#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২২

শুদ্ধ তার বাবা আর সোহাগকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে উকিল কাগজগুলো দেখে কি বলেছেন? আসিফ সাহেব এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,

‘এই কাগজগুলো আড়ালের জন্য মৃ’ত্যু ফাঁ’দ। এতে যে দলিলগুলো দেখছিস সেগুলো সব আড়ালের নামে। প্রায় দু কোটি টাকার সম্পত্তির মালিকানা আছে আড়ালের নামে। একটি পাঁচতলা বাড়ি আর হাইওয়ের ধারে দুটি জমির প্লট আড়ালের নামে করা হয়েছে। আর এসব কিন্তু বেশি আগে করা হয়নি। করা হয়েছে ছয়মাস আগে। এই সম্পত্তির জন্য এখন সাত্তার আড়ালের পিছনে পড়েছে। তবে একটা ব্যাপার বুঝলাম না। এতোদিন আড়ালকে কেনো বাঁচিয়ে রেখেছিলো? এতোদিন কেনো মারার চেষ্টা করেনি ওকে? সুযোগ তো কম ছিলো না।’

‘আড়াল এতোদিন সেইফ ছিলো ওর চাচারই কারনে বাবা। ওর চাচা মি’থ্যে ভালো মানুষের মু’খো’শ পড়ে থাকলেও আড়ালের প্রতি তার ভালোবাসা মি’থ্যে ছিলো না। আড়ালকে ছোটবেলা থেকে নিজের মেয়েদের থেকে কম ভালোবাসেন নি। তাই এতোদিন আড়ালের গায়ে কোন আঁ’চ লাগতে দেননি। তিনি ভেবেছিলেন আড়ালকে বিয়ে দিয়ে দিলে অন্তত এসব থেকে দুরে থাকবে আর সেইফ ও থাকবে। নিজের সংসার নিয়ে ব্যাস্ত হলে আর অন্য কোন কিছুতে মাথা ঘামাতে আসবে না। কিন্তু আড়ালের বিয়ে থেকে পালিয়ে যাওয়াতে তিনি আর কোন রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তাই শেষমেশ আড়ালকে মে’রে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। আসলে ওনারা তো প্রফেশনাল কোন অ’প’রা’ধী বা স’ন্ত্রা’সী নয়। শুধু আড়ালের বাবার বে’আ’ইনি কার্যকলাপ সম্পর্কে জেনে যাবার পর তাকে ব্ল্যা’ক’মেইল করে নিজদের অভাব ঘুচানোর চেষ্টা করেছেন। তাই খু’ন করার পর মনে ভ’য় ঢুকে গেছিলো ধ’রা পড়ে যাওয়ার। আর ফুপির খু’নে’র সময় সাত্তার কিন্তু বাড়িতে ছিলো না। গেছিলো শহরে নিজের ব্যাবসার কাজে। আর আড়ালের চাচিও স্বীকার করেছে যে এসব এর মাষ্টার প্ল্যান ছিলো তার স্বামীর। আড়ালের বাবার ওপর প্রথম সন্দেহ করেছিলো সাত্তার নিজেই। সেই তার স্ত্রীকে সামনে রেখে পেছন থেকে গুটি সাজিয়ে গেছে। শুধু ফুপির খু’নে’র দিনই সত্তার ছিলো অনুপস্থিত।’

সোহাগ হটাৎ প্রশ্ন করে বসে,

‘আচ্ছা আংকেল আর আমি তো শুধু দলিল গুলো নিয়ে আমার চাচার কাছে গেছিলাম দলিল গুলো বুঝতে। কিন্তু আরও যে কাগজগুলো ছিলো সেগুলো থেকে জানতে পারলি কিছু? ওগুলো কিসের কাগজ? আমিতো ওগুলো এখনো দেখিইনি। ওতেও কি আড়ালের কোন সম্পৃ’ক্ততা আছে?’

শুদ্ধ কিছু কাগজপত্র সোহাগ এর হাতে দিয়ে বলে,

‘এগুলোতে আড়ালের নামে কিছু নেই। এতে শুধু আড়ালের বাবার কু’কী’র্তির হিসাব আছে কয়েকটা কাগজে। মানে তার পরবর্তী কিছু কাজের হিসাব আরকি। যার দায়িত্ব আড়ালের বাবাকে দেওয়া হয়েছিলো সে অসুস্থ হবার আগে। ওনার কাজ ছিলো লোক দিয়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে নে’শা’দ্রব্য চো’রাই চালান করা। কোন একটা বড় সি’ন্ডি’কেট এর সাথে জড়িত ছিলো। কিভাবে, কার দ্বারা, কবে, কোথায়, কখন মা’ল সাপ্লাই দেওয়া হবে তা ছিলো আড়ালের বাবার দায়িত্বে। আগে একজন সাধারণ সাপ্লায়ার ছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে নিজের জায়গা শক্ত করেছেন মা’দক সি’ন্ডি’কেটের কার্যক্রমে। এই কাগজগুলো ঘেটে এই তথ্যগুলো স্পষ্ট। আর এই বাকি কাগজগুলো মধ্যে কিছু হলো সাপ্লায়ার দের বায়োডাটা আর কিছু হলো তাদের কাজের হিসাব।’

‘এখন তাহলে নেক্সট কি করতে চাস?

‘আড়ালের বাবা যে কোটি টাকার স’ম্প’ত্তি করে রেখেছে এবং আড়ালের নামে সম্পত্তির মালিকানা দিয়ে রেখেছে তা শুধু জানে আড়ালের চাচা। আর কেউ নয়। আর আড়ালের চাচা এখন আমাদের কাছে আছে তাই আড়ালের কোন ক্ষ’তি হওয়ার সম্ভাবনা আর এখন নেই। তাই আড়ালকে নিয়ে এখন আমি নিশ্চিন্ত। আর আড়ালের বাবা যে একজন মা’দ’ক ব্যবসায়ী ছিলেন তার প্রমাণ এই কাগজগুলো। তাই আড়ালের বাবার কেসটা আবার রিওপেন করতে আমাকে খুব বেশি ঝ’ড় পোহাতে হবে না। আড়ালের চাচি আর ওই লোকগুলো তো আগে থেকেই জে’লে রয়েছে। নতুন করে তাদের নিয়ে কোন ঝা’মেলা পোহাতে হবে না। আশা করছি এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি চাইছি এই সম্পত্তির কথা যেনো বাইরে না আসে। তাহলে আড়ালকেও হয়রানি করা হবে। তুই এখন ঘুমিয়ে পড়। সকালে অনেক কাজ আছে। বাকি কথা কাল হবে।’

শুদ্ধ তার বাবাকে নিয়ে গেস্ট রুম থেকে বেড়িয়ে এসে একসাথে ঘুমোতে যায় তার বাবার রুমে। বিছানায় এসে শুদ্ধ তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে,

‘আচ্ছা সন্ধ্যার পর উকিলের ওখান থেকে ফোন দিয়ে বললে আলম চাচাকে আনিয়ে তৎক্ষনাৎ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আড়ালকে বিয়ে করে নিতে। তখন কারণ জিজ্ঞেস করলে বললে সময় নেই পরে বলবে। বললে না তো আর।’

‘সাত্তার আজ বিকেলে হটাৎ কোথ থেকে ফিরে এসে ওবাড়ির আশেপাশের সবাইকে বলেছে তাকে নাকি তার বউ একয়দিন লোক দিয়ে আটকে রেখেছিলো। কোনমতে পালিয়ে বেঁ’চে ফিরে এসেছে। এসেই আড়ালের খোজ করছিলো। কা’ন্নাকা’টি করে সবাইকে বলছিলো সে নাকি সব হারিয়েছে এখন আড়ালকে আর হারাতে পারবে না। আড়ালকে নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিবেন। কারো কাছে নাকি শুনেছে আড়াল তার কলেজের কোনো স্যারের বাড়িতে আছে। তাই পাড়ার কিছু প্রতিবেশীদের নিয়ে রওনা হয়েছিলো আমার বাড়ির উদ্দেশ্যে। আড়ালকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সাত্তার একা আসলে যদি আড়ালকে না দিই সেই ভ’য়ে লোকজন নিয়ে রওনা হয়েছিলো। ওদের পাশের বাড়ির সাদ্দামকে তুই ওদিকের সব খবর দিতে বলে রেখেছিলি। ও তোকেই সবার আগে ফোন করেছিলো সব জানাতে। কিন্তু তুই কোন রাজকার্যে ব্যস্ত ছিলি তা সুধু তুই জানিস। তোকে ফোনে না পেয়ে পরে আমাকে ফোন করেছিলো। আমি ঘটনা শোনার পর খানিক চি’ন্তায় পড়ে গেছিলাম। কেননা সুবর্ণা যে আমার বোন আর আমরা যে আড়াল এর আপনজন তা মুখে মুখে ওদের বললে ওরা কিছুতেই বিশ্বাস করতো না। আর প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট সময় সুযোগ দুটোই তখন ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিলো। উল্টে ঝা’মেলা বেড়ে যেতো। হয়তো আড়ালের চরিত্র নিয়েও কথা উঠে যেতো। যেহেতু বাড়িতে তিন তিনটে ছেলে আছে। সবাই আমাদের বি’রু’দ্ধে গিয়ে যেভাবেই হোক আড়ালকে নিয়ে যেতো। আর আড়ালকেও আটকানো যেতো না। যেহেতু আড়ালের নজরে সাত্তার এর চরিত্র একেবারে সাফসুতরা ছিলো সেই সময়। তার ওপর আবার অপহরণ হবার কথা বলে আড়ালের সহানুভূতি কুড়িয়ে নিতো। তাই আড়াল ও তার চাচার সাথে যেতেই রাজি হতো। ও রাজি হলে কোনভাবেই ওকে আটকানো যেতো না। তাই তোকে ফোন দিয়ে তখন বিয়ে করার কথা বলেছি। যাতে বিয়ের সম্পর্ক দিয়ে তুই ওকে আটকাতে পারিস। বিয়ের কথা শুনলে অন্তত পাড়ার লোকেরা নিয়ে যাবার কথা বলবে না। বুঝলাম না সাত্তার শেষমেষ একা কি ভেবে এসেছিলো। আচ্ছা আড়ালকে কি বলে বিয়েতে রাজি করিয়েছিস তুই। ও তো এতো সহজে সব মেনে নেওয়ার মেয়ে নয়।’

শুদ্ধ খানিক থেমে বলে ওঠে,

‘এখন তুমি যদি তোমার ছেলে আর ছেলের বউ এর পার্সোনাল কথোপকথন শুনতে ইচ্ছুক হও তবে আমার কোন আপত্তি নেই তোমাকে শোনাতে।’

আসিফ সাহেব খানিক বিব্রত হলেও প্রকাশ করলেন না। দাবড়ে বলে ওঠেন,

‘আমি তোর বাবা হই বন্ধু নয়। ফাজলামো বাদ দিয়ে ঘুমো এখন।’

_____________

নভস্থলের বুকে অঁজিষ্ণুর আধিপত্য বিস্তার হচ্ছে ধীরে ধীরে। তেজের ছটা বেড়ে চলেছে বাতাসের গতিতে। আড়ালের সকালের শুরুটা হলো নিস্তব্ধতা দিয়ে। চোখ খুলে আশেপাশে কাউকেই চোখে পড়লো না। জানালার পর্দাটাও দেওয়া আছে। ঘরে খুব বেশি আলোও নেই। তবুও ঘুম ভেঙে গেলো। এতো রাতে ঘুমানোর পরেও সকাল সকাল ভুম ভেঙে গেলো। ঘুম থেকে উঠে টেবিলের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে সেই চিকন চুড়ি জোড়া। অল্প আলোতেও পাথরগুলো চকচক করছে। রাতে অস্বস্তি হচ্ছিল বলে হাত থেকে খুলে ঘুমিয়েছিলো। চুড়ি জোড়া চোখে পড়তেই মনে পড়লো কাল তার বিয়ে হয়েছে। সে এখন বিবাহিত। সে লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে সেজেছিলো। আর তারপর.. তারপর আর ভাবতে পারলো না। চোখের সামনে ভেসে ওঠলো শুধু র’ক্ত আর র’ক্ত। নিজেকে অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে না দিয়ে ওঠে পড়ে আড়াল। নিজেকে সামলে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে ফ্রেশ হতে। এখন থেকে সামলে ওঠা শিখতে হবে।

ঘুমে বিভোর অবস্থায় ফোনের রিংটোন বেজে ওঠলে শুদ্ধ বিরক্ত হয়ে বালিশের কাছ থেকে ফোন হাতড়ে চোখ বুলিয়ে দেখে সাফিন ফোন করছে। রিসিভ করে কানে ধরতেই কর্নপাত হয় সাফিনের চিন্তিত কন্ঠ। শুদ্ধ এক লাফে উঠে বসে। ওপাশ থেকে সাফিন এর বলা কথা শুনে শুদ্ধ ‘আমি এখনি আসছি’ বলে ফোন কেটে দেয়। কোনমতে গায়ে টিশার্ট পড়ে দৌড়ে বের হয় হসপিটালের উদ্দেশ্যে। মনে মনে বলে, ‘আবারও র’ক্তা’র’ক্তি কান্ড হলো। সকালটাই শুরু হলো র’ক্ত দিয়ে। সামনে আরও কি কি হবে কে জানে!’

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here