#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১৮

হটাৎ শুদ্ধর গলা পেয়ে আড়াল চকিতে দরজার দিকে তাকায়। সদ্য জলে ভেজানো গলা আবারও শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো যেনো। কি বলবেন উনি? তাও আবার একলা ঘরে। বৃষ্টির সামনে বলা যেতো না কি? শুদ্ধ আড়ালের থেকে এক হাত দুরত্ব রেখে বিছানায় বসলো। আড়াল চোখ তুলে চাইলো না। মাথা নিচু করে বসে রইলো। শুদ্ধ নিরবতা ভাঙছে না।

আড়াল এর বড্ড অবাক লাগলো শুদ্ধের নিরবতায়। মনটা এবার ক্রোধের বিষে বিষিয়ে ওঠলো। এমন ভাবে লোকটা নিরব হয়ে বসে আছে যেনো তার কৃতকর্মের জন্য কত অনুশোচনা হচ্ছে। তবে ক্রোধের ছাই মুখে না মেখে শক্ত হয়ে বসে রইলো আড়াল

শুদ্ধ এক লম্বা শ্বাস টেনে নিয়ে আড়ালকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘এখন তোমাকে কিছু কথা বলবো, প্লিজ মন দিয়ে শুনবে। বাবা..’

‘শুদ্ধ ভাইয়া, নিচে কেউ একজন এসেছে। আড়াল এর খোঁজ করছে। বলছে আড়ালের সাথে দেখা করতে চায়। নিচে ড্রয়িংরুমে বাবার সাথে বসে আছে।’

হটাৎ বৃষ্টির গলা পেয়ে শুদ্ধ থেমে যায়। কথা শেষ করে ওঠতে পারে না। শক্ত গলায় বৃষ্টিকে শুধু জিজ্ঞেস করে কয়জন এসেছে? বৃষ্টি উত্তর দেয়, ‘একজন ভদ্রলোক।’

‘তুই গিয়ে বল আড়াল খাবার খাচ্ছে। একটু পর আসছে। যাওয়ার আগে দরজাটা লাগিয়ে যাস।’

আড়াল বৃষ্টির কথা শুনে মনে মনে ভাবছিলো কে এলো তার খোঁজ করতে তা দেখতে এখনি নিচে যাবে। এমন সময় শুদ্ধর এমন অদ্ভুত মিথ্যে শুনে আড়াল খানিক রেগে যায়। খানিক উচ্চ স্বরে বলে উঠে,

‘আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে বলে কি আমি আপনার কথা ছাড়া কারো সাথে দেখাও করতে পারবো না? আপনি মিথ্যে কেনো বললেন?’

শুদ্ধ কোনো উত্তর না দিয়ে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। যাওয়ার আগে বাইরে থেকে লক করে দিয়ে গেলো দরজা। আড়াল হতবাক হয়ে যায় শুদ্ধর এমন ব্যাবহারে। রাগের থেকে কষ্ট বেশি লাগলো। মনে হলো সব স্বাধীনতা বুঝি শেষ হয়ে গেলো। দুমিনিট পর আচমকা লক খোলার শব্দে কান খাড়া হয় আড়ালের। শুদ্ধ আবার এসেছে। তবে হাতে লাল কিছু একটা রয়েছে। সাথে একটা বক্স ও আছে। আড়ালের মনে হলো হাতের রক্তলালের মতো দেখতে ওটা শাড়ি। শুদ্ধ এগিয়ে এসে আড়ালের হাতে শাড়িটা দিয়ে বলে,

‘এই শাড়িটা ঝটপট পাঁচ মিনিটের মধ্যে পড়ে আসবে। অন্যান্য যা যা লাগে সৃষ্টির গুলো সব আছে। যাও ওয়াশরুম থেকে পড়ে এসো।’

‘আমি শাড়ি কেনো পড়বো? যেখানে বিয়ের সময় আপনার শাড়ি ছাড়া কোন প্রবলেম হয়নি সেখানে সামান্য একজন দেখা করতে এসেছে বলে তার সামনে শাড়ি ছাড়া যাওয়াতে প্রবলেম কেনো হবে?’

‘তুমি যদি এভাবেই আমার সাথে তর্ক বির্তক করতে থাকো তাহলে কোন প্রশ্নের উত্তর কখনোই পাবে না।’

আড়াল শুদ্ধের হাত থেকে শাড়িটা কেড়ে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। শাড়ি পড়া ছোটবেলা থেকেই শেখা। তাই বেশি সময় লাগলো না। পাঁচ মিনিটের মধ্যে শাড়ি পড়ে বেড়িয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে।

লাল টুকটুকে শাড়ি, চোখ নাক খানিক লাল, ঘারে ঝুলে আছে হাতে করা মাঝারি সাইজের খোপা। দুপাশে অজস্র ছোট বড় চুল ঝুলে আছে নিজেদের মতো করে। শুদ্ধ আড়ালকে কয়েক সেকেন্ড খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে তার সামনে এসে দাড়াতে বলে। আড়াল বেশ বিক্ষোভ পূর্ণ চেহারা নিয়ে শুদ্ধর সামনে এসে দাড়ায়। চোখের দৃষ্টি নত। শুদ্ধ কঠিন স্বরে বলে ওঠে,

‘আমার দিকে তাকাও। যতক্ষণ আমি কথা বলবো আমার চোখে চোখ রেখে মনোযোগ সহকারে কথা শুনবে। চোখের দৃষ্টি বা মনোযোগ আমার থেকে সরে গিয়ে যদি এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে তাহলে দুটোই বাগে আনতে আমি জানি।’

এতোক্ষণ এর বিক্ষোভ এর ছায়া লেপ্টে থাকা মুখে নেমে এলো ভয়ের আধার। আড়াল চোখ তুলে তাকালো শুদ্ধের চোখে। সেদিন জেদের সাথে পাল্লা দিয়ে যার চোখে চেয়ে ছিলো অনিমেষ। আজ তার চোখে চাইতে গিয়ে পাল্লা দিতে হচ্ছে ভয়ের সাথে। নাকি অন্যকিছু। ঠিক বোঝা গেলো না।

আড়াল নিজের অস্বস্তি লুকিয়ে স্বাভাবিক দৃষ্টি দিলো। শুদ্ধর কন্ঠের ন্যায় চেহারাতেও কাঠিন্যতা। সে বজ্র কন্ঠে বলতে শুরু করে,

আমাদের একটু আগে বিয়ে হয়েছে। সেটা যেভাবেই হোক না কেনো। আজ থেকে তুমি আমার স্ত্রী, আমার দায়িত্ব। সে তুমি মানো বা না মানো। তুমি এখন আমার বিয়ে করা বউ সেই অনুযায়ী আমার তরফ থেকে তোমার জন্য এখন দুটো অপশন আছে। হয় বাইরের মানুষের সামনে আদর্শ বউ এর দায়িত্ব পালন করবে অথবা তা বন্ধ দরজার ভেতরে। চাইলে দুটোই একসাথে কন্টিনিউ করতে পারো। বাইরে না ঘরে, কোথায় তুমি বউ এর দায়িত্ব পালন করবে তা তোমার ব্যাপার। তবে ফার্স্ট অপশন চুজ করলে অবশ্যই সবার সামনে আমাদের সম্পর্কটাকে আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের মতোই প্রেজেন্ট করতে হবে। সবাই জানবে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক। আমাদের সম্পর্কের সীমা হবে ততটুকুই। আর যদি সেকেন্ড অপশন চুজ করো, তাহলে বাইরে কারো সামনে তুমি আমাদের সম্পর্কটাকে কিভাবে প্রেজেন্ট করছো তাতে আমি নাক গলাবো না। বাট পার্সনালি আমি আমার কোন অধিকার ছেড়ে সাধুবাবা হয়ে জীবন কাটাতে পারবো না। বিয়ে করেছি। বউ নিয়ে সংসার করবো। হানিমুনে যাবো। বাচ্চা কাচ্চা হ…’

‘আপনি চুপ করবেন? আর বলতে হবে না। এতো ঘুরিয়ে পেচিয়ে না বলে সোজা বলে দিলেই তো হয় আপনি আমাকে আপনার হাতের পুতুল বানাতে চান। আপনি যেভাবে আমায় নাচাবেন আমি সেভাবেই নাচবো। আপনার সাথে সংসারি করে বাচ্চাকাচ্চার জন্য আমি বিয়ে করি নি। তা…’

‘তার মানে তুমি সেকেন্ড অপশন চুজ করছো। তাইতো? ওকে। তবে এক কাজ করো শাড়ী টারি খুলে ফেলো।’

‘আপনি কিন্তু এবার লিমিট ক্রস করছেন শুদ্ধ! আপনি কিন্তু এমন করতে পারেন না!’

আড়ালের দুইপা পিছিয়ে গিয়ে ভীতু গলায় আওড়ানো শব্দ শুনে শুদ্ধ খানিক বিরক্তি প্রকাশ করে দাতে দাত চেপে বলে,

‘আমি তোমার এক ঘন্টা আগে তিন কবুল বলে বিয়ে করা বর। তাই নাম ধরে ডাকতেই পারো। সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে তুমি যা ভেবে বাংলা সিনেমার পুরোনো ডায়লগ দিচ্ছো আমার তেমন কোনো মুড নেই। আর না তেমন কিছু মিন করেছি। তেমন ইনটেনশন হলে শাড়িটা তোমায় খুলতে বলতাম না। আমার নিজেরও হাত আছে। বলছিলাম যে শাড়িটা খুলে নিজের পছন্দের ড্রেস পরে নিচে যাও। যে এসেছে তাকে তোমার বরের পরিচয় দেওয়ার কোন দরকার নেই। এমনকি কারো কাছেই নয়। শুধু আমি আমার প্রাপ্যটুকু পেলেই হবে। আমি নিচে যাচ্ছি। তুমি চলে এসো।’

শুদ্ধ কথা শেষ করেই রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। দু দন্ড দাড়ায়না আড়ালকে কিছু বলার সুযোগ দিয়ে। আড়াল লজ্জায় শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। আড়ালের মনে হচ্ছে এতোক্ষণ কথা তো নয় যেনো বিষ মাখা সুঁচ ফোটাচ্ছিলো গায়ে ওই লোকটা। দুমনা করে তাকালো বিছানায় রাখা একটা লাল বক্সের দিকে। হাতে নিয়ে খুলে দেখে তাতে একটা স্বর্ণের চেইন, মাঝারি এক জোড়া কানের দুল আর অবিকল মায়ের হাতের বালার মতো এক জোড়া বালা। সাথে আবার চিকন এক জোড়া ছোট সাদা পাথর বসানো চুরি ও আছে। জ্বলজ্বল করছে লাইটের আলোতে। বালা জোড়া হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে আবার রেখে দিলো। ভাবলো এমন কিছু শুধু মায়ের হাতেই মানায়। তার হাতে নয়। বাকি জিনিসগুলো একে একে পড়ে আয়নার সামনে দাড়ালো। নিজেকে এমন বউ সাজে দেখে মলিন হাসলো আড়াল। হটাৎ কিছু মনে করে মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেলো। নিজের দিকে চেয়ে মনে পড়লো অতীতের কিছু ছন্দস্মৃতি। ইচ্ছে হলো সব টেনে খুলে ফেলতে। মনটা বিশুষ্কতায় এলোমেলো হয়ে গেলো। দীর্ঘ এক শ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে শান্ত করে রওনা করে ড্রয়িংরুমের উদ্দেশ্যে। এতো রাতে যে এসেছে সে নিশ্চয়ই এমনি এমনি আসেনি। আসন্ন ব্যাক্তির মধ্যেও কি কোন রহস্য আছে যা অজানা। আকাশ পাতাল কল্পনায় ডুবে অন্যমনষ্ক হয়ে সিড়ি বেয়ে নামতে থাকে আড়াল।

শুদ্ধ ড্রয়িংরুমে পৌছিয়ে সোফায় বসা লোকটার মুখ দেখে খানিক খুশিই হয়। মনে মনে যা ভেবেছিলো তাই হলো। সেই এসেছে যার আসার কথা ভেবেছিলো। সরাসরি তার সামনে না যেয়ে পাশের রুমে গিয়ে কাউকে ফোন করে শুদ্ধ। খানিক্ষন পর ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলে শুদ্ধ গলার স্বর নামিয়ে ধীর কন্ঠে বলে ওঠে,

‘সব সামলে নিয়েছি আমি। আড়াল আমার কথামতোই তার সাথে দেখা করবে। আর হ্যা, সে কিন্তু আর কাওকে সাথে আনেনি। একাই এসেছে। বাকিটা এবার তুমি সামলাও।’

শুদ্ধ নিজের কথা শেষ করে ওপাশের বলা কথা কিছুক্ষণ শুনে ফোনটা কেটে পকেটে ভরে নেয়। অপেক্ষায় থাকে আড়ালের। তার খুব ভালো করেই জানা আছে আড়াল তার কথামতোই নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিচে আসবে। ভাবতে না ভাবতেই শুদ্ধ দেখতেই পায় সিড়ি বেয়ে নেমে আসছে আড়াল। আড়ালের স্নিগ্ধতা শুদ্ধের মনে শিহরণ জাগিয়ে তোলে। লাল টুকটুকে পুতুলের মতো লাগছে মেয়েটাকে। আড়াল আসতেই আড়াল কে থামিয়ে দেয় শুদ্ধ। কাছে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,

‘তোমার সাজগোজ বলছে তুমি ফার্স্ট অপশন চুজ করেছো। এবার ওই রুমে আমি যা যা বলবো সবকিছুতে শুধু হ্যা করে যাবে। একদম পতিব্রতা দায়িত্বশীল স্ত্রীর মতোন। মনে যেনো থাকে।’

শুদ্ধ কথা শেষ করে আড়ালের পেছন থেকে আচল টেনে নিয়ে মাথায় দিয়ে বলে, ‘এবার ঠিক আছে। চলো।’
আড়ালকে আগে যেতে বলে শুদ্ধ পিছন পিছন যেতে থাকে। আড়াল ড্রয়িংরুমে গিয়ে সোফায় বসা মানুষটার মুখ দেখে আশ্চর্য নয়নে চেয়ে থাকে। মনে প্রশ্ন জাগে এই মানুষটা এতোদিন কোথায় ছিলো?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here