#ইস্ক
#সাদিয়া

২৩
ইয়াদের কান্নার বেগ কমবে বৈ বাড়ছে ক্রমশ। গলা ফাটিয়ে কেঁদে যাচ্ছে ছেলেটা আর একটা মেয়ে হয়ে তিতিল ওভাবে কাঁদতে পারছে না। অথচ তার ওড়না চোখের পানিতে ভিজে একাকার। বুকের ভেতরের প্রবলধারে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। নিশ্বাস টা থেমে থেমে আসছে। ইয়াদের ওমন কান্না বুকের আগুন আর কষ্ট কে দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণ করছে। এ দহন বিরহ সওয়ার অক্ষমতা প্রকাশ করে তিতিল দরজায় ধাক্কা দিল। এবার সে পাগলের মতো ডাকছে ইয়াদ কে। তবে লোকটা না দরজা খুলছে আর না নিজের ওই হৃদয়বেদায়ক কান্না থামাচ্ছে। তিতিল এবার জোরে জোরে কান্না করতে করতে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল। ওপাশ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ তিতিল খেয়াল করল লোকটা কান্না থামিয়ে দিয়েছে। ওপাশ থেকে আর কোনো শব্দ আসছে না। ভয়ে আতকে উঠল তিতিল। ভেতরটা একদম জড়সড় হয়ে গিয়েছে। এবার দ্বিগুণ ভয় নিয়ে ডাকতে লাগল সে, দরজায় ধাক্কাল। কিন্তু না কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তিতিলের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন সে কি করবে? আল্লাহ না করুক কোনো অঘটন ঘটুক তাই মনে মনে দোয়া করে যাচ্ছে।

আচমকা ইয়াদ দরজা খুলল। তিতিল চমকে তাকাল লোকটার দিকে। ইয়াদ তখন ডান হাতের সামনের পিঠ দিয়ে নাকের পানি টা মুছে নিয়েছে। তিতিল তাকিয়ে কষ্টে নেতিয়ে গেল পুরো। মানুষটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। চোখ গুলি ফুলেফেঁপে উঠেছে। আর অসম্ভব লাল দেখাচ্ছে। ফর্সা হওয়ায় নাক গাল সব কিছু লাল হয়ে আছে দেখে তিতিল ঠোঁট ভেঙ্গে এবার কেঁদেই দিল।

“এ জন্যেই দরজা খুলতে বলেছো?”

চোখ ভর্তি পানি নিয়ে ঝাপসা চোখে তাকাল সে। তবে কোনো জবাবহীন চোখের পানি ঝাড়ছিল।

“আমি তোমার চোখের পানি দেখতে পারব না। এখান থেকে যাও। আর তোমার কান্না করারই কি আছে?”

“আপনাকে ডাকছিলাম না আমি? দরজা খুলেন নি, এভাবে কাঁদছিলেন যে?”
কান্না ভরা ধরে আসা গলায় বলল তিতিল কথাটা যা অনেকটা বাচ্চাদের মতো দেখাচ্ছিল।

ইয়াদ বলল “আমি কান্না করলে তোমার কি?”

নাক টেনে তিতিল জবাব দিল “ঘুমাবেন চলুন।”

“তুমি যাও। আমি বারান্দায় থেকে যেতে পারব। আর এমনিতেও এক ঘরে থাকলে তোমার সমস্যা হবে। আমি এটা চাই’ই না। যাও শুয়ে পরো।”

“যাবেন না আপনি?”

“….

“ঠিক আছে আমিও বারান্দায় আছি।”

ইয়াদ তাকাল তিতিলের দিকে। তিতিল চোখ ফিরিয়ে নিয়ে পানি মুছল।
“তিতিল যাও।”

“বলে দিয়েছি।”

“এখানে ঠান্ডা লাগবে তোমার?”

“তাহলে?”

“তিতিল” বলে বেশ জোরে ধমক দিল ইয়াদ এতে যে মেয়েটা খুব একটা ভয় পেয়েছে কি না বুঝা গেল না। তার দিকে আর তিতিল তাকাল না। নিজের মতো করে বারান্দার এক কোণায় এসে দাঁড়িয়ে রইল। রাত বাড়তি। তাই মৃদু হীম হাওয়া বইছে চারিপাশে। ইয়াদ বুঝতে পারল তিতিলের ঠান্ডা লাগছে। নরম গলায় সে তিতিল কে বলল “তিতিল প্লিজ ঘরে যাও দেখো ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার।” তার কথাতে তিতিল কোনো উত্তর দিল না। ইয়াদ বুঝল এভাবে কাজ হবে না। তাই আর কিছু না বলে সে তিতিল কে কোলে তুলে নিল। তিতিল বেশ কড়া গলায় বলল “আমার সাথে কোনো রকম প্রতারণ করতে যাবেন না। আপনি ঘরে না গেলে আমিও ঢুকব না। আমার ঠান্ডা লাগলে আপনার কি?” ইয়াদ তিতিলের কথায় জবাব দিল না। শক্ত মুখের আঁচে সে তিতিল কে নিয়ে ঘরে গেল।

নামিয়ে দিয়ে বলল “ঘুমাও।”

“না।”

“যাও ঘুমাও গিয়ে আমি ফ্লোরে থেকে নিব। ঘরেই আছি। এবার যাও।”

“বিছানা থাকতে নিচে কেন থাকতে হবে?”

“তুমি কি বলতে চাইছো আমি তোমার সাথে এক বিছানায় থাকব? শরীর ঘুমের মাঝে লাগলেই তো..” কথাটা থামিয়ে দিয়ে আবার বলল “যাও ঘুমাও গিয়ে।”

“আজ বিছানাতেই থাকবেন। মাঝে না হয় কো কোলবালিশ দিয়ে দিবো।”

তিতিলের কথা শুনে ইয়াদ তাচ্ছিল্যের সুরে হাসল। তিতিল সেই হাসি না দেখার ভান করে মুখ ফিরিয়ে নিল। ইয়াদ আর কথা না বাড়িয়ে বিছানার এক কোণায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।

—-
ঘুম ভাঙ্গল জানালা দিয়ে আসা সূর্যের কিরণে। কাল রাতে কখন যে ঘুমিয়ে ছিল বলতে পারে না। সারারাতে টের পর্যন্ত পাওয়া গেল না। এক টানা এক ঘুম। রাত কিভাবে ঘুমে পাড় হয়ে গেল তা বুঝা গেল না। রাতে কান্নার ফলে বোধহয় এমন হয়ে থাকবে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালার বাহিরে তাকাল ইয়াদ। শরীরটা কেমন ম্যাচম্যাচ করছে। মাথাটাও বেশ ধরা। হঠাৎ তিতিল রুমে এলো। ইয়াদ একবার তিতিলের দিকে তাকিয়ে আবার জানালার বাহিরে মুখ ফিরাল। তিতিল কেমন করে যে তাকাল তার দিকে পরে মুখে হাসি প্রসারিত করে হাতে কফি নিয়ে এগিয়ে গেল ইয়াদের দিকে। সেটা বিছানার পাশের টিটেবিলে রেখে বলল,
“খেয়ে নিলে মাথা ধরাটা কমে যাবে।”
ইয়াদ এবার তাকাল তিতিলের দিকে। শুধু “হু” শব্দ তুলল মুখ দিয়ে।

“কফি টা ঠান্ডা করে ফেলছেন।” কথাটা শুনে ইয়াদ সেটা হাতে তুলে নেয়। “কষ্ট করার দরকার ছিল না” বলে দম নেয়। তিতিলের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে জানালার বাহিরে তাকিয়েই কফির মগে চুমুক লাগায়। তিতিল বুঝতে পারছে লোকটা তাকে কালকের কথার কারণেই কঠিন ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে। তিতিলের কেমন যেন কষ্টে হতে লাগল বলে সে উঠে গেল। দরজার কাছে আসতেই ইয়াদ পিছন থেকে বলল “রেডি থেকো একটু পর আমরা বের হয়ে যাচ্ছি।” কপাল কুঁচকে তিতিল ইয়াদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল “কোথায়?” ইয়াদও সোজাসুজি জবাব দিল “বাসায়।”

তিতিল কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে গেল। বের হওয়ার পূর্বে দরজায় দাঁড়িয়ে বলল “আমি আজ যাবো না।” ইয়াদ তাকালে দেখতে পেল তিতিল নেই। আনমনে ইয়াদের বাহিরে তাকিয়ে কফির মগ কে আপন করে নিল।

দুপুরের রান্নার তোরজোড় দেখে ইয়াদ বেশ বুঝতে পারল মেয়েটার যাওয়ার নিয়ত নেই। তবুও তলিয়ে দেখতে বলল “এত রান্না করার কি আছে? যাওয়ার সময় রাস্তায় খেয়ে নিতাম।” তিতিল তরকারি নেড়ে একবার তাকিয়ে আবার ফিরে গেল জবাবহীন।

“তিতিল বললাম তো রেডি হয়ে নাও।”

“আপনার যাওয়ার খুব ইচ্ছা?”

“থাকার তো কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছি না।”

“তবে চলে যান।”

“আর তুমি?”

“আমি এখন যাবো না। দেরি আছে।”

“কি চাইছো তিতিল?”

“এই যে থাকব এখানে।”

ইয়াদ আর কথা বাড়াল না। চুপচাপ নিজের রুমে গিয়ে ল্যাপটপ ছেড়ে কাজে মন দিল।

—-
আকাশ টা আজ ভালো নেই। রোদের দেখা নেই যে! মন খারাপের আভাস দেখা যাচ্ছে। ইয়াদের মতো আকাশেরও বুঝি আজ মন ভালো নেই। বারান্দার এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে ইয়াদ। ভবিষ্যৎ কি হবে সে ভেবে পায় না। তিতিল কে ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব প্রায়। সে কি করে জানত এই মেয়েটার প্রেমেই একদিন হুমড়ি খেয়ে বেসামাল হয়ে পড়তে হবে!

ইয়াদের ভাবনা কেটে গেল চোখের সামনে কফির মগ দেখে। পিছন ফিরতেই দেখতে পেল তিতিল আর একটু কাছে এসে তার দিকে মগ এগিয়ে দিয়েছে। ইয়াদ নির্বাক ভঙ্গিতে কফির মগে একবার তাকিয়ে তিতিলের চোখে চোখ রাখল। তিতিল একটু নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে হাতে থাকা মগটা মৃদু নাড়িয়ে বলল “কফি ঠান্ডা হয়ে যাবে।” ইয়াদ চুপচাপ কফির মগটা হাতে তুলে নিল। তাকিয়ে দেখতে পেল তিতিল তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে নিজের কফিতে চুমুক দিয়েছে। ইয়াদ এমন মাতালো দৃশ্য দেখে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল “কষ্ট করার কি দরকার ছিল?” তিতিল কথার প্রক্ষিতে তাকাল ইয়াদের দিকে। লোকটা তখন মনমরা হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তিতিল ইয়াদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মুচকি হাসল। হঠাৎ বলল “আকাশে আজ মনখরাপের ভীড় জমেছে।” ইয়াদ তখন নির্লিপ্ত। ধোঁয়া উঠা গরম মগে ঠোঁট স্পর্শ করে উদাস মনে বিড়বিড় করল “ঠিক যেন আমারই অনুরূপ।”

আরো কিছুক্ষণ নীরবতা চলল সেখানে। এর মাঝে শীতল হাওয়া বইতে শুরু করল। মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামতে পারে। তিতিলের মুখে হাসির দেখা মিলল। ইয়াদ মগে শেষ চুমুক দিয়ে লম্বা শ্বাস ফেলে দেয়। তিতিল বলল,
“বৃষ্টি নামতে পারে।”

“….

“গোসল করবেন?”

“কি” বলে তাকাল ইয়াদ তার দিকে।

“বললাম বৃষ্টিতে গোসল করবেন?”

“একদম না। এই বেলায় ঠান্ডা লাগতে পারে।”

“আমি অনেকদিন বৃষ্টিতে গোসল করি না।”

ইয়াদ তাকাল তিতিলের দিকে। এর মাঝে ঝপঝপ করে টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তেই ইয়াদ খেয়াল করল মেয়েটার চোখে খুশিতে ঝলঝল করে উঠল। তিতিল ঠিক তার চোখের দিকেই তাকিয়ে আছে। ইয়াদ এমন খুশিতে খুশি হয়ে বলতে গেল “ঠিক আছে” তার আগেই মেয়েটা খানিক হেসে তার হাত ধরে বারান্দা পেড়িয়ে বাহিরে পৌঁছে গেল। আকাশ থেকে ঝপঝপ করে নামা পানিতে মুহূর্তেই দুজন ভিজে গেল। তিতিল মুচকি হেসে আকাশে মুখ তুলে চাওয়ার চেষ্টা করল। তবে বৃষ্টির পানির ভারে তাকাতে পারছিল না। মেয়েটার মুখে হাসি ফুটে উঠে। ইয়াদ ধ্যান ধরা অটল চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বৃষ্টির পানিতে মেলে দিয়েছে নিজের হাত। আনন্দে সেই পানি নিজের গায়ে মেখে নেওয়ার অভিপ্রায়ে মেয়েটা যেন নাচতে লাগল। এমন হাসিখুশি তিতিল কে দেখে ইয়াদের মনে শতশত আবেগের ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল। ইয়াদ বেশ খেয়াল করল তিতিল লাল একটা থ্রীপিজ পরেছে। বৃষ্টির পানিতে ভিজে একদম লেপ্টে আছে শরীরে। ইয়াদের মাথা ধরে আছে। এই সময়ে নিজেকে আটকে রাখা অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে তার জন্যে। কারণ সে অনুভূতির সাগরে ভাসতে ভাসতে শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যার পরিনতি ভয়াবহ! নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে দাঁত কিটে দাঁড়াল সে। বৃষ্টির পানি চুল দিয়ে বেয়ে টপটপ করে চোখের উপর পড়ছিল আর প্রেয়সী কে মোহনীয় রূপে উপস্থাপন করছিল। ইয়াদ বুঝতে পারছে এভাবে আর নিজেকে প্রিয়তমার থেকে দূরে রাখা সম্ভব নয়। কারণ বৃষ্টির হীম শীতল শরীরে প্রিয়তমার উষ্ণতা খুঁজছে। উথাল পাগলামো মন বারবার বলছে “ভালোবাসা কে আজ চাই। পূর্ণ ভালবাসায় চাই।”

চলবে….
(দেরি হওয়ার জন্যে দুঃখিত। আপনাদের সারপ্রাইজ রেডি করতে আমি একটু ব্যস্ত। দোয়া করবেন❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here