ইদানীং প্রায়ই খেয়াল করছি আমার স্টুডেন্ট আমাকে ম্যাম না বলে ভাবি ডাকছে।প্রথমে মনের ভুল হিসাবে নিলেও পরপর কয়েকদিন পর্যবেক্ষণ করার পর বিষয়টা নিশ্চিত করতে পারি।

-ভাবী হয়েছে।

শিশিরের ডাকে আয়ামার ভাবনাচ্ছেদ ঘটে।পেয়েছি এবার বিচ্ছুকে।একটু কড়া গলায় বলি,,,

-শিশির আমি তোমার কী হই?
-টিচার।

শান্ত গলায় বলে শিশির।আমি ধমক দিয়ে বলি,,,

-তো ভাবী বললে কেন?কী ধরণের বেয়াদবি এগুলো?আন্টিকে বললে তোমার কি অবস্থা হবে বুঝতে পারছো?

শিশির মেয়েটা দুষ্টু আর চঞ্চল প্রকৃতির হলেও খুব সেনসিটিভ মাইন্ডের মেয়ে।ধমক দেওয়ার আগেই কেঁদে দেয়।আমার কড়া কথা শুনে এমনিতেই মেয়েটার চোখের কার্ণিশে অশ্রু ছলছল করছিলো।ধমক খেয়ে মেয়েটা এবার কেঁদেই দেয়।বেশি করে ফেললাম?

-প্লিজ ম্যাম আম্মুকে বলবেন না।আম্মু আমাকে মেরেই ফেলবে।কিন্তু আমি কি করবো বলুন?ভাইয়া আমায় বলেছে আপনাকে ভাবি না ডাকলে আমায় ফোনে এঞ্জেলা টম খেলতে দেবে না।তখন আমি ওদের কিভাবে খাওয়াবো, গোসল করাবো, পটি করাবো বলুন তো? কষ্ট পাবে না ওরা?

মেয়ের কথা শুনে আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝে উঠতে পারছি না।এরই মধ্যে রান্নাঘর থেকে আন্টির ডাক আসে,,,

-কিরে শিশির?তোকে গল্প করার জন্য মেঘের কাছে দিয়েছি?পড়বি নাকি আমি আসবো?
-আন্টি ওর পড়া অলরেডি কমপ্লিট।পড়ার মাঝে গল্প করলে মন ভালো থাকে।মন বসে পড়ায়।তাই আর কী…!আপনি শুধু শুধু ওকে ভয় দেখাবেন না।

আন্টির কথার জবাবে আমি বলি।মহিলা মেয়ের প্রতি একটু বেশিই কড়া।প্রথম দিকে মেয়েটা কথা শুনতো না।জেদ করতো।মহিলা তো আমার সামনেই মেয়েকে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় দিয়েছিলেন।আমি পরে ওনাকে আটকায়।এভাবে মারলে তো সন্তানের ভেতরে বাবা মার প্রতি ঢুকে যায়।মেয়েটা সেদিন আর পড়তেই পারলো না।কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গিয়েছিলো। আমায় জড়িয়ে ধরে কি কাঁদাটাই না কেঁদেছিলো!কিন্তু মানুষ হিসেবে আন্টি ভালোই আছেন।শিশির আমার লাস্ট টিউশন।প্রায়ই বক্সে করে জোর করে খাবার দিয়ে দেন আমায়।এখন পর্যন্ত ছ’টার মতো টিউশন করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত আন্টির মতো গার্ডিয়ান পাই নি।
শিশিরের বাবা আর্মিতে উচ্চপদস্থ পদে চাকরি করেন।খুব শীঘ্রই অবসর গ্রহণ করবেন।শিশিরের বড় ভাই আছে।নাম শুভ্র।ছেলেটাকে আমি খুব একটা দেখিনি।রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকায় খুব একটা দেখা যায় না তাকে বাসায়। টিউশনির শুরুর দিকে একবার তাকে দেখে ছিলাম।তাড়াহুড়ো করে সেদিন আসছিলাম।ব্যাগে পার্স ঢুকাতে গিয়ে কার সাথে যেন ধাক্কা লাগে আমার।চোখ তুলে লম্বা সুঠাম দেহের একজন যুবককে দেখতে পাই।মাস্ক থাকায় তার মুখটা ভালো করে দেখা হয় নি।তবে চোখ দুটো ভীষণ অমায়িক। আমি খাটো হওয়ায় আমার কাছে তাকে তালগাছ লেগেছে নাকি সে এমনিতেই তালগাছ আমি জানি না।আঙ্কেলও নাকি অনেক লম্বা।তাই বলা যায় শুভ্র বাবার মতো হয়েছে।চোখ দুটো দেখে মনে হয়েছিলো এই ব্যাটায় ভাজা মাছ উলটে খেতে পারে না।একবারে ইনোসেন্ট। কিন্তু এ যে ভাজা মাছের এক পিঠ খেয়ে আরেক পিঠ উলটে রাখতে পারে তা কেউ সহজে বিশ্বাস করতে চাইবে না।

-এই সামান্য বিষয় নিয়ে এখনো কাঁদতে হয় শিশির?এভাবে কাঁদলে মানুষ তো তোমায় কাঁদুনি শিশির বলে ডাকবে।

আনার কথায় যেন মেয়ের কান্নার মাত্রা আরও বেড়ে যায়।কাঁদতে কাঁদতে বলে,,,

-ডাকলে ডাকুক।ওরা বুঝবে কি আমার কষ্ট?

শিশিরের কথা শুনে আমি ফিক করে হেসে দেই।মেয়ে অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,,

-আমার কথা আপনার কাছে ফানি লাগলো ম্যাম?
-না,না। একদম না।তুমি তো জানো আমি অকারণে হাসি।বলো তোমার কথায় কি কষ্ট!

হাসি চেপে বলি। শিশির আমার দিকে চোখ ভর্তি অশ্রু নিয়ে তাকিয়ে বলে,,,

-আমার বুকের ভেতর আর গালে না খুব কষ্ট মিস!
-আচ্ছা,কেন?

কৌতুহল দিয়ে বলি আমি।মেয়ে নাক টেনে বলে,,

-আম্মু আমায় শুধু বকে তাই আমার বুকের ভেতর কষ্ট।আর ভাইয়া আমায় শুধু শুধু গালে থাপ্পড় মারে তাই আমার গালে ব্যথা আর কষ্ট।
-ইশ!নিশ্চয়ই তুমি দুষ্টুমি করো!শুধু শুধু বকবে আর মারবে কেন আম্মু ভাইয়া?
-মাঝে মাঝে আম্মু দুষ্টুমির জন্য বকে।আবার ভাইয়া দুষ্টুমি করে আমার নাম দেয়।টাকা মারে ভাইয়া।নাম দেয় আমার।।আবার ভাইয়া না?বাইরে যাওয়ার সময় দেয় মাইর আবার বাসায় এসে দেয় মাইর।
-তুমি আম্মুকে বলো না এভাবে মারে ভাইয়া?
-বললে ভাইয়া আরও মারে।

শিশিরের কথা শুনে যেমন হাসি পায় তেমন কষ্টও লাগে।ছেলেটাকে যতটা ভদ্র মনে হয় আসলে সে ততটা ভদ্র নয়।মিচকা শয়তান টাইপের অনেকটা।আমি শিশিরের কান্না মুছে দিয়ে বলি,,,

-ভাইয়াকে বলে দেবো না মারতে।এখন যাও মুখ ধুয়ে এসো। কেঁদে রাজকন্যার মতো চেহারাটাকে পেত্নীর মতো বানিয়েছে।

আমার কথা শুনে শিশির ওয়াশরুমের দিকে যায়।বের হলে হোমওয়ার্ক দিয়ে আমি বের হই মেসের দিকে।ঝোড় হয়েছে একটু আগে।আকাশ কেমন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।হাল্কা ঠান্ডা হাওয়া বইছে।বেশ ভালোই লাগছে আবহাওয়াটাকে।
হঠাৎ একটা চেনা চেনা ছায়া দেখতে পাই।আন্দাজ করি শুভ্র হবে।ব্যাটাকে একটু ঝাড়া দরকার।না হলে লায় পেয়ে তালগাছ হয়ে তালগাছের মাথায় উঠবে ব্যাটা।ভদ্রভাবে ডাক দিই,,,

-এক্সুইজমি।

সে আমার কথা শোনেনি নাকি শোনেও না শোনার ভান করে এড়িয়ে যাচ্ছে বুঝলাম না।আবার ডাক দিই,,,

-আসসালামু আলাইকুম শুভ্র ভাইয়া।সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব।আপনার সাথে কথা ছিলো।

এবার ব্যাটা আর এড়িয়ে যেতে পারে না।পেছন ঘুরে আমার সালামের জবাব দেন,,,

-ওয়ালাইকুম আস সালাম। জ্বী বলুন কি কথা?
-আপনি শিশিরকে কি শিখিয়ে দিয়েছেন?

আমার কথা শুনে লোকটা এমন ভান করলো যেমন সদ্যজাত শিশু।কিছুই বুঝেন না তিনি।আমি একটু কড়া গলায় বলি,,,

-চুপ করে আছেন যে?
-আমি কি শিখাবো।কিছুই শিখাইনি আমি।

তোতলাতে তোতলাতে বলেন উনি।আমি লম্বা শ্বাস নিয়ে বলি,,,

-মিথ্যা বললে পাপ হয়।আপনি উনাকে শিখিয়েছেন আমায় ভাবি ডাকতে।আর না ডাকলে বলেছেন ফোনে এঞ্জেলা টম খেলতে দেবেন না।একে তো বাচ্চাটাকে ফোনের প্রতি এডিক্টেড করছেন তারওপর এসব উলটা পালটা জিনিস শিখাচ্ছেন।দেখে তো মনে হয় ভাজা মাছ উল্টে খেতে পারেন না।মাসুম বাচ্চা একেবারে!আহা!

এতগুলো কথা শুনালাম। সেই হিসাবে লোকটার উচিত আমার কাছে ক্ষমা চাওয়া।কিন্তু সে তা না করে আমার কথা উড়িয়ে দিয়ে বাসার দিকে হাঁটা লাগান।আমি মাঝ রাস্তায় বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।


মেসে গিয়ে দেখি রুমমেট এশা দেওলিয়ার মতো দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে।কান্না করেছে মনে হয়। চোখ মুখ বেশ ফোলা।

-কি রে কি হয়েছে?

আমার কথা শুনে মেয়ে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দেয়।কি এক জ্বালা!আজকে কি কান্না দিবস নাকি?যে পাচ্ছে সেই আমায় জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠছে।

-আরেহ এশা কাঁদছিস কেন?কী হয়েছে?
-জানিস? ও না….ও না?

কথা শেষ করার আগেই আবার হাউমাউ করে কেঁদে দেয়।

-কার কথা বলছিস?
-নাবিল।নাবিল না আবার নুসরাতের পোস্টে লাভ রিয়েক্ট দিয়েছে।
-দিতেই পারে তো এতে কাঁদার কি আছে?
-কাঁদার কি আছে মানে?হারামজাদায় আমার সাথে ফ্লাট করছে বুঝিস না তুই?আজকেই ব্রেকাপ করবো খচ্চোরটা সাথে।

ঝাড়ি দিয়ে বলে উঠে এশা।ঝাড়ি খেয়ে আমি অনেকটা থতমত খেয়ে যাই।ইয়ার্কি করে এশাকে বলি,,,

-এই বলো জান,কলিজা,কিডনি। আবার হারামজাদা বলে গালিও দাও।বুঝি না তোমাদের ব্যাপার স্যাপার।
-বুঝবিও না।তুই তো সিঙ্গেল।সরি সন্ন্যাসী
-এইভাবে অপমান করলি?আমি সিঙ্গেল থাকতে চেয়েছিলাম শুধু।সন্ন্যাসী হয়ে যাবো বুঝলে কবেই কারও বাবু সোনা হয়ে যেতাম!

কথাটা বলে বাথরুমে চলে যাই।যা ভ্যাপসা গরম পড়েছে!অস্থির লাগছে খুব।শাওয়ার নিলে হয়তো একটু সস্তি পাবো!এমনিতেই আমি টাইম নিয়ে গোসল করি।ভ্যাপসা গরম পরায় প্রায় দেড়ঘন্টা সময় নিয়ে শাওয়ার নিই।এত টাইম নেওয়ায় এশা হারামিটা দরজায় নক করতে লাগে,,,

-কিরে মরলি নাকি?
-হ্যাঁ মরেছি।চল্লিশার দাওয়াত খেতে আসিস। বাথরুমে এসেও দেখছি শান্তি দিস না।
-তাড়াতাড়ি বের হো।একটা গুড নিউজ আছে।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে শাওয়ার নিয়ে বের হই।দেখি এশা কফি বানাচ্ছে।

-কী গুড নিউজ দিবি বলছিলি?
-এত তাড়া কিসের?পেয়ে যাবি তো বলেছি।তুই বস আমি কফি নিয়ে আসছি।

এশা বলে।আমি বিছানায় বসে ফ্যানের বাতাসে চুল শুকাতে লাগি।কিছক্ষণ বাদে এশা কফি নিয়ে আসে।কাপে আলতো করে এক চুমুক দিয়ে বলি,,,

-বল কি গুড নিউজ?
-গেস কর।
-তোর আর নাবিলের ঝামেলা মিটে গেছে তাই তো?
-আরেহ ধুর!ঐ বানরের কাছে যদি আমি আর গেছি!
-তাহলে?
-তুই আর আমি একই ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছি।

এশার কথা শুনে নিজেকে স্থির রাখতে পারি না।এক লাফে উঠে এশাকে জড়িয়ে ধরি।অনেকের কাছে এই ব্যাপারটা সামান্য হলেও আমার কাছে বিশাল অর্জন।সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়ে আমি।এসএসসি দেওয়ার পরই বিয়ের পিঁড়িতে বসার কথা ছিলো।অনেক জোর জবরদস্তি করে কলেজে বাইরে চলে আসি।বাবা বেসরকারি কলেজের শিক্ষক।সংসার তার আয়েই চলে।দাদি এখনো বেঁচে থাকায় তার কথায়ই সংসার চলে।বেতন পাওয়ার সাথে সাথে বাবা দাদির হাতে সব টাকা তুলে দেন।যার যা লাগবে দাদির কাছ থেকে চেয়ে নেবে।ছোট থাকতেই নাকি দাদি তার বোনের নাতির সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেন।কিন্তু দাদির বোনের সেই নাতিকে আমার একদম পছন্দ না।মুখ দেখলেই কেমন গা জ্বলে।তার চাহনিতে খারাপ উদ্দেশ্য স্পষ্ট দেখি।কথা ছিলো এসএসসির পর তার সাথে বিয়ে হওয়ার।রেজাল্ট ভালো হওয়ায় বাবাকে কোনো রকমে মানিয়ে বাইরে চলে আসি।আমার সিদ্ধান্তে বাবা সম্মতি দেওয়ায় দাদি বাবার ওপর নারাজ।দাদির মতে মেয়েদের পড়াশোনার অত দরকার নেই। শেষে তো অন্যের বাড়িতে গিয়ে ঘর সামলাতে হবে।মেয়েদের পড়াশোনা মানেই টাকা নষ্ট। দাদির কাছে টাকা থাকায় বাসা থেকে কোনো খরচ পাই না।তাই বাধ্য হয়ে টিউশন করে নিজের খরচ চালাই।বাবাকে ফোন দিয়ে খবরটা জানাই।বাবা খুশীতে কেঁদে দেন।বাইরে পড়ার জন্য উনি শর্ত দিয়েছিলেন উনি যে পাব্লিক ভার্সিটিতে পড়েছেন আমিও যেন সেই পাব্লিক ভার্সিটিতে ভর্তি হতে পাই।তাহলেই বিয়েটা আটকিয়ে রাখবেন তিনি যে পর্যন্ত না আমি প্রতিষ্ঠিত হই।আজ আমি সফল।আমি আমার বাবার শর্ত মানতে পেরেছি।

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ

#একজোড়া_পায়রা
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here