#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৬

শেষমেশ ভাবলাম কলেজের পিছনের দেয়াল টপকে পালাবো। হাতে এখনো সময় আছে। যাওয়ার সময় মায়ের সাথেও একটু দেখা করে যাবো। যেই ভাবা সেই কাজ। ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়লাম। আসার সময় খেয়াল করলাম আশেপাশের কিছু ছাত্র ছাত্রী বাকা চোখে চেয়ে কিছু বলছে। হয়তো বারবার ব্যাগ হাতে যাচ্ছি আর আসছি সেইটা দেখেই অবাক হচ্ছে। আর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। এসব উপেক্ষা করে আমি এগিয়ে গেলাম কলেজের পিছন দিকে। কোনভাবে ঠিক বেড়িয়ে যেতে পারবো।

ক্লাস রুম থেকে বেড়িয়ে দ্রুত এগিয়ে গেলাম কলেজের পেছন দিকে। সেখানে গিয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নজরে পরলো দেয়ালের একপাশে মাটির উঁচু ঢিবি। তার ওপর আর ছোট খাটো কিছু রাখলে অনায়াসে পা রেখে উঠে যেতে পারবো। কিন্তু কি রাখবো? আশেপাশে কিছুই চোখে পড়ছে না। ঢিবির যা উচ্চতা তাতে আমি দেয়াল টপকাতে পারবো না। এসবে অভ্যস্ত নই আমি। আমার জায়গায় অন্যকেউ হলে হয়তো ঠিকি এতোখনে উঠে পরতো। এখন কি করবো আমি? ভাবলাম আশেপাশে আরও ভালো করে একটু খুঁজে দেখি তেমন কিছু পাই কি না। একটু এগিয়ে গেলাম ভেতর দিকে। সামনে কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে দেখি কয়েকটা ইট। ব্যাস আর কি লাগে। ইট গুলো নিয়ে ঢিবির উপর পরপর সাজিয়ে রাখলাম। তারপর অনায়াসে উঠে গেলাম দেয়ালের উপর। কিন্তু লাফ দিতে ভয় করছে। সময় নষ্ট করা যাবে না। তাই সাহস যুগিয়ে লাফ একটা দিয়েই দিলাম।

মনে হচ্ছে যেন বিশ্ব জয় করেছি। অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছে। আসলে নিজ চেষ্টায় সামান্য সুচেও যদি সুতো লাগানো হয় তাহলেও আনন্দ লাগে।

কলেজ ছুটি হতে এখনো ত্রিশ মিনিট বাকি। আমি একটা সিএনজি ডেকে উঠে পরলাম। কলেজ থেকে বাড়ির দুরত্ব বিশ কিলোমিটার। গ্রামের ভেতর কোন কলেজ নেই। গ্রাম থেকে দশ কিলোমিটার এর মধ্যে দুইটি কলেজ আছে। কিন্তু মায়ের ইচ্ছে ছিলো আমাকে এই কলেজে পড়ানোর। তাই এতো দুরে এসে ভর্তি হওয়া।

বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দুরে নেমে গেছি। পাশেই মায়ের কবর। দেয়ালের এপাশ থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বাশের বেড়া দেওয়া কব*রটা। মাকে জরিয়ে ধরে হটাৎ খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। বলতে ইচ্ছে করছে না বলতে পারা হাজারো অভিযোগ। অভিযোগ গুলো মায়ের বিরুদ্ধে নয়। আমার নিজের বিরুদ্ধে। সেদিন যদি মায়ের কথা শুনে কলেজ না গিয়ে মায়ের কাছে থেকে যেতাম তাহলে কি আর আজ মা এখানে একা একা মাটির বুকে আশ্রয় নিতো। নিতো নাতো। সেদিন মায়ের সাথে থাকলে মায়ের কোন বিপদ হতো না। আমিও মাকে হারাতাম না। আজ থেকে দুই মাস আগেও মায়ের ছায়া ছিলো আমার সাথে। আর আজ শুধু মায়ের স্মৃতি ছাড়া কিছুই নেই আমার কাছে। ফ্ল্যাশব্যাক এর মতো ভেসে উঠছে মায়ের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্ত। ভাবতেও লজ্জা লাগছে যেই মাকে মনে করে আজ প্রতিনিয়ত চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছি, মা থাকতে কখনো মনে হয়নি এই মানুষটা ছাড়া বাচবো কিভাবে। কখনো বলা হয়নি মাকে কতোটা ভালোবাসি। বলবো কি করে, নিজেই তো কখনো উপলব্ধি করি নি মায়ের উপস্থিতি আমার জন্য কতটা অত্যাবশ্যক। হয়তো কখনো মায়ের কথার অবাধ্য হই নি। বা মায়ের সাথে খারাপ আচরণ করে মাকে কষ্ট দেই নি। কিন্তু ভালোবেসে কখনো মাকে জরিয়েও তো ধরিনি। কখনো বলি নি, ‘মা তোমার হাতের চুড়ির আওয়াজ টা খুব মিষ্টি। শুনতে বেশ লাগে।’ কখনো আহ্লাদ করে মায়ের কাছে স্পেশাল কোনো রান্নার আবদার করা হয়নি। মা হয়তো আশা করতো আমার থেকে এসব। কিন্তু পেতো না। আর আমিও এসব করতাম না। কারন মা কখনো আমার আবদার এর অপেক্ষা করতো না। আমার চাওয়ার আগেই সব পেয়ে যেতাম। বাবা-মা দুজনের ভুমিকা একাই পালন করতো আমার মা।

হটাৎ বাইকের হর্ন এর আওয়াজে আমার হুশ এলো। অনেকক্ষণ তো হলো। এখন যেতে হবে। সোজা গিয়ে বাম পাশের রাস্তা ধরে দশ মিনিট হাঁটলেই আমার বাড়ি। মাকে মনে মনে বিদায় জানিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম বাড়িতে। কলতলা থেকে হাত পা ধুয়ে সোজা চলে এলাম আমার ঘরে। চাচির বাপের বাড়ির সব মেহমান হয়তো চলে গেছে। বাড়িটা ফাকা লাগছে। কারো গলার আওয়াজ পাচ্ছি না। ঘরে ঢোকার সময় সিড়ির সামনে কোন জুতোও দেখলাম না। তার মানে সবাই চলে গেছে। আমি কলেজ ড্রেস ছেড়ে একটি সাদা কামিজ পড়লাম। এটা মা কয়েক মাস আগে নিজে হাতে বানিয়ে দিয়েছিলো। অবশ্য আমার সব জামা কাপড়ই মায়ের হাতে বানানো। তবে এট নাকি মায়ের অনেক পছন্দের ছিলো। আমার বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো।

বাইরে বেরিয়ে এলাম চাচির মতিগতি বুঝতে। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। চাচিকে কোথাও না দেখতে পেয়ে টুসুকে খুজতে গেলাম রান্নাঘরে। এখন তো ওর রান্নাঘরে থাকার কথা। কিন্তু টুসুরও কোনো পাত্তা পেলাম না। আমার কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো। বাইরে টা আবার দেখতে এলাম। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। হটাৎ নজরে এলো দুই জোড়া পুরুষালি জুতো। পাঁচ মিনিট আগেও তো ঘরে ঢোকার সময় এই জুতোগুলো ছিলো না। তাহলে এখন কোথা থেকে এলো। কেউ যদি এসেই থাকে তাহলে কোথায় তারা।

এবার মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেলো। তাহলে কি স্যারের কথাই ঠিক। আমি কি নিজে থেকে বিপদে ঝাপ দিলাম। আচ্ছা বাবা ঠিক আছে তো। বাবার কোন ক্ষতি করেনি তো ওরা। আমি খুব সাবধানে পা ফেলে বাবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। বাবার গোঙানোর আওয়াজ আসছে ভেতর থেকে। আমি একটু উঁকি দিয়ে দেখতে পেলাম ভেতরে দুজন লোক বাবার ঘর তল্লাশি করছে। লোক দুটো গামছা দিয়ে মুখ বেধে রেখেছে। দুজনের লুঙ্গিতে গোঁজা রয়েছে দুটো ধারালো চাকু। আমি ভয়বিহ্বল হয়ে দাড়িয়ে আছি। এ যে ঘোর বিপদ। এরা কারা? বাবার ঘরে কি খুঁজছে? ধুপধাপ আরও পায়ের আওয়াজ এলো আমার কানে। আমি সতর্ক পায়ে পাশের ঘরটাতে ঢুকে পড়লাম। এখানে টুসু থাকে। দরজার আড়ালে থেকে আমি চাচির গলার আওয়াজ পেলাম। আমি এই ঘর থেকে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি ও ঘরের আসবাবপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ার খুটিনাটি শব্দ। হন্যে হয়ে কিছু একটা খুজে যাচ্ছে সবাই।

হটাৎ চাচির গলার আওয়াজ পেলাম। চাচি বিচ্ছিরি ভাষায় বাবাকে গালি দিচ্ছে আর কিছু একটা না পাওয়া নিয়ে আফসোস করছে। অচেনা দুজন ব্যাক্তি হটাৎ বলে উঠলো,

‘এই ঘরে কিছুই নাই। এই শু*য়ো*রের ঘরে শু*য়ো*র রে বাচাইয়া রাইখা লাভ কি আফা। ওরে মাইরা ফালাই। ওর বউ মরছে, মাইয়ারও ঠেহি এতোক্ষণে দম বাইর হইয়া গেছে ও আর বাইচা থাইকা কি করবো। আমাগোর যদি কোন কামেই না লাগে তয় অরে টানাটানির কোন দরকার নাই। ওর দম ও আইজকা বাইর কইরা দেই।’

চাচি বেশ সহজ গলায় তাদের উদ্দেশ্য করে বলে, ‘আড়ালরে মা*ই*রা কোনহানে কি করলো খোজ নিছো? কলেজ তো ছুটি হইয়া গেছে অনেকক্ষণ হইলো। সিএনজি লইয়া কেরা গেছিলো কলেজের সামনে? আব্বাস আর রহমতুল্লাহ না?’

‘হ আফা। দুইজন দুই সিএনজি লইয়া গেছে। ফোন তো দেই নাই আফা। এহন তো অগো লগে ফোন নাই। কাম শেষ হইলে ওরা নিজেরাই ফোন দিয়া জানাইবো। এহন এই মা*ল রে কি করমু? গলায় বহামু নাকি একটা কো*প।’

আমার সারা শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো। আমার শেষ সম্বলটুকুও কি আজ শেষ হয়ে যাবে। আমি একা একা ল*ড়া*ই করতে গেলে কতটুকুই বা পারবো ওদের সাথে। আমার বাবাকেও কি আজ হারিয়ে ফেলবো। আবার চাচির গলার আওয়াজ পেলাম।

‘উনি আগে আহুক। উনি যা কইবো তাই কইরো। আমি কিছু জানি না। এমনেতেই হে কয় আমার বুদ্ধি নাই। খালি ভুলভাল কাম করি। এহন কিছু কইলে হে ক্ষে*ইপা যাইবো আমার উপর। তোমরা ধৈর্য ধইরা আরও একটু ভালো কইরা খুজ দেহি। এই রুম ছাড়া আর সব রুম সক্কাল হইতে এই পর্যন্ত অনেক খুঁজাখুজি করছি কিছুই পাই নাই। এই ঘরডাতে জিনিস পত্র বেশি। থাকলে এই ঘরেই কোথাও আছে। তারপর হে আইলে তার কাছে জিগাইয়া ওনার ব্যাবস্থা কইরো। আমি টেন*শনে আছি টুসুরে লইয়া। কোনহানে যে গেছে ঠিক নাই। হুট কইরা আইয়া পরলে বিপদ। আমি বাইরে যাইয়া পাহারা দেই। তোমারা কাম চালাইয়া যাও।’

চাচি বাবার ঘর ছেড়ে সিড়ির দিকে চলে গেলো। আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনা কি করবো। অনেক প্রশ্ন মনের কোনায় উকি দিলো। চাচি ‘উনি’ সম্বোধন করে কাকে উদ্দেশ্য করলো? আর কে আছে এসবের পিছনে? কি খুজজে তারা এমন করে? আমাকে মা*রা*র জন্যও কলেজে লোক পাঠিয়েছে। কেনো? আমাকে এভাবে বসে থাকলে কাজ হবে না। কিছু একটা করতে হবে। নিজেকেও বা*চতে হবে। বাবাকেও বা*চাতে হবে। সাহস করে খুব সাবধানতা অবলম্বন করে বেড়িয়ে এলাম রুম থেকে। চাচি এখন সিড়ির দিকে আছে। তাই আমায় দেখে নেওয়ার চান্স খুব কম। কোনভাবে আমার রুমে চলে যেতে পারলেই হবে। ব্যাগে আমার ফোনটা আছে। সেটাই এখন শেষ সম্বল। আমি ধীর পায়ে এগুতে লাগলাম আমার রুমের দিকে। আচমকা চাচির কথায় আমি থমকে দাড়ালাম। আমার অন্তর আত্মা যেন বেড়িয়ে গেলো। শেষ রক্ষা কি তবে আর হলো না।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here