্দেহ!তাও নিয়ে নিই শাড়িটা।এশার একটা সাদা ব্লাউজ আছে।ওটার সাথে যাবে শাড়িটা।পরম যত্নে শাড়িটা ব্যাগে তুলছিলাম হঠাৎ খালামুনি বললো,,,
-হঠাৎ শাড়ি নিচ্ছিস যে!শান্তকে বিয়ে করবি?
-শাড়ি কি শুধু মানুষ বিয়ের জন্যই পরে?
-তোর তো ছোট থেকেই বিয়ের খুব শখ।শাড়ি চুড়ি দেখলে হুশ থাকে না।যাদের জীবনের লক্ষ্য বিয়ে করা তারাই তো এত শাড়ি পছন্দ করে।আর পরার জন্য লাফায়।পড়াশোনা যে করছিস পড়াশোনা করে কি হবে শেষে তো লাল শাড়ি পরে বিয়েই করতে হবে।
-হুম।যারা শাড়ি ভালোবাসে তাদের জীবনের লক্ষ্যই বিয়ে করা।প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেত্রী,স্পিকার এরাও তো শাড়ি পরে।তো তুমি কি গিয়ে বলবে এদেরও জীবনের লক্ষ্য বিয়ে করা?প্রায় সবারই তো বিয়ে হয়ে গেছে তো এরা কি আবার বিয়ে করার উদ্দেশ্যে শাড়ি পরে?হ্যাঁ বিয়ে করতে হবে সবার।ইসলামে এটি ফরজ। তাই বলে সবাই যে তোমার মতো কাহিনি করে বিয়ে করবে তা কিন্তু না!চলি।কাল্কেই শাড়িটা পাবে ইনশাআল্লাহ। রাত্রি করে এসে হলেও শাড়িটা দিয়ে যাবো।আল্লাহ হাফেজ
খালামুনিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চাপা কান্না নিয়ে বাসা থেকে বের হই।হলে এসেই বাথরুমে যাই।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ইচ্ছেমতো কাঁদতে লাগি।
★
এশার যে ব্লাউজটা নিয়েছি তা অফ শোল্ডার গলার।বড্ড অসস্থি লাগছে আমার।একে তো ভ্যাপসা গরম।তার ওপর শাড়ি।অস্থির লাগছে আমার।এই ভ্যাপসা গরমে চুল খুলে রাখার মানে দেখছি না।ভেজাও আছে চুল কিছুটা।হাল্কা করে কাঁটা দিয়ে হাত খোঁপা করে। টানা করে আইলাইনার আর ঠোঁটে হাল্কা লিপস্টিক দিয়ে এশার সাথে নির্ধারিত স্থানে যাই।কাজল আমি দিই না।লেপ্টে যায়।তখন আমায় দেখে মনে হয় চন্দ্রামুখী প্রতিশোধ নিতে এসেছে।গিয়ে দেখি শুভ্রও একই রঙের পাঞ্জাবি পরেছেন।এমনিতেও প্রায়ই লোকটা পাঞ্জাবি পরে থাকে তবে আজ যেন লোকটাকে পাঞ্জাবীতে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে।আমাকে দেখে উনি আমার দিকে এগিয়ে আসেন।তা দেখে এশা ইয়ার্কি করে আমায় ওর কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দেয়।উনি কাছে আসতেই এশা লাফ দিয়ে বলে উঠে,,,
-দুলাভাই বান্ধবী ম্যাচিং ম্যাচিং।পার্ফেক্ট কাপল।
-উহু।
উনার উত্তরে এশা ভরকে যায়।তাজ্জব দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,,,
-মানে?
-টিপ আছে তোমার কাছে এশা?
-নাহ।
-কাজল বা আইলাইনার?
-আইলাইনার আছে।
-দাও তো।
এশা ব্যাগ থেকে আইলাইনার বের করে দেয়।উনি তা দিয়ে আমার কপালে ছোট্ট করে টিপ এঁকে দেন।আমি বড় বড় চোখ নিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে থাকি।
-এইবার পার্ফেক্ট।টিপ ছাড়া অসম্পূর্ণ লাগছিলো তোমায়।একটা টিপ দিতে পারলে না?
-আমি টিপ দিই না।বাজে লাগে আমায় দেখতে।
-কে বলেছে বাজে লাগে তোমায়?
-আমি নিজেই বললাম।
স্টেজে মেয়েরা নৃত্য পরিবেশন করছে।আমি আর শুভ্র পাশাপাশি বসে আছি।হাতে আমার হাওয়াই মিঠাই।খুব পছন্দের বলে শুভ্র জোর করে কিনে দিয়েছে।মাঝে মাঝে প্যাকেট খুলে খাচ্ছি।বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ার ভয়ে আবার প্যাকেট গিট্টু মেরে রাখছি।হঠাৎ শুভ্র বলে ওঠে,,,
-বেনী করে ডান দিকে চুল গুলো রাখো।ভালো দেখাবে।
-আমার বিরক্ত লাগবে।একে তো গরম আবার বেণি করে ঢং করে ডান দিকে চুল রাখতে হবে!
উনি আর কিছু বলেন না।কিছুক্ষণ বাদেই খেয়াল করলাম তিনি গুণগুণ করে গান গাচ্ছেন।
O tere kandhe ka jo til hey,,
O tere seeene mey to dil hey,,
O tere bijli ka jo bill hey,,
aj se mera ho geya,,,
আমায় ইঙ্গিত করেই মনে হয় গাচ্ছেন।কিছু বোধহয় ইঙ্গিত করছেন।কাঁ্ধের তিল!আমার তো ডান কাধে একটা তিল আছে।উনি তিলের কথা বলছেন না তো?চুল খুলে উনার মতো হাল্কা বেণী করে ডান দিকে চুলটাকে দিই।উনি গান গাওয়া বন্ধ করে দেন।
সন্ধ্যার দিকে লালমাটিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিই।আমি একাই যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু উনি আমায় একা ছাড়েন নি।উনারও নাকি কাজ আছে তাই উনিই আমায় লালমাটিয়ায় নিয়ে গেলেন।উনি নিচে বাইক নিয়ে দাঁড়ান। আমি চট করে গিয়ে খালামুনিকে শাড়িটা দিয়ে আসি।পরে আবার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিই।
-আপনার না কাজ আছে!
-হুম।
-কোথায়?থামালেন না তো কোথাও!
-কাজ নেই যে কোথাও?
-মিথ্যে বলা আমার পছন্দ না।
-আমিও মিথ্যে বলি না।তোমার সাথে একান্ত কিছু সময় কাটানোই আমার কাজ ছিলো।
উনার কথা শুনে আমি বেকুব হয়ে যাই।অজান্তেই হেসে দিই।
-হাসি পাচ্ছে?তুমি যদি এভাবে ঘোমটা মাথায় আর উড়ন্ত চুলে আমার কাছে কিছু চাও না?আমি না করতে পারবো না।
-তাহলে এখন যা চাই তাই ই দেবেন?
-চেষ্টা করবো।
-উহু দিতেই হবে।
-আর না দিলে?
-কথা বলবো না আর। আড়ি।
-ব্ল্যাকমেইল করো?
-ধরে নিন তাই ই।
-কি চাও তুমি?
-বাইক থামান আগে।
উনি আমার কথামতো বাইক থামান।ক্যাম্পাসের আশেপাশে চলে এসেছি।রাস্তায় মানুষজন খুব একটা নেই।
-কি চাও?
-আপনার মুখ দেখতে
আমার কথা শুনে উনি স্তব্ধ হয়ে যান।শুকনো গলায় বলেন,,,
-Are you serious?
-জ্বী আমি সিরিয়াস।
চলবে,,ইনশাআল্লাহ