আমি যেদিন প্রথম যৌন উত্পীড়ন এর শিকার হই, তখন আমার বয়স সবে নয় বছর। কোন এক অলৌকিক শক্তির কারনে হয়তো ধর্ষণ হতে হতে বেচে গিয়েছিলাম । যেদিন তোমার বোনের স্বামী মধ্যরাতে মাতাল অবস্থায় আমার ছোট্ট শরীরের প্রতিটা ভাজে ভাজে মিশিয়ে দিয়েছিলো তার কালো স্পর্শের দাগ। সেদিন আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম মা। বিশ্বাস করো! খুব ভয় পেয়েছিলাম! নিজেকে দোষী মনে হচ্ছিলো খুব। ভাবছিলাম আমি যদি এখন কোন শব্দ করি তাহলে খালামনি জেগে যাবে। আর আমায় খুব খারাপ মেয়ে বলবে। বাবা-মা শুনতে পেলে আমায় কখনো ভালোবাসবে না। সবাই ঘৃণা করবে। কেউ খেলতেও আসবে না আমার সাথে। বলবে, ‘আড়াল একটা পচা মেয়ে।’ সবাই আমায় খুব ঘৃণা করবে।

এসব ভেবে একদম মরা পাতার মতো নেতিয়ে ছিলাম বিছানার সাথে। যেন আমি সত্যিই ঘুমিয়ে আছি। এ ঘুম ভাঙার নয়। এ যেন শত জনমের ঘুম। তবে আমার কতটা ঘৃণা হচ্ছিল তার পরিমাপযোগ্য কোন যন্ত্র বোধ হয় এখনো এই দুনিয়ায় আাবির্ভাব হয় নি। নয়তো বলে দিতে পারতাম। আমার ঘৃণার পরিমাণ ঠিক কতটা।

তবে সবচেয়ে আশ্চর্য কথা কি জানো? সেদিন তোমার বোন খুব বেশি দুরে ছিলো না। একি বিছানার ওপাশটাতেই তোমার বোন ও শুয়েছিলো। তবে টের পায়নি। পাবে কি করে? আমি তো কোন টু শব্দও করি নি। তোমার আদরের সেই বোন জামাই ও জানে আমি সেদিন ঘুমিয়েছিলাম। আমি কিছু টেরই পাই নি। সেই ভাবনা থেকে কি সুন্দর মহাপুরুষ হয়ে দিব্বি ঘুরে বেড়ায়। যেন তার থেকে মহাপ্রাণ এই পৃথিবীতে আর নেই। আমার মাথায় হাত রেখে করুনা দেখাতে আসে।

ওই লোকটা প্রতিটা রাতে শান্তির ঘুম ঘুমায় সেই একি বিছানায়। শুধু ঘুমাতে পারি না আমি। খুব কষ্ট হয় মা। খুব কষ্ট হয়। কেন আমি সেদিন চুপ করে রইলাম মা! কেন ঘুমিয়ে থাকার নাটক করলাম!

সেদিন আমি চুপ না থাকলে সেই মুহুর্তে কি হতো জানি না। তবে এটুকু জানি, সেদিন চুপ না থাকলে প্রতিটা রাত নিজেকে দোষারোপ করে কাটাতে হতো না। তবে বিশ্বাস করো মা, আমি এই দুর্ঘটনা দুদিন পরেই ভুলে গিয়েছিলাম। সেই বয়সটাতে আমার মনে খুব একটা দাগ কাটতে পারেনি সেই কালো রাত। নয় বছর বয়সি এক শিশুর মনে অতোটা আত্মসম্মান তখনো জন্ম নেয়ার কথা নয়। তাই না মা?

সবটা তো ভুলতেই বসেছিলাম। সেই বিষাক্ত অনুভূতি গুলো ভুলে দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন বড় হতে লাগলাম তখন আমার বুদ্ধি ও আত্মসম্মান এর পরিধি ক্রমশ বাড়তে লাগলো। তার সাথে অঙ্কুরিত হতে লাগলো অনুতাপ এর বীজ। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার সাথে কি ঘটে গেছে। আমার সাথে যা হয়েছিলো তা না পারছিলাম কাওকে বলতে। না পারছিলাম সহ্য করতে। সবথেকে বেশি অনুভব করলাম সেদিন। যেদিন আমাদের গ্রামের রিনা দিদি টা হটাৎ আত্মহত্যা করলো। তারপর জানতে পারলাম তাকে নাকি কেউ ধর্ষণ করেছিল। আমার তখন মনে হচ্ছিল আমারও রিনা দিদির মতো মরে যাওয়া উচিত। তারপর আমিও অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি রিনা দিদির মতো আত্মহননের পথ বেছে নিতে। তোমার মেয়েটা বড্ড ভীতু মা! বড্ড ভীতু!

তুমি সেদিন এই পৃথিবীতে ছিলে। আজ নেই। সেদিন চাইলেই তোমায় সবটা বলতে পারতাম। আজ চেয়েও পারছিনা। তখন আমি নয় বছর বয়সের এক ছোট্ট অসহায় প্রান ছিলাম মা। আজ কিন্তু আর তা নই মা। আজ আমি আগের মতো ভয় পাই না। আজ আমি অষ্টাদশী এক নারী। তবে একলা ঘুমাতে ভয় হয় মা। বড্ড ভয় হয়। মনে হয় এই বুঝি কোন কালো হাত দানবীয় থাবা বসাতে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।

তুমি কেনো চলে গেলে মা। কেনো চলে গেলে। আমি রোজ একটু একটু করে সাহস যোগাচ্ছিলাম। তোমায় বলবো বলে। যে তোমার মেয়ে কতটা কষ্ট পাচ্ছে। কি হয়েছিল তোমার আদরের রাজকন্যার সাথে। তুমি শুনলে না মা। তুমি শুনলে না। তার আগেই চলে গেলে আমায় একা রেখে।

হটাৎ কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে আমি থেমে গেলাম। চোখ মুছে উঠে দাড়িয়ে দুচোখ ছাপানো অসহায়ত্ব ঝেরে ফেললাম। মায়ের কবরটা মায়া চোখে এক ঝলক দেখে বেড়িয়ে এলাম সেখান থেকে। বেড়িয়ে আসার আগে মাকে বলে এসেছি আমি আবার আসবো। আমার না বলা কথাগুলো মাকে বলতে। আরও যে অনেক কথা বাকি আছে। এখন আর পিছন ফিরে চাইবো না। এখন সামনে এগিয়ে যাবার সময়। দুনিয়ার তালে তাল মিলিয়ে আমায় এগিয়ে যেতে হবে। আমার মায়ের স্বপ্ন পুরন করতে হবে যে। আর মায়ের দেওয়া শেষ কথাটা রাখতে আমায় ফিরতে হবে ওই অসুস্থ নীড়ে। বাবা যে আমার দায়িত্ব।

____

বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই সপাটে এক চড় পড়লো আমার গালে। আমি চেয়ে দেখি আমার চাচি অগ্নিসংযোগ এর প্রস্তুতি নিয়ে দাড়িয়ে আছে অগ্নিমূর্তি ধারন করে। আমার স্বপক্ষে সুস্পষ্ট সাফাই হবে এখন বারুদ সম। তাই অগ্নিকান্ড না ঘটাতে চাইলে আমায় চুপ থাকতে হবে। কোন সাফাই গাওয়া চলবে না।

আমি কিছু বললাম না। চুপ করে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার মৌনতা লক্ষ করে আমার চাচি আরও একধাপ এগিয়ে গেলো। আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে উঠোনে ছুড়ে ফেলে দিলো। আমি হুমরি খেয়ে পরলাম পাশে থাকা শুকনো লাকড়ির ওপর। চাচি তাতেও খান্ত হননি। চেচামেচি করে বাড়ির সবাইকে হাঁক ছেড়ে ডেকে উঠলেন। সাথে আছে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ। যার যার ঘর থেকে সবাই বেড়িয়ে এলো। এসে আমায় উঠোনে পড়ে থাকতে দেখে কেউই অবাক হলো না। যেন খুব স্বাভাবিক ঘটনা। যেন এমনটা হওয়ারই ছিলো।

আমি ধীরে ধীরে উঠে দাড়ালাম। মুখের ভেতর কেমন নোনতা স্বাদ লাগছে। বোধহয় দাঁতে লেগে মুখের ভেতর কোথাও একটা কেটে গেছে। এক দলা থুতু ফেললাম আমার ডানদিকে বরাবর। লাল টকটকে রক্ত চোখে পড়লো শুধু। তবে থুতু ফেলার সময় আমি চাচির চোখে চোখ রেখে এক রাশ ঘৃণা মিশ্রিত দৃষ্টি দিয়েছিলাম। যেন তাকে উদ্দেশ্য করেই ফেলেছি। এ যেন নিরব প্রতিবাদ। তাতে চাচি কিছুটা ভড়কে গেছিলো বটে।

ঠোঁটের কোনায় ও জ্বালা করছে। এখানেও কাটলো বুঝি। আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই উঠে দাঁড়ালাম। চাচা গম্ভীর চেহারা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন। হয়তো মনে মনে মায়া হচ্ছে। তবে তিনি যে তা প্রকাশ করবেন না তা আমি জানি। চাচি আমায় চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে গেলো লাকড়ি ঘরের ভেতর। বাইরে থেকে আটকে দিলো দরজা। যাতে আমি পালাতে না পারি। কিন্তু চাচি তো জানে না আমি পালাবো না। পালাতে হলে কি আর ফিরে আসতাম।

বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে চাচির চিৎকার চেচামেচি। বোধ হয় পাড়ার লোকজন এসেছে। তাদেরই হয়তো কেচ্ছা শোনাচ্ছে। বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে বাইরে রাত কাটিয়ে আসা এক নষ্টা মেয়ের কেচ্ছা। আচ্ছা এখন যদি আমার মা বেঁচে থাকতো তাহলে কি হতো! যদি বাবা সুস্থ থাকতো তাহলে বা কি হতো! বাবা! এই মানুষটার জন্যই তো ফিরে আসা। মা তো আমায় বাবার দায়িত্ব দিয়ে গেছে। নয়তো কবেই এই বিষাক্ত নীড় ছেড়ে চলে যেতাম কোন সুস্থ আশ্রয়ের খোঁজে।

লাকড়ি ঘরটা হলো অনেক আগের পুরোনো টিনের একটা একচালা ঘর। এ ঘরটায় একসময় চাচা-চাচিরা থাকতো। দু বছর আগে এ ঘর ছেড়ে আমার বাবার নিজের টাকায় দেওয়া এক তলা বিল্ডিং এর দুটো রুমে উঠেছিলো। আজ আমার জায়গা হয়েছে এই ঘরটাতে। ঘরের কোনা থেকে একটা ব্যাগ টেনে বের করলাম। কাল রাতে পালানোর সময় এখানে রেখে গেছিলাম। আমি ফিরে আসার পর যে এখানেই আমার জায়গা হবে তা আমি জানতাম। তাই আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম।

ব্যাগ থেকে সালোয়ার কামিজ বের করলাম। এতো ভারি শাড়িটা আর পড়ে থাকতে পারছিনা। তবে শাড়িটা খোলার আগে একবার আয়নায় নিজেকে দেখতে ইচ্ছা হলো। লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ি, কপালে লাল টিপ, ঠোটে লাল লিপস্টিক এর রঙের প্রলেপ তার সাথে তরতাজা রক্তের দাগ। অদ্ভুত সুন্দর লাগবে হয়তো। অথবা কোন রক্ত পিপাসু। যাকে দেখলে কারো মায়া হয় না। কিন্তু দেখবো কিভাবে আয়না তো নেই।

দরজার ভেতর থেকে খিল দিয়ে আমি শাড়িটা বদলে সুতি কাপড়ের সালোয়ার কামিজ পরে নিলাম। শাড়িটা ভাজ করে রেখে দিয়ে খিলটা আবার খুলে রাখলাম। আমি জানি, কিছুক্ষণের মধ্যে কেউ একজন আসবে এ ঘরে। আমার ধারনা যদি ভুল না হয় তবে দশ পনেরো মিনিটের মধ্যেই জোহরের আযান দেবে। সবাই ব্যাস্ত হয়ে যাবে নামাজে। তখন আর কারো খেয়াল থাকবে না এই ঘরের দিকে। বাইরে এখনো ক্ষীন আওয়াজে আমার গুনকীর্তন শোনা যাচ্ছে। কি সুন্দর তেল মসলা লাগিয়ে গরম তেলে ভাজা ভাজা করা হচ্ছে আমার চরিত্র।

বাইরে আমার গুনকীর্তন এর আওয়াজ হটাৎ থেমে গেছে। এখন আর কিছু শুনতে পাচ্ছি না। নিরবতায় ছেয়ে গেলো চারদিক। সবাই হয়তো নামাজের জন্য গেছে। ভাবতে না ভাবতেই দরজার ছিটকিনি খোলার আওয়াজ হলো। আমার মুখে ফুটে উঠলো অদ্ভুত এক হাসি। এ হাসি সে দেখতে পাবে না। একান্তই ব্যাক্তিগত এ হাসি।

#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here