#উজানে_ফেরে_নদী
৯.
উজান কি আসলেই তাকে ভালবাসতো? ও কি সত্যি তাকে এখনও খুঁজে বেড়ায়? কিন্তু তার জীবনটা তো আর আগের মত নেই। কতদিন যে সে ঘরের কোনে লুকিয়ে বসে থেকেছে তা তার মনে নেই। তখন শুধু আশেপাশে ভয়ঙ্কর সব ছায়া দেখতে পেত। আরিফ আর ফুপু তাকে মানসিক ডাক্তারের কাছে নেয়া শুরু করলো। প্রায় বছর খানেক কাউন্সেলিং আর মেডিসিন নেবার পর সে যখন অনেকটা স্বাভাবিক হল তখন আরিফ তাকে বাড়িতে নিয়ে এল। তবে এখনও হঠাৎ হঠাৎ তার প্যানিক আ্যাটাক হয়। মাঝে মাঝেই বিষন্নতা পেয়ে বসে। তখন আবার সে ঘরবন্দী হয়ে পড়ে।
জাহানারা বাটিতে নারিকেল তেল নিয়ে মেয়ের ঘরে এলেন। বিয়ের ঝামেলায় কদিন মেয়েটার তেমন খেয়াল রাখা হয়নি। মেয়েটার জীবনটা এমন হবার জন্য তিনি নিজেকেই দায়ী ভাবেন। ওই সময় হয়তো ওই ভাবে বাড়ি থেকে ঢাকায় না পাঠানোই উচিত ছিল।
-আয় মাথায় তেল দিয়ে দেই। চুলগুলোর অবস্হা দেখেছিস?
-এই রাতের বেলা তেল দিব না মা।
-অল্প দিয়ে দেব। ভাল লাগবে দেখিস।
নদী এসে মায়ের পায়ের কাছে বসলো। চুলে তেল দিতে তাক প্রচন্ড বিরক্ত লাগে।
-ছেলেদুটো তোকে খুঁজছিল।
-কোন ছেলে?
-আরিফের বন্ধুরা।
-কেন?
-ধন্যবাদ দিতে। তুই নাকি চা পাঠিয়েছিলি?
-হ্যাঁ। উনি বকুলতলায় একা একা বসে ছিলেন। আমার জন্য চা করছিলাম। তাই ওনাকেও পাঠালাম।
-ছেলে দুটা বেশ ভাল বল। ওদের মত কারো একজনের সাথে তোর বিয়ে দিতে পারলে আমি নিশ্চন্ত হতাম।
-কি যে বল মা।
-কেন তুই কোন দিক দিয়ে খারাপ বল?
নদী মনে মনে ভাবে বলা যাবে না মা। বললে তুমি ভীষন কষ্ট পাবে।
চুলটা আঁচড়ে বেনি করে দিয়ে তিনি উঠলেন।
-নিচে আয়। সবাইকে খাওয়া দিতে হবে। নাই নাই করেও বাসায় অনেক লোক।
-চাচীদের বল।
-চাচীরা সব রান্না ঘরেই আছে। তুইও আয়।
মেয়েটা সারাদিন একা একা ঘোরে। তিনি চান নদী আবার স্বাভাবিক হোক। সবার মধ্যে থেকে হইচই করুক। এই কদিন তো বিয়ে বা হলুদের কোন আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে তিনি ওকে দেখেননি।
ঘুম থেকে অনেক সকাল সকাল উঠলেও নাস্তা নদী অনেক দেরিতে করে। সবার সাথে টেবিলে বসতে তার আর ভাল লাগে না। তাই সবার খাওয়া শেষ হলে সে একা একাই নাস্তা করে। তার নাস্তার মাঝ পথেই হৃদি আর আরিফ এসে নাস্তার টেবিলে বসলো। নদী দুজনকে ভাল করে লক্ষ্য করে। দুজনের মুখ সুখের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে।
কি সুন্দর দুজন টুকটুক করে কথা বলছে। সে তার প্লেট নিয়ে উঠে পড়লো। ওদের আলাদা স্পেস দেয়া দরকার। আরিফ ওকে নাস্তা শেষ না করেই উঠতে দেখলো।
-উঠছিস কেন? খাবার শেষ কর।
-আমার খাওয়া শেষ।
নদী হাত ধুয়ে ফিরে এল সাথে সাথেই। আরিফের পাশে এসে দাঁড়ালো।
-কিছু বলবি?
-তোমার বন্ধুরা পৌছেছে?
-হমম, একটু আগেই ম্যাসেজ করেছে।
-তোমার ফোনটা একটু লক খুলে দাও তো।
-কেন কি দরকার?
-এত কথা বলতে পারবো না।
আরিফ লক খুলে এগিয়ে দিল। সে উজানের ফোন নাম্বারটা দেখে নিল। আগের নাম্বারটাই আছে। নাম্বারটা কপি করে তার ফোনে পাঠিয়ে দিয়ে ম্যাসেজটা ডিলিট করে দিল। তারপর ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে সে সেখান থেকে চলে এল।
সে তো ফোন ব্যবহার করা ছেড়েই দিয়েছিল। পুরাতন ফোনটা ফুপুর বাসাতেই আছে । কিছুদিন আগে আরিফ নতুন ফোন এনে দিয়েছে। নিজের ঘরে এসে নাম্বারটা সেভ করে। সে ফোন করলে কথা বলবে তো?
তুলি আর মিতা আপু একদিন এসেছিল ফুপুর বাসায় তাকে দেখতে। রাফাতের সাথে মারামারির ঘটনা তখন জেনেছিল। তুলি বলছিল উজান প্রায় ওকে খুঁজতো। তুলিকে ফোন করে খবর জানতে চাইতো।
কেন যে আমরা ঠিক সময়ে সঠিক মানুষকে চিনতে ভুল করি।
১০.
ছুটির দিনগুলো উজান বিছানায় গড়গড়ি করেই কাটিয়ে দেয়। তার আজকের পরিকল্পনাও তেমন ছিল। গত সপ্তাহে বিয়ে বাড়ি গিয়েছিল তাই কোনো রেস্ট হয়নি। কিন্তু সকাল থেকেই মায়ের চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়ি মাথায় উঠলো। সে হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে এল। বাবা পেপার পড়ছেন বসে। মা রান্না ঘরে একা একা চিৎকার করে যাচ্ছে।
-কি হয়েছে মা?
-কি আবার হবে? তোমরা সব বড় হয়েছ। এখন তো আমার দরকার নেই। আমার খোঁজ কে রাখে?
-মাথা ঠান্ডা কর তো মা। কি হয়েছে বল?
-তোর তো অফিস থাকে। উপমা ওর পড়া নিয়ে। কিন্তু ওই লোকটার তো তা নয়। হাঁটুর ব্যথায় হাটতে পারতেছি না। ওই লোকটাকে বললাম ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট নিতে । গায়েই লাগালো না।
-আমাকে বললেই তো হত। বিকেলে রেডি হয়ে থেকো। আমি নিয়ে যাব। এখুনি এপয়েন্টমেন্ট করে রাখছি।
নাস্তা খেয়ে এসে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো ম্যাসেজ এসেছে। তাও অনেক রাতে।
“নির্ধারিত সময় নিয়ে আমরা পৃথিবীতে আসি,
পুরোটা সময় হয়তো বেঁচে থাকি,
তবে এই বেঁচে থাকাও অনেকের কাছে শাস্তির মত..
মৃত্যুই হয়তো মুক্তি।”
অপরিচিত নাম্বার। এমন অদ্ভুত ম্যাসেজের মানে কি? কত রকম পাগল যে দুনিয়ায় আছে। ভুল নাম্বারে পাঠিয়েছে হয়তো। ল্যাবএইডে ফোন করে এপয়েন্টমেন্ট নিল। তারপর শুয়ে পড়লো। আপাতত আর কোনো কাজ নেই।
বিকেলে মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেও টেস্ট করিয়ে ফিরতে ফিরতে রাত হল বেশ। রাতের খাওয়া শেষে একটা সিরিয়াল দেখা শুরু করল। ফোনটা ভাইব্রেট করতেই তাকালো।
“আমরা আমাদের জ্ঞাতসারেই
প্রিয় কাউকে নীল আকাশের চেয়েও
অসীম সত্তা কল্পনা করি।
এরপর সেই অসীম সত্তা-ই কোন এক
মায়াবী সন্ধ্যায় আমাদের নিঃস্ব করে।”
আবারও সেই একি নাম্বার থেকে ম্যাসেজ। ফোন করলো সাথে সাথে। ফোন বাজলো কিন্তু কেউ ধরলো না। ম্যাসেজ লিখলো।
“কে আপনি? কি চাই।”
“কিছু তো চাই না।”
“কে আপনি বললেন না তো?”
“পরিচয় না বলাই মনে হয় ভাল।?”
“তাহলে বিরক্ত করবেন না প্লিজ।”
আর কোনো উত্তর পেলো না। যাক ভাল হয়েছে। এখনকার পোলাপানের কোন কাজ নাই। অযথা মানুষকে বিরক্ত করে। রনির এক বন্ধু এই ফোন কোম্পানিতে জব করে। ওকে নাম্বারটা দিতে হবে। কারে নামে রেজিস্টার করা হয়তো জানা যাবে।
“পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,
হয় নাকি?”
“সমস্যা কি আপনার?”
“অনেক সমস্যা। একদিনে বলে শেষ করা যাবে না।”
“তাহলে আর কি। নিজের সমস্যা নিজের কাছে রেখে দেন। অন্যের সমস্যার কারণ হবার তো দরকার নেই।”
““কোনদিন, আচমকা একদিন
ভালোবাসা এসে যদি হুট করে বলে বসে,-
‘চলো যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাই’,
যাবে..?”
অযথা যন্ত্রনা ভাল লাগে না। রনিকে কালকে অফিসে যেয়েই নাম্বারটা দিতে হবে।
চলবে….
এমি।