#আকাশ_এখন_মেঘলা
মোর্শেদা হোসেন রুবি

৩||

প্রতিদিন বিকেলে ছোট ছেলের জন্য নাস্তা তৈরী করে অপেক্ষা করাটা ইসমাত জাহানের দৈনন্দিন জীবনের একটা রুটিনবাঁধা কাজ হয়ে গেছে। বাকি ছেলেদের জন্য তার এটা করার দরকার হয়না কারণ তাদের প্রত্যেকেরই আলাদা পরিবার আছে। বউ বাচ্চা আছে। বরং ইসমাত নিজেই সেখানে অতিথির ভূমিকায় থাকেন।
বড় ছেলে বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে সাততলায় থাকে। মেজ ছেলে তার বউ ছেলেমেয়ের সাথে শ্বাশুড়ীকেও রেখেছে বছর খানেক হয়। বেচারি বিধবা মানুষ। ছেলেরা রাখেনা বলে মেয়ের বাড়িতে থাকেন। যদিও মেজ ছেলের বৌ তার মায়ের আশ্রয়ের চেয়ে তার নিজের প্রয়োজনের গানটাই রোজ সারেঙ্গী বাজিয়ে ইসমাতকে শোনায়। তার মা না থাকলে নাকি সে বাচ্চাদের মানুষই করতে পারতো না। কীভাবে স্কুলে যেতো আর কীভাবে ঘর সামলাতো সে নাকি ভেবেই পায়না। ইসমাত কিছু বলেন না। চুপচাপ মেজ বৌ এর রোজকার পুঁথিপাঠ শোনেন। যেদিন অতিরিক্ত হয়ে যায় সেদিন একেবারে লতি ছেলা ছিলেন। তাতে মেজ বৌ একটু দমন হয়। কিছুদিন পর আবার যেই কে সেই।

ইসমাত আজকাল ওকে পাত্তা কম দেন। বেশি কথা বলা মানুষ এমনিতেই পছন্দ নয় তার। স্বার্থপর লোকজন তো আরো না। বড় বউ স্বার্থপর হলেও সেয়ানা স্বার্থপর। মুখে খুব মা মা করবে কিন্তু সময়মতো তাকে আসল রূপে পাওয়া যায়। এসব ভাবতে গেলে চিন্তায় ঘুম আসেনা ইসমাতের। আমান তার অন্ধের ষষ্ঠী। এই ছেলেটা তার প্রতি যথেষ্ট যত্নবান। কিন্তু সেটা কতদিন ইসমাত জানেন না। বউ এলেই তো তিনি হয়ে যাবেন পেইংগেস্ট।

আজকাল মনের মধ্যে এই গোপন ভয়টাই সদা ঘাপটি মেরে থাকে। কে জানে আমানটার বউ কেমন হয়। এটাও যদি বড় আর মেজ জনের মতো স্বার্থপর হয়ে থাকে তবেই হয়েছে। ইসমাতের কপাল পুড়লো বলে। যদিও ছেলে তার সোনার টুকরা। মায়ের অকাল বৈধব্য সে মন দিয়ে অনুভব করে। ইসমাতের সুখ সুবিধার দিকে শ্যেন নজর তার। কেবল পড়ুয়া বলেই নয়, ছেলে তার এমনিতেও প্রেম ভালবাসার পথ কখনও মাড়ায়নি। কিছুদিন আগেও একবার দুরু দুরু বুকে করেছিলেন প্রশ্নটা।
” হ্যারে তোর কোন পছন্দ টছন্দ আছে ? আজকাল তো সবারই থাকে। তোর নেই ? ”

” হতে দেইনি মা। ” ছেলের সরল উত্তর ইসমাতকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলো সেদিন। তার আমান লাখে একটা ছেলে। আত্মীয় বন্ধু সবার আগ্রহ ওর প্রতি। ইসমাতের প্রতি সবার বাড়তি আগ্রহের এটা একটা কারণ যে আমান মাকে ভীষণ মূল্যায়ন করে। কিন্তু এসব আচরণ ইসমাতের ভয় বাড়ায় বই কমায়না। মেয়েগুলা বিয়ের আগে যত আদবকায়দা আর সুষ্টুনী মুষ্টুনী মার্কা ভাবসাব দেখায় বিয়ের পর আর সেটা থাকেনা। এর ভুরি ভুরি প্রমান আছে তার কাছে। তার মেজ ছেলের বউটাই তো। সম্পর্কে ইসমতের দুরসম্পর্কের আত্মীয়া। বিয়ের আগে মেজবৌমার আচরণ আর বিয়ের পরের আচরণে আকাশ পাতাল পার্থক্য। যত দিন যাচ্ছে এই পার্থক্যের পরিমান ততই বাড়ছে। সে কারণেই ইসমাত ঠিক করেছেন ছেলের জন্য এবার অনাত্মীয় ঘর থেকে মেয়ে আনবেন। আত্মীয়দের মেয়েগুলো বিয়ের পর দুটার জায়গায় চারটা ডানা গজিয়ে যায়। আত্মীয় বলে কিছু বলাও যায়না। তারচে অনাত্মীয় হলে দুচারটা ঠাস ঠাস শোনানো যাবে।

কিছুদিন আগে পুরোনো প্রতিবেশী মহুয়া আপা তার মেয়ে দুলির কথা বলছিলেন। মেয়েটাকে কিছুদিন আগে একটা অনুষ্ঠানে দেখেছেন। বেশ সুন্দর। তার বাকি দুই বৌমার চেয়েও ব্রাইট আর চৌকস। ইসমাতের ভালো লেগেছিলো। তারপরই তিনি মহুয়া আপাকে জানিয়ে দিয়েছেন যে তার ছেলের পছন্দ হলে তার দিক থেকে কোন আপত্তি থাকবেনা। ইসমত মুখে বলেননি কিন্তু এই স্বস্তির প্রধান কারণ মহুয়া আপা নিজে। ইসমাত যতদিন তাদের সাথে এক বাড়িতে ছিলেন ততদিন ধরেই তিনি মহুয়া আপাকে দেখেছেন । অত্যন্ত অমায়িক আর ভদ্র মহিলা এই মহুয়া আপা। তার মেয়ে যে তার মতোই হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। তারপরেও তিনি মনে করেন বিয়েশাদীর ব্যপারে পাত্রপাত্রীর নিজস্ব ভালোলাগা থাকার দরকার আছে। সারাজীবনের ব্যপার। তিনি চাননা কেবল তাকে খুশি করতে গিয়ে ছেলে তার কষ্ট পাক। সেকারণেই দুলির সাথে আলাদা দেখা করানোর চেষ্টা করেছিলেন ইসমাত। ছেলে কাজের চাপে সময়ই পায়না। শেষ পর্যন্ত ওর অফিসেই বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মহিয়ার বড় ছেলে সাবের। আজ ওদের আমানের অফিসে যাবার কথা ছিল । কী কথা হলো কে জানে। কথাটা জানার জন্য ইসমাত মনে মনে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে আছেন।

ছেলের গাড়ির শব্দে বেরিয়ে এলেন ইসমাত। আমানকে দেখা যাচ্ছে। ছেলেকে দেখেই ওর নাস্তার টেবিল গুছিয়ে ফেললেন তিনি । আমান মাকে দেখে সুন্দর করে হাসলো। একহাতে জড়িয়ে ধরে সারা দিনে অসংখ্যবার করা প্রশ্নটা আরেকবার করলো। ইসমাত ক্লান্তিহীন ভাবে হেসে জবাব দিলেন, ” আমার শরীর ভালোই আছে। তুই কুলি করে হাতটা ধুয়ে নাস্তাটা খেয়ে যা।”

আমান তাই করলো। ইসমাত মনে মনে অপেক্ষা করছেন আমান কখন সাবেরদের সাথে দেখা হবার কথাটা বলবে কিংবা দুলিকে পছন্দের কথাটা বলবে। কিন্তু ছেলেকে নিরবে নাস্তা খেতে দেখে ইসমাত আর থাকতে পারলেন না। নিজেই আগ বাড়িয়ে জানতে চাইলেন, ” কী রে অফিস কেমন কাটলো ? ”

” অফিস কেমন কাটলো মানে ? অফিস অফিসের মতোই কেটেছে।” এক চামচ ডাবের পুডিং মুখে দিয়ে বললো আমান।

ইসমাত বিরক্তি চেপে বললেন,” সাবেরদের যাবার কথা ছিলো না আজ। ওরা কী যায়নি ? নাকি দুলিকে তোর পছন্দ হয়নি কোনটা ? ”

আমান এবার হেসে ফেললো, ” এই কথা ? হ্যাঁ সাবেররা গিয়েছিলো। দুলিও এসেছিলো। প্রায় ঘন্টাদেড়েক আড্ডা দিয়েছি আমরা।”

” তাই নাকি ? ” ইসমাতের চোখে মুখে আনন্দচ্ছটা। ” কী বললো দুলি? ”

” সে তেমন কোন কথা বলেনি। কথা যা বলা সাবেরই বলেছে। আসলে মেয়েটা একটু নার্ভাস ছিলো।”

” নার্ভাস কেন ? ”

” আর বলোনা। বোকার মতো এক ক্লাসমেট না বান্ধবী কাকে যেন সাথে করে নিয়ে এসেছে। সেই মেয়ে ভেবেছে, আজ ওদের মার্কসিট পাওয়া যাবে। দুলি ওকে এরকম ধারণাই দিয়েছে। যা বুঝলাম মেয়ের একা লং জার্ণি করে অভ্যাস নেই। এদিকে দুলি বা সাবেরকে দেখলাম ব্যপারটাতে সেভাবে রেসপন্স করছে না। অথচ দুলির কারণেই তার আসা। অন্তত তার কথাবার্তায় সেরকমই মনে হচ্ছিলো। শেষ পর্যন্ত আগবাড়িয়ে আমাকেই একটা ভূমিকা নিতে হলো। দুজনের মার্কসিট ওকে করে ওদের হাতে ধরিয়ে দিলাম আর দুলিদের সাথে মেয়েটাকে ওদের বাড়ির গেটে নামিয়ে দিলাম। আজকের ঘটনা বলতে এটাই । আর তুমি যেটা জানতে চাচ্ছিলে সেটার উত্তর হলো হ্যাঁ, দুলিকে আমার পছন্দ হয়েছে।”

ইসমাত চুপচাপ শুনছিলেন। এবার মৃদুস্বরে বললেন, ” দুলি মেয়েটাকে সাথে নিয়ে এসেছিলো নাকি মেয়েটাই দুলির উপর দায় চাপাচ্ছিলো ? ”

” তেমন মনে হয়নি আমার। মেয়েটা বারবার দুলিকে বলতে গিয়ে উসখুস করছিলো সে তুলনায় দুলি নির্বিকার। ওর প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। কিন্তু যেভাবে ইগনর করছিলো ব্যপারটা….যাই হোক। আমার যা মনে হলো তাই বললাম।”

” হমম, আজকালকার মেয়েগুলো যে কী ফটকাবাজ। তোর জেসমিন আন্টির ছেলের বৌটাকে দেখিস না। মানুষটা ছোট হলে কী হবে। দুনিয়ার বদ। তো এদের ব্যপারটা কী ? ”

আমান চায়ের কাপ শেষ করে নামিয়ে রেখে বললো, ” আমি পারসোনালি কয়েকভাবে ব্যপারটা বোঝার চেষ্টা করেছি। দুলি একা আসতে হবে ভেবে সঙ্গী হিসেবে ঐ মেয়েটাকে জুটিয়েছে এটা কনফার্ম । হয়তো এতে ওর বড় ধরণের কোন ইন্টেনশান ছিলো না কিন্তু এটা বর্তমান সময়ের সবচে কমন একটা ধোঁকা সিস্টেম। যেটা অনেকে হাসতে হাসতে করে ফেলে এবং ধরা পড়ার পর এতোটুকু অপরাধবোধে ভোগে না। এই যা..।”

ইসমাত বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বললেন,” কিন্তু এগুলোই তো অসততার জীবাণূ। ছোট এলার্জি থেকেই তো খোসপাঁচড়া দেখা দেয়। এর মানে ভবিষ্যতে যে কোন পরিস্থিতিতে দুলিরা রং বদলাতে পারবে।”

” হয়তো। তাই বলে সাথের মেয়েটাকে ইনোসেন্ট ভাবার কিছু নেই। সে নিজে কোন ধান্ধায় রাজি হয়েছিলো তাই বা কে জানে। আজকাল ইনোসেন্সিটাও এক ধরণের চালাকি। কিছু জানিনা কিছু বুঝিনা ভাব ধরা। খোঁজ নিয়ে দেখোগে এটা দুলির চেয়ে বড় ধান্ধাবাজ। ”

” তোর তাই মনে হলো ? ”

” উঁহু, আমার ঠিক উল্টোটা মনে হয়েছে। ভয়টা এখানেই। এতো ভালোমানুষ যে মেয়ে। তার দুলির সাথে ঘনিষ্ট হবার কথা নয়। কিন্তু যা বুঝলাম তারা বাল্যবান্ধবী। সম্পর্কটা দীর্ঘদিনের। টিকে আছে কেমন করে আল্লাহই জানেন।”

” এভাবে কী চলে বল। এতো ঠগ বাছতে গেলে তো গা উজাড় হয়ে যাবে। এভাবে তোর বিয়েই হবেনা।”

” তো কী করতে বলো আমাকে ? দুলিকে বিয়ে করে ফেলবো ? ” আমান মায়ের দিকে তাকালো। ইসমাত চিন্তায় ডুব দিলেন।

আমান মাকে চিন্তার সাগরে ফেলে উঠে দাঁড়ালো। মিনিট খানেক পরে একটা ছোট্ট সাদাকাগজ হাতে বেরিয়ে এলো নিজের রুম থেকে। সেটা মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, ” এটা সেই আপাতদৃষ্টিতে বোকা মেয়েটার ঠিকানা আর ফোন নম্বর। দেখো কোন কাজে আসে কিনা।”

ইসমাতকে দেখালো বাজপড়া মানুষের মতো। তিনি কাগজটা হাতে নিলেও তাতে চোখ রাখলেন না। চোখ রাখলেন ছেলের মুখের দিকে। আমান অস্বস্তি কাটিয়ে বললো , ” মেয়েটা শ্যামলা। গায়ের রঙটা কিছুটা কালোর দিকে। কিন্তু আমি বাজি ধরে বলতে পারি কোন ফর্সা মেয়ে ওর সামনে দাঁড়াবার যোগ্যতা রাখেনা। আমি জানিনা দুলি কী মনে করে মেয়েটাকে আমার সামনে আনলো। আমার পক্ষে এখন অন্য মেয়েকে বিয়ের কথা ভাবা সহজ হবেনা মা। মুখটা মাথার ভেতর গেঁথে আছে। কী সর্বনাশ হলো বলো তো।

” সর্বনাশ হয়েছে ? “.

” তা নয়তো কী। দুপুরেও তো দিব্যি ভালো ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে একে না পেলে বিয়ে করার কোন মানে হয়না। ছেলেমানুষী চিন্তা কিনা তুমিই বলো।”

ইসমাত জবাব দিলেন না। গভীর বিস্ময়ে চেয়ে রইলেন ছেলের দবকে। আমান অস্বস্তি ভরে বললো,” এভাবে তাকিয়ো না মা। তুমি যদি এখন বলো দুলিকেই বিয়ে করতে হবে তাহলে তাই সই। তাছাড়া এই মেয়ের কী ভরসা। এতো সুন্দর একটা মেয়ে। কোথায় কয়টা জুটিয়ে বসে আছে কে জানে।” গভীর নিঃশ্বাস পড়লো আমানের

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here