#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২০
আচমকা আড়ালের চোখে মুখে র’ক্ত ছিটকে আসে। হাত দিয়ে মুখ হাতড়ালে ভিজে আসে হাত। চোখের সামনে হাত দুটো মেলে ধরলে আড়াল বুঝতে পারে সে আবারও কিছু হারালো। আবারও ঠ’কে গেলো কাছের মানুষের থেকে। আড়াল হালভাঙা হয়ে চিৎকার দিয়ে জ্ঞা’ন হারায়। নেতিয়ে পড়ে পিছনের সিটে। গাড়ি এখন থেমে আছে শুন’শান মাঝ রাস্তায়। আড়ালের হৃদয় বি’দা’রক চিৎ’কার শুনে শুধু এক পলক তাকিয়ে ছিলো শুদ্ধ পিছনের সিটে। আড়ালকে সিটে পড়ে থাকা অবস্থায় দেখে বুঝতে পেরেছে জ্ঞা’ন হারিয়েছে ও। গাড়ির ভেতর জুড়ে চলছে বী’ভ’ত্স চিৎকার এর রৌরব খেলা। শুদ্ধের ছু’ড়ি ধরা হাত বেয়ে র’ক্ত পড়ছে চুইয়ে চুইয়ে। গাড়ির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে র’ক্তে’র দাগ। হটাৎ চি’ৎ’কার আর গো’ঙানির আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেলো। সাত্তার জ্ঞা’ন হারিয়ে ঢলে পড়েছে বাদিকের জানালার গ্লাসে। শুদ্ধ আবারও গাড়ি স্টার্ট দেয়। গাড়ির গতি আগের মত একইভাবে চললেও গাড়ি ঘুরিয়ে অন্য পথ নিয়েছে শুদ্ধ। ছু’ড়ি টা সাত্তার এর গায়ের ওপর মুছে নিয়ে সিটের ভেতরে রেখে দেয়। হাতটাও তারই শার্টের পরিষ্কার জায়গায় ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে র’ক্তে’র দাগ মুছে নেয়। অর্ধ পরিষ্কার হাতে নিজের প্যান্ট এর পকেট থেকে ফোন বের করে একটি নাম্বার এ কিছু একটা টাইপ করে মেসেজ করে দেয় তাৎক্ষণিক।
দশ মিনিট পর শুদ্ধ একটি হসপিটাল এর সামনে এসে গাড়ি দাড় করায়। গাড়ী থেকে থামতেই দুজন ছেলে এগিয়ে আসে গাড়ির দিকে। শুদ্ধ গাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলে দুজনের মধ্যে রাহাত নামের ছেলেটি বলে ওঠে, ‘ভেতরে সব রেডি আছে চল’। আর সাফিন নামের ছেলেটি শুদ্ধর দিকে না তাকিয়ে সরাসরি সাত্তার কে কাধে করে নিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় হসপিটাল এর ভিতরে। শুদ্ধ ও সময় ন’ষ্ট না করে আড়ালকে কোলে করে নিয়ে প্রবেশ করে হসপিটালে। যাওয়ার আগে গাড়ির চাবি রাহাত এর হাতে দিয়ে কিছু ইশারা করে যায়। রাহাত ও বেড়িয়ে পড়ে গাড়ি নিয়ে।
শুদ্ধ আর সাফিন তিন তলার করিডোরে দাড়িয়ে আছে বাইরের দিকে ফিরে। ভেতরে সাত্তার এর ট্রি’টমে’ন্ট চলছে। তার একটা কান কেটে অর্ধেক ঝুলে পড়েছে আর ঘাড়ের ডান দিকে ছুড়ির গভীর ক্ষত। তখন শুদ্ধর গলায় সাত্তার ছু’রি ধরলে তার হাত থেকে ছুরি কেড়ে নিয়ে সাত্তারের ঘারে আর কানে বসিয়ে দিয়েছিলো শুদ্ধ। সেই র’ক্ত’ই গিয়ে ফিনকি দিয়ে পড়ছিলো আড়ালের মুখে। আড়াল এর তেমন কিছুই হয়নি। অতিরিক্ত মানসিক চাপ আর চোখের সামনে অমন ঘটনা দেখে জ্ঞা’ন হারিয়েছে শুধু। একটা ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে ঘুম পাড়ানো হয়েছে তাকে। পাশাপাশি স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে।
‘নেক্সট প্লান কি?’
সাফিন এর প্রশ্ন শুনে শুদ্ধ ঘুড়ে দাড়ায়। সাফিন কে উদ্দেশ্য করে লহু স্বরে বলে ওঠে,
‘যা আগে ছিলো। নতুন কোন প্লান নেই।’
‘আড়ালকে নেওয়ার জন্য ওরা এতোটা ম’রিয়া কেনো হয়েছিলো যে এতো রি’স্ক নিয়ে তোদের বাড়ি পর্যন্ত চলে গেলো। তাও আবার একা। এ বিষয়ে কিছু জানিস?’
‘কিছুটা জানি। পুরোটা খানিকক্ষণ পর জেনে যাব।’
‘কিভাবে? ওটাকে যেভাবে মে’রে’ছিস, কথা বলার মতোন অবস্থায় আছে নাকি? যে তুই জিজ্ঞেস করবি আর ও গড়গড় করে সব বলে দেবে।’
‘সেদিন ফুপির রুমের দেয়ালের ভেতর থেকে যে দুই ব্যাগ ভর্তি কাগজ পত্র পাওয়া গেলো সেগুলোই সব প্রশ্নের উত্তর। সন্ধ্যার দিকে সোহাগ আর বাবা গিয়েছিলো উকিলের কাছে সেগুলো নিয়ে। অনেক কিছুই জানা গেছে। বাবা ফোন করে কিছুটা বলেছিলো আমায়। বাকিটা বাবা আর সোহাগ ফিরে এলে জানা যাবে।’
সাফিন আরও প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলো এরই মধ্যে ডক্টর চলে আসে। সাফিন আর শুদ্ধকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
‘ওনার কানের ছোট একটা অ’পা’রেশন করতে হবে। খুব বেশি রিস্ক নেই। ঘারের ক্ষ’ততে সিরিয়াস কিছু হয় নি। তবে ভুগতে হবে বেশ কিছুদিন। কানের অপারেশন আমরা এখনি শুরু করতে চাচ্ছি। কিছু ফর্মালিটি আছে। ওগুলো অন্তত পুরন কর। তোরা সিআইডির লোক আর আমি তোর নিজের চাচা বলে কি কোন ফর্মালিটিই মানবি না। তখন সাফিন এর কল পেয়ে দৌড়ে এসেছি বাড়ি থেকে। ওটাকে যখন এমন কানকাটা হনুমানই করে ছাড়বি তাহলে আমাদের বাড়িতে থাকা অবস্থাতেই করতি। ব্যাপারটা সহজ হতো। শুধুশুধু এতো ঘোরাঘুরি করলি।’
শুদ্ধ তার ছোট চাচার দিকে তাকিয়ে খানিক হেসে বলে ওঠে,
‘তোমার কথা শেষ হলে বলো কি কি ফর্মালিটিস আছে। সাফিন করে দেবে।’
শুদ্ধের ছোট চাচা সৌভিক একজন নার্সকে ডেকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে সাফিনকে পাঠিয়ে দেয় ফর্মালিটিস পূরণ করতে। যেটুকু না করলেই নয়। সৌভিক ওদের পাঠিয়ে নিজে চলে যায় অপারেশন এর প্রস্তুতি নিতে। এর মধ্যে হসপিটাল এ উপস্থিত হয় শুদ্ধের বাবা। শুদ্ধকে সবার আগে জিজ্ঞেস করে আড়ালের কথা। আড়ালের খবর নিয়ে খানিক নিশ্চিন্ত হয়ে সাত্তারের বিষয়ে একে একে সবটা শোনে শুদ্ধের থেকে। তারপর গম্ভীর হয়ে শুদ্ধকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে,
‘আমরা ব্যাপারটাকে যতোটা সহজ ভেবেছিলাম ব্যাপারটি ততটা সহজ নয়। এই কেসটা অনেক আগেই ক্লোজ করে দেওয়া হয়েছে। তুই যা করছিস তা সবটাই আনঅফিসিয়াল। অফিসিয়াল ভাবে যারা কেসটা ক্লোজ করিয়েছে তারা টের পেলে তোর একূল ও যাবে ওকূল ও যাবে। আর এখন যা যা জেনে এলাম তাতে জানি না মেয়েটাকে আদোও বাচাতে পারবি কিনা ওদের হাত থেকে। শুধু শুধু ওরা আড়ালের জন্য মরিয়া হয়ে যায় নি। আড়াল যে এখন সোনার হরিন। ওকে তো ওরা পেতে চাইবেই।’
‘এখানে এসব আলোচনা না করাই ভালো। উকিলের থেকে কি কি জেনেছো তা বাড়ি গিয়ে শুনবো। সোহাগ কাগজপত্র গুলো নিয়ে সঠিক জায়গায় পৌছে গেছে?’
‘হ্যা। ওগুলো রেখে কিছুক্ষণ পর চলে আসবে এখানে।’
আর কোন কথা হলো না দুজনের মাঝে। সাফিন ফর্মালিটি সব পূরণ করে দিলে অপারেশন শুরু হয় সাত্তার এর। রাহাত ও এরমধ্যে চলে আসে। রাহাত আর সাফিনকে হসপিটালে রেখে আড়ালকে নিয়ে রওনা হয় শুদ্ধ ও তার বাবা। বাড়ি পৌঁছে আড়ালের রুমে নিয়ে আড়ালকে শুইয়ে দিয়ে শুদ্ধ তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ঘন্টা খানিক পড় অথবা তার আগেই ওর জ্ঞান ফিরবে। ওর মানসিক অবস্থা ঠিক থাকলে ভালো। নয়তো আবারও ইনজেকশন পুশ করে ঘুম পাড়াতে হবে রাতটুকুর জন্য। আমি আছি ওর কাছে। তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো। নয়তো মা তোমায় আজ ঘরে ঢুকতে দেবে না। ওর জ্ঞান ফিরলে আমি সামলে নেবো।’
‘তোর মা আমার বউ। আমার বউ আমি বুঝে নেবো। সেটা তোর চিন্তা করতে হবে না। কিন্তু তুই কেনো ওর সাথে একা থাকবি? আমিও আছি ওর সাথে। ও উঠলে নিশ্চয় প্যানিক করবে। শুধু ভয় পায়নি মেয়েটা, মনে আঘাতও পেয়েছে অনেক।’
‘তোমার ভাগনি আমার বউ। আমার বউ আমি বুঝে নেবো। সেটা তোমার চিন্তা করতে হবে না। ওকে আমি একাই সামলে নিতে পারবো।’
শুদ্ধের বিড়বিড়িয়ে বলা কথাগুলো আসিফ সাহেব স্পষ্ট শুনে খানিক বৈক্লব্য হলেন। কিন্তু এমন ভাব করলেন যেনো কিছুই শোনেন নি। এমন বিব্রত অবস্থায় ছেলেটা মাঝে মাঝেই টেনে হিঁ’চ’ড়ে নামিয়ে অভ্যস্ত। ওর সাথে মুখ লাগাতে গেলেই এমন এমন উত্তর দেবে যে পাল্টা উত্তর দেবার কোন অবকাশ থাকবে না। আসিফ সাহেব গলা ঝেড়ে আড়াল এর মাথার কাছে গিয়ে বসলেন। শুদ্ধ ওয়াশরুমে ঢুকে যায় ফ্রেশ হতে। শার্টের বাম হাতার দিকটা র’ক্তে’র দাগে ভরে গিয়েছিলো। গাড়ি থেকে নামার আগে হাতাটা গুটিয়ে কনুইয়ের বেশ উপরে তুলে নিয়েছিলো যাতে কারো চোখে না পড়ে র’ক্ত গুলো। হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে এখনো হালকা রক্তের দাগ রয়ে গেছে। গোসল করতে হবে এক্ষুনি। শরীর টা রিরি করছে একদম।
শুদ্ধ ওয়াশরুমে ঢুকে গেলে শুদ্ধর মা আসে রুমে। দরজার সামনে থেকে শুদ্ধের বাবাকে দেখতে পায় আড়ালের মাথার কাছে বসা। তিনি পরম স্নেহের সাথে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আড়ালের মাথায়। হাতে চুলগুলো পেচিয়ে গেলে আবার ধৈর্যের সহিত দু’হাতে চুলগুলো ছাড়িয়ে আলগা করে দিচ্ছে। যেনো একটি ছোট বাচ্চা তার মায়ের চুল নিয়ে খেলছে। আবার চুলে জট বাধলে মা বকবে সেই ভয়ে খুব সাবধানে চুলগুলো ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে আলগা করছে দুহাতে। কি সুন্দর মায়াবী মূহুর্ত। এ যেন সত্যিই মা ছেলের জীবন্ত দৃশ্য। আলো বেগম ভেতরে ঢুকলেন না। আরও একটু পিছিয়ে গিয়ে পর্দার পিছনে লুকিয়ে নিলেন নিজেকে। দেখতে পেলেন তার গুরুগম্ভীর স্বামী আশেপাশে কিছু খুজছেন। বিছানা ছেড়ে ওঠে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা তেলের বোতল থেকে খানিক তেল আর টি টেবিল এ রাখা গ্লাস থেকে একটু পানি হাতে ঢেলে নিয়ে বিছানায় ফিরে গিয়ে আড়ালের মাথায় মনোযোগ দিয়ে মালিশ করতে লাগলেন। এমন দৃশ্য দেখে অদ্ভুত শান্তি পেলেন আলো বেগম। তৃপ্তি পেলেন হৃদয়ে।
শুদ্ধ বিশ মিনিট সময় নিয়ে গোসল করে বাইরে বেড়িয়ে আসে। ওয়াশরুমের ছিটকিনি খোলার আওয়াজ পেয়ে আসিফ সাহেব তড়িৎ গতিতে সোজা হয়ে বসেন। হাতে লেগে থাকা অবশিষ্ট তেলটুকু নিজের মাথায় সাবধানে ঘষে নেন। আলো বেগম আর লুকিয়ে না থেকে রুমের ভেতর চলে এসে সরাসরি দুজনকে খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করেন। যেনো এই মাত্রই এসেছেন রুমে। দুজনেই মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানায় তবে বলে দেয় এই রুমেই খাবে দুজনে। আলো বেগম চলে যায় খাবার আনতে।
শুদ্ধ ও তার বাবা দুজনে একসাথে বসে ভাত মেখে সবে মুখে তুলবে এমন সময় আড়াল বিরবির করে কিছু বলে ওঠে। আলো বেগম এগিয়ে যায় আড়ালের কাছে। আড়াল চোখ খুলে কয়েক সেকেন্ড থম মেরে থাকে। আচমকা চিৎকার শুরু করে দেয় রক্ত বলে। আড়ালের চিৎকারে দুজনই এঁটো হাতে ওঠে পড়ে খাবার রেখে। কারোরই আর খাওয়া হলো না। হবে কি করে, মেয়েটা যে দুজনেরই প্রাণ।
#চলবে