#উজানে_ফেরে_নদী

১১.

জাহানারা নদীকে নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। হৃদির নতুন সংসার গুছিয়ে দেবেন সাথে নদীকেও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন। হৃদির বিয়ের পর থেকেই লক্ষ্য করছেন নদী অনেক বদলে গেছে। বেশ উৎফুল্ল থাকে এখন। যে মেয়ে ঢাকায় আসতেই চাইতো না সে এককথাতেই ঢাকায় আসতে রাজি হয়ে গেল।

রাতের ট্রেনে নদীর বাবা তাদের দুজনকে উঠিয়ে দিলেন। আরিফ স্টেশন থেকে তাদের পিক করবে। ট্রেন ঠিক সময়েই এসে পৌঁছাল। তাদের বগির সব যাত্রি নেমে যাবার পর তারা দুজন নামলো। কুলি তাদের ব্যাগগুলো তুলে নিয়েছে। স্টেশনের বাইরে আসতেই তারা আরিফকে দেখতে পেল।
গাড়িতে তাদের বসিয়ে ব্যাগগুলো ঠিকমত উঠিয়ে আরিফ এসে বসলো। ড্রাইভারকে তাড়াতাড়ি চালাতে বলল কেননা চাচীদের বাসায় পৌছে দিয়ে তাকে অফিসে যেতে হবে। এখনও রাস্তায় তেমন যানযট নেই। বেশী সময় লাগবে না।

-কোন অসুবিধা হয়নি তো চাচী?
-না বাবা। সব ঠিকঠাক ছিল।
-তোর কি অবস্হা? সব ঠিক আছে?
-হমম।
-আমি ডাক্তারের এ্যপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রেখেছি। শনিবার বিকেলে।
-আমার আর ঔষধ খেতে ভাল লাগে না।
-সেটা বললে তো হবে না। রেগুলার ঔষধ খাচ্ছিস বলেই তো এখন অনেক ভাল আছিস। আর এবার তো তোকে আরও বেটার মনে হচ্ছে।
-হ্যাঁ বাবা ঠিকই বলেছে। গত কয়েকদিন ধরে আল্লাহর রহমতে অনেকটা ভাল আছে। মনে হচ্ছে যেন আমার আগের মেয়েটাকে ফিরে পেয়েছি।
-এটা তো খুবই ভাল খবর? কিরে নতুন কিছু হয়েছে নাকি?
-কি যে বল।
নদী লাল হয়ে গেল। মাথা নিচু করে ফেলল। আরিফ দেখে চিন্তিত হল। হঠাৎ এমন পরিবর্তনের কারণ কি?

সবাই বাসায় ঢুকতেই হৃদি দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরলো।
-আরে ছাড় তো। সারা রাত জার্নি করে এসেছি। গায়ে কত জীবানু। আগে গোসল করি তারপর ধরিস।
-কি যে বল না মা। তাহলে আমরা যখন বাসায় যাই তখন তুমি আমাদের সাথে সাথে ধর কেন?
-খুব তো কথা শিখেছিস। এখন কোন ঘরে থাকবো দেখিয়ে দে। নতুন বাসাটা তো বেশ ভালই দেখছি। আর বড় ব্যাগটায় খাবার আছে। ফ্রিজে রাখ আর আরিফ কি খাবে সেগুলো গরম করে ফেল।

হৃদি ওদের ঘরে দিয়ে রান্না ঘরে আসে। খাবারের ব্যাগটা আরিফ রান্নাঘরেই রেখেছে। সে বক্সগুলো খুলে দেখলো। সব তাদের পছন্দের জিনিস। মা পারেও এসব করতে। আরিফ রেডি হয়ে এসে রান্না ঘরে উকি দিল।
-টেবিলে বস। আমি খাবার গরম করছি।
-সময় নেই। তুমি এক কাজ কর বক্সে দিয়ে দাও। অফিসে যেয়ে খাব। একটু বেশি করেই দিও। রনি আর উজান আছে।
-ওনাদের বাসায় বল একদিন। তাহলেই তো হয়।
-আরে আমার বউয়ের মাথায় তো অনেক বুদ্ধি। এই সপ্তাহে তো ব্যাস্ততা। পরের সপ্তাহে বলি কি বল?
-বল। মা তো বেশ কিছুদিন থাকবেনই। আপুও আছে। আমার তো কিছু করতে হবে না।
-ও তাই বলি। হঠাৎ দাওয়াত কেন। নিজের রান্না করা লাগবে না তাই।
-আমার রান্না তো অতটা ভাল না। এবার আম্মুর কাছে শিখে নেব।
-আচ্ছা নিও। এখন তাড়াতাড়ি কর।

জাহানারা গোসল থেকে বাহির হয়ে এসে দেখেন আরিফ চলে গেছে। হৃদি তখনও জিনিসপত্র গুছাচ্ছে।
-ছেলেটা খেয়ে যায়নি?
-নিয়ে গেছে মা। বন্ধুদের সাথে খাবে।
-ওর বন্ধু দুইটা কিন্তু বেশ ভাল।
-ভাল তো হবেই। কত ভাল পরিবারের ছেলে দুজনেই। আর উজান ভাই তো ঢাকা ইউনিভার্সিটিতেই পড়তো। নদী আপুদের ডিপার্টমেন্টেই। ও হয়তো চিনতেও পারে।
-চিনলে নিশ্চই বলতো।
-তোমার মেয়ে যে চাপা। কাউকে কিছু বলে।
-তাও ঠিক বলেছিস। কিন্তু এখন অনেক ভাল আছে জানিস।
-দেখে তো তাই মনে হল। বেশ হাসিখুশি। কাল ওকে নিয়ে তাহলে মুভি দেখতে যাব। খুব ভাল একটা বাংলা মুভি এসেছে। আর শপিং ও করবো।
-জিজ্ঞেস করে দেখ কি বলে। আর আরিফের কাছেও অনুমতি নিয়ে রাখিস।
-কাল তো শুক্রবার মা। ওকে নিয়েই যাব। তুমি চিন্তা করো না।

নদী গোসল করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। এশহরের মানুষগুলো সকাল থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাস্তায় কত রকম মানুষের আনাগোনা। সামনের বাসার বারান্দায় একজন মাঝবয়সি লোক খালি গায়ে বসে দাড়ি সেভ করছে। সে ঘরে চলে এল। দরজা জানালার পর্দাগুলো টেনে দিল।

হৃদিটা একদম আনাড়ি। বাড়িঘর কিচ্ছু গুছায়নি। কোন জিনিস ঠিক জায়গায় রাখা নেই। মা এসেই সব ঠিক করতে লেগে গেছে। সে এসে মায়ের কাছে দাঁড়ালো।
-কি করতে হবে মা।?
-তোর এই ধুলার মাঝে কিছু করতে হবেনা একটু পরেই তো হাঁচি শুরু হবে। বুয়াকে দিয়ে আগে সব মুছে নিই তারপর আসিস। এখন তুই যা। আর তোর বাবাকে জানিয়েছিস আমরা পৌঁছেছি?
-আরিফ ভাই তো স্টেশনেই কথা বলল। তুমি ভুলে গেলে?
-দেখেছিস মনেই নেই। তুই যা। আর হৃদিকে পাঠিয়ে দে।

ফোনটা চার্জে লাগানো ছিল। সেটা নিয়ে সে শুয়ে পড়লো। টায়ার্ড লাগছে। ট্রেনে একদম ঘুম হয়নি। মা বলা মাত্রই তো রাজি হয়ে সে ঢাকা চলে এল। কিন্তু যার জন্য এল তার সাথে কি দেখা হবে?

“একবার ডাক দিয়ে দেখ আমি কতটা কাঙ্গাল,
কত হুলুস্থূল অনটন আজন্ম ভেতরে আমার..”

ম্যাসেজটা পাঠিয়ে সে উজানের বিরক্ত মুখটা চিন্তা করে হেসে ফেলল। ম্যাসেজটা এল একটু পরেই।
“আপনার কি মাথায় সমস্যা?”
“সমস্যা তো ছিলই। এখন মনে হয় আরও বেশী হয়েছে।”
“ইমপসিবল।”

“তোমারো কি কিছু কথা ছিলো কিছু নীল ব্যর্থতা
কিছু বিনষ্ট ফসলের ক্ষেত
আজীবন নির্বাক অপেক্ষার সাহস
তোমারো কি কিছু কথা ছিলো কিছু লালিত বেদনা
কিছু বিপরীত নদীতে ফেলে আসা নিজস্ব প্রতিকৃতি

আমার কিছু কথা ছিলো কিছু দুঃখ ছিলো
আমার কিছু তুমি ছিলো তোমার কাছে !”

“আপনি যদি আর একটা ম্যাসেজ করেন তাহলে আপনাকে ব্লক করতে বাধ্য হব।”
“আপনি তো বেশ মজার। ব্লক কি মানুষ বলে কয়ে করে নাকি?”

নদী ফোনটা রেখে হি হি করে হাসতে লাগলো। মানুষটা এখনও ঠিক আগের মতই আছে। একটুও বদলে যায়নি। হৃদি এসে তার পাশে বসলো।

-কি রে আপু একা একা হাসছিস কেন?
-পুরোনো কথা মনে পড়লো তাই।
-কি কথা?
-আমাদের ডিপার্টমেন্টের একজন বড়ভাই ছিল। যখন আমার কোন কিছুর দরকার হত আলাদিনের জিনির মত সামনে চলে আসতো। যেন উনি জানতো আমার এখনই ওনার সাহায্য লাগবে।
-বাহ বেশ মজার মানুষ তো। নিশ্চই তোমাকে ফলো করতো?
-করতো মনে হয়। কিন্তু আমি তো তাকে চিনতে পারিনি বল।
-জীবনে চলার পথে ভুল হতেই পারে আপু। সেই ভুলগুলো সংশোধন করেই আমাদের আবার চলা শুরু করতে হয়। তুমি তোমার কথাই চিন্তা করে দেখ? যদিও আমি সব কিছু জানিনা তবুও বলছি, তোমার ভুলের কারনে তুমি নিজে অসুস্হ হলে। তোমার নিজের পড়ালেখা নষ্ট হল। তোমার জীবন থেকে কয়েকটা বছর এমনি হারিয়ে গেল। কিন্তু যার জন্য এমন হয়েছে তার হয়তো কিছুই হয়নি। হয়তো বলছি কেন আসলেই কিছু হয়নি। এখনও সময় আছে আপু। আবার নতুন করে শুরু কর।
-তোর তো নেতা হওয়া উচিৎ। যে কঠিন বক্তব্য দিলি।
-হতেও পারি ভবিষ্যতে। যেটা বলতে এসেছিলাম। কাল তোকে নিয়ে মুভি দেখতে যাব। আর সাথে শপিং।
-আমি যাব না। তোরা যা।
-এই সব বলে লাভ নেই। যেতেই হবে।

তার তো বাহিরে যেতেই ভয় লাগে। যদি কখনও ওই শয়তানটার সামনে পড়ে যায় তখন কি হবে?

চলবে…

এমি।

*পর্ব ছোট হবার কারণে আমি দুঃখিত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here