#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২৪+২৫
শুদ্ধ ফোন কেটে দিয়ে রিয়াদ কে ফোন দিলে রিয়াদ ফোন রিসিভ করে উ’দ্রি্’ত কন্ঠে ঘন ঘন শ্বাস টেনে বলে আড়ালকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। শুদ্ধর মনে কু ডেকে ওঠে, শ’ঙ্কা হয় আড়ালকে হারিয়ে ফেলার। তার এখনো তো বলাই হলো না, কতোটা ভালোবাসা জমিয়ে আড়াল করে রেখেছে সে তার আড়ালের জন্য। তার আগেই কি হারিয়ে ফেলবে মেয়েটাকে। তবে কি আর ভালোবেসে তাকে একটি বার নাম ধরে ডাকা হবে না। যে ডাকে সে অনুভব করবে এ মনে জমানো শত সহস্র অনুভূতি।
দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে রিয়াদ এর বলা ঠিকানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় শুদ্ধ। মাথা কাজ করছে না তার। কোন কিছু চিন্তা ভাবনা করার মতো সময় বা মানসিকতা কোনটাই এখন নেই। কোথায় খুঁজবে এখন আড়ালকে?
রিয়াদ ফোন কেটে দিয়ে বিশ্বজয়ের তৃপ্তিতে হেসে দেয়। চোখে তার প্রাপ্তির স্বাদ। যেন কোন অসাধ্য সাধন করেছে সে। যা অন্যকেউ কখনো করতে পারবে না সে ছাড়া। সামনে দাড়ানো বৃষ্টি আর সৃষ্টির দিকে বা’কা চোখে চায়, বা’কা হাসি দিয়ে অ’দ্ভু’ত ভ’ঙ্গিতে দাড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে দুজনকে বলে,
‘দেখে নিয়েছিস তো আমার সা’হস আর অভিনয় এর ট্যালেন্ট। শুদ্ধ এবার শুরশুর করে চলে আসবে এখানে। প্রথমে হয়তো একটু চোখ রাঙাবে। দ্যাটস ওকে, বাট এট লাস্ট কিন্তু আমার গলা জরিয়ে ধন্যবাদ দেবে। ওকে এখানে এনে আড়ালের সাথে একান্ত অবকাশ করে দেওয়ার জন্য। ও এখানেই আসছে, তোরা একে একে কেটে পর এখান থেকে। আড়ালকে একলা থাকতে দে। আমিও যাচ্ছি। দেখি আশপাশ থেকে তোদের জন্য ভাবি জোটাতে পারি কি না। বাইবাই শা’লি’কা’স।’
রিয়াদ বুকের কাছটাতে শার্টে ঝোলানো সানগ্লাসটি নিয়ে না’ট’কীয় ভ’ঙ্গি’তে চোখে পড়ে। হেলেদুলে গুনগুন শব্দ করতে করতে সিড়ি বেয়ে ওঠে যায় ওপর তলায়। রিয়াদ চলে যেতেই বৃষ্টি আর সৃষ্টি দমফাটা হাসিতে ফেটে পড়ে। ওদের হাসির শব্দ শুনে খানিক দুরের কফিশপে একলা বসে থাকা আড়াল এক পলক ফিরে তাকায় ওদের দিকে। আড়ালের প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি খেয়াল করে দুজনেই চুপ মেরে যায়। আড়ালের কাছে এগিয়ে গিয়ে ওকে বলে,
‘মিষ্টিভাবি তুমি একটু বসো আমরা ওই পাশের দোকান থেকে একটু আসছি। কোথাও যেওনা কিন্তু। জাস্ট এক মিনিট লাগবে।’
দুজনে চলে গেলে আড়াল একিভাবে বসে থাকে। কোনো প্রতিক্রিয়া জানায় না। হটাৎ একটা বাচ্চা এসে আড়ালের হাতে একটা কাগজ গুজে দিয়ে দৌড় দেয়। আড়াল কিছু জিজ্ঞেস করারও সুযোগ পায় না। চার ভাজ করা কাগজটা সামনে মেলে ধরতেই আড়ালের নজরে সবার আগে পড়ে বড় বড় অক্ষরে নিচের দিকে লেখা টুসু নামটা। বুকটা হটাৎ ভারী হয়ে গেলো। টুসু! টুসু পাঠিয়েছে এটা। চার লাইনের লেখাটায় চোখ বুলালে দৃষ্টিগোচর হয় কিছু লেখা,
‘তোর সাথে অনেক কথা আছে আরু. অনেক কিছু বলার আছে তোকে. তুই নিচে পার্কিং সাইডে চলে আয়. হাতে আমার সময় নেই। কেউ যেনো টের না পায়.’
টুসু
আড়াল টুসুর নাম দেখে এদিক সেদিক না তাকিয়ে সোজা চলে যায় পার্কিং সাইডের দিকে। লেখাটা যে টুসুর তাতে আড়াল শতভাগ নিশ্চিত। এমন করে বাংলা লেখায় ফুলস্টপ বসানোর মতো কাজ শুধু টুসুই করতো তাকে জ্বালানোর জন্য। নিচে পার্কিং সাইডে আড়াল এসে দাড়ালে আশেপাশে কাওকে দেখতে পায় না। হন্যে হয়ে খোঁজ করে চারিদিকে। খোজ করতে করতে একেবারে রাস্তার দিকে এলে আচমকা হাতের কবজিতে হেচকা টান অনুভব করে। আড়ালের হাতের কবজিতে বসানো শক্ত থা’বার হাতের মালিক আর অন্যকেউ নয় টুসু। টুসু আড়ালকে টেনে নিয়ে একটা সিএনজিতে বসিয়ে দেয়। সাথে সাথেই চলতে শুরু করে সিএনজি। টুসুর দুই গাল ভিজে চকচক করছে অ’শ্রু ধারায়। পাশে চোখ ফেরালে আড়াল আবিষ্কার করে চোখমুখ খিঁ’চি’য়ে বসে আছে তার চাচা। কানের ব্যান্ডেজ টা পুরো লাল হয়ে ভিজে জবজবে অবস্থা। কাধের ব্যান্ডেজটাও ভিজে আছে র’ক্তে। অদৃশ্য রৌ’রব তুল্য ব্যথায় যেন ছটপট করছে মানুষটা।
সাত্তার আর টুসুর মাঝবরাবর বসে আছে আড়াল। সিএনজির দুপাশের পর্দাটা টাঙানো আছে। ভেতরে খুব বেশি আলো নেই। তবুও টুসুর বি’ধ্ব’স্ত কান্নামাখা মুখ আর চাচার য’ন্ত্র’ণা স্পষ্ট বুঝতে পারছে আড়াল। প্রথমে চাচার মুখটা দেখার সাথে সাথে বুকে এক অদৃশ্য ভয়ের তীর বিঁধেছিলো। কিন্তু ধীরে ধীরে তীরটা আলগা হয়ে আসছে ব্যা’থা’য় জ’র্জ’রিত চাচার মুখ দেখে। অ’স’হ্য য’ন্ত্র’ণায় মানুষটা ছট’ফট করছে। কিছু বলতে নিয়েও বলা হচ্ছে না। টুসুও চুপ করে আছে। সিএনজির প্রবল গতির মতো আড়ালের মনটাও কষ্টের প্রবল দাবদাহে পুড়ে ওঠছে। হটাৎ গাড়িটা থেমে গেলে। টুসু নেমে গেলো তৎক্ষনাৎ। দুইমিনিট পর হাতে কিছু ওষুধ আর এক বোতল পানি নিয়ে ফিরলো। চোখের অশ্রু মুছতে মুছতে কয়েকটা ওষুধের পাতা ছিড়ে ওষুধ বের করে সাত্তার এর হাতে দেয়। সাত্তার পানি দিয়ে গিলে নেয় ওষুধগুলো। আড়াল এখনো চুপ করে শুধু দেখে যাচ্ছে। দশমিনিট পর একটা ছোট গলির মোড়ে সিএনজি থামে। সবাই নেমে পড়ে সিএনজি থেকে। টুসু সিএনজি চালকের হাতে এক হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে আড়াল আর সাত্তারকে নিয়ে ঢুকে পড়ে সামনের পুরোনো টিনের ঘরটাতে।
ঘরে ঢুকে সাত্তারকে চৌকিতে শুয়িয়ে দিয়ে আড়ালকে জরিয়ে ধরে হাওমাও করে কেদে ওঠে টুসু। আড়াল টুসুকে ধরে দাড়িয়ে দেখে যাচ্ছে তার চাচাকে। ইচ্ছে করছে চাচার হাতটা ধরে জিজ্ঞেস করতে কোথায় কষ্ট হচ্ছে তার? কি করলে কষ্ট কমবে? কিন্তু পারছে না। গতকাল রাতের ঘটনা বারবার ভেসে ওঠছে চোখের দৃশ্যপটে। টুসুকেও কিছু বলা হলো না। কথা যেনো সব হারিয়ে গেছে। খুজে পাওয়া মুসকিল।
টুসু আড়ালকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে সাত্তারের দিকে তাকায়। ছট’ফ’টানি অব’নত হচ্ছে তার, ব্যা’থা কমে আসছে হয়তো। ওষুধটা কাজে দিয়েছে। সাত্তার এর চোখ বুজে আসতে চাইছে কিন্তু চোখের সাথে সায় দিলো না মন। জোর করে চোখ তুলে তাকালো আড়ালের দিকে। আড়ালও তাকিয়ে আছে তার দিকে। নি’স্তে’জ দৃষ্টি আর নিম্ন স্বরে সাত্তার আওরিয়ে ওঠে,
‘আরু মা।’
আড়াল যেনো চেখের দৃষ্টি দিয়েই ফিরিয়ে দিলো উত্তর। টুসু অনবরত কেদেই যাচ্ছে। আড়ালের চাচা একটা ঢোক গিলে আবারও বলে,
‘তুই নিশ্চয় এখন আমায় নি’কৃ’ষ্ট মনের বি’কৃ’ত একজন মানুষ ভাবিস, নারে ম? যে কিনা বি’শ্রি ভাষায় গা’লি দিয়ে কারো গলায় ছু’রি ধরে। যে কিনা এক মুহুর্তের ব্যবধানে খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে এসে হিং’স্র হয়ে ওঠে। আমায় মাফ করিস মা। মাফ করে দিস। তুই কি ভেবেছিলিস আমি তোর ক্ষ’তি করার জন্য তোকে আমার সাথে করে নিয়ে যাচ্ছিলাম? নারে মা, তোকে তো শুধু টুসুর সাথে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে নিয়ে যাচ্ছিলাম। জানিস ও না আমার মেয়ে, নিজের মেয়ে। তোর বড় বোন হয় ও। তোরা দুজন আমার দুই চোখের মনি। দুজন মা আমার।
চাচার মুখে টুসুর কথা শুনে আড়াল স্তম্ভিত হয়ে যায়। বি’স্মি’ত চোখে পাশ ফিরে তাকায় টুসুর দিকে। টুসু নি’ম্ন’মুখি হয়ে অশ্রু বিসর্জন দিতে বড্ড ব্যাস্ত। তবে টুসুর নির্লিপ্ততা বলে দিচ্ছে সে আগে থেকেই অবগত ছিলো এ বিষয়ে। শুধু সেই কিছু জানতো না। আড়ালের চাচা আবারও বলে,
‘মনে অনেক প্রশ্ন জমেছে, না রে মা? আমি কতোটা গুছিয়ে বলতে পারবো জানি না। আমার জীবনটা তো পুরোটাই অগোছালো। গোছগাছ বলতে যা কিছু আছে সবটাই ফাঁ’পা। এলোমেলোই বলছি, তুই গুছিয়ে নিস কথাগুলো।
তোর বাবা আর আমি ছিলাম দুই ধারার ব্যাক্তিত্ব। তার সাথে আমার কখনোই পড়তো না। তার কাজকর্ম, স্ব’ভাব, নীতি কোনকিছুই আমার পছন্দ ছিলো না। কিন্তু তবুও আমি তাকে ভালোবাসতাম। তাকে নিজের বড় ভাই হিসেবে যথেষ্ট মান্য করে চলার চেষ্টা থাকতো সর্বদা। সিমা নামের একটা মেয়েকে আমি খুব ভালোবাসতাম। মেয়েটাও আমাকে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু বড় ভাই বিয়ে করছিলো না বলে আমিও আমার সিমাকে ঘরে তুলতে পারছিলাম না। তবে লুকিয়ে সিমাকে বিয়ে করেছিলাম। মাঝে মাঝে দেখা করতাম সুযোগ বুঝে। ছয় মাস নাগাদ এভাবেই চলছিলো আমাদের সম্পর্ক। হটাৎ একদিন বাড়ি গিয়ে দেখি কয়েকজন লোক বসে আছে উঠোনে। সবাই বেশ হাসিখুশি। আমাকে দেখে সবার আনন্দ আরও দ্বিগুণ হয়ে গেলো। সালাউদ্দিন ভাই আমাকে ডেকে নিয়ে ঘরে গেলো আলাদা কথা বলতে। সে যা বললো তা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিলো। সে নাকি পঞ্চাশ হাজার টাকা সুধ নিয়েছিলো ব্যাবসা করার জন্য। ব্যাবসা গেছে ভেসে, দাড় করিয়ে উঠতে পারে নি এক কোনা ও। বিশ হাজার কোনভাবে শোধ করেছে, ত্রিশ হাজার এখনো বাকি সাথে আবার চড়া সুধ জমা হয়েছে তার সাথে। যার থেকে টাকা নিয়েছিলো তার ভাস্তিকে বিয়ে করলে বাকি ত্রিশ হাজারসহ সুধের টাকা মাফ করে দেবেন। সাথে আরও ত্রিশ হাজার টাকা দেবেন আমাকে। পাত্রীর এর আগে বিয়ে হয়েছিলো, দু’জন মেয়েও আছে। তাই বিয়ের জন্য তাদের বড্ড তাড়া। আমার সামনে বসেই সালাউদ্দিন ভাই গলায় দড়ি দিতে যাচ্ছিলেন। আমি এই বিয়ে না করলে তার নাকি মরণ ছাড়া আর কোন গতি থাকবে না। সে সময় আমাদের বাবাও এসে যোগ দিলেন তার বড় ছেলের সাথে। মা কিছু বলে ওঠতে পারেন নি। তার কথার কি আর কোন দাম ছিলো সংসারে। বাবার সামনে তো মা থাকতো বোবা হয়ে। শেষমেশ না পেরে বাবা আর ভাইকে সিমার কথা বলে দেই। তারা কিছুক্ষণ ভেবে আমায় বললো তখনকার মতো বিয়েটা করে নিতে। পড়ে সিমাকেও ঘড়ে তুলে আনা যাবে। আমি মেরুদণ্ডহীন পুরুষের ন্যায় মেনে নিয়েছিলাম সব। ভরসা ছিলো সিমাকে তো আর ছাড়ছি না। গ্রামের অনেকেই দু তিনটে করে বিয়ে করে। খুব বড় ব্যাপার ছিলো না তখন। এমনটাই বলছিলো আমার ভাই আর বাবা। কিন্তু আমার সিমা এটা মেনে নেয়নি। আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলো আমার বিয়ের কথা শোনার পর। কোনভাবেই তার নাগাল পাইনি। বড্ড অভিমানী ছিলো আমার সিমা। কোন এক আত্মীয় বাড়ি চলে গেছিলো শুনেছিলাম। তার মাস খানেক বাদেই সালাউদ্দিন ভাই ভাবিকে বিয়ে করে নিয়ে এলো। আর তারপরেই সে চলে গেলো বিদেশ। এভাবে চলে যায় কয়েক মাস। হটাৎ লোকমুখে শুনতে পাই আমার সিমা নাকি আর নেই। অন্তঃসত্ত্বা ছিলো সে, আট মাসের সময় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে সে দুনিয়া ছেড়েছে। ওর মা’রা যাওয়ার খবর শুনার পর আমি পরিণত হয়েছিলাম জিন্দা লাশে। অপরাধবোধে সর্বশান্ত হচ্ছিলাম রোজ। আর আমাদের সন্তানকে এক অনাথ আশ্রমে রেখে আসা হয়েছিলো। সেই অনাথ আশ্রমে রেখে আসা বাচ্চাটি হলো টুসু। ওর খোঁজ খবর রাখতাম আমি। তারপর একটু বড় হলে অনাথ আশ্রম থেকে আমাদের এখানে বড় ভাবিকে এনে দিয়েছিলাম তার ছোটখাটো ফরমায়েশ খাটতে। যাতে চোখের সামনে একটু দেখতে পারি নিজের মেয়েটাকে। ও আর তুই দেড় বছরের ছোট বড়। ওকে নিজের মেয়ের পরিচয় দেওয়া সম্ভব ছিলো না। কারণ সিমা এতো কঠিন পরিস্থিতিতেও আমার নাম নেয়নি। মুখ খোলেনি অভিমানে। শেষমেশ ম’রেই গেছে অ’ভা’গী। তারপর যদি হটাৎ করে কেউ জানতো আমি টুসুর জন্মদাতা পিতা তাহলে গ্রামের লোক আমায় মে’রে ফেলতো। সিমার মৃত্যুর জন্য আমায় দোষী করা হতো। টুসু আর তুই আমার চোখের সামনেই বড় হতে লাগলি। তোদের দুজনকেই আমি আমার দুই চোখের মনি ভাবতাম। আমার পরিচয়ে বর হওয়া মেয়ে দুজন কখনোই আমাকে নিজের বাবা মানতো না, কাছেই আসতো না। তাই আপন করে নিতে চাইলেও সে সুযোগ আমি পাইনি। আমি সবসময় তোর প্রতি ভালোবাসাটা প্রকাশ করতাম কিন্তু টুসুর প্রতি ভালোবাসা কখনো প্রকাশ করতাম না। এভাবেই চলছিলো সব। চলতে চলতে একসময় সালাউদ্দিন ভাই এর কাজ কর্মের ওপর আমার স’ন্দেহ হতে লাগলো। আমি মুখ ফসকে তোর চাচির সামনে প্রকাশ করে ফেলেছিলাম সেটা। তারপর শুনেছিলাম, সে তার ভাইকে দিয়ে খোজ নিয়ে জানতে পেরেছিলো সালাউদ্দিন ভাই কোন এক বে’আ’ইনি কাজের সাথে জড়িত আছে। তারপর তোর চাচি সালাউদ্দিন ভাইকে তার কর্মকান্ডের কথা বলে কৌশলে জায়গা করে নেয় দালান ঘরে। সাথে চেয়ে বসে মাসে মাসে নির্দিষ্ট পরিমানে টাকা। ঝা’মে’লা চাননি তাই সালাউদ্দিন ভাই ও মেনে নেয় সব। আমি কোন কথা বলি নি কারও হয়েই, ছিলাম নির্লিপ্ত। দেখার ইচ্ছে ছিলো শেষ পর্যন্ত কি হয়। তখন জানা ছিলো না সালাউদ্দিন ভাই ঠিক কতোটা অমানুষ আর আমার বউ ঠিক কতোটা সুযোগ সন্ধানী। যেদিন ভাবি খু’ন হয় সেদিন ভোরে আমি শহরে গিয়েছিলাম ব্যাবসার জন্য পাইকারি মা’লা’মা’ল আনতে। ভাবি আর ভাই এর মধ্যে যে কিছু নিয়ে ঝামেলা চলছিলো কয়েকদিন যাবত, তা পুরোপুরি না জানলেও কিছুটা অবগত ছিলাম আমি। তবে তোর চাচি পুরোটাই জানতো কিন্তু আমাকে কখনো খুলে বলেনি। সেদিন ঠিক কি হয়েছিলো ভাবির সাথে আমি জানি না। ওইদিন ফিরতে ফিরতে আমার রাত হয়ে গেছিলো। ফিরে এসে সবার মতো আমিও সেটাই শুনেছিলাম যেটা সবাই জানতো। সালাউদ্দিন ভাইকেও ওরকম জখম অবস্থায় দেখে আর সন্দেহ হয়নি যে এখানে তার কেন হাত আছে। সে যদি সুস্থ থাকতো তাহলে হয়তো তার ওপর সন্দেহ হতো। আমি ধরেই নিয়েছিলাম ডাকাত দলের হাতেই মৃত্যু হয়েছে আমার ভাবির। তারপর থেকে তুই আরও বেশি চুপচাপ হয়ে গেলি। তোর চাচি সবসময় খেচ খেচ করতো তোর সাথে। আমি সামনা সামনি কিছু বলতাম না তবে আলাদা করে তার সাথে ঝগড়া হতো রোজ। তার কিছুদিন পর নাবিলার বিয়ের কথা চললো। সারাফাত এর ভাই আরাফাত তোকে পছন্দ করলো। সারাফাতকে আমি চিনতাম। ও খুব ভালো ছেলে তাই ভেবেছিলাম ওর ভাই ও ভালোই হবে। তোর সাথে বিয়ে হলে তুই সুখিই হবি। এই জা’হা’ন্নাম থেকে মুক্তি পাবি। আমি বেশ স্বস্তি পেয়েছিলাম এসব ভেবে। তের চাচিও রাজি হলো। অবশ্য তোর চাচিকে টাকা না দিলে হয়তো তোকে অতো ভালো ঘরে বিয়ে দিতে রাজি হতো না। তারপর বিয়ের দিন হটাৎ তুই পালিয়ে গেলি। আমার দুনিয়া ভে’ঙে গু’ড়িয়ে গেছিলো তোর চিন্তায়। তোর তো যাওয়ার জায়গা ছিলো না কোথাও। কেথায় গেলি, কি করছিস এসব ভেবে ভেবে সারা রাত ঘুমোতে পারি নি। তারপরের দিন দুপুরের আগে যখন ফিরে এলি তখন তোকে সুস্থ অবস্থায় দেখে আমার আত্মায় পানি এসেছিলো। কিন্তু আমার সামনেই তোকে যখন তোর চাচি গায়ে হাত দিচ্ছিলো তখন আমি চেয়েও কিছু করতে পারছিলাম না। আমার শরীরটাও সায় দিচ্ছিলো না তখন। একটু অভিমান ও ছিলো তোর ওপর। সব মিলিয়ে চুপ ছিলাম। তারপরের দিন ভেবেছিলাম সব ঠিক করে ফেলবো। কিন্তু আমার কিছু করতে হলো না। সারাফাত তোকে বের করে নিয়ে এলো লাকড়ি ঘর থেকে। ভেবেছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে এবার ধীরে ধীরে। তুই পরেরদিন কলেজ গেলি। তুই যাওয়ার পর আমি বাজারে গিয়েছিলাম তোর পছন্দের মাছ কিনবো বলে। বাজার থেকে ফেরার সময় দেখি টুসু আমাদের বাড়ির পেছনের দিকে দৌড়ে পালাচ্ছে। তারপরেই দুজন লোক সেখানে এসে এদিক সেদিক খোঁজ শুরু করে। টুসুকে ধরেও নেয়। আমি বাঁচাতে গেলে আমাকেও অনেক মারধর করে। তারপর টুসু পাশ থেকে এক ভারি গাছের ডাল এনে দুজনের মাথায় মারে। দুজনই সেখানে পড়ে তখন কা’ত’রাতে থাকে। আমি টুসুকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে যেতে চাইলে ও বলে ভেতরে আরও বেশি বি’প’দ। তোর কথা জিজ্ঞেস করলে বলে তুই নাকি সর্বোচ্চ নিরাপদ আশ্রয়ে আছিস। তারপর ওকে নিয়ে এখানে আসি, এটা আমার এক পরিচিত লোকের ঘড়। এখন এখানে থাকে না। এ ঘড় ভে’ঙে নতুন ঘড় করবে সামনের মাস থেকে। তাকে বলে ঘড় ভা’ঙা’র আগ পর্যন্ত থাকার অনুমতি নেই। একয়দিন এখানেই ছিলাম আমি আর টুসু। টুসু আর আমি দুজনেই জ’খ’ম ছিলাম। একটু সুস্থিত হলে গতকাল বাড়ি গিয়েছিলাম সব খোঁজ খবর নিতে। আমরা চলে আসার পর কি কি হয়েছিলো সবটা শুনি লোকমুখে। কয়েকজনের মুখে এও শুনি আমাকেও নাকি পু’লি’শ খুঁজছে। তোর চাচি নাকি পুলিশদের কাছে আমার নামেও কিছু বলেছে। আমি পাত্তা দেই নি। নিজের কথা ভাবার মতোন তখন ইচ্ছে বা সময় কোনটাই ছিলো না। তারপর একজন তোর খোঁজ দেয় আমাকে। তোর খোঁজ পেয়ে তোকে আনতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। রওনা হই তোর স্যার এর বাড়ি। যদি তোকে আমার সাথে যেতে না দেয় সেই ভেবে গ্রামের মানুষ ও জুটিয়ে নেই সাথে। যাওয়ার পথে টুসুকে সাথে নিতে আসলে ও সব শুনে আমায় মানা করে এসব করতে। কারণ জিজ্ঞেস করলে প্রথমে কিছুই বলে নি। খানিক জোড় করতেই আড়ালে ডেকে নিয়ে বলে দেয় ভাবির বাপের বাড়ির কথা। সেদিন জানলাম ভাবি অনাথ ছিলো না। টুসু যা যা জানতো সবটাই বলে আমায়। আমি শান্তি পেয়েছিলাম এটা ভেবে যে তুই আর একা নোস। তোর আপনজন পেয়েছিস তুই। তারপরে গ্রামের লোকজন সবাইকে চলে যেতে বলে টুসুকে নিয়ে ফিরে যাই ওই বাড়ি। ও বাড়ি ফেরার পর সাহস করে বলে দেই টুসুকে আমার সমস্ত অতীত। ও যে আমার ঔরসজাত সন্তান, আমিই ওর জন্মদাতা অভাগী পিতা সবটা খুলে বলি ওকে। প্রথম থেকে সব শোনার পর ও কোন অভিযোগ করে নি, শুধু কেঁদেছে। ভেবেছিলাম তোকে এখানে এনে টুসুর সাথে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবো। তাই তোকে আনতে গিয়েছিলাম ওই বাড়ি। কিন্তু সেখানে গিয়ে সব ওলট পালট হয়ে যায়। শুনি তোর বিয়ে হয়ে গেছে। তোর বরকে আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছিল। তোকে কোন কথা বলতে দিচ্ছিলো না, নিজেই সব বলে যাচ্ছিলো। তারওপর আবার বলছিলো তোর সাথে নাকি ছেলেটার আগে থেকেই সম্পর্ক ছিলো। সেটা শুনে আরও বেশি সন্দেহ হচ্ছিল। তারপর তোদের নিয়ে রওনা হই বাড়ির উদ্দেশ্যে। পথে বাধে বিপত্তি। বাড়ি যাওয়ার সোজা রাস্তা রেখে থানার সামনের রাস্তা ধরে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে ওই ছেলে। যেখান দিয়ে গেলে আধ ঘন্টার মতো বেশি সময় লাগার কথা। মিষ্টির অজুহাতে বারবার গাড়ি থামাতে বললেও গাড়ি থামায়নি ছেলেটা। তখন সবার বলা পুলিশের কথা আমার মনে খোচাতে থাকে। ভাবি হয়তো আমায় থানায় নিয়ে গিয়ে ধরিয়ে দেবে পুলিশে। তোর চাচির মিথ্যেতে হারিয়ে ফেলবো তোদের দুজনকে। তাই আর কোন পথ না পেয়ে আমার কাছে থাকা ছু’রি ছেলেটার গলায় ধরি ভয় দেখাতে। ওটা কয়েকদিন সাথেই ছিলো আমার। ছু’রি ধরেছিলাম যাতে আমায় ভয় পেয়ে থানার দিকে না যায়, থামিয়ে দেয় গাড়ি। কিন্তু সব কিছুই উল্টিয়ে যায় এক মুহুর্তে..
আড়াল মনোযোগ দিয়ে বিস্মিত হয়ে তার চাচার কথা শুনছিলো। হটাৎ ঘরের ভেতর বিকট শব্দ করে ওঠে। ঘর যেনো মাথার ওপর ভেঙে পড়লো বলে। সবাই আঁতকে ওঠে দরজার দিকে চেয়ে।
#চলবে