#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১০

‘তুমি কি বাথরুম যেতে চাও?’

আমি বিহ্বলিত হয়ে গেলাম ছেলেটির কথা শুনে। আমার চাহনিতে ছেলেটার এটাই মনে হলো? আমি কি ঠিকঠাক চাইতেও পারিনা? আমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না। ওনার কথা শুনে সবাই মুড়ি খাওয়া বাদ দিয়ে আমার দিকে কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকালো। আমি একটু গুটিয়ে গেলাম। কি একটা পরিস্থিতি।

বৃষ্টি আর সৃষ্টি আমায় বললো, ‘তুমি লজ্জা কেনো পাচ্ছো আড়াল? তুমি নিচে যাও। তোমার রুমের সাথেই তো এটাচড বাথরুম আছে। তুমি কি একা যেতে ভয় পাচ্ছো। তাহলে টুবলু টাকে সাথে নিয়ে যাও। এই টুবলু যাতো তোর মিষ্টিপু কে একটু নিচে নিয়ে যা।’

ওদের সাথে শান্ত আর ফুয়াদ ও বলে ওঠলো, হ্যা হ্যা! তুমি কিন্তু একদম লজ্জা পাবে না আড়াল। আমাদের সাথে সবসময় সবকিছু শেয়ার করবে। আমরা কিন্তু লজ্জা টজ্জা একদম পাই না।’
‘ঠিকি বলেছিস রে! তুই তো একটা গাধা। গাধার আবার লজ্জা কিসের।’
‘আর তোরা তো একেক টা বদের হাড্ডি।’

আমি পড়লাম মহাজ্বালায়। ওই দানবটা কি আর কোন টপিক পেলো না? এটাই বুঝতে হলো? এখন এমনভাবে বসে আছে যেন কোন নিরিহ ছোট্ট বাবু। এই দানবটার দিকে তাকালেও রাগে গা রি রি করছে। আমি নজর ঘুরিয়ে ওদের বললাম, ‘তোমরা ভুল বুঝছো। আমি তেমন কিছু তো বলিনি। আমি ঠিক আছি। তোমরা থাকো আমি রুমে যাচ্ছি। আমার ভালো লাগছে না।’

আমি উঠে চলে এলাম ওখান থেকে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হটাৎ টুবলুর কথা শুনে কৌতূহলবশত আমি একটু দাড়ালাম। ওই দানব টাকে বলছে, ‘শুদ্ধ ভাইয়া, আমি যে জন্য বাথরুমে একা যেতে ভয় পাই মিষ্টিপু ও কি সেইজন্যই একা যেতে ভয় পাচ্ছে? আমি তো বাথরুমে গেলে একা একা চেন লাগাতেই পারি না। শুধু আটকে যায়। তুমি তো আমাকে হেল্প করো। তাহলে মিষ্টিপুকেও হেল্প করো না ভাইয়া। যাও।’

আমার মাথাটা নাগরদোলার মতো ঘুরতে লাগলো। কোন থামাথামি নেই। লজ্জায় চোখ মুখ খিঁচে কোনমতে দৌড়ে নিচে নেমে এলাম। মনে হচ্ছে সিঁড়িগুলোও যেনো আমাকে দেখে হাসছে। ওই দানবটাকে তো আমি দেখে নিবো। কোন চোখের চাওনির অর্থ কি তা বুঝিয়ে ছাড়বো।

সিঁড়ি পার হয়ে নিচে নামতেই মুখোমুখি হলাম স্যারের সাথে। স্যারকে দেখে কিছুক্ষণ আগের লজ্জা, অস্বস্তি সব ভুলে গেলাম। মনে রইলো শুধু হাজারো প্রশ্ন। যার উত্তর শুধু এই লোকটার কাছেই আছে। স্যার আমাকে দেখে ইউ টার্ন মেরে রাস্তা বদলে অন্যদিকে যেতে লাগলো। আমি হটাৎ বলে ওঠলাম,

‘প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার ভয়ে পালাচ্ছেন। স্যার?’

আমার সহজ গলার কঠিন উক্তি। কন্ঠে কিছুটা উপহাস। স্যার আমার মুখে এমন বাক্য শুনে কিছুটা থেমে আবার যেতে লাগলে আমি আবারও প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম,
‘যেখানে আমার সবথথেকে আপন মানুষগুলো ভরসাযোগ্য নয়। সেখানে আপনাকে বিশ্বাস করি কি করে স্যার?’

স্যার এবার ঘুরে দাড়িয়ে আমার সম্মুখীন হলো।

‘আপনি সব জানেন। চাচির বলা না বলা সব কিছুই আপনি জানেন। তাই তখন চাচিকে আর কিছু বলতে দেননি। চাচি আর বাবা এখন কোথায়?’
‘যেখানে তাদের থাকা উচিত।’
‘আমার ধৈর্যের পরিক্ষা নেবেন না স্যার। আমার কারো সাথেই সখ্যতা গড়ে নেওয়ার যোগ্যতা নেই। তাই ধৈর্যের সাথেও আমার কোন সখ্যতা নেই। আমি না চাইলে আপনি আমায় জোর করে এখানে রাখতে পারবেন না। এখানে আমি আছি শুধুমাত্র আমার প্রশ্নের উত্তর এর খোঁজে। যা শুধুমাত্র আপনার কাছেই আছে। সেই উত্তর গুলোই যদি আমি আপনার থেকে না পাই তবে এখানে আমি থাকবো কেনো?’

স্যার এর মুখভঙ্গিতে চুল পরিমাণ তারতম্য ঘটলো না। একিভাবে দাড়িয়ে আছেন। ক্ষনিক সময় পেরোতেই স্যার বললেন আমায় আমার রুমে যেতে। আমি গেলাম না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাকে একইভঙ্গিতে দাড়িয়ে থাকতে দেখে এবার মুখ খুললেন,

‘আপনার বাবা হসপিটালে আছেন। আর আপনার চাচি জেলে। এটুকু আপাতত জেনে রাখুন। আর কিছু জানার কোন প্রয়োজন আপনার নেই। তাদের কর্মের যোগ্য শাস্তি তারা পাবে।’

স্যারের কথা শুনে এবার আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। আমি রাগে দুঃখে চিৎকার করে বলে উঠলাম,

‘আমি কেন শুধু এটুকু জানবো? আমার সবটা জানার সর্বাঙ্গীণ অধিকার আছে। প্রতারণার শিকার হয়েছে আমার মা আর আমি। নৃ’শং’স ভাবে হ’ত্যা হয়েছে আমার মা, এতিম হয়েছি আমি। তাতে আপনার তো কোন ক্ষতি হয়নি। তাই আপনার কিছু যায় আসে না। তাহলে আপনি কি করে বুঝবেন আমার যন্ত্রনা। আপনি কে হন আমাকে এসব বলার? আপনি প্রথম থেকে আমাকে সাহায্য করে যাচ্ছেন আমি না চাইতেও। তার মানে এই নয় আপনি সবকিছু থেকে আমাকে বঞ্চিত করবেন। নাকি আপনিও তাদের দলে অন্তর্ভুক্ত। নাম লিখিয়েছেন বুঝি তাদের দলে। এবার কি তবে আমার খু’ন আপনার হাতে? নাকি মায়ের খু’নে’ও আপনার হাত ছিলো? তাই আমাকে সত্য জানতে এগোতে দিচ্ছেন ন….

কথা শেষ করার আগেই আমার গালে সপাটে ভারী চড়ের আঘাত হানলো কেউ। আমার মাথা ঝিমিয়ে উঠেছে পুরুষালি হাতের থাবায়। চোখের কোনা বেয়ে গড়িয়ে গেলো এক ফোঁটা দুঃখ ধারা। তবে সর্বাধিক ঝটকা খেলাম সামনে চোখ তুলে চেয়ে। আমার সামনে স্যার নয় দাড়িয়ে আছে শুদ্ধ ভাইয়া। রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার চোখে। স্যার শুদ্ধ ভাইয়ার নাম নিয়ে ধমকে ওঠলেন। তাতে শুদ্ধ ভাইয়া তিল পরিমাণ নড়লেন না। হটাৎ বজ্রের মতো গর্জে উঠে বলে ওঠলেন,

যার ওপর তোমার মায়ের খুনের অভিযোগ করছো সেই মানুষটা তোমার মায়ের ভাই। তার সবথেকে ভরসার জায়গা। যাকে তোমার মা সবথেকে বেশি ভরসা করতো তাকেই তোমার মায়ের খুনি বানিয়ে দিচ্ছো। বাহ! তোমাকে তোমার প্রশ্নের জবাব না দেওয়ার কারন তোমার মায়ের শেষ ইচ্ছা। কারন তোমার মা চান নি তুমি এসবের কোন কিছু জানো। আর এসবে নিজেকে জরিয়ে ফেলো।

বাড়ির সবাই এখন আমাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে। আমি হতবাক হয়ে দাড়িয়ে আছি। শুদ্ধ ভাইয়াকে থামিয়ে দিয়েছেন স্যার। আর কিছু বলতে দিলেন না। আমি স্যারের চোখে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। এই মানুষটা আমার মামা হয়। এই বাড়ির প্রতিটি মানুষ আমার আপনজন। তাহলে এতোদিন কেনো গোপন ছিলো সব?

শুদ্ধ ভাইয়া আমার হাত ধরে কোথাও নিয়ে গেলেন। একটা বন্ধ রুমের তালা খুলে আমায় নিয়ে ঢুকলেন। রুমে ঢুকতেই সবার আগে নজরে পড়লো দেয়ালে ঝুলানো একটি ফ্রেমে হাস্যজ্বল আটটি মুখ। চেয়ারে দুজন অর্ধবয়স্ক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা বসা। তাদের পিছনে দাড়ানো ছয়টি স্পষ্ট চেহারা। যার মধ্যে আমার মা ও একজন।

‘চেয়ারে বসা দুজন তোমার মায়ের পিতামাতা। তারা এখন এই দুনিয়ায় নেই। আর পিছনে দাড়ানো সবাইকে নিশ্চয়ই চিনতে পারছো?

ফুপি কোনো এক ছেলেকে ভালোবাসে এমন কথা জানার পর দাদা ফুপিকে জবরদস্তি বিয়ে দিতে চাইলে ফুপি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছিলো আজ থেকে উনিশ বছর আগে।

বাবা যে তোমার কলেজের টিচার তা ফুপি জেনে শুনেই তোমাকে সেই কলেজে ভর্তি করিয়েছিলো। ফুপি সবসময় আমাদের সব খবর রেখে গেছে। আমরাই ব্যার্থ হয়েছি ফুপির খোঁ’জ নিতে। তোমার বাবার অ’বৈ’ধ কার্য সম্পর্কে অনেক আগেই ফুপির সন্দেহ হয়েছিলো। ধীরে ধীরে খোঁজ নিয়ে সেই স’ন্দে’হ’ই সঠিক হয়ে সামনে আসে ফুপির। তখন তোমার বাবার বি’রু’দ্ধে সব প্রমাণ হাতে রেখে তারপর তোমার বাবাকে অ’বৈ’ধ কাজ থেকে দুরে সরে আসতে বলে কিন্তু তোমার বাবা তাতে নারাজ ছিলো। সে উল্টো ফুপিকে খু’নে’র হুমকি দেয়। ফুপি তার আসন্ন বিপদ সম্পর্কে খানিকটা আঁচ করতে পারছিলো। ফুপির মনে হয়েছিলে তার কিছু হয়ে গেলে তুমি একা হয়ে যাবে। তোমার বাবার কালো ছায়া তোমায় অন্ধকারে ঠেলে দিবে। তাই তোমার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ফুপির খুনের ঠিক আগের দিন বাবার সাথে দেখা করতে কলেজে এসেছিলো ফুপি। সেদিন আমিও ছিলাম বাবার সাথে। ফুপিকে দেখে আমরা অনেক খুশি হই। অনেক কথা হয় আমাদের মধ্যে। ফুপির সব কথা ছিলো শুধু তোমায় নিয়ে। তুমি ছোট থাকতে কেমন ছিলে, কি কি দুষ্টুমি করতে, কিভাবে বড় হয়েছো সবটা খুব আনন্দের সাথে বলছিলে ফুপি। তেমায় নিয়ে ফুপি কি কি স্বপ্ন দেখে তাও বলেছিলো। তারপর এক পর্যায়ে তোমার বাবার সম্পর্কে সবটা খুলে বলে। ফুপির মুখে এসব কিছু শুনে রাগে রক্তের বেগ বেড়ে যাচ্ছিলো আমার আর বাবার। আমরা কিছু করতে চাইলে ফুপি বলেছিলো ফুপির কাছে নাকি তোমার বাবার বি’রু’দ্ধে সমস্ত প্রমাণ আছে। প্রমানগুলো আমাদের হাতে দিয়ে বলেছিলো পরের দিন তোমায় নিয়ে চলে আসবে ওই জাহান্নাম ছেড়ে। কিন্তু তার আগেই ওরা সবকিছু শেষ করে দিলো। ফুপিকে হ’ত্যা করে ফেললো। বাঁ’চ’তে দিলো না ওরা ফুপিকে।

খু’নে’র এক ঘন্টা আগেও ফুপির সাথে আমার কথা হয়েছিলো। ফুপি বারবার বলছিলো তোমাকে এই অ’ন্ধ’কার গহ’ব্ব’রের কা’লো সত্য কোনদিন জানতে দিবে না। ফুপি চায়নি তুমি কখনো রাগের বসে হলেও কোন অ’ন্যা’য়ের ভাগিদার হও।

ফুপির খু’নে’র পর তোমার চাচি সবার কাছে এমন রটনা রটিয়েছিল যে বাড়িতে নাকি ডা’কা’ত পড়েছিলো। তারা সবকিছু লু’ট’পা’ট করে নিয়ে যাওয়ার সময় ফুপি আর তোমার বাবা বাধা দিলে তাদের নাকি হ’ত্যা’র চেষ্টা করা হয়। তোমার চাচা চাচি নাকি তখন বাড়িতে ছিলো না। আর তুমি ও তোমার চাচাতো বোনেরাও যে যার কলেজে ছিলে। তার বলা মি’থ্যে কাহিনী সবাই বিশ্বাস করে নেয়। এমনকি পুলিশের তদ’ন্তেও এমনটাই বেরিয়ে আসে। পুলিশও অন্যকিছুর হদিস করতে পারে নি। আমাদের কাছে ফুপির দেওয়া তোমার বাবার বি’রু’দ্ধে সব প্রমাণ থাকলেও ফুপির খু’নে’র সম্পর্কে কিছু জানতাম না। কোন প্রমাণ তো দূরে থাক। কিছুই বুঝে ওঠতে পারছিলাম না আমরা কি করবো। তখন আমি আর বাবা টুসুর সাথে যোগাযোগ করি। ওকে ফুপি আমাদের সম্পর্কে সবটা বলেছিলো। ওর ও আসার কথা ছিলো তোমাদের সাথে আমাদের বাড়িতে। তোমাদের বাড়ির পাশে বাসা ভাড়া নিয়ে তোমার চাচা চাচির গতিবিধির ওপর নজর রাখতে শুরু করি আমরা। টুসু রোজ ও বাড়ির খবর দিয়ে যেতো। হটাৎ একদিন…

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here