#ইস্ক
#সাদিয়া
২৫
বেগতিক জ্বরে ভুলভাল বকছে মেয়েটা। ইয়াদ নির্বাক ও নির্বোধের মতো দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় আসছে না কি করে পরিস্থিতি সামাল দিবে। এত দুশ্চিন্তার মাঝেও হাসি পাচ্ছে তার। কারণ তিতিল এই জিনিস পত্র দিয়ে তাকে ফিকা মারছে তো আবার এসে জড়িয়ে ধরছে। মাঝে মাঝে শার্টের উপরে দাঁত ফুটিয়ে দিচ্ছে। ইয়াদ খুব চেষ্টা করতে লাগল এমন অবস্থার লাগাম টানতে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। উপায়ন্তর না পেয়ে ইয়াদ তিতিলের হাত ধরে বিশাল ধমক দিল। মেয়েটা এবার একদম নিরব হয়ে গেছে। খানিক ঠোঁট বাঁকিয়ে গোলগোল চোখে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে ইয়াদের দিকে। যেন এখনি কিছু একটা অঘটন ঘটিয়েই ছাড়বে সে।
ইয়াদ বেশ ধমকের সুরে বলল
“তখন বলেছিলাম না উঠে আসতে? এখন হলো তো মজা?”
“….
“আর একটুও যদি নড়াচড়া করেছো তো বুঝাব আরো মজা। চুপ করে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ো।”
“….
“কি বলছি আমি? আর ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন তুমি?”
তিতিল এবার ভেতরের একটু একটু রাগটাকে নিয়ে এগিয়ে গেল ইয়াদের দিকে। গিয়েই তার ঠোঁটজোড়া দখল করে নিল। ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি হলো ইয়াদ কিছু বুঝতেও পারল না। তিতিলের জ্বর মিশ্রিত উষ্ণ ঠোঁট গুলি তার ঠোঁটে গভীর পরশ বুলে দিচ্ছে। হঠাৎ ইয়াদ নিজের ঠোঁটে ধারালো কিছু অনুভব করল। বুঝল পাজি মেয়েটা তার ঠোঁটে দাঁত ফুটিয়েছে। তাড়াতাড়ি করে ইয়াদ ছাড়াতে গেলে তিতিল ঝাপটে ধরল তাকে। এক প্রকার জোর করেই নিজেকে ছাড়িয়ে আনল ওই ধারালো ইঁদুর দাঁত গুলি থেকে। ইয়াদ ঠোঁটে হাত দিয়ে সেটা আবার নিচে নামিয়ে দেখল রক্ত বের হয়েছে কি না। রক্ত বের না হলেও ঠোঁট ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠেছে। ইয়াদ তাকাল তিতিলের দিকে। বিড়বিড় করে বলল,
“বদজাত মেয়ে।”
“বকলে আবার দিব টুস করে কামড়।”
“কি করবে তুমি?” এক পা এগিয়ে এলো ইয়াদ।
তাকে এগিয়ে আসতে দেখে জ্বরের ঘোরে থাকা মেয়েটার হুশ ফিরল না। সে দাঁত বের করে হেসে জবাব দিল “কামড় দিব। এবার কিন্তু রক্ত বের করে ছাড়ব।” ইয়াদ আরেকটু এগিয়ে এসে বলল “তাই?” মেয়েটা অবুঝের মতো মাথা নাড়াল। ইয়াদ কে এগিয়ে আসতে দেখে একটুও পিছাল না মেয়েটা হয়তো জ্বরের ঘোরে আছে বলেই। সুস্থ হলে কি তিতিল এমন কান্ড করে বসত? কিংবা তার এগিয়ে আসা দেখে কি এভাবেই ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতে পারত মেয়েটা? ভয়ে কি একটুও পিছিয়ে যেতো না বা থরথর করে কাঁপত নয় কি? কি জানি এর উত্তর জানা নেই ইয়াদের। সে একদম প্রেয়সীর কাছে। জ্বরে হুশ জ্ঞান হীন মেয়েটার একদম নিকটে। ইয়াদ তিতিলের কোমর চেঁপে এগিয়ে আনল। আদুরে গলায় বলল,
“আমি দিলে সেই চাঁপ নেওয়ার মতো ক্ষমতা আছে কি তোমার?” মেয়েটা তার কথার মানে বুঝল কি না কে জানে। তার কাঁধে দুই পাশে হাত উঁচু করে রাখল। তারপর হেসে জবাব দিল “না করেছে কে আপনাকে? দিন না আমার ঠোঁটেও একটু ধারালো পরশ।” ইয়াদ উত্তর দিল না। খানিক হাসল। সে জানে এসব মেয়েটা ঘোরে করছে। অথচ মুহূর্ত টা কতই না সুন্দর। সময় টা যদি থমকে যেত কিংবা তিতিল সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় এমনটা দাবী করত? সত্যিই যদি তিতিল চাইত তাকে ভালোবাসার পরশে সিক্ত করতে তাহলে ইয়াদ একটা সেকেন্ডও দেরি করত না। কিন্তু এ সবের কিছুই হচ্ছে না এখন। ইয়াদ গাঢ় করে তিতিলের কপালে চুমু খেলো। মেয়েটার নেতিয়ে পড়া ফুলের মতো হয়ে আছে। হয়তো তার ভালোবাসার পরশটা বুঝতে পেরেছে।
ইয়াদ অনুভব করল তিতিল ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সে তার মুখটা উঁচু করে দেখল চোখ পানিতে ভিজে গিয়েছে। হঠাৎ এমন কান্নার কারণ বুঝল না সে।
“তিতিল আমি কি তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম?”
মেয়েটা নত মস্তিষ্কে মাথা নাড়ল উপর নিচ। ইয়াদ আর কিছু বলতে পারল না। তিতিল এবার বলেই ফেলল,
‘আপনি খুবই পঁচা। আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছেন। আমি আপনার জন্য অনেক অপেক্ষা করেছি। অনেক! কিন্তু আপনি আসেন নি। প্রতিদিন আপনার জন্যে কাঁদতাম। কিন্তু আপনি? আপনি খুব পঁচা। সরে যান আমার থেকে। সরে যান।” তিতিল মৃদু ধাক্কা দিতে লাগল ইয়াদের বুকে। ইয়াদ তিতিলের বাহু ধরে টেনে শক্ত করে চেঁপে ধরল তিতিলকে বুকের মাঝে। বুকের মাঝে অবাধ্য পাখির মতো ছটফট করলেও মেয়েটা এবার শান্ত হয়ে গিয়েছে। তিতিল কে শান্ত দেখে ইয়াদ আরেকটু শক্ত করে বাহুডোরে আঁকড়ে নিল তিতিল কে। অজান্তেই ছেলেটার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল দুই ফোঁটা। আসলেই সে ভুল করেছে। মহা ভুল করেছে তিতিল কে কষ্ট দিয়ে।
তিতিলের চোখ বুজে আসছে। মেয়েটা বিরবির করে বিলাপ পারছে অবচেতন মনে। যার কিছুই ইয়াদ বুঝে উঠতে পারছে না। ছটফট করা তিতিল টা এবার শান্ত হয়েছে। ইয়াদ তার দিকে একবার তাকিয়ে কোলে তুলে নিল। জ্বর বেশ বাড়ছে। কতবার না করেছিল এ অবেলায় না ভিজতে তবুও অবাধ্য মেয়েটা বারণ মানেনি।
ইয়াদ তিতিল কে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে রান্নাঘর থেকে একটা বাটিতে পানি নিয়ে এলো। তারপর নিজের রুমাল নিয়ে পানিতে ভিজিয়ে তিতিলের কপালে লেপ্টে দিল। মেয়েটার বিড়বিড়ানো এখনো কমেনি। ইয়াদ চুপ করে শুনার চেষ্টা করছে তবে পারছে না।
একটু পরপর তিতিলের কপালের জলপট্টি ভিজিয়ে দিতে আরম্ভ করল। কিন্তু জ্বর কমছে না। বাহিরে আবার ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এখন থেকে বাজারও খানিক দূরে কি করবে বুঝতে পারছে না। তিতিলের উপর দুইটা কম্বল মেলে দিল ইয়াদ। তবুও মেয়েটা কেঁপে কেঁপে বিড়বিড় করে উঠছে। ইয়াদের আর সহ্য হচ্ছে না তিতিলের এমন কষ্ট। সে রান্নাঘরে গেল। খুঁজে খুঁজে সরষের তেল বের করে তাতে রশুনের কোয়া দিল। তারপর সেটা গরম করে নিয়ে তাড়াতাড়ি তিতিলের নিকট গেল। হাতে পায়ে যত্নে গরম তেল মালিশ করে দিল ছেলেটা। হীম শীতল হাত পা গুলিতে যেন এবার রক্ত চলাচল শুরু হয়েছে। কিন্তু মেয়েটার শরীর এখনো কেঁপে কেঁপেই উঠছে। ইয়াদের বুকে এবার চিনচিন ব্যথা শুরু হলো। কপালে চিন্তার ভাঁজ আর মুখে কষ্টের।
হঠাৎ তিতিল বলে উঠল “আমার খুব ঠান্ডা লাগছে একটু, একটু জড়িয়ে ধরুন না ইয়াদ।” এই প্রথম তিতিলের মুখে নিজের নাম শুনে শিহরণে কেঁপে উঠল ইয়াদের বক্ষস্থল। শুকনো ঢোকও গিলল সে। এবার যেন তার হাত পা’ই ঠান্ডা হতে আরম্ভ করেছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। তিতিল আগের মতোই চোখ বন্ধ করে আছে। আগের মতোই ঠোঁট নড়ছে তার।
ফের বলে উঠল “কি হলো ধরছেন না কেন একটু? আমার খুব ঠান্ডা লাগছে। জ জড়িয়ে ধরুন।”
জ্বরের ঘোরে হোক কিংবা অন্য কিছুতে ইয়াদের বুকে সহস্র ঢেউ বারি খেয়ে যাচ্ছে তিতিলেরর প্রাণঘাতী কথায়। মনে প্রাণে চাইছে মুহূর্ত টা তিতিল কে নিজের করে নেওয়ার হোক। কিন্তু সেটা ভুল। এমনিতেই মেয়েটা তার উপর রাগান্বিত এবার যদি এমন মারাত্মক ভুল হয়ে যায় নিজের দ্বারা তবে মেয়েটা কিছুই ক্ষমা করবে না তাকে। এই ভুল সে করতে চায় না। ইয়াদ এক পলকে তাকিয়ে আছে তিতিলের কাঁপা ঠোঁটের দিকে। ভেতরে যে ঘূর্ণিঝড় বইছে তার। যা বুকের ভেতর তছনছ করে দিচ্ছে। দাঁতে দাঁত কিটে নিজেকে বৃথা বুঝ দিচ্ছে ছেলেটা।
কপালে জলপট্টি দেওয়ার সময় তিতিল তার হাতটা খপ করে ধরল। মেয়েটার উষ্ণ হাতটা তার শরীরের লোমকূপ নাড়িয়ে দিল। অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে তিতিলের দিকে। ভুলেও সে কোনো ভুল করতে চায় না। ভ্রু উঁচু করে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। এই মেয়েটা কি বুঝতে পারছে না কি করতে যাচ্ছে সে? কোন ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠেছে সে। এর পরিণতিও ভালো হবে না সেটা কি এই মেয়েটা বুঝতে পারছে? একবার যদি সে নিজেকে সামলানোর বাহিরে চলে যায় তখন কোন মুহূর্তে উপনীত হতে হবে যদি জানত মেয়েটা তবে কি এমন করত? ইয়াদ চোখ বন্ধ করে ঢোক গিলল। নিজেকে সামলানোর যুদ্ধ টা এবার আস্তে আস্তে আরো কঠিন হতে শুরু করে দিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে তার দ্বারা বিরাট ভুল হওয়ার আশংকা পাচ্ছে সে। তাই তিতিলের গরম হাতের থেকে নিজের হাতটা বের করে নিতে চাইলে তিতিল এবার তার হাত ধরে টান দিল। ইয়াদ দেখল মেয়েটা তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই নেশাক্ত চোখ তাকে কিছু বলতে চাইছে। কিছু একটা ইঙ্গিত করছে। ইয়াদ যেন সেই নেশায় আস্তেআস্তে ভীষণ বাজে রূপে ডুবে যেতে লাগল। ঢোক গিলে সে বলল,
“তিতিল হাতটা ছাড়ো। জানো না তুমি কি করছো।”
“….
“তিতিল হাতটা ছাড়ো।”
“একটু উষ্ণ পরশ দিবেন ইয়াদ? আমার হৃদয়টাকে একটু উষ্ণতা দিন না?”
“তিতিল তুমি জ্বরের ঘোরে উল্টাপাল্টা বকছো। এমন কিছু হলে সুস্থ মস্তিষ্কে তুমি আমাকে ঝাড়ু দিয়ে দৌড়াবে। দেখো ভুল আগেই করেছি নতুন করে আর তোমায় নেশায় পড়ে এমন ভুল করতে চাই না যাতে তোমাকেই হারাতে বসি।”
“একটু উষ্ণতা দিন না ইয়াদ। প্লিজ।”
ইয়াদের শরীর মন আর কিছুই সায় দিচ্ছে না। ইচ্ছা করছে চিৎকার করে বলতে “আমার ভালোবাসার পরশে তোমায় উষ্ণ করতে চাই তিতিল। আমার প্রতিটা ছুঁয়া তোমায় হৃদয়ে খোদাই করে দিতে চাই।” ইয়াদ চুপ থেকে সর্বোচ্চ আর শেষ চেষ্টা টা করল নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে। কিন্তু তিতিলও নাছোড়বান্দা সে এবার ইয়াদের হাত ছেড়ে কলার চেঁপে নিজের দিকে টেনে আনল। তাল সামলাতে না পেরে ইয়াদ তিতিলের দিকে ঝুঁকে গেল। তিতিলের চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
“খুব উষ্ণতা পাওয়ার শখ জেগেছে হৃদয়ে?”
তিতিল স্মিত হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। ইয়াদ এক হাতে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ফিসফিসানো গলায় বলল “আজকের উষ্ণতা তুমি ঘোরের মাঝেও মনে রাখবে। তারপর দেখব আর কোনো দিন এই ইয়াদের উষ্ণতা পাওয়ার লোভ জাগে কি না। উষ্ণতা নিতে তৈরি তো আমার ভালোবাসা?”
তিতিল জবাব দিল না। মুচকি হাসল। ইয়াদ তিতিলের কপালে গভীর চুমু দিলি তিতিল নিজ হাত ইয়াদের কাঁধের উপর রাখে। ইয়াদ একবার তিতিল কে দেখে ঠোঁটে ডুব দিল। তিতিলের পরদে পরদে উষ্ণ ছুঁয়া এঁকে দিতে লাগল। উন্মাদের মতো তিতিল কে ঝাপটে ধরেছে ছেলেটা। তিতিলও শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল নিজের জমিয়ে রাখা ভালোবাসা কে। টিনের চালে ঝুম বৃষ্টির আওয়াজ। একটু একটু করে রাত বাড়ছে আর বাড়ছে ইয়াদের তিতিলকে দেওয়া উষ্ণতা।
চলবে….