#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২

ভাবতে না ভাবতেই দরজার ছিটকিনি খোলার আওয়াজ হলো। আমার মুখে ফুটে উঠলো অদ্ভুত এক হাসি। এ হাসি সে দেখতে পাবে না। একান্তই ব্যাক্তিগত এ হাসি। আমার হাসি হোক বা চোখের জল, দুটোই আমার একান্ত প্রাপ্তি বলে আমি মনে করি। আমি দাড়িয়ে রইলাম একিভাবে। পিছন ফিরলাম না। সামনের জং ধরা টিনের গায়ে এক দল লাল পিঁপড়ে সারিবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের নিজ লক্ষ্যে। তাদের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে পিছনে থাকা ভয়ে তটস্থ দাঁড়ানো ছায়া মুর্তিকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

‘আমি নিজ ইচ্ছেতে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে ছিলাম। নিজ ইচ্ছেতেই ফিরে এসেছি। আমায় নিয়ে অযাচিত উপদেশ দিয়ে যে তোকে পাঠিয়েছে তাকে বলে দিস, আমি শুধু পিঁপড়ের মতো কামড়াতেই জানি না। পিঁপড়ের মতোন ধৈর্য ধরে লক্ষ্যে এগিয়ে যেতেও জানি। পিঁপড়েরা কখনো নিমন্ত্রণ এর অপেক্ষায় থাকে না। আর না থাকে সুযোগ এর অপেক্ষায়। দু’টোই সময় সাপেক্ষে গড়ে নিতে তারা জানে। লক্ষ্যে পৌছানোর রাস্তা না পেলে নতুন রাস্তাও গড়ে নিতে জানে। পিঁপড়ার একবার লড়াই শুরু হলে তা কতক্ষণ চলতে পারে জানিস? মৃত্যু পর্যন্ত। মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাশক্তি থাকলে সাহস আর সুযোগ দুটোই হয়ে যাবে। সাহস টা পেয়ে গেছি। এখন শুধু সুযোগের অপেক্ষা। খুব শীঘ্রই সেই সুযোগ আমার পায়ে এসে হুমরি খেয়ে পড়বে। এখন তুই যা। আমি কোথাও যাচ্ছি না। আমার যা করার আমি এখানে থেকেই করবো। আর আরেকটা কথা। আমাকে নিয়ে ভয় পাবি না। ওরা ততখন আমার কিছুই করবেনা যতখন আমি অসহায় এর খোলস পড়ে আছি। তাই নিশ্চিন্তে থাকতে পারিস।’

হতাস হয়ে চোখের জল মুছলো টুসু। সন্তপর্ণে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেলো বাইরে। আড়াল যে মারের দাগ লুকোতে সামনে না ঘুরে পিছন ফিরে কথা বললো তা বেশ ভালোই বুঝেছে সে। সেই দুর্বল মেয়েটা আজ দুর্বলতা লুকাতে বেশ ভালোই শিখে গেছে। গেটের ওপাশ থেকে লুকিয়ে সবটাই দেখেছে টুসু। কিভাবে ওই অসভ্য মহিলা আড়ালের গায়ে হাত তুলেছে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে গেট দিয়ে বের হয়ে যায় টুসু। সোজা রাস্তা ধরে দুই মিনিট হেঁটে হাতের বাম পাশের দুতলা বাড়িটিতে ঢুকে একটি রুমের ভেতর এসে দাড়ায়। সামনে কেউ একজন বসে আছে। আড়ালের বলা সব কথা তাকে খুলে বলে। সামনের ব্যাক্তির থেকে কোন প্রতিউত্তর না পেয়ে চলে আসতে নেয় টুসু। তখনি পেছন থেকে সেই অজ্ঞাত ব্যাক্তি দরাজ গলায় বলে ওঠে,

‘তুইও ওকে বলে দিস টুসু, পিঁপড়ে কখনো একলা চলে না। তারা সর্বদা দলবেঁধে চলে। এটা তাঁদের দুর্বলতার প্রকাশ নয়, বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ।’

টুসু মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বেরিয়ে আসে সেখান থেকে।
_____

লাকড়ি ঘরের অর্ধেক জায়গা হিজিবিজি করে লাকড়িতে ঠাসানো। আর অর্ধেকটাতে একটা আধভাঙা চৌকি বসানো আছে। চৌকিতে কোন তোশক পাতা নেই। আছে শুধু মোটা আস্তরণের দুটো ছেড়া কাথা। সেই কাথার নিচে অবশ্য একটা বাশের তালাই দেওয়া আছে। চৌকির উপর বসে আছে আড়াল। অপেক্ষা করছে অন্ধকার হওয়ার। দুপুর থেকে বিকেল অবধি কারো কোন সারা শব্দ পাওয়া যায়নি। যাবে কি করে। সবাইতো গেছে রিসিপশনের অনুষ্ঠানে। আসার সময় নিশ্চই মেয়ে জামাইদের সাথে নিয়েই আসবে। তাদের সামনে তো আর আমাকে আটকে রাখতে পারবে না। ভালো মানুষ সাজতে নিশ্চয়ই আমাকে এ ঘর থেকে বের করতেই হবে। তখন কি করবে চাচি? তবে তাদের ফিরে আসার আগেই আমাকে বের হতে হবে এ ঘর থেকে। এখন শুধু অন্ধকার হওয়ার অপেক্ষা।

টিনের সহস্র ফুটো দিয়ে এখন আর কোন আলোর রেখা তীরের মতো ছুটে আসছেনা। বাইরে এখন পুরো অন্ধকার হয়ে এসেছে। আড়াল আর সময় নষ্ট না করে চৌকির উপর উঠে দাড়ায়। এখান থেকে খুব সহজেই চালের টিন ছোঁয়া যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে উপরে ওঠা সম্ভব নয়। তাই ওপাশ থেকে কিছু মোটা ও ভারি লাকড়ি এনে জড়ো করে চৌকির ওপর। তারপর সেই লাকড়ির ওপর দাঁড়িয়ে উপরের সারি সারি টিনের মধ্যে থেকে একটি টিন কিছুটা আলগোছে সরিয়ে উঠে পড়ে চালের উপর। পুরোনো ঘর হওয়ার দরুন লোহায় জং ধরে জোরা আলগা হয়ে আছে। তারপর সাবধানে পা রেখে চালের পিছন দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে কিছু সিমেন্ট এর বস্তা ও ইট রাখা আছে। সেই ইটের স্তুপের ওপর পা রেখে নিচে নেমে আসে আড়াল।

আর সময় নষ্ট না করে এগিয়ে যায় সামনের দালান ঘরের দিকে। বসার ঘরে যেতেই দেখতে পায় টুসু ঘর গোছগাছ করছে। নতুন জামাই আসবে বলে কথা। তাও আবার জোরা জামাই। ঘর তো ফিটফাট রাখতেই হবে। তাই হয়তো যাওয়ার আগে অর্ডার দিয়ে গেছে টুসু কে। টুসুর সামনে যেতেই টুসু কান্না করে দিয়ে জরিয়ে ধরে আড়ালকে। কাঁদতে কাঁদতে আড়ালকে বলে, ‘ওরা যাওয়ার আগে লাকড়িঘরে তালা মেরে গেছিলো আরু। তাই আর সারাদিনে তোর কাছে যেতে পারিনি রে।’ টুসুকে সান্ত্বনা দিয়ে আড়াল এগিয়ে যায় দক্ষিণ দিকের শেষ ঘরটার দিকে। দরজায় দাড়াতেই আড়াল দেখতে পায় শুকনো শরীর নিয়ে অগোছালো বিছানায় জড়বস্তুর ন্যায় পড়ে আছে তার বাবা। কোন নড়চড় নেই। নড়চড় থাকবে কি করে। প্যারালাইসিস হয়ে গোটা শরীর এর সাথে মুখটাও যে অকেজো হয়ে গেছে। মুখ এক পাশে বেঁকিয়ে যাওয়ার কারনে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছে যে বাবা।

বাবার শিয়রের কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে ডাক দেয় আড়াল। ‘বাবা’ ডাক শুনে সালাউদ্দিন আহমেদ চোখ খুলে তাকায়। আড়ালকে দেখতে পেয়ে গোঙাতে শুরু করে তৎক্ষনাৎ। কিছু হয়তো বলতে চাইছে। কিন্তু তা পারছেন না। একটা সময় চোখ দিয়ে অবিরত জল পড়তে শুরু করে। মুখটা কেমন বিবর্ন হয়ে গেছে। আড়ালের চোখ দিয়েও অনবরত জলের ধারা বইতে থাকে। মানুষটাকে দেখে চেনাই যাচ্ছে না। আড়াল ওর বাবার মাথায় হাত রেখে আবেগ মাখা গলায় ফিসফিস করে বলে,

‘তোমার চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে বাবা! অশ্রু ঝরছে! এই অশ্রুর কারন আমার জানা নেই। এই পরিস্থিতিতে অশ্রু ঝরার কারনের অভাব নেই। তাই তোমায় সান্ত্বনা দিতে পারছি না। আমার মা ও ঠিক এই ভাবেই অশ্রু ঝরাতে ঝরাতে এই দুনিয়া ছেড়েছে বাবা। তোমাকে আমি সেই সুযোগ দেবো না। খুব তারাতারি তুমি মুক্তি পাবে এই কষ্ট থেকে। আর অল্পকিছু দিন বাবা। মাত্র অল্প কিছু দিন। তারপর আর তোমায় এতো কষ্ট পেতে হবে না।

কথা শেষ করে রুম থেকে বেড়িয়ে এসে বাইরে দাড়িয়ে হাওমাও করে কেঁদে ওঠে আড়াল। টুসু দুর থেকে দেখতে পায় আড়ালের কান্না। টুসুও কেঁদে ওঠে। আড়ালের বুকটা ফেটে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন। এতো কষ্ট কি সত্যিই পাওনা ছিলো। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না। নিজেকে ধাতস্থ করে উঠে দাড়ায় আড়াল। এখন যেতে হবে। কিছুক্ষণ বাদেই সবাই চলে আসবে। তাই আর সময় নষ্ট না করে যেখান দিয়ে এসেছিলো সেখান দিয়েই চলে যায়। কাল থেকে যে আরেক নাটক শুরু হবে। এখন শুধু তারই অপেক্ষা।

________

সকালের আলো ফুটেছে অনেক আগে। এখন আহমেদ ভিলার সবাই কাজে খুব ব্যাস্ত। নতুন মেয়ে জামাইদের আপ্যায়নে যেনো কোন ত্রুটি না থাকে তাতে কঠোর নজরদারি করছেন আড়ালের চাচি আমিনা বেগম। গতকাল সবার আসতে আসতে অনেক রাত হয়ে গেছিলো। তাই রাতে আর বেশি ঘাটাঘাটি হয়নি আড়ালকে নিয়ে। তখন কোনরকম পাশ কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। কিন্তু এখন কি করবেন সেই চিন্তায় চিন্তায় মাথা খারাপ হবার যোগার। আমিনা বসার ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় তার ছোট জামাই ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে বাইরে আসছে। জামাইকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে গিয়ে তাকে বসতে বলে মেয়েকে ডেকে নাস্তা দিতে বলেন আমিনা। কিন্তু আরাফাত খেতে মানা করে শক্ত গলায় প্রশ্ন করে, ‘আড়াল কোথায় আন্টি?’ আমিনা বেগম কথা এড়িয়ে গিয়ে বলেন বাবা আগে খেয়ে নাও তারপর সব কথা হবে।’ আরাফাত রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলে,

‘আগে আমি আমার প্রশ্নের উত্তর চাই আন্টি। আড়াল কোথায়? আমি জানি ও ফিরে এসেছে। ওর আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। যে এবাড়ি ছেড়ে অন্যকোথাও গিয়ে উঠবে। আমি নিশ্চিত ও ফিরে এসেছে। আপনারা ছাড়া ওর আর কেউ নেই। তাই বলুন ও কোথায়? আমার ওর সাথে বোঝাপড়া আছে। অনেক প্রশ্ন আছে আমার।’

আমিনা বেগম পরিস্থিতি বেগতিক বুঝতে পেরে আরাফাত কে বলে দেয় আড়ালের অবস্থান। আরাফাত অপেক্ষা না করে দৌড়ে যায় লাকড়ি ঘরের দিকে। আমিনা বেগম পিছন পিছন এগিয়ে যান চাবি নিয়ে। তালা দেওয়া দেখে আরাফাত রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকায় আমিনা বেগমের দিকে। আমিনা বেগম তালা খুলে দিয়ে আর দাড়ান না সেখানে। আরাফাত ভেতরে ঢুকে দেখে..

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here