#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১৫
কি বললো, কেনো বললো কিছুই বুঝলাম না। গাধী বলে মুখ লটকিয়ে চলে গেলো। ঘুম নিয়ে বোধহয় কিছু বললো। কেনো? হটাৎ দেয়াল ঘড়িতে চোখ গেলে লাফিয়ে ওঠে ওয়াশরুমে দৌড়ালাম। ইশ কত দেরি হয়ে গেছে। অজু করবো কখন?

নামাজ পড়ে উঠতে না উঠতেই বৃষ্টি আর সৃষ্টি এলো ডাকতে। ছাঁদে আড্ডা দেওয়ার সময় হয়েছে। দরকারি জিনিসপত্র সব উপরে নেওয়া হয়েছে। এখন সবাই গেলেই হয়। কথা শেষ করে দুজনে একটুও দাঁড়ায়নি। ছুট লাগিয়েছে রান্নাঘরের দিকে। এখনো তো জল নেওয়া বাকি।

মাথায় ওরনা দিয়ে একটা পিন আপ করে নিলাম। কাল ছাঁদে হাওয়ার বেশ তোরজোর লক্ষ্য করেছিলাম। বারবার মাথা থেকে ওরনা পড়ে যাচ্ছিলো। তাই আজ প্রস্তুতি নিয়েই রওনা হলাম ছাঁদে। ছাদে পৌছিয়ে মাদুর বিছিয়ে রাখা জায়গায় বসে পড়লাম। সবার উপস্থিতি বিদ্যমান। ছোটদের মধ্যে টুবলু, গুবলু, তিন্নি আর গুবলি আছে। আর আছে বৃষ্টি, সৃষ্টি, শান্ত ও ফুয়াদ। কেউই বাকি নেই। শুধু আমাকে তাড়া করা মানুষটা অনুপস্থিত। চারপাশে এখনো পুরোপুরি কৃষ্ণাভ হয় নি। আকাশের পশ্চিম বুকে তুলনারহিত সৌষ্ঠব এর বৈচিত্র্যতা চলছে। আঁধার হয়েও যেনো হয়নি। সমারোহ হচ্ছে রাঙা মেঘের প্রচ্ছদ। মনটা কি ফুরফুরে লাগছে।

সিঁড়ি ভেঙে দুমদাম আওয়াজ করে কেউ উঠে আসছে। এতো আওয়াজ করে আসার কোন মানে হয়। শুদ্ধ ভাইয়া তো এমন করে চলাফেরা করে না তাহলে কে? উপস্থিত হলো নতুন মুখ। ছাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁটুতে হাত রেখে হাঁপাচ্ছে। কি অদ্ভুত। মাত্র দুই তলা সিঁড়ি ভেঙে এমন চূর্ণন অবস্থা। যা আওয়াজ তুলে এলো, দৌড়ে এসেছে বোধহয়। পাশ থেকে সবাই হটাৎ রিয়াদ ভাইয়া বলে চিল্লিয়ে ওঠলো। ছোটরা সবাই দৌড়ে গিয়ে জাপ্টে ধরলো লোকটাকে। আমার মাথায় অন্য চিন্তা বাসা বাঁধলো। এই লোকটার নাম রিয়াদ। উনিই কি আজ হসপিটালে ভর্তি ছিলো? যাকে শুদ্ধ ভাইয়া দেখতে গিয়েছিলো। কিন্তু কাল এক্সিডেন্ট করে আজ এমন সুস্থ অবস্থায় সশরীরে কিভাবে আসতে পারে?

ছেলেটাকে সবার মধ্যে এনে বসিয়ে দিলো বাচ্চারা। সবার মধ্যেই অনেক কৌতুহল দেখা গেলো। একেকজনের একেক রকমের প্রশ্নপর্ব চলছে। ছেলেটি এখনো বেশ হাপাচ্ছে। তবে সবার এতো গা মাখামাখি প্রশ্নতে একটুও বিরক্ত হচ্ছে না। উল্টো যখন যে যা প্রশ্ন করছে তখন তার দিকে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে প্রশ্নগুলো শুনে যাচ্ছে। হটাৎ চিৎকার দিয়ে সবাইকে চুপ করতে বলে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে নেয়। আর বলতে শুরু করে,

‘তোদের সবার প্রশ্নের এক এক করে উত্তর দিতে গেলে আমার জীবন যৌবন এর ডেট এক্সপায়ার হয়ে যাবে। আমি আমার মতো করে বলছি, তোরা শোন। আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে আজ সকালে পৌঁছিয়েছি। জানিস তো, ফ্লাইটে এক ঘন্টা ও ঘুমোতে পারি না। তাই বাসায় গিয়েই একটা জম্পেশ ঘুম ডাউনলোড করে তাতে ইনস্টল হয়ে গেছি। ঘুমের ডেটা স্পিড এতো হাই লেভেলের ছিলো যে ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সকাল পেরিয়ে দুপুর আর দুপুর পেড়িয়ে বিকেল গড়িয়ে গেছে অথচ আমার ঘুমের ডেটা কানেকশন লস হয়নি। শেষমেশ কিছুক্ষণ আগে উঠে দেখি প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। এদিকে খিদের চোটে পেটের ভেতর ইঁদুরেরা সব ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ যাকে পাবি তাকে ছোঁ শুরু করেছে’। মনে হচ্ছে সামনে যা পড়ছে সব খেয়ে ফেলি। কোনমতে শার্ট প্যান্ট চেঞ্জ করে এবাড়ির দিকে রওনা হয়েছি পেট পুজো করতে। কপাল গুনে চৌরাস্তার মোরে আসতেই দেখা হলো সেই ডাইনিটার সাথে। টফিকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে। আর ওই টফি হারামজাদা আমায় দেখে এই দৌড় কি সেই দৌড়। যেনো ও একটা পুলিশ আর আমি হলাম চোর। এক দৌড়ে চৌরাস্তা থেকে বাসার ছাঁদে চলে এসেছি। আর একটু হলেই বার্গার মনে করে কামড় বসাতো আমার গায়ে। ওফ্ফ! খুব বাঁচা বেঁচেছি আজ।

রিয়াদ ভাইয়ার কথা শেষ হতেই সবাই হাসতে হাসতে কলা গাছের মতো ধপাস করে একে অপরের গায়ে পড়া শুরু করে। আমি নিজেও হা করে আছি ওনার কথা শুনে। সবার এতো হাসাহাসিতে ওনার যে কোন হেলদোল নেই তা ওনার নিতান্ত মনদ পূর্ণ চেহারায় স্পষ্ট। কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে সবাই তাকিয়ে দেখি শুদ্ধ ভাইয়া উপরে আসছে। ওই ছেলেটা শুদ্ধ ভাইয়াকে দেখে দৌড়ে গিয়ে জরিয়ে ধরে। এতক্ষণের এতো বিষন্নতা সবকিছু নিমিষেই হারিয়ে গেলো ছেলেটার মুখ থেকে। কিন্তু শুদ্ধ ভাইয়ার মুখটা হটাৎ চুপসে গেছে। উপরে উঠে আসার পর প্রথম তো এমন ছিলো না। স্বাভাবিক ছিলো। হটাৎ এমন পরিবর্তন এর কারন কি?

‘হেই ব্রো, কেমন লাগলো সারপ্রাইজ? বলেছিলাম একসপ্তাহ পর আসবো। এক সপ্তাহ আগেই আসবো ভাবিসনি তো? সবসময় তুই সবাইকে যখন তখন চমকে দিস। আজ কিন্তু আমি দিলাম। বাট প্রচুর খিদে পেয়েছে ইয়ার। চল তো নিচে। ওদের এসব মুড়ি আর চপ,বেগুনি খেলে আমার চলবে না। আমার তো চাই শাশুমাদের হাতের গরম ভাত আর মাছের ঝোল। সাথে এক পিস গন্ধরাজ লেবু। আহা! জীবনটা ধন্য হয়ে যাবে। চলতো যেতে যেতে আমার কষ্টের প্যারাগ্রাফ পড়ে শোনাচ্ছি তোকে।

ছেলেটা গুবলি কে বউ বলে ডেকে গালে একটা চুমু খেয়ে কোলে তুলে নিয়ে শুদ্ধ ভাইয়াকে নিচে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। উনি যেতে যেতে একবার ফিরে তাকালেন আমার দিকে। আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে দাড়িয়ে রইলাম। মনের প্রশ্নের ছাপ চেহারায় পড়তে দিলাম না। ওনারা চলে গেলে আমি সৃষ্টি কে জিজ্ঞেস করলাম,

‘আচ্ছা এই ভাইয়া টা কে? কিছু মনে না করলে ওনার ব্যাপারে কি কিছু জানতে পারি?’

‘রিয়াদ ভাইয়া তো শুদ্ধ ভাইয়ার বন্ধু। ভাইয়ার বাবা-মা নেই। গতবছর মারা গেছেন। বাকি আত্মীয় সবাই আমেরিকাতে সেটেল্ড। ভাইয়াও সামনে বছর আমেরিকা চলে যাবে। এখানে ভাইয়ার আপন বলতে কেউ নেই। ভাইয়া আমাদের এখানেই প্রতিদিন খাওয়া দাওয়া করে। রাতে বাসায় চলে যায়। এখানে অবশ্য জেঠু থাকতে বলেছিলো যতদিন না আমেরিকা যাচ্ছে। বাড়ির সবাই-ই বলেছিলো। কিন্তু রিয়াদ ভাইয়া বলে, ‘বাবা-মায়ের স্মৃতির নীড় ছেড়ে তো চলেই যাবো। যতদিন আছি এই নীড়েই থাকবো।’ তাই কেউ আর বেশি জোরাজোরি করেনি। সারাদিন শুদ্ধ ভাইয়ার সাথেই থাকে। এখানেই খাওয়া দাওয়া করে। শুধু রাত হলে তার বাসায় চলে যায়। পনেরো দিন আগে আমেরিকা গিয়েছিলো তার চাচাকে দেখতে। হার্ট অ্যাটাক করেছিলো ভাইয়ার চাচা। এখন কিছুটা সুস্থ হয়েছে তাই হয়তো ব্যাক করেছে।’

‘আচ্ছা শুদ্ধ ভাইয়ার ক’জন ফ্রেন্ড? এই একজনই বুঝি?’

ভাইয়ার ফ্রেন্ড তো আরও তিনজন আছে। সাফিন ভাইয়া, রাহাত ভাইয়া আর সোহাগ ভাইয়া। তবে রিয়াদ ভাইয়ার মতো এতোটা ক্লোস নয়।’

‘তুমি সিওর ওনার আর কোন ফ্রেন্ড নেই?’

‘হ্যা আড়াল। থাকলে চিনবো না?’

আড়াল মনে মনে প্রাক্কলন করে কিছু পুরোনো ঘটনা। নতুন আরও অনেক প্রশ্ন যোগ হয়ে সন্দেহের দানা বাঁধে মনে।

সৃষ্টিদের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে আড়াল নিচে নেমে নিজের ঘরে চলে যায়। কিছু হিসেব এর খাতা খুলতে হবে।

‘আরে বড় শাশুমা, আর পারছিনা গো খেতে। আর দিও না। আমি এখন উঠছি।’

হাত ধুয়ে উঠতে গিয়ে শুদ্ধের দিকে চোখ ফেরালে দেখতে পায় উল্টোদিকের চেয়ারে বসে শুদ্ধ এমন করে তার দিকে তাকিয়ে আছে যেনো চান্স পেলে এক্ষুনি গিলে খাবে। রিয়াদ একটু ভয়ে ভয়ে শুদ্ধকে জিজ্ঞেস করে,

‘ব্রো তুই কি বাই এনি চান্স আমার ওপর রেগে আছিস? আমি তো এলামই আজ। আসার পর তো তেমন কিছু করিনি, উল্টো ওই ডাইনির কুকুর টার দৌড়ানি খেয়ে এসেছি। তাহলে এমন আগুন চোখে কেনো তাকিয়ে আছিস?’

শুদ্ধর মা রান্নাঘরে যাওয়ার পর রুম ফাকা হলে রিয়াদ কে দাঁত কিরমিরিয়ে বলে,

‘রুমে আয়, তারপর তোর জামাই আদরের শেষ আপ্যায়ন টা আমি নিজ হাতে করছি।’

শুদ্ধ কথা শেষ করে নিজের রুমে চলে যায়। রিয়াদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় শুদ্ধর কথা শুনে। শুদ্ধের পিছু পিছু এগিয়ে যায় রুমে, বিষয়টা বুঝতে।

পাঁচ মিনিট পর,

‘ভাই সরি সরি! আর কখনো তোকে না জানিয়ে সারপ্রাইজ দেবো না। তুই ফোন করার আগে ফোন রিসিভ করবো। তাও ওই ডাইনি না না সরি ডায়না কে আমার গলায় ঝুলাস না। ও একটা আস্ত পিত্তরসের ডিব্বা। আমাকে হজম করে ছাড়বে। মানুষ মাছ খেলে তাও কাটা বেছে খায়, ওই ডাইনি আমার এক গাছ চুলও ছাড়বে না। ছেড়ে দে ভাই কেঁদে বাচি।’

শুদ্ধ কোন কথা না বলে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। তখন যদি ফোন রিসিভ করতো তাহলে বলে দিতো আড়ালের কথা। এখন আড়ালের সামনে পড়া মানে গুচ্ছ গুচ্ছ প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া। এই একটা নতুন তৈরি হওয়া প্রশ্ন থেকে যে আরও কত প্রশ্ন নিয়ে সামনে দাঁড়াবে মেয়েটা, কে জানে?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here