আমি পদ্মজা – ২৯
_____________
নূরজাহান শক্ত করে পদ্মজার হাত ধরেন। ক্ষীণ স্বরে বললেন,’ঘরে আহো,পরে কইতাছি।’
কান্নার শব্দ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। নূরজাহান পদ্মজাকে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকেন। আমির চেয়ার টেনে বসার জন্য প্রস্তুত হতেই নূরজাহান হইহই করে উঠলেন,’তুই বইতাছস ক্যান?’
আমির হকচকিয়ে গিয়ে বলল,’মানে?’
‘বউয়ের ধারে আর থাহন যাইবো না। আইজ কাইলরাত্রি।’
‘মুসলমানদের কালরাত্রি পালন করতে নেই। গুনাহগার হবেন।’ বলল পদ্মজা। তার মাথা নত। প্রথম দিন এসেই কথা বলা ঠিক হলো নাকি ভাবছে।
মুখের উপর কথা শুনে নূরজাহান কড়া চোখে তাকান। পদ্মজা দেখার পূর্বে সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে চোখের দৃষ্টি শীতল রূপে নিয়ে আসেন। তিনি পদ্মজাকে প্রশ্ন করলেন, ‘গেরামের রেওয়াজ ফালাইয়া দেওন যাইব?’
নূরজাহানের কণ্ঠ স্বাভাবিক। পদ্মজা নির্ভয়ে চোখ তুলে তাকাল। বলল,’যা পাপ তা করতে নেই দাদু। জেনেশুনে ভুল রেওয়াজ সারাজীবন টেনে নেওয়া উচিত না। আমার কথা শুনে রাগ করবেন না।’
‘তুমি কী আইজ জামাইয়ের লগে থাকতে চাইতাছো?’ নূরজাহানের কণ্ঠ গম্ভীর। এমন প্রশ্নে পদ্মজা ভয় পেয়ে যায় এবং লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠে। আমতা আমতা করে বলল,’ন…ন…না! তে…তেমন কিছু না।’
পদ্মজা আড়চোখে আমিরকে দেখে আবার চোখের দৃষ্টি নত করে ফেলল। আমির নূরজাহানকে জড়িয়ে ধরে বলল,’আমি যাচ্ছি বুড়ি।’ এরপর পদ্মজার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে কোমল কণ্ঠে বিদায় জানাল, ‘আল্লাহ হাফেজ পদ্মবতী।’
পদ্মজা নতজানু অবস্থায় মাথা নাড়াল। আমির ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পদ্মজা ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করে নূরজাহানকে দেখে। ঢোক গিলে বলে,’রাগ করেছেন দাদু?’
নূরজাহান হাসলেন। পদ্মজার এক হাত ধরে বিছানার কাছে নিয়ে যান। বললেন,’আমার বইনে তো ঠিক কথাই কইছে। গুসা করতাম কেরে?’
পদ্মজা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। নূরজাহান বললেন,’তুমি বও। আমি জোসনার মারে ভাত দেওনের কথা কইয়া আইতাছি।’
‘আমি খেয়েছি দাদু। তখন খাওয়ালেন আম্মা।’
‘ব্যাগডা কই? শাড়িডা খুইলা আরেকটা পরো। সিঁদুর রঙেরডা পরবা।’ বলতে বলতে নূরজাহান ব্যাগ থেকে সিঁদুর রঙের শাড়ি বের করলেন। পদ্মজার দিকে এগিয়ে দিলেন। পদ্মজা হাত বাড়িয়ে শাড়ি নিলো। জানতে চাইল,’কোথায় পাল্টাব?’
‘খাড়াও দরজা লাগায়া দেই। ঘরেই পাল্ডাও। আমারে শরমাইয়ো না বইন। তোমার যা আমারও তা।’
পদ্মজা শাড়ি হাতে নিয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে শাড়ি পাল্টানোর মতো উপযুক্ত জায়গা খুঁজতে থাকে। পালঙ্কের পিছনে চোখ পড়ে। পদ্মজা সেদিকে গিয়ে শাড়ি পাল্টে নিল। এরপর নূরজাহানের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,’দাদু,তখন কাঁদছিল কে?’
নূরজাহান বিছানায় বসতে বসতে জবাব দেন,’আমার খলিলের বড় ছেড়ার বউ।’
পদ্মজা দুই কদম এগিয়ে আসে। আগ্রহভরে জানতে চায়,’কেন কাঁদছিল? উনাকে কি ঘরে আটকে রাখা হয়েছে?’
‘বও। আমার ধারে বও।’
পদ্মজা নূরজাহানের সামনে ঝুঁকে বসে। নূরজাহান বললেন,’ তোমার চাচা হউরের(শ্বশুর) বড় ছেড়ার বউ রুম্পার গত বৈশাখো মাথা খারাপ হইয়া যায়। এরে ওরে মারতে আসে। কেউরে চিনে না। নিজের সোয়ামিরেও চিনে না। আলমগীর তো এহন ঢাহাত থাহে। আমির তো গেরামে আইছে অনেকদিন হইলো। আলমগীর শহরে আমিরের কামডা করতাছে। এর লাইগগাই তো আলমগীর বিয়াতে আছিল না। রুম্পা তোমার হউরিরে দা নিয়া মারতে গেছিল।’
‘এজন্য আপনারা ঘরে আটকে রাখেন উনাকে? হুট করে কেন এমন হলেন?’ পদ্মজা আঁতকে উঠে জিজ্ঞাসা করল।
নূরজাহান এদিকওদিক তাকিয়ে কী যেন দেখলেন! এরপর সতর্কতার সাথে ফিসফিসিয়ে বললেন,’বাড়ির পিছে বড় জঙ্গলা আছে। দোষী জায়গা। ভুলেও ওইহানে যাইয়ো না। রুম্পা শনিবার ভরদুপুরে গেছিল। এর পরেরদিন জ্বর উডে। আর এমন পাগল হইয়া যায়। এগুলো তেনাদের কাজ! রাতে নাম লওন নাই। তুমি মাশাল্লাহ চান্দের টুকরা। ভুলেও ওইদিকে যাইয়ো না। ক্ষতি হইব।’
নূরজাহানের কথা শুনে পদ্মজার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে পড়ে। মনে মনে ভাবে, অবিশ্বাস্য! ভয় পেয়ে কারো মাথা খারাপ হয়ে যায়?
পদ্মজা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,’উনাকে ডাক্তার দেখানো হয়েছে?’
‘হ। দেহানো হইছে তো। শহরে দুইবার লইয়া গেছে। কবিরাজ আইলো। কেউই ভালা কইরা দিতে পারে নাই। আইচ্ছা এসব কথা বাদ দেও এহন। এই বাড়িত যহন বউ হইয়া আইছো সবই জানবা। খালি বাইরে কইয়ো না এই খবর। গেরামের কেউ জানে না। রাইত অইছে ঘুমাও।’
নূরজাহান শুতে শুতে বললেন,’হুনো জামাইয়ের কাছে কইলাম যাইবা না।’
‘না,না…যাব না।’
‘বুঝলা বইন,তোমার দাদা হউরে বিয়ার প্রত্তম রাইতে লুকাইয়া আমারে তুইলা নিজের ঘরে লইয়া গেছিল। আদর-সোহাগ কইরা ভোর রাইতে পাডাইয়া দিছিল। আমি ছুডু আছিলাম। তাই ডরে কইলজা শুকায়া গেছিল।’
বলতে বলতে নূরজাহান জোরে হেসে উঠেন। পদ্মজা মৃদু করে হাসে। নূরজাহান ডান দিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়েন। পদ্মজা ধীরে ধীরে এক কোণে কাচুমাচু হয়ে শুয়ে পড়ে। কী অদ্ভুত সব! সাধারণত বিয়ের রাতে নতুন বউরা ঘুমানোর সুযোগ পায় না। জামাইয়ের বাড়ির মানুষেরা সারাক্ষণ ভীড় করে ঘেঁষে থাকে। পদ্মজা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। হারিকেনের আগুন নিভু নিভু করে জ্বলছে। নিভে যাবে যেকোনো মুহূর্তে। কেটে যায় অনেকক্ষণ। ঘুম আসছে না। দেহ অচেনা অনুভূতিতে ছেয়ে যাচ্ছে। আচমকা পদ্মজা ভ্রু কুঁচকে ফেলে। কান খাড়া করে ভাল করে শোনার চেষ্টা করে। আবার কাঁদছে! রুম্পা মিনমিনিয়ে কাঁদছে। পদ্মজা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। সাথে সাথে নূরজাহান পদ্মজার দিকে ফিরেন। জানতে চান,’ডরাইতাছো?’
‘উনি আবার কাঁদছেন।’
‘সারাবেলাই কান্দে। এইসবে কান দিও না। ঘুমাইয়া পড়ো।’
পদ্মজা উসখুস করতে করতে শুয়ে পড়ে। হারিকেন নিভে যায়। নূরজাহান ঘুমে তলিয়ে যান। নাক ডাকছেন তিনি। নাক ডাকার তীব্রতা অনেক। যা পদ্মজাকে বিরক্ত করে তুলে। পদ্মজা ঘুমানোর চেষ্টা করে। হাজার ভাবনার ভীড়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। শেষ রাতে ঘুমের ঘোরে অনুভব করে, হাঁটুতে কারো হাতের ছোঁয়া। পদ্মজা চোখ খুলে। মুখের সামনে কেউ ঝুঁকে রয়েছে। পদ্মজা ধড়ফড়িয়ে উঠে চিৎকার করে উঠল,’কে?’
সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ অবয়বটি ছুটে বেরিয়ে যায়। পদ্মজা কাঁপতে থাকল। শরীর বেয়ে ঘাম ছুটছে। ভয়ে ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। সে নূরজাহানকে ভয়ার্ত স্বরে ডাকে,’দাদু…দাদু।’
নূরজাহান একটু নড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। পদ্মজা আর ডাকল না। সে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। তার চোখের দৃষ্টি দরজার বাইরে। মস্তিষ্ক ভাবছে, দরজা তো লাগানো ছিল। বাইরে থেকে কেউ কীভাবে ঢুকলো? নাকি এর মাঝে দাদু টয়লেটে গিয়েছিলেন? পদ্মজার বুক হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করছে। সে জিহ্বা দিয়ে শুকনা ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। একটু ভয় ভয় করছে। কে এসেছিল! এভাবে গায়ে হাত দিচ্ছিলো কেন? পদ্মজা চোখ খিঁচে ছিঃ বলে আগন্তুকের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে। বাকি রাতটুকু আর ঘুম হলো না তার। ভয়টা কমেছে। এই জায়গায় পূর্ণা থাকলে হয়তো পুরো বাড়ি চেঁচিয়ে মাথায় তুলে ফেলতো। পদ্মজা মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে,এরকম ঘটনা পূর্ণার জীবনে যেন না আসে। একদম গুড়িয়ে যাবে। উঠে দাঁড়াতে পারবে না। পূর্ণার কথা মনে পড়তেই পদ্মজার বুকটা হু হু করে উঠল। কান্না পায়। অন্যদিন পাশে পূর্ণা থাকে। আজ নেই!
ফজরের আযান পড়তেই নূরজাহান চোখ খুলেন। বিছানা থেকে নেমে দেখেন,পদ্মজা জায়নামাজে দাঁড়াল মাত্র। তিনি প্রশ্ন করলেন,’ওযু করলা কই?’
‘জি, কলপাড়ে।’
‘চিনছো কেমনে?’
পদ্মজা হাসলো। বলল,’খুঁজে বের করেছি।’
নূরজাহান চোখমুখ শক্ত করে বলেন,’নতুন বউ রাইতের বেলা একলা ঘুরাঘুরি কইরা কল খোঁজার কী দরকার আছিল? আমারে ডাকতে পারতা।’
পদ্মজার মাথা নত করে অপরাধী স্বরে বলল,’ক্ষমা করবেন দাদু।’
‘কি কাল আইলো। আইচ্ছা,পড়ো এহন। নামায পড়ো।’
নূরজাহান অসন্তুষ্ট ভাব নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
পদ্মজার দুই চোখ ছলছল করে উঠে। যখন টের পেল এখুনি সে কেঁদে দিবে,দ্রুত ডান হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছে। এরপর নামাযে মন দিল।
___________
পদ্মজাকে কাতান শাড়ি পরানো হয়েছে। বউভাতের অনুষ্ঠান চলছে। সে এক বিশাল আয়োজন। বিয়ের চেয়েও বড় করে বউভাতের অনুষ্ঠান হচ্ছে। অলন্দপুরের বাইরে থেকেও মানুষ আসছে পদ্মজাকে দেখার জন্য। আটপাড়ার প্রতিটি ঘরের মানুষ তো আছেই। পদ্মজার চারপাশে মানুষের গিজগিজ। রাতে ঘুম হয়নি। পরনে ভারী শাড়ি,গহনা। এতো মানুষ চারিদিকে। সব মিলিয়ে পদ্মজার নাজেহাল অবস্থা। মাথা নত করে বসে আছে সে।
‘আপা।’
পূর্ণার কণ্ঠ শুনে মুহূর্তে পদ্মজার ক্লান্তি উড়ে যায়। চকিতে চোখ তুলে তাকায়। পূর্ণা,প্রেমা,প্রান্ত ঝাঁপিয়ে পড়ে পদ্মজার উপর। পূর্ণা আওয়াজ করে কেঁদে উঠে বলল,’রাতে আমার ঘুম হয়নি আপা।’
পদ্মজার গলা জ্বলছে। প্রেমা,পূর্ণা,প্রান্তকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে। চাপা কণ্ঠে বলে,’আমারো ঘুম হয়নি বোন।’
‘আপা চল,বাড়ি চল।’
‘কাইল যাইব। আইজ না। এহন পদ্মজা আমরার বাড়ির ছেড়ি।’ লাবণ্য বলল। সে সবেমাত্রই এই ঘরে ঢুকল। পদ্মজার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। পূর্ণা রাগ নিয়ে বলে,’আমার বোন আমি নিয়ে যাবো।’
‘আমাদের আপা আমরা নিয়ে যেতে এসেছি।’ বলল প্রান্ত।
রানি প্রান্তর কান টেনে ধরে বলল,’পেকে গেছিস তাই না?’
‘উ! ছাড়ো রানী আপা। ব্যথা পাচ্ছি।’
‘ওরেম্মা! তুই শুদ্ধ ভাষাও শিইখা লাইছস?’ রানি অবাক হয়ে জানতে চাইল। প্রান্ত অভিজ্ঞদের মতো হেসে বলল,’ইয়েস।’
যারা যারা প্রান্তকে চিনে সবার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। প্রান্ত একটি ইংরেজি শব্দ বলেনি যেন মাত্রই এখানে বজ্রপাত ঘটাল। রানি চোখেমুখে বিস্ময়ভাব রেখে বলল,’এইটা মুন্না না অন্য কেউ।’
‘আমি মুন্না না আমি প্রান্ত। প্রান্ত মোড়ল।’ প্রান্তের বলার ভঙ্গী দেখে সবাই হেসে উঠল। পদ্মজা হাসতে হাসতে রানিকে বলল,’প্রান্ত অনেকগুলো ইংরেজি শব্দ শিখেছে।’
‘বউ মানুষ কেমনে দাঁত বাইর কইরা হাসতাছে দেখছো? বেহায়া বউছেড়া।’ কথাটি দরজার পাশ থেকে কেউ বলল। অন্য কেউ শুনতে না পেলেও পদ্মজা শুনতে পেল। সে সেদিকে তাকাল।
অল্প বয়সী দুজন মহিলা এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন পদ্মজাকে চোখ দিয়ে গিলে খাবে। পদ্মজা তাদের উদ্দেশ্যে হাসে। পদ্মজার হাসি দেখে মহিলা দুজন থতমত খেয়ে গেল। দুজন চাওয়াচাওয়ি করে আবার পদ্মজার দিকে তাকাল। পদ্মজা ততক্ষণে চোখ সরিয়ে নিয়েছে।
_____________
অতিথি আপ্যায়ন চলছে ধুমধামে। রমিজ আলী,কামরুল,রজব সবাই উপস্থিত রয়েছে। খাওয়া শেষে তারা আড্ডা শুরু করে।
রমিজ বললেন,’মনজুর ছেড়া,জলিল,ছইদ এরা কী আইছে?’
কামরুল দাঁতের ফাঁক থেকে যত্ন করে গরু মাংস বের করেন। এরপর উত্তর দেন,’না আহে নাই। হেদিন ছইদের বাপে আমার কাছে গেছিল।’
‘কেরে গেছিল?’
‘ছইদরে যাতে মাতব্বরের হাত থাইকা বাঁচায়া দেই।’
‘হেরা এহন কই আছে?’
‘আছে কোনহানে। কয়দিন পর পরই তো উধাও হইয়া যায়। এহনের ছেড়াদের দায়-দায়িত্ব নাই বুঝলা। আমার যহন দশ বছর তহন ক্ষেতে কাজ করতে যাইতাম।’
কামরুলের কথা উপেক্ষা করে রমিজ অন্য প্রসঙ্গ তুললেন,’ক্ষমতা যার বেশি হের সুখ বেশি। আমার মাইয়াডা নির্দোষ আছিল। তবুও কেমনডা করছিল সবাই? আইজ মাতব্বরের ছেড়া বলে কিচ্ছুই হইল না। বদলা আমরা বিয়া খাইতে আইছি।’
রমিজের অসহায় মুখখানা দেখে কামরুল,রজব,মালেক হো হো করে হেসে উঠলেন। রমিজের দৃষ্টি অস্থির। পেট ভরে খাওয়ার লোভে এখানে এসেছেন তিনি। নয়তো এখানে আসার এক ফোঁটাও ইচ্ছে ছিল না।
____________
পদ্মজা কিছুতেই খেতে পারছে না। অথচ ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। চোখের সামনে এতো মানুষ থাকলে কী খাওয়া যায়। পূর্ণা ব্যাপারটা ধরতে পেরে লাবণ্যকে বলল। লাবণ্য সবাইকে বেরিয়ে যেতে বলে। কেউ শুনে না। তাই সে ফরিনা বেগমকে নিয়ে আসে। ফরিনা বেগম সবাইকে বের করে, দরজা ভিজিয়ে দিয়ে যান। ঘরে শুধু রানি,লাবণ্য,পদ্মজা,প্রেমা,পূর্ণা এবং প্রান্ত। পদ্মজা খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। পূর্ণা বলে,’আপা আমি তোমাকে খাইয়ে দেই?’
পদ্মজা অবাক হয়ে তাকাল। ঠোঁটে ফুটে মিষ্টি হাসি। পূর্ণা অনুমতির অপেক্ষা না করে এক লোকমা ভাত বাড়িয়ে দিল। পদ্মজার দুই চোখ ছলছল করে উঠে। পূর্ণা কখনো খাইয়ে দেয়নি। এই প্রথম খাওয়াতে চাইছে। পদ্মজা হা করে। লাবণ্য হেসে বলল,’আমার এমন একটা বইন যদি থাকতো।’
‘আমি তোর বইন না?’ বলল রানি।
লাবণ্য চোখমুখ শক্ত করে বলল,’জীবনে খাইয়ে দিছস? আবার বইন কইতে আইছস যে।’
‘তুই খাইয়ে দিছস? পূর্ণা তো ছুটু। তুইও তো ছুটু।’
‘আগে পদ্মজা খাওয়াইছে। এরপর পূর্ণা।’
‘আইচ্ছা ভাত লইয়া আয়। খাওয়াই দিমু।’ রানি বলল।
‘এহন পেট ভরা।’
‘হ,এহন তো তোর পেট,নাক,মাথা সবই ভরা থাকব।’
দুই বোনের ঝগড়া দেখে পূর্ণা,পদ্মজা হাসে। কী মিষ্টি দুজন। ঝগড়াতেও যেন ভালোবাসা রয়েছে। লাবণ্যের চেয়ে রানি বেশি সুন্দর। তবে,লাবণ্যকে দেখলে বেশি মায়া লাগে। লাবণ্য যে রাগী দেখলেই বোঝা যায়। গতকাল কি রাগটাই না দেখাল! ঘরে ঢুকল আমির। আমিরকে দেখেই পদ্মজা সংকুচিত হয়ে গেল। রানি প্রশ্ন করল,’এইহানে কী দাভাই?’
‘পদ্মজাকে নিয়ে যেতে হবে। ওহ খাচ্ছে। আচ্ছা,খাওয়া শেষ হলে নিয়ে যাবো।’ বলতে বলতে আমির পদ্মজার সামনে বসল। লাবণ্য জিজ্ঞাসা করল,’কই নিয়ে যাবা?’
‘আম্মার ঘরে।’
‘কেন?’
‘আম্মা বলছে নিয়ে যেতে।’
‘আম্মা একটু আগেই দেইখা গেল।’
আমির হকচকিয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল,’ওহ তাই নাকি?’
রানি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমিরকে পরখ করে নিয়ে বলল,’দাভাই,মিথ্যে বলছো কেন?’
‘মি…মিথ্যে আমি? অসম্ভব। আম্মা না দাদু বলছে নিয়ে যেতে। এই তোরা যা তো। তোদের বান্ধবিরা আসছে। যা। হুদাই ঘেনঘেন শুরু করেছিস।’
লাবণ্য কথা বাড়াতে চাচ্ছিল। রানি টেনে নিয়ে যায়। প্রেমা,প্রেমাও বেরিয়ে যায়। তারা বাড়ি থেকে পরিকল্পনা করে এসেছে, একসাথে পুরো হাওলাদার বাড়ি ঘুরে দেখবে। পূর্ণা খাইয়ে দিচ্ছে। পদ্মজা আমিরের উপস্থিতিতে বিব্রত হয়ে উঠেছে। খাবার চিবোতে পারছে না। আমির পদ্মজাকে বলল,’বড় ভাবি বলল,রাতে নাকি ঘুমাওনি।’
‘না। হ্যাঁ। আসলে ঘুম আসেনি।’
‘ঘুমাবে এখন?’
‘না,না। কী বলছেন? বাড়ি ভর্তি মানুষ।’ পদ্মজা দ্রুত বলল। আমিরের চোখের দিকে তাকিয়ে। কথা শেষ হতেই চোখ নামিয়ে নিল।
আমির বলল,’আচ্ছা,খাও। আমি আসছি।’
‘আপনি কী রাতে দাদুর ঘরে এসেছিলেন?’
আমির চলে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছিল। এই কথা শুনে চমকে তাকাল। পদ্মজার দিকে ঝুঁকে জানতে চাইলো,’কেন? কেউ কী এসেছিল তোমার ঘরে?’
আমিরের এমন ছটফটানি দেখে পদ্মজা খুব অবাক হলো। সে অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বলল,’হ্যাঁ, এসেছিল। শেষ রাত্রিরে।’
‘আচ্ছা।’ বলেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল আমির। পদ্মজা পিছনে ডাকল, শুনল না আমির। হুট করে আমিরের পরিবর্তন পদ্মজাকে ভাবাতে লাগল।
চলবে…
®ইলমা বেহরোজ
(ভুলক্রুটি এড়িয়ে যাবেন। তাড়াহুড়োতে লিখেছি।)
_____________
নূরজাহান শক্ত করে পদ্মজার হাত ধরেন। ক্ষীণ স্বরে বললেন,’ঘরে আহো,পরে কইতাছি।’
কান্নার শব্দ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। নূরজাহান পদ্মজাকে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকেন। আমির চেয়ার টেনে বসার জন্য প্রস্তুত হতেই নূরজাহান হইহই করে উঠলেন,’তুই বইতাছস ক্যান?’
আমির হকচকিয়ে গিয়ে বলল,’মানে?’
‘বউয়ের ধারে আর থাহন যাইবো না। আইজ কাইলরাত্রি।’
‘মুসলমানদের কালরাত্রি পালন করতে নেই। গুনাহগার হবেন।’ বলল পদ্মজা। তার মাথা নত। প্রথম দিন এসেই কথা বলা ঠিক হলো নাকি ভাবছে।
মুখের উপর কথা শুনে নূরজাহান কড়া চোখে তাকান। পদ্মজা দেখার পূর্বে সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে চোখের দৃষ্টি শীতল রূপে নিয়ে আসেন। তিনি পদ্মজাকে প্রশ্ন করলেন, ‘গেরামের রেওয়াজ ফালাইয়া দেওন যাইব?’
নূরজাহানের কণ্ঠ স্বাভাবিক। পদ্মজা নির্ভয়ে চোখ তুলে তাকাল। বলল,’যা পাপ তা করতে নেই দাদু। জেনেশুনে ভুল রেওয়াজ সারাজীবন টেনে নেওয়া উচিত না। আমার কথা শুনে রাগ করবেন না।’
‘তুমি কী আইজ জামাইয়ের লগে থাকতে চাইতাছো?’ নূরজাহানের কণ্ঠ গম্ভীর। এমন প্রশ্নে পদ্মজা ভয় পেয়ে যায় এবং লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠে। আমতা আমতা করে বলল,’ন…ন…না! তে…তেমন কিছু না।’
পদ্মজা আড়চোখে আমিরকে দেখে আবার চোখের দৃষ্টি নত করে ফেলল। আমির নূরজাহানকে জড়িয়ে ধরে বলল,’আমি যাচ্ছি বুড়ি।’ এরপর পদ্মজার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে কোমল কণ্ঠে বিদায় জানাল, ‘আল্লাহ হাফেজ পদ্মবতী।’
পদ্মজা নতজানু অবস্থায় মাথা নাড়াল। আমির ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পদ্মজা ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করে নূরজাহানকে দেখে। ঢোক গিলে বলে,’রাগ করেছেন দাদু?’
নূরজাহান হাসলেন। পদ্মজার এক হাত ধরে বিছানার কাছে নিয়ে যান। বললেন,’আমার বইনে তো ঠিক কথাই কইছে। গুসা করতাম কেরে?’
পদ্মজা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। নূরজাহান বললেন,’তুমি বও। আমি জোসনার মারে ভাত দেওনের কথা কইয়া আইতাছি।’
‘আমি খেয়েছি দাদু। তখন খাওয়ালেন আম্মা।’
‘ব্যাগডা কই? শাড়িডা খুইলা আরেকটা পরো। সিঁদুর রঙেরডা পরবা।’ বলতে বলতে নূরজাহান ব্যাগ থেকে সিঁদুর রঙের শাড়ি বের করলেন। পদ্মজার দিকে এগিয়ে দিলেন। পদ্মজা হাত বাড়িয়ে শাড়ি নিলো। জানতে চাইল,’কোথায় পাল্টাব?’
‘খাড়াও দরজা লাগায়া দেই। ঘরেই পাল্ডাও। আমারে শরমাইয়ো না বইন। তোমার যা আমারও তা।’
পদ্মজা শাড়ি হাতে নিয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে শাড়ি পাল্টানোর মতো উপযুক্ত জায়গা খুঁজতে থাকে। পালঙ্কের পিছনে চোখ পড়ে। পদ্মজা সেদিকে গিয়ে শাড়ি পাল্টে নিল। এরপর নূরজাহানের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,’দাদু,তখন কাঁদছিল কে?’
নূরজাহান বিছানায় বসতে বসতে জবাব দেন,’আমার খলিলের বড় ছেড়ার বউ।’
পদ্মজা দুই কদম এগিয়ে আসে। আগ্রহভরে জানতে চায়,’কেন কাঁদছিল? উনাকে কি ঘরে আটকে রাখা হয়েছে?’
‘বও। আমার ধারে বও।’
পদ্মজা নূরজাহানের সামনে ঝুঁকে বসে। নূরজাহান বললেন,’ তোমার চাচা হউরের(শ্বশুর) বড় ছেড়ার বউ রুম্পার গত বৈশাখো মাথা খারাপ হইয়া যায়। এরে ওরে মারতে আসে। কেউরে চিনে না। নিজের সোয়ামিরেও চিনে না। আলমগীর তো এহন ঢাহাত থাহে। আমির তো গেরামে আইছে অনেকদিন হইলো। আলমগীর শহরে আমিরের কামডা করতাছে। এর লাইগগাই তো আলমগীর বিয়াতে আছিল না। রুম্পা তোমার হউরিরে দা নিয়া মারতে গেছিল।’
‘এজন্য আপনারা ঘরে আটকে রাখেন উনাকে? হুট করে কেন এমন হলেন?’ পদ্মজা আঁতকে উঠে জিজ্ঞাসা করল।
নূরজাহান এদিকওদিক তাকিয়ে কী যেন দেখলেন! এরপর সতর্কতার সাথে ফিসফিসিয়ে বললেন,’বাড়ির পিছে বড় জঙ্গলা আছে। দোষী জায়গা। ভুলেও ওইহানে যাইয়ো না। রুম্পা শনিবার ভরদুপুরে গেছিল। এর পরেরদিন জ্বর উডে। আর এমন পাগল হইয়া যায়। এগুলো তেনাদের কাজ! রাতে নাম লওন নাই। তুমি মাশাল্লাহ চান্দের টুকরা। ভুলেও ওইদিকে যাইয়ো না। ক্ষতি হইব।’
নূরজাহানের কথা শুনে পদ্মজার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে পড়ে। মনে মনে ভাবে, অবিশ্বাস্য! ভয় পেয়ে কারো মাথা খারাপ হয়ে যায়?
পদ্মজা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,’উনাকে ডাক্তার দেখানো হয়েছে?’
‘হ। দেহানো হইছে তো। শহরে দুইবার লইয়া গেছে। কবিরাজ আইলো। কেউই ভালা কইরা দিতে পারে নাই। আইচ্ছা এসব কথা বাদ দেও এহন। এই বাড়িত যহন বউ হইয়া আইছো সবই জানবা। খালি বাইরে কইয়ো না এই খবর। গেরামের কেউ জানে না। রাইত অইছে ঘুমাও।’
নূরজাহান শুতে শুতে বললেন,’হুনো জামাইয়ের কাছে কইলাম যাইবা না।’
‘না,না…যাব না।’
‘বুঝলা বইন,তোমার দাদা হউরে বিয়ার প্রত্তম রাইতে লুকাইয়া আমারে তুইলা নিজের ঘরে লইয়া গেছিল। আদর-সোহাগ কইরা ভোর রাইতে পাডাইয়া দিছিল। আমি ছুডু আছিলাম। তাই ডরে কইলজা শুকায়া গেছিল।’
বলতে বলতে নূরজাহান জোরে হেসে উঠেন। পদ্মজা মৃদু করে হাসে। নূরজাহান ডান দিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়েন। পদ্মজা ধীরে ধীরে এক কোণে কাচুমাচু হয়ে শুয়ে পড়ে। কী অদ্ভুত সব! সাধারণত বিয়ের রাতে নতুন বউরা ঘুমানোর সুযোগ পায় না। জামাইয়ের বাড়ির মানুষেরা সারাক্ষণ ভীড় করে ঘেঁষে থাকে। পদ্মজা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। হারিকেনের আগুন নিভু নিভু করে জ্বলছে। নিভে যাবে যেকোনো মুহূর্তে। কেটে যায় অনেকক্ষণ। ঘুম আসছে না। দেহ অচেনা অনুভূতিতে ছেয়ে যাচ্ছে। আচমকা পদ্মজা ভ্রু কুঁচকে ফেলে। কান খাড়া করে ভাল করে শোনার চেষ্টা করে। আবার কাঁদছে! রুম্পা মিনমিনিয়ে কাঁদছে। পদ্মজা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। সাথে সাথে নূরজাহান পদ্মজার দিকে ফিরেন। জানতে চান,’ডরাইতাছো?’
‘উনি আবার কাঁদছেন।’
‘সারাবেলাই কান্দে। এইসবে কান দিও না। ঘুমাইয়া পড়ো।’
পদ্মজা উসখুস করতে করতে শুয়ে পড়ে। হারিকেন নিভে যায়। নূরজাহান ঘুমে তলিয়ে যান। নাক ডাকছেন তিনি। নাক ডাকার তীব্রতা অনেক। যা পদ্মজাকে বিরক্ত করে তুলে। পদ্মজা ঘুমানোর চেষ্টা করে। হাজার ভাবনার ভীড়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। শেষ রাতে ঘুমের ঘোরে অনুভব করে, হাঁটুতে কারো হাতের ছোঁয়া। পদ্মজা চোখ খুলে। মুখের সামনে কেউ ঝুঁকে রয়েছে। পদ্মজা ধড়ফড়িয়ে উঠে চিৎকার করে উঠল,’কে?’
সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ অবয়বটি ছুটে বেরিয়ে যায়। পদ্মজা কাঁপতে থাকল। শরীর বেয়ে ঘাম ছুটছে। ভয়ে ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। সে নূরজাহানকে ভয়ার্ত স্বরে ডাকে,’দাদু…দাদু।’
নূরজাহান একটু নড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। পদ্মজা আর ডাকল না। সে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। তার চোখের দৃষ্টি দরজার বাইরে। মস্তিষ্ক ভাবছে, দরজা তো লাগানো ছিল। বাইরে থেকে কেউ কীভাবে ঢুকলো? নাকি এর মাঝে দাদু টয়লেটে গিয়েছিলেন? পদ্মজার বুক হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করছে। সে জিহ্বা দিয়ে শুকনা ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। একটু ভয় ভয় করছে। কে এসেছিল! এভাবে গায়ে হাত দিচ্ছিলো কেন? পদ্মজা চোখ খিঁচে ছিঃ বলে আগন্তুকের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে। বাকি রাতটুকু আর ঘুম হলো না তার। ভয়টা কমেছে। এই জায়গায় পূর্ণা থাকলে হয়তো পুরো বাড়ি চেঁচিয়ে মাথায় তুলে ফেলতো। পদ্মজা মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে,এরকম ঘটনা পূর্ণার জীবনে যেন না আসে। একদম গুড়িয়ে যাবে। উঠে দাঁড়াতে পারবে না। পূর্ণার কথা মনে পড়তেই পদ্মজার বুকটা হু হু করে উঠল। কান্না পায়। অন্যদিন পাশে পূর্ণা থাকে। আজ নেই!
ফজরের আযান পড়তেই নূরজাহান চোখ খুলেন। বিছানা থেকে নেমে দেখেন,পদ্মজা জায়নামাজে দাঁড়াল মাত্র। তিনি প্রশ্ন করলেন,’ওযু করলা কই?’
‘জি, কলপাড়ে।’
‘চিনছো কেমনে?’
পদ্মজা হাসলো। বলল,’খুঁজে বের করেছি।’
নূরজাহান চোখমুখ শক্ত করে বলেন,’নতুন বউ রাইতের বেলা একলা ঘুরাঘুরি কইরা কল খোঁজার কী দরকার আছিল? আমারে ডাকতে পারতা।’
পদ্মজার মাথা নত করে অপরাধী স্বরে বলল,’ক্ষমা করবেন দাদু।’
‘কি কাল আইলো। আইচ্ছা,পড়ো এহন। নামায পড়ো।’
নূরজাহান অসন্তুষ্ট ভাব নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
পদ্মজার দুই চোখ ছলছল করে উঠে। যখন টের পেল এখুনি সে কেঁদে দিবে,দ্রুত ডান হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছে। এরপর নামাযে মন দিল।
___________
পদ্মজাকে কাতান শাড়ি পরানো হয়েছে। বউভাতের অনুষ্ঠান চলছে। সে এক বিশাল আয়োজন। বিয়ের চেয়েও বড় করে বউভাতের অনুষ্ঠান হচ্ছে। অলন্দপুরের বাইরে থেকেও মানুষ আসছে পদ্মজাকে দেখার জন্য। আটপাড়ার প্রতিটি ঘরের মানুষ তো আছেই। পদ্মজার চারপাশে মানুষের গিজগিজ। রাতে ঘুম হয়নি। পরনে ভারী শাড়ি,গহনা। এতো মানুষ চারিদিকে। সব মিলিয়ে পদ্মজার নাজেহাল অবস্থা। মাথা নত করে বসে আছে সে।
‘আপা।’
পূর্ণার কণ্ঠ শুনে মুহূর্তে পদ্মজার ক্লান্তি উড়ে যায়। চকিতে চোখ তুলে তাকায়। পূর্ণা,প্রেমা,প্রান্ত ঝাঁপিয়ে পড়ে পদ্মজার উপর। পূর্ণা আওয়াজ করে কেঁদে উঠে বলল,’রাতে আমার ঘুম হয়নি আপা।’
পদ্মজার গলা জ্বলছে। প্রেমা,পূর্ণা,প্রান্তকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে। চাপা কণ্ঠে বলে,’আমারো ঘুম হয়নি বোন।’
‘আপা চল,বাড়ি চল।’
‘কাইল যাইব। আইজ না। এহন পদ্মজা আমরার বাড়ির ছেড়ি।’ লাবণ্য বলল। সে সবেমাত্রই এই ঘরে ঢুকল। পদ্মজার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। পূর্ণা রাগ নিয়ে বলে,’আমার বোন আমি নিয়ে যাবো।’
‘আমাদের আপা আমরা নিয়ে যেতে এসেছি।’ বলল প্রান্ত।
রানি প্রান্তর কান টেনে ধরে বলল,’পেকে গেছিস তাই না?’
‘উ! ছাড়ো রানী আপা। ব্যথা পাচ্ছি।’
‘ওরেম্মা! তুই শুদ্ধ ভাষাও শিইখা লাইছস?’ রানি অবাক হয়ে জানতে চাইল। প্রান্ত অভিজ্ঞদের মতো হেসে বলল,’ইয়েস।’
যারা যারা প্রান্তকে চিনে সবার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। প্রান্ত একটি ইংরেজি শব্দ বলেনি যেন মাত্রই এখানে বজ্রপাত ঘটাল। রানি চোখেমুখে বিস্ময়ভাব রেখে বলল,’এইটা মুন্না না অন্য কেউ।’
‘আমি মুন্না না আমি প্রান্ত। প্রান্ত মোড়ল।’ প্রান্তের বলার ভঙ্গী দেখে সবাই হেসে উঠল। পদ্মজা হাসতে হাসতে রানিকে বলল,’প্রান্ত অনেকগুলো ইংরেজি শব্দ শিখেছে।’
‘বউ মানুষ কেমনে দাঁত বাইর কইরা হাসতাছে দেখছো? বেহায়া বউছেড়া।’ কথাটি দরজার পাশ থেকে কেউ বলল। অন্য কেউ শুনতে না পেলেও পদ্মজা শুনতে পেল। সে সেদিকে তাকাল।
অল্প বয়সী দুজন মহিলা এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন পদ্মজাকে চোখ দিয়ে গিলে খাবে। পদ্মজা তাদের উদ্দেশ্যে হাসে। পদ্মজার হাসি দেখে মহিলা দুজন থতমত খেয়ে গেল। দুজন চাওয়াচাওয়ি করে আবার পদ্মজার দিকে তাকাল। পদ্মজা ততক্ষণে চোখ সরিয়ে নিয়েছে।
_____________
অতিথি আপ্যায়ন চলছে ধুমধামে। রমিজ আলী,কামরুল,রজব সবাই উপস্থিত রয়েছে। খাওয়া শেষে তারা আড্ডা শুরু করে।
রমিজ বললেন,’মনজুর ছেড়া,জলিল,ছইদ এরা কী আইছে?’
কামরুল দাঁতের ফাঁক থেকে যত্ন করে গরু মাংস বের করেন। এরপর উত্তর দেন,’না আহে নাই। হেদিন ছইদের বাপে আমার কাছে গেছিল।’
‘কেরে গেছিল?’
‘ছইদরে যাতে মাতব্বরের হাত থাইকা বাঁচায়া দেই।’
‘হেরা এহন কই আছে?’
‘আছে কোনহানে। কয়দিন পর পরই তো উধাও হইয়া যায়। এহনের ছেড়াদের দায়-দায়িত্ব নাই বুঝলা। আমার যহন দশ বছর তহন ক্ষেতে কাজ করতে যাইতাম।’
কামরুলের কথা উপেক্ষা করে রমিজ অন্য প্রসঙ্গ তুললেন,’ক্ষমতা যার বেশি হের সুখ বেশি। আমার মাইয়াডা নির্দোষ আছিল। তবুও কেমনডা করছিল সবাই? আইজ মাতব্বরের ছেড়া বলে কিচ্ছুই হইল না। বদলা আমরা বিয়া খাইতে আইছি।’
রমিজের অসহায় মুখখানা দেখে কামরুল,রজব,মালেক হো হো করে হেসে উঠলেন। রমিজের দৃষ্টি অস্থির। পেট ভরে খাওয়ার লোভে এখানে এসেছেন তিনি। নয়তো এখানে আসার এক ফোঁটাও ইচ্ছে ছিল না।
____________
পদ্মজা কিছুতেই খেতে পারছে না। অথচ ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। চোখের সামনে এতো মানুষ থাকলে কী খাওয়া যায়। পূর্ণা ব্যাপারটা ধরতে পেরে লাবণ্যকে বলল। লাবণ্য সবাইকে বেরিয়ে যেতে বলে। কেউ শুনে না। তাই সে ফরিনা বেগমকে নিয়ে আসে। ফরিনা বেগম সবাইকে বের করে, দরজা ভিজিয়ে দিয়ে যান। ঘরে শুধু রানি,লাবণ্য,পদ্মজা,প্রেমা,পূর্ণা এবং প্রান্ত। পদ্মজা খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। পূর্ণা বলে,’আপা আমি তোমাকে খাইয়ে দেই?’
পদ্মজা অবাক হয়ে তাকাল। ঠোঁটে ফুটে মিষ্টি হাসি। পূর্ণা অনুমতির অপেক্ষা না করে এক লোকমা ভাত বাড়িয়ে দিল। পদ্মজার দুই চোখ ছলছল করে উঠে। পূর্ণা কখনো খাইয়ে দেয়নি। এই প্রথম খাওয়াতে চাইছে। পদ্মজা হা করে। লাবণ্য হেসে বলল,’আমার এমন একটা বইন যদি থাকতো।’
‘আমি তোর বইন না?’ বলল রানি।
লাবণ্য চোখমুখ শক্ত করে বলল,’জীবনে খাইয়ে দিছস? আবার বইন কইতে আইছস যে।’
‘তুই খাইয়ে দিছস? পূর্ণা তো ছুটু। তুইও তো ছুটু।’
‘আগে পদ্মজা খাওয়াইছে। এরপর পূর্ণা।’
‘আইচ্ছা ভাত লইয়া আয়। খাওয়াই দিমু।’ রানি বলল।
‘এহন পেট ভরা।’
‘হ,এহন তো তোর পেট,নাক,মাথা সবই ভরা থাকব।’
দুই বোনের ঝগড়া দেখে পূর্ণা,পদ্মজা হাসে। কী মিষ্টি দুজন। ঝগড়াতেও যেন ভালোবাসা রয়েছে। লাবণ্যের চেয়ে রানি বেশি সুন্দর। তবে,লাবণ্যকে দেখলে বেশি মায়া লাগে। লাবণ্য যে রাগী দেখলেই বোঝা যায়। গতকাল কি রাগটাই না দেখাল! ঘরে ঢুকল আমির। আমিরকে দেখেই পদ্মজা সংকুচিত হয়ে গেল। রানি প্রশ্ন করল,’এইহানে কী দাভাই?’
‘পদ্মজাকে নিয়ে যেতে হবে। ওহ খাচ্ছে। আচ্ছা,খাওয়া শেষ হলে নিয়ে যাবো।’ বলতে বলতে আমির পদ্মজার সামনে বসল। লাবণ্য জিজ্ঞাসা করল,’কই নিয়ে যাবা?’
‘আম্মার ঘরে।’
‘কেন?’
‘আম্মা বলছে নিয়ে যেতে।’
‘আম্মা একটু আগেই দেইখা গেল।’
আমির হকচকিয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল,’ওহ তাই নাকি?’
রানি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমিরকে পরখ করে নিয়ে বলল,’দাভাই,মিথ্যে বলছো কেন?’
‘মি…মিথ্যে আমি? অসম্ভব। আম্মা না দাদু বলছে নিয়ে যেতে। এই তোরা যা তো। তোদের বান্ধবিরা আসছে। যা। হুদাই ঘেনঘেন শুরু করেছিস।’
লাবণ্য কথা বাড়াতে চাচ্ছিল। রানি টেনে নিয়ে যায়। প্রেমা,প্রেমাও বেরিয়ে যায়। তারা বাড়ি থেকে পরিকল্পনা করে এসেছে, একসাথে পুরো হাওলাদার বাড়ি ঘুরে দেখবে। পূর্ণা খাইয়ে দিচ্ছে। পদ্মজা আমিরের উপস্থিতিতে বিব্রত হয়ে উঠেছে। খাবার চিবোতে পারছে না। আমির পদ্মজাকে বলল,’বড় ভাবি বলল,রাতে নাকি ঘুমাওনি।’
‘না। হ্যাঁ। আসলে ঘুম আসেনি।’
‘ঘুমাবে এখন?’
‘না,না। কী বলছেন? বাড়ি ভর্তি মানুষ।’ পদ্মজা দ্রুত বলল। আমিরের চোখের দিকে তাকিয়ে। কথা শেষ হতেই চোখ নামিয়ে নিল।
আমির বলল,’আচ্ছা,খাও। আমি আসছি।’
‘আপনি কী রাতে দাদুর ঘরে এসেছিলেন?’
আমির চলে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছিল। এই কথা শুনে চমকে তাকাল। পদ্মজার দিকে ঝুঁকে জানতে চাইলো,’কেন? কেউ কী এসেছিল তোমার ঘরে?’
আমিরের এমন ছটফটানি দেখে পদ্মজা খুব অবাক হলো। সে অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বলল,’হ্যাঁ, এসেছিল। শেষ রাত্রিরে।’
‘আচ্ছা।’ বলেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল আমির। পদ্মজা পিছনে ডাকল, শুনল না আমির। হুট করে আমিরের পরিবর্তন পদ্মজাকে ভাবাতে লাগল।
চলবে…
®ইলমা বেহরোজ