#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১৩
আড়াল_কথা
‘তাহলে তোমার কোন আপত্তি নেই তো বাবা? আমি আড়াল কে নিয়ে যাবো তো?’
আসিফ সাহেব উত্তর না দিয়ে খবরের কাগজ নিয়ে বসে পড়লেন। তার মুখভঙ্গিতে মনের অবস্থা বোঝা দায়।
_______
সকালের খাবার পর্ব শেষ করে আমি রেডি হয়ে ড্রয়িংরুমে চলে আসি। এসে দেখি শুদ্ধ ভাইয়া ড্রয়িংরুমে দাড়িয়ে বিক্ষোভ পূর্ণ চেহারা নিয়ে বারবার হাতের কালো ঘরিটাকে দেখছে। আমি নিজের হাত ঘড়ির দিকে নেত্রপাত করে দেখি কলেজ শুরু হতে এখনো এক ঘন্টা বাকি। এখান থেকে গাড়ি করে যেতে আধঘন্টার বেশি সময় লাগার কথা নয়। শুদ্ধ ভাইয়ার এমন অযথা বিরক্তি দেখে একটু অস্বস্তি হলো। মনে হলো হয়তো আমার জন্যই এমন বিরক্ত হচ্ছেন।
আমি এগিয়ে গিয়ে শুদ্ধ ভাইয়ার সামনে দাড়ালে উনি আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে বেরিয়ে পড়েন বাইরের উদ্দেশ্য। আমিও পিছু পিছু এগিয়ে গেলাম। গাড়ির সামনে গিয়ে দেখি বৃষ্টি, সৃষ্টি, শান্ত আর ফুয়াদ সবাই গাড়ির পিছনে বসে আছে। শুদ্ধ ভাইয়া অলরেডি
ড্রাইভিং সিট এ বসে পড়েছে। আমি সামনের সিটে বসার জন্য সামনের সিটের দরজা খুলে বসতে গেলে শুদ্ধ ভাইয়া শান্তকে ডেকে বলে ওঠে,
‘শান্ত তুই সামনে এসে বোস। আর ওকে পিছনের সিটে বৃষ্টির সাথে বসতে দে।’
শুদ্ধ ভাইয়ার এমন কথায় অপমানে আমার মনটা তমসাবৃত হয়ে এলো। তবে মুখে তা প্রকাশ না করে পিছনে গিয়ে বসে পড়লাম বৃষ্টির সাথে। একটু লজ্জা লাগলো সবার দিকে তাকাতে। কারো দিকে না তাকিয়ে মেঘমেদুর মুখ নিয়ে জানালার দিকে মুখ করে বসে রইলাম। গাড়ি চলছে দ্রুত গতিতে। কিছুক্ষণ পর একটা কলেজের সামনে এসে গাড়ি থামে। ওরা সবাই নেমে গেলে শুদ্ধ ভাইয়া হটাৎ আমায় উদ্দেশ্য করে বলে,
‘আড়াল সামনে এসে বসো।’
আমার এবার বেশ রাগ হলো। একটু আগে সামনে বসছিলাম তখন বসতে দিলো না। আর এখন আবার বলছে সামনে বসতে। ইচ্ছে হলো মুখের ওপর বলে দিতে যে, ‘আমি বসবো না। আপনার যা খুশি করুন।’
কিন্তু যতই হোক, ওনাদের জন্য আমি আজ সসম্মানে বেঁচে আছি। বিশেষ করে ওনার জন্য। তাই রাগ হলেও, রাগে মাটি চাপা দিয়ে বেরিয়ে এলাম পিছন থেকে। সামনের সিটে গিয়ে বসলাম। আমি বসতেই উনি গাড়ি স্টার্ট দিলেন। কিছুদুর যেতেই হটাৎ একটা ক্লিনিকের সামনে গিয়ে গাড়ি থামালেন। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার অবকাশ পেলাম না। উনি এসে দরজা খুলে আমায় বের হতে বললেন। আমি বেরতেই উনি, ‘আমার সাথে এসো’ বলে হসপিটালের ভেতরের দিকে যেতে লাগলেন। মনে মনে ভাবলাম হয়তো চেনা পরিচিত কেউ ভর্তি আছে। তাই কিছু না বলে উনার পিছু নিলাম।
ভেতরে গিয়ে উনি তিন তলায় উঠে আমাকে একপাশে দাঁড় করিয়ে বললেন,
‘তুমি পাঁচ মিনিট এখানে একটু দাঁড়াও। আমার ফ্রেন্ড রিয়াদ এখানে ভর্তি আছে। একটা এক্সিডেন্ট করেছে গতকাল। আমি একটু দেখা করে আসছি।’
আমাকে দাড়াতে বলে উনি চলে গেলেন। ওনার প্রতি যতটুকু সম্মান ও কৃতজ্ঞতা বোধ ছিলো তা যেন সবটা মন থেকে ইস্তফা দিয়ে উবে যাচ্ছে। এতোটা কেয়ারলেস কেউ কি করে হতে পারে! আাসার সময় সিটিং এরিয়া দেখলাম। ওখানেও তো আমায় বসিয়ে রেখে আসতে পারতো। এখানে এভাবে একা একা কতক্ষণ দাড়িয়ে থাকবো। হয় গাড়িতে বসিয়ে রেখে আসতো নয়তো আমায় কলেজে নামিয়ে দিয়ে তারপর এখানে আসতো। আশেপাশে কত লোক। কিভাবে তাকিয়ে আছে! যেনো চোখ দিয়ে গিলে খাবে।
হটাৎ আঠারো নাম্বার কেবিনের দিকে নজর আটকে গেলো। একজন মহিলা মোবাইলে কথা বলতে বলতে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসছে। আমি বরফের ন্যায় জমে গেলাম। মন বলছে দৌড়ে পালিয়ে যেতে। কিন্তু পা যেন জমে গেছে। মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো, ‘তাহেরা খালা’ নামটি। চোখের সামনে ভেসে ওঠলো একটি আমাবস্যার ন্যায় কালো রাতের প্রতিচ্ছবি।
আচমকা অনুভব হলো, কেউ যেন আমার বাহু ধরে ঝাঁকি দিলো। কালো অন্ধকারচ্ছন্ন স্মৃতি মিলিয়ে গিয়ে স্পষ্ট হলো তাহেরা খালার চেহারা। আমার চোখে চেয়ে আছে হাসিমাখা ঝলমলে চেহারা নিয়ে। যেম হারানো কিছু ফিরে পেয়েছে। বিনিময়ে আমারও বোধহয় হাসি ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু মনের বিরুদ্ধে গিয়ে হাসি মুখে খালার চোখে চাইতে পারলাম না। আমি এখানে কেনো, এখন কোথায় আছি, মায়ের সাথে কি করে কি হলো সব একে একে জিজ্ঞেস করতে লাগলো। আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। তাহেরা খালা আমার উত্তর না পেয়ে হতাস না হয়ে নিজের কথা শুরু করলেন,
‘তোর মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি রে মা। আমার অবস্থাও ভালো নয়। বড্ড বিপদে আছি। উপরওয়ালা জানেন কপালে কি আছে।’
খালার কথাগুলো এতোক্ষণ কানে এলেও যেনো আমায় ছুতে পারছিলনা। কিন্তু হটাৎ কথা বলতে বলতেই অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। ওনার কান্নায় যেনো আমার হুশ এলো। নিজেকে ধাতস্ত করে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম। খালাকে কি বলে সান্ত্বনা দেবো চট করে মাথায় এলো না। খালা কাঁদতে কাঁদতে আবার বলতে লাগলেন,
‘গতকাল বিকেলে তোর খালু হটাৎ বাসায় এসে বলে দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হতে। কোন এক বিশেষ কাজে নাকি গ্রামে যাবে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলেও কোন উত্তর দেয় নি। কোনমতে আমাকে আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যার পর এসে গ্রামে পৌছাই আমরা। আমাদের বাড়িতে রেখে তোর খালু হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যেনো বেরিয়ে যায়। আমি পাশের বাড়ির ভাবির কাছে গেলে শুনতে পাই তোদের কথা। খুব কষ্ট লাগছিলো শুনে। তোর খোঁজ চাইলে কেউ দিতে পারলো না। কেউই জানে না তুই কোথায়। ঘন্টা দুয়েক পর হটাৎ আমার ফোনে হাসপাতাল থেকে কল আসে। জানায়, তোর খালুকে নাকি কারা মেরে হাসপাতালের সামনে ফেলে গেছে। এসে দেখি তোর খালুর অবস্থা খুব খারাপ। সারা শরীরে ক্ষতের চিহ্ন। ডান হাত একেবারে ভেঙে গেছে। ওই হাত নাকি ভালো হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। আর..’
খালা কথা থামিয়ে হটাৎ আবারও কেঁদে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে। কেনভাবে কান্না থামিয়ে খালা বলে ওঠে,
‘আমি আর বলতে পারছিনা রে আড়াল। আমি এখন কি করবো বুঝতে পারছি না। এখানে আমায় সাহায্য করার মতো কেউ নেই। গ্রাম ছেড়েছি নয় বছর হলো। বছরে একবার এসে ভিটে মাটি চোখের দেখা দেখে যেতাম। কারো সাথে তেমন সম্পর্ক নেই।’
খালা কান্নার কারনে ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না। হটাৎ কল আসে খালার ফোনে। খালা কথা বলায় ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। আমি এগিয়ে যাই কেবিনের দিকে। দরজা খুলে ভিতরে গেলে চোখে পড়ে সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো একটি নেতানো শরীর। আমার বুকে এক ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো। হটাৎ যেন বুকের ভেতর নয় বছরের পুরোনো গেড়ে বসা পাথরটি আলগা হয়ে এলো। তাকিয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। হটাৎ কেবিনে প্রবেশ করে একজন ডক্টর ও দুইজন নার্স। সাথে খালাও চলে আসে। ডক্টর নার্সের হাত থেকে ফাইল নিয়ে উল্টে পাল্টে কিছুক্ষণ দেখে নেয়। ফাইলে চোখ রেখেই খালাকে বলতে শুরু করে,
‘ওনার যা অবস্থা দেখছি তাতে এখানে রাখা ঠিক হবে না। ওনাকে ঢাকায় নিয়ে যান আপনারা। সাথে আর কেউ আসে নি? আপনারাই ওনার গার্জেন? ওনাকে যেভাবে মারা হয়েছে তাতে তো এটা পুলিশ কেস। কিন্তু পুলিশকে জানানো হয়নি। হাসপাতাল কতৃপক্ষ কেনো এটা মেনে নিলো জানি না। তাদের যখন টাকা খাইয়িয়ে পুলিশের থেকে ছুটকারা পেয়ে গেছেন, তাহলে টাকা পয়সার নিশ্চয়ই কোন অভাব নেই। ঢাকা নিয়ে গিয়ে ভালো চিকিৎসা করান। ওনাকে যেভাবে মারা হয়েছে তাতে আমার মনে হচ্ছে এটি মেয়েঘটিত কোনে বিষয়। ওনার পুরো শরীরে অজস্র ক্ষত রয়েছে। ডান হাত একেবারে ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আর পু’রু’ষা’ঙ্গ কেটে একেবারে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। কেউ এমনি এমনি নিশ্চয়ই এমনভাবে মারবে না। জানি না আমার আন্দাজ কতোটা সঠিক। তবে ওনি কতোটা সুস্থ হবেন তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বাকিটা আপনারা বুঝুন।’
ডক্টরের কথা শেষ হতেই আমি দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম কেবিন থেকে। চারপাশের লোকলজ্জা আমায় ছুতে পারলো না। এক দৌড়ে গাড়ির কাছে এসে থেমে গেলাম। গাড়ি লক করা দেখে গাড়ির পিছন দিকে এসে দাড়ালাম।
ওই লোকটা শাস্তি পেয়েছে। সর্বোচ্চ শাস্তি ভোগ করছে লোকটা। আমার মন তো এমন কিছুই চেয়েছিলো। তবে সেই চাওয়া ছিলো নিজের হাতে লোকটাকে শাস্তি দেওয়ার। ইচ্ছে হতো নিজ হাতে শেষ করে ফেলি ওই জানোয়ারকে। আজ নিজেকে বড্ড হালকা লাগছে। তবে কেন জানি ভেতর থেকে ঠেলে কান্না আসছে। কেন হচ্ছে এমন। হটাৎ কেউ ‘আড়াল’ বলে ডেকে ওঠে। চোখ মুছে পিছন ঘুরে দেখি শুদ্ধ ভাইয়া দাড়ানো।
কলেজে ব্রেক টাইমে ক্লাসে বসে আছি। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারো প্রশ্ন। লোকটাকে ওভাবে কে মারলো? আমার মতো আরও কোন মেয়ে কি ওই জানোয়ারের নজরে পড়েছিলো? তার কাছের কেউ কি এমন অবস্থা করেছে? প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে। সেই রাতের কথা বার বার মনে হচ্ছে। কোনভাবে ভুলে ওঠতে পারছি না। মাথা মনে হচ্ছে ফেটে যাবে। প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে মাথার ভেতর।
শুদ্ধ ভাইয়া আজ কলেজ আসতে কেনো জানি মানা করছিলো। হয়তো আমার চোখ মুখ দেখে বুঝেছিলো আমার কিছু হয়েছে। তাই দয়া দেখাতে বাড়ি যেতে বলছিলো। এখন মনে হচ্ছে বাড়ি যাওয়াই ঠিক ছিলো।
হটাৎ পিয়ন এসে বলে গেলো আমার বাড়ির লোক নাকি এসেছে আমায় নিতে। গেটের সামনে গিয়ে দেখি শুদ্ধ ভাইয়া গাড়ি নিয়ে এসেছে। আমি সামনে যেতেই সামনের সিটের দরজা খুলে আমাকে ভেতরে বসতে বলে। আমার নিজেরও যাওয়ার ইচ্ছে আছে তাই কথা না বাড়িয়ে বসে পড়ি গাড়িতে। জানতে ইচ্ছা হলো এখানে কেনো এসেছেন উনি। আমাকে কেনো নিয়ে যাচ্ছেন? কিন্তু কেন জানি কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো না। মনে হলো যেন মুখটা নাড়িয়ে কথা বললেও বড্ড কষ্ট হয়ে যাবে। মাথা এলিয়ে দিলাম গাড়ির সিটে। চোখটা বুঁজে আসছে। জোর করে খুলতে ইচ্ছে হলো না। ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলাম গভীর তন্দ্রায়।
হটাৎ কারো ডাকে চোখ টেনে খুললাম। চোখের পাতা বড্ড ভারী লাগছে। কিন্তু আশেপাশে চেয়ে সব ঘুম উবে গেলো। মনের সমস্ত কালো মেঘ কেটে গিয়ে উদয় হলো আনন্দের সূর্য। ফুটে ওঠলো গাল ভরা হাসি। যে হাসিটা মায়ের খুব পছন্দ ছিলো।
#চলবে