#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৪

কাল কলেজে দেখা করতে চাই।’
তৎক্ষনাৎ এক মিনিটের মাথায় একই নাম্বার থেকে রিপ্লাই আসে,
‘আমি নতুন ভবনের ছাদে থাকবো। আপনি প্রথম ক্লাস করে চলে আসবেন।’

অপর ব্যাক্তিটিকে পাল্টা প্রশ্ন করতে না দেখায় আমি অবাক হলেও পরে হেসে দেই। এ হাসিতে আছে প্রসন্নতা। আমার ওপর এক অদৃশ্য আস্থা ও অধিকার রাখে সে ব্যাক্তি। যার কোন ব্যাখ্যা নেই। আছে শুধু প্রাপ্তি। তা প্রথম থেকেই আমি অনুভব করেছি।
ফোনটাকে আগের জায়গায় রেখে দিয়ে ঘরটাকে একটু গুছিয়ে নেই। খুব অগোছালো হয়ে আছে। মনে মনে ছক কষতে থাকি পরবর্তী পদক্রম এর।

সাদা দেয়ালের গায়ে কালো ফ্রেমের ওয়াল ক্লক টাতে দশটা বেজে ত্রিশ মিনিট। এখনো ঘর থেকে একবারের জন্যও বের হইনি। নাবিলা আপু সকালের খাবার এ ঘরেই দিয়ে গেছিলো। খাবারের প্লেটটি এ ঘরেই রয়ে গেছে। ভাবলাম খাবারের প্লেটটি দিয়েই আজকের যাত্রা শুরু করি। খাবারের প্লেটটি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। রান্নাঘরের সামনে আসতেই আমার হৃদস্পন্দন থেমে গেলো যেনো। শ্বাস আটকে দাড়িয়ে পরলাম। আমার সামনে কেউ দাড়িয়ে আছে।
মা! আমার মা দাড়িয়ে আছে! আমি পাগলের মতো এলোমেলো পায়ে দৌড়ে যাই। জরিয়ে ধরি মাকে। আমার মা এসেছে। আমার মা কোথাও যায়নি আমাকে ছেড়ে। কিন্তু আমার শুকনো মরুভূমির ন্যায় বুকটা মায়ের স্পর্শে শীতল হলো না। রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রগাঢ় প্রশান্তির হাওয়ায় কেঁপে উঠলাম না এক চুলও। আচমকা হেঁচকা টান অনুভব হলো। ছিটকে গিয়ে পড়লাম বটির পায়ার ওপর। ডান ভ্রুয়ের মাঝ বরাবর চিনচিন করে জ্বালা করছে। কাটলো বোধহয়। হাত দিয়ে দেখি একটুখানি রক্ত।

আমি অবাক হলাম না। আড়ম্বরশূন্য আমার মুখমণ্ডল। খুব সহজভাবেই উঠে দাড়ালাম। পচা নর্দমায় হাত রেখেছি। দুর্গন্ধ তো গায়ে মাখবেই। পচন ও ধরতে পারে। এ রক্ত তারই খানিক আভাস মাত্র।

চাচি বেজায় চটে গেছে। গালিগালাজ করছেন চাপা স্বরে। পাছে কারো কানে না যায়। নতুন জামাই মেয়ে ছাড়াও বাপের বাড়িরও মানুষও এখন বাড়িভর্তি।

নতমস্তকে চাচির কাছে ক্ষমা চেয়ে বললাম, আসলে তুমি তো শাড়ি পড়না। সালোয়ার কামিজ পড়। আজ পরেছো জানতাম না। এমন শাড়ি তো মায়ের ছিলো আর তোমার হাতের বালাটাও মায়ের হাতের বালার মতো। যেটা মা সবসময় পড়তো। বাবা বিদেশ যাওয়ার পর প্রথম আয় দিয়ে মাকে কিনে দিয়েছিলো।মা কখনো হাতছাড়া করতো না বালা জোড়া। শাড়ি আর হাতের বালা মিলিয়ে পিছন থেকে অবিকল মায়ের মতো মনে হচ্ছিলো তোমায়। আমার ভুল হয়েছে। মস্ত বড় ভুল। তোমায় মনে করে ভুল করেছি।

মায়ের শাড়ি আর চুড়ির কথা শুনে চাচি বেশ হকচকিয়ে গেল। বেশ ঘাবড়ে গিয়ে বললেন,
‘তোর মায়ের কেন হইবো? এইগুলা আমার। তর চাচায় আইনা দিছে। মেলা দাম। এক্কেবারে ফাও কথা কইবি না।’

আমি মৃদু হাসলাম শুধু। কথা বাড়ালাম না। লাভ কি! তাই চাচিকে বলে চাচির সাথে হাত লাগালাম কাজে। চাচি সবজি ধুয়ে বটি নিয়ে বসলেন সবজি কাটতে। হাত নাড়িয়ে চাড়িয়ে কাজ করছে। কাজের তালে তালে হাতের চিকন দু গোছা চুড়ি ও মোটা বালার সঙ্গে ঘর্ষন লেগে টুংটাং আওয়াজ হচ্ছে। আমার বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। কেউ যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে বুকের ভেতর। এমন শব্দ দুইমাস আগে প্রায়শই শুনতে পেতাম। কখনো মুগ্ধ হয়ে কান পেতে শোনা হয়নি। কখনো মনে হয়নি খুব মুল্যবান কিছু শুনছি। আজ মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রুতিমধুর ধ্বনি বোধহয় মায়েদের হাতের চুড়ি থেকে উৎপত্তি পেয়েছে। মায়েদের হাতের চুড়ির আওয়াজেও বুঝি নেশা থাকে? হবে হয়তো। কিন্তু এটা আমার মায়ের হাত নয়। এটা আমার মায়ের খুনির হাত।

রাতের বেলা জানালা ধরে দাড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছি এমন সময় নাবিলা আপু এলো। বিছানায় এসে আমাকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসলো। আমায় মাথায় হাত রেখে বললো, ‘সারাদিন তোর বেশ মন খারাপ দেখেছি আজ। সকালে এতোকিছু হওয়ার পরেও তোর মুখটা এতো শুকনো ছিলো না যতটা দুপুর থেকে দেখছি। কেউ কি কিছু বলেছে? আরাফাত তো চলে গেছে। আর নাদিয়াকেও সারাফাত সাবধান করে দিয়েছে তোর সাথে যেনো না লাগে। মা কি কিছু বলেছে? মিথ্যে বলবিনা। সত্যি বললে বল নয়তো শুধু শুধু বানোয়াট বন্দনা করার প্রয়েজন নেই।’

আমি কিছু লুকালাম না। বললাম, ‘আজ চাচি নতুন শাড়ি আর চুড়ি পড়েছিলো। তুমি খেয়াল করলে শাড়ি না হোক, বালা জোড়া চিনবে। আমার মায়ের বালা ওটা। যেটা মা সবসময় পড়তো। দুপুরে ভ্রুয়ের যে কাটা জায়গায় মলম লাগালে সেটা হয়েছে চাচি কে মা ভেবে পিছন থেকে জরিয়ে ধরার শাস্তি স্বরূপ। আচমকা চাচি কে মায়ের শাড়ি আর বালাতে দেখে মায়ের মৃত্যু বেমালুম ভুলে বসেছিলাম। মা মনে করে জরিয়ে ধরে মায়ের গায়ের গন্ধ নিতে গিয়েছিলাম। কি বোকামি!

মাকে মেরে নাকি কেউ মায়ের আলমারি লুটপাট করে নিয়ে গিয়েছিলো। ভেবেছিলাম মায়ের সাথে মায়ের শেষ স্মৃতিগুলোও হারিয়ে ফেলেছি। তাহলে ওগুলো চাচি কিভাবে পেলো আপু?

নাবিলা আপু আমার দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইলো। উঠে বাইরে চলে গেলো। আমি চোখের জল মুছে বসে রইলাম একইভাবে। আপুকে যে প্রশ্ন করেছি তার উত্তর আংশিক আমার জানা আছে। তবু্ও আপুকে এসব বলার কারন আপুর দ্বারা চাচির মনে ভয় ঢুকানো। চাচি বড্ড ভীতু প্রকৃতির। আপুর থেকে প্রশ্নের সম্মুখীন হলে নেতিয়ে পরবে। আর তখন আমি আমার পরবর্তী পদক্রম অনুযায়ী এগোতে পারবো।

আমি এগিয়ে গেলাম চাচির ঘরের দিকে। চাচি আর নাবিলা আপু কথা কাটাকাটি করছে। চাচি বেশ ভরকানো গলায় থেমে থেমে জবাব দিচ্ছে। একসময় চাচির হাত থেকে বালা জোড়া খুলে নিলো আপু। বললো, ‘এটা আমার কাছে থাকবে।’ চাচি থতমত খেয়ে ভয়মিশ্রিত চাহনিতে চেয়ে আছে। কিছু বলছে না। আমি তখন ঘরে ঢুকলাম। দুজন চুপ করে আছে। আপু বললো, ‘কিছু বলবি?’ আমি চাচির দিকে চেয়ে সহজ গলায় বললাম,

‘আমি কাল থেকে আগের মতো কলেজ যেতে চাই। আমার চলে যাওয়ার হলে আবার ফিরে আসতাম না এ বাড়িতে। তাই ভয়ের কারন নেই। আমার জন্য কোন সমস্যা তোমাদের হবে না। তাই চাচির কাছে অনুমতি নিতে এসে..।’

আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে আপু চাচির চোখে চোখ রেখে বললো, তুই কাল থেকে কলেজ যাবি। তোকে কেউ আটকাবে না। মা তো নয়ই। তাই না মা?

চাচি প্রশ্ন পেয়ে যেনো আরও একটু থতমত খেলেন। মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘যাইক কলেজে। আমি না করমু কেন? যাইকগা। আমার কোন না নাই।’

আমি অনুমতি পেয়ে চলে এলাম ঘর থেকে। আবছা করে শুনতে পেলাম চাচিকে আবার প্রশ্নের জালে আষ্টেপৃষ্টে জরাগ্রস্ত করছে আপু। আপু কতটা কি জানতে পারবে আমি জানি না তবে আমার এখনো অনেক কিছু জানার বাকি আছে। অনেক প্রশ্নের উত্তর যে এখনো অজানা।

_______________

ভোরের শুদ্ধ আলো দিয়ে শুরু হলো আমার নতুন সকাল। রান্না আমি পারি না। মা কখনে রান্না করতে দেয়নি। তাই যেটুকু পারি সেটুকু কাজ করে ফেললাম। গত রাতের এঁটো বাসন ধুয়ে রান্নাঘর পরিষ্কার করে ফেললাম। মা থাকতে একটুও নোংরা হতে দিতো না। সবসময় পরিষ্কার রাখতো। কিন্তু এখন রান্নাঘরে ঢুকতেও ঘৃনা লাগে। ঘর ঝারু দিয়ে চাচিকে রান্নার কাজে একটু হেল্প করে আমি তৈরি হলাম কলেজের জন্য। সারাফাত ভাই নাবিলা আপু আর নাদিয়া আপুকে নিয়ে আজ চলে যাবে। ভাইয়া তাদের সাথে এক গাড়িতেই কলেজে যেতে বললেন। ভাইয়ার কথা ফেলতে পারলাম না। ভাইয়াট সাথে বেড়িয়ে পড়লাম কলেজের জন্য।

আপুদের বিদায় দিয়ে কলেজে ঢুকলাম। আশেপাশে কতো ছেলেমেয়েরা বসে আড্ডা দিচ্ছে। আমার এমন কোন বন্ধু নেই। বন্ধু বানাতেও যোগ্যতা চাই। আমার তা নেই। এগিয়ে গেলাম একাদশ শ্রেনির দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস রুমের দিকে। একটা খালি বেঞ্চে বসে পড়লাম। ক্লাস করার কোন ইচ্ছা নেই। সবকিছু বিষের মতো লাগছে। হটাৎ কিছু একটা মনে করে ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে এলাম ক্লাস থেকে। নতুন ভবনের দিকে এগিয়ে পা বাড়ালাম সামনে। মনে মনে ভাবছি আমিতো ফোনের ওই লোকটাকে কখনো দেখিনি। চিনবো কি করে? শুধু ফোনের মাধ্যমে কথা হয়েছে। টুসু তো চেনে। কিন্তু পরিচয় বলেনি। আমি নিজেই নাকি তাকে দেখতে পাবো। ঐদিন ঐ লোকটার কথামত বিয়ে থেকে পালিয়ে তার বলা ঠিকানায় গেলে অবশ্য দেখা হতো। কিন্তু আমি বাবাকে রেখে পালাতে পারি নি। ও বাড়ি ছাড়লে অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানা রয়ে যাবে। তাইতো ফিরে গিয়েছিলাম। ভাবতে ভাবতে কখন নতুন ভবনের সামনে চলে এসেছি টের পাইনি। ছয়তলা সিড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম ছাদের দিকে।

এতগুলো সিড়ি বেয়ে উঠে দম যেনে বেড়িয়ে যাচ্ছে। ফ্লোরে হাটু গেড়ে বসে পড়লাম। গলাটা শুকিয়ে শুকনো কাঠ হয়ে গেছে। একটু পানি পেলে আত্মা ঠান্ডা হতো। আচমকা মুখের সামনে পানির বোতলসহ একটি হাত ও ফ্লোরে মুর্তিমান এক ছায়া আমার সামনে কোথাথেকে উদয় হলো। আমি উপরে চেয়ে দেখি দানবীয় শরীরের অধিকারী একটা ছেলে হাতে পানির বোতল নিয়ে মুর্তির মতো দাড়িয়ে আছে। আমি হকচকিয়ে উঠে দাড়ালাম। ছেলেটি পানির বোতল সরাচ্ছেই না। একিভাবে বোতল হাতে দাড়িয়ে আছে। আমি না নেওয়া অবধি বোধহয় সরাবেও না। কি ঘারত্যারা।

আমি বোতলটি হাতে নিয়ে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে বোতলটি ফেরত দিয়ে দিলাম। ছেলেটি তৎক্ষনাৎ আমাকে পাশ কাটিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। কোন টু শব্দ পর্যন্ত করলোনা। ভেবেছিলাম ধন্যবাদ জানাবো কিন্তু সেই সুযোগ পর্যন্ত দিলো না। হটাৎ আমার মাথায় এলে এই ছেলেটাই ফোনের সেই ব্যাক্তি নয়তো? আমি হুরমুড়িয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলাম ঘারত্যারা ছেলেটির খোজে। কোথাও ছেলেটির দেখা মিললো না। এইটুকু সময়ে কর্পূরের ন্যায় উরে গেলো যেন। হটাৎ কে যেন আমার মাথায় হাত রাখলো। আমি একটু চমকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি….

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here