আকাশে অনেক তারা – ৮

——–
”খাবার রুমে নিয়ে যেতে হবে কেন? সে কি হাঁটতে পারে না না-কি?”

নাহার ছেলের দিকে একটু রাগত চাহনিতে চেয়ে অসন্তোষপূর্ণ গলায় বললেন কথাগুলো। জবাবে জুবায়ের কয়েক মূহুর্ত চুপ থেকে মায়ের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলল,

”সে এই বাড়িতে নতুন, মা। এখনই সকলের মাঝে এসে খেতে আনইজি ফিল করবে। মানিয়ে নিতে একটু সময় প্রয়োজন।”

নাহার স্থির হয়ে ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন খানিক্ষন।
চোখেমুখে অবিশ্বাস্য ভাব। স্থিরাবস্থা ছিন্ন করে কাঁধ ঝাড়া দিলে বলে উঠলেন,

”বিয়ে করেছিস মাত্র কয়েক ঘন্টা। এই কয় ঘন্টায় এত পরিবর্তন! না জানি ভবিষ্যতে কি করবি?”

”মা, কিসব বলছ তুমি? সে অস্বস্তি বোধ করবে সে কারনে খাবারটা রুমে নিয়ে দিচ্ছি। এর সাথে আমার পরিবর্তনের কি সম্পর্ক? ঠিক আছে আমি যাব না। তুমি গিয়ে দিয়ে আস নিজে।”

”দেখলি, দেখলি জান্নাত। কথার ধরনই বলে দিচ্ছে পরিবর্তন হয়েছে কি হয়নি! খুব বেশিদিন বাকি নেই। এই ছেলে বউয়ের গোলামি করবে দেখে নিস। তোর বাপ খাল কেটে কুমির এনেছে!”

জুবায়ের আশেপাশে তাকাল। তার বড় বা মেজ বোন দু’জনের একজনও কোনোরূপ প্রতিবাদ করল না মায়ের কথায়। হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল সে। সে জানে, লেখার সঙ্গে তাঁর বিয়েতে একমাত্র তাঁর বাবা মোতালেব সাহেব ব্যতীত আর কারোই মত ছিল না। মোতালেব সাহেব বাড়ির কর্তা হিসেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্দেশ দিয়েছেন সেকারনে সকল উপস্থিত থেকেছে বিয়েতে। বিয়েটা হয়েছে জুবায়েরের দু’ বোন, তাদের স্বামী আর কয়েকজন নিকটতম আত্মীয়ের একান্ত উপস্থিতিতে। অন্যদিকে, লেখাদের দিক থেকে শুধুমাত্র লেখা আর তাঁর বাবাই ছিল। কোনো জাঁকজমক, কোনো আড়ম্বরতা ছিল না বিয়েতে। এমন সাদামাটা বিয়ে আজকাল দেখাই যায়না। সারল্যই তো জীবনের প্রকৃত উপলব্ধি বয়ে আনে। মায়ের কথা মনে নিল না। মুচকি হাসল জুবায়ের। ততক্ষণে লেখার খাবার নাহার অনিচ্ছা সত্ত্বেও একত্রে একটা ট্রেতে সাজিয়ে-গুছিয়ে জুবায়েরের সামনে রেখেছেন। সে কোনো কথা না বলে একবার মা বোনদের দিকে চেয়ে ট্রে-টা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল কিচেনের দিক থেকে। যেতে যেতে আশেপাশে চোখ বুলালো একবার। আঁখিকে দেখেনি সেই দুপুর থেকে একবারও। কোথায় গেছে মেয়েটা? আবারও একটা নিঃশ্বাস নির্গত করল সে। আল্লাহ যা করেন নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে মঙ্গলকর কিছু রেখেছেন বলেই করেন!
_____________________________________

জুবায়ের রুমে গিয়ে দেখল লেখা বিছানায় শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। চাহনি নিস্পৃহ।
সে খাবারটা টি-টেবিলে রেখে ডাকে তাকে।

”জুলেখা!”

হুঁশ আসে লেখার। হকচকিয়ে গিয়ে উঠে বসে। জুবায়েরের মুখে হাসি। লেখার অবস্থা দেখেই সে হাসছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে লেখা বলে উঠল,

”আপনি কখন এলেন?”

”যখন আপনি সিলিংয়ের দিকে একমনে তাকানোয় মত্ত ছিলেন।”

লেখা কিছু বলল না। জুবায়ের বলল,

”খাবার এনেছি।”

জুবায়েরের চাহনি লক্ষ্য করে খাবারের দিকে তাকায় সে। মুখে তৎক্ষনাৎ লালাক্ষরণ হয়। জুবায়ের তার মুখভঙ্গি পরোখ করতে ভুলে না। সে জিজ্ঞেস করে,

”আপনি রোজা রেখেছেন কখনো?”

”না।”

জুবায়েরের মুখটায় তমশা ভর করে। মনে তীক্ষ্ণ কষ্ট অনুভূত হয়। সে বাপের কথাগুলো স্মরণ করে নিজেকে স্বাভাবিক করে। বলে,

”হাত ধুঁয়ে এসে খাবারটা..”

কথা শেষ হয়না জুবায়েরের। লেখা খাবারের প্লেট হাতে তুলে নিয়ে সেটায় হাত মাখিয়েছে ইতোমধ্যে।

”হাত না ধুঁয়েই খেতে শুরু করেছেন?”

”ধুঁয়েছি না তখন?”

”কখন?”

”গোসল করেছি তো।”

”আপনি কি সবসময়ই এমন জুলেখা?”

মুখের খাবার চিবোতে চিবােতে লেখা পাল্টা প্রশ্ন করে,

”কেমন?”

”হাত না ধুঁয়ে খেতে শুরু করেছেন! আপনার মত মেয়েরা তো খুব হাইজিন কনশাস হয়।”

লেখা মুখ তুলল। ক্ষীণ চোখে জুবায়েরের দিকে চেয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলল,

”মেয়েদের সম্পর্কে খুব জানেন দেখছি!”

জুবায়ের থতমত খেয়ে গেল। ধাতস্থ হয়ে বলল,

”কি বলতে চাইছেন?”

”কিছু না।”

নিঃশব্দে লেখা খাচ্ছে। এতক্ষণ খিদে থাকলেও এখন সে আবিষ্কার করল খিদেটা আর নেই। পেটটা ফাঁপা লাগছে। জুবায়েরের কথায় নাকি অনেক্ক্ষণ খিদে চেপে রাখায় খাওয়ার মনটা মরে গেছে বুঝতে পারছে না সে। এখন মনে হচ্ছে যেন অনেক কিছু খেয়ে শেষ করেছে সে। সে কারনে অন্ননালী দিয়ে খাবার পাকস্থলীতে যাচ্ছে না।

”আপনি বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম বলে খাওয়া শুরু করেছিলেন জুলেখা!”

অন্যমস্ক হয়ে গেছিল সে। জুবায়েরের কথা শুনে জবাব দিল,

”হুঁ, কিছু বলছেন?”

”খাবার আগে দোয়া পড়েছিলেন?”

”না। আমি জানি না তো।”

”কিছুই জানেন না আপনি!”

”ধর্ম বিষয়ে আসলেই কিছু জানিনা আমি।”

ঠোঁটে স্মিত হাসি ফুঁটিয়ে লেখা ফের বলল,

”আপনার সঙ্গে আমার বিয়েটা হওয়ায় আপনি খুব বিপদে পড়ে গেলেন, না? আমি আসলেই আপনার টাইপ নই মি..”

লেখার মুখে সঙ্কোচ। নামটা ভুলে গেছে সে। জুবায়ের গোপণে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস চেপে গেল। মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল,

”জুবায়ের প্রধানীয়া। জুলেখা বিনতে আশরাফের স্বামী। সারাজীবনের সঙ্গী! ইহকাল পরকালের সঙ্গী!”

কেঁপে উঠল লেখা। শব্দগুলো স্বাভাবিক কিন্তু তার পেছনের মর্মার্থ ভীষণ গভীর। লেখাকে থম ধরে বসে থাকতে দেখে জুবায়ের তাড়া দিল,

”জুলেখা দ্রুত খাওয়া শেষ করুন। নিচে আপনার বাবা অপেক্ষা করছে। তাছাড়া নতুন বউ এতক্ষণ ঘরে বসে থাকাটাও অশোভন দেখায়।”

আরো দু’টো লোকমা মুখে দিতেই বমি বমি ভাব হল লেখার। অনিচ্ছায় সে কোনোদিনই কিছু করতে পারে না। তাঁকে খাবার প্লেট রেখে দিতে দেখে জুবায়ের বলে উঠল,

”কি করছেন?”

”আর খাব না।”

”এমনিতেই আপনি নামাজ পড়েননি। এখন আবার খাবার অপচয় করবেন! খাবার এমনি এমনি আসে না জুলেখা।”

লেখা যেন জমে গেল। তাঁর সদ্য বিয়ে করা স্বামী ব্যক্তিটি কি তাঁকে খাবারের খোঁটা দিচ্ছে!

”আপনি খাবারের খোঁটা দিচ্ছেন আমাকে? এই দায়িত্ব নিয়েছেন আমার?”

লেখার ব্যথিত মুখটা জুবায়েরের মনে ভারী হাওয়ার বর্ষণ করল।

”আমি সেভাবে বলিনি।”

”কীভাবে বলেছেন তাহলে? আমি কি বাচ্চা, যেভাবে বলবেন সেভাবে বুঝে যাব!”

”দেখুন জুলেখা, খাবারের একটা দানা আমরা কেউ সৃষ্টি করতে পারি না। পৃথিবীর সমস্ত মানুষ মিলেও পারবে না। তাহলে, কেন নষ্ট করব খাবার আমরা?
খাবার অপচয় করলে সংসারে বরকত কমে যায়! এই সংসারটা এখন আপনার। সংসারের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্বও আপনার।”

”বিয়ের একদিনও হল আর আপনি সংসারের দায়িত্ব দিয়ে দিলেন?”

বাবা বলেছিল মেয়েটা কাঁদা মাটির মত। কথাটা সম্পূর্ণ ঠিক নয়। মোটামুটি জটিলতা রয়েছে ভেতরে।
অবশ্য, যেমন পরিবেশে বড় হয়েছে সে হিসেবে এমন একটু আধটু জটিলতা অস্বাভাবিক কিছু নয়। জুবায়ের হাসল,

”আমার এক আত্মীয় আছে। বিয়ে হয়েছে পনেরো বছর। এখনো অবধি সে স্বামীর সংসারটাকে নিজের সংসার বলে দাবি করতে পারেনি। সেই অধিকারই তাঁর স্বামী দেয়নি তাঁকে।”

লেখা চুপ করে আছে। তাঁর মুখভঙ্গি গম্ভীর। সংসারের মারপ্যঁচ সে বোঝেনা। এতদিন বাবা মাসে মাসে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছে। সে পড়াশোনা করেছে আর সেই টাকা উড়িয়েছে। দু’জনেই নিশ্চুপ থাকল অনেক্ক্ষণ।
খাবারের প্রতি কিছুক্ষণ পূর্বেও লেখার উপচে পড়া
লোভ ছিল। আর এখন তাঁর অনীহা জুবায়েরের চাহনি এড়াচ্ছে না। জুবায়ের সেই দুপুরে খেয়েছিল। এতক্ষণে পেটের খাবার হজম হয়ে খিদেটা নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে শুরু করেছে। তাদের বাড়িতে দুপুরে খাবার হয়। আর সন্ধ্যায় মাগরিবের পর ভরপেট নাস্তা। খাবার পেতে এখনো দেরি। এগিয়ে গিয়ে লেখার হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে নিল সে।

”ঠিক আছে আর খেতে হবে না। আপনি হাত ধুয়ে নিন।”

লেখা অবাক হয়ে জুবায়েরের দিকে তাকায়।

”খেতে হবেনা?”

”না, হাত ধুয়ে ফেলুন।”

”খাবার নষ্ট হবে তো।”

”হবেনা। আমি খাব।”

”আপনি?”

লেখার কথা জড়ানো। সে চোখের পলক ফেলছে না।
জুবায়ের প্লেটটা রেখে হাত ধুঁয়ে এল ওয়াশরুম থেকে।
লেখা নিজের অবস্থানে অনড়। তাঁর মাখা ভাতের সঙ্গে আরো একটু ভাত মিশিয়ে তরকারির বাটি থেকে তরকারি নিয়ে প্লেটে ঢেলে নিল জুবায়ের। অবলীলায় সেটা মেখে নিজের মুখে পুরে নিল। দ্বিতীয়বারও খেল।
লেখার শরীর গুলিয়ে উঠল। সে কোনোদিন এভাবে কারো খাবার খেতে পারবে না। কোনোদিন না। দৌঁড়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল সে। মুহিবের সঙ্গে সে বহুদিন খাবার ভাগাভাগি করে খেয়েছে। মুহিবের হাতেও খেয়েছে। কিন্তু, এভাবে মুহিবের আঁধখাওয়া খাবার সে খায়নি। মুহিবও খায়নি। এই লোকটা কি মানুষ? কি অবলীলায় খাচ্ছে!
______________________________

জুবায়েরের খাওয়া শেষ হওয়ার পরও লেখাকে ওয়াশরুম থেকে বেরতে দেখা গেল না। ঘরেই হাত ধুয়ে ওয়াশরুমের দরজায় টোকা দিল সে।

”এতক্ষণ কি করছেন আপনি লেখা?”

লেখা প্রতিক্রিয়া করল,

”বেরচ্ছি।”

দু’মিনিট বাদে লেখা বেরল। জুবায়ের খাবারের প্লেট আর তরকারির বাটিগুলো একত্রে ট্রেতে গুছিয়ে নিয়েছে ততক্ষণে। লেখাকে দেখে সে বলল,

”চলুন!”

”কোথায়?”

”নিচে! সবাই অপেক্ষা করছে। আপনি এ বাড়িতে প্রবেশ করেছেন থেকে এই ঘর থেকে বেরোননি এখনো।”

লেখা চাহনি এদিক-সেদিক নিক্ষেপ করে। বিচলিত সে জিজ্ঞেস করে,

”আপনার বাড়িতে বিয়েটা বোধহয় কেউ মন থেকে মেনে নিতে পারেনি তাইনা?”

”কেউ মেনে না নিলে কি আপনি এ বাড়ির বউ হতেন? বিশেষ করে বাবা।”

”আপনার বাবার কথা বলিনি!”

”তাহলে কে? মা?”

লেখা অস্বস্তি নিয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। জুবায়েরের মুখটা থমথমে হয় ক্ষণিকের জন্য। সে নিজেকে সামলে জবাব দেয়,

”মাকে নিয়ে আপনি মনে দয়া করে কোনো বিরূপ ধারনা পোষন করবেন না। আমার মা মাটির মানুষ।
কিছুদিনে নিজেই বুঝে যাবেন। আপনি মায়ের মনমত হতে পারলে নিজের কলিজাটাও কেঁটে দেবেন প্রয়োজনে তিনি।”

”আর মনমত হতে না পারলে?” তীক্ষ্ণ গলায় লেখা জিজ্ঞেস করল।

”কেন হতে পারবেন না?”

হাসিমুখে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল জুবায়ের। লেখা মুখে বিরক্তিকর ভাব ফুঁটিয়ে বলল,

”উনি যেমন মানুষ পছন্দ করেন তেমন ধরন আমি পছন্দ নাও করতে পারি। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে আমি কিছু করতে পারব না।”

”জীবনের সবথেকে বড় সিদ্ধান্তই তো নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিয়েছেন।”

”মানে?”

”একটা মানুষের জীবনের সবথেকে বড় টার্নিং পয়েন্ট হল বিয়ে। বিয়ে নামক বন্ধন থেকেই নতুন জীবনের সূচনা হয়। সেই সূচনা কারো জন্য ভালো কারো জন্য খারাপ হতে পারে। এক্ষেত্রে, তাই মানুষ নিজের পছন্দ বেশি গুরুত্ব দেয়। অথচ, আপনি তো আপনার বাবা পছন্দকে গুরুত্ব দিয়েছেন। নিশ্চয়ই নিজের ভালোর কথা চিন্তা করেই করেছেন।”

লেখা চুপ করে রইল। জুবায়েরের কথাগুলো সত্যি। সে শুনতে পেল,

”আশা করি, আপনি ভবিষ্যতেও নিজের ভালোর কথা চিন্তা করে আমার মায়ের মনের মত হয়ে উঠবেন!”

দমটা অনেক্ক্ষণ আঁটকে রেখে ছাড়ল এখন লেখা।
হুঁট করেই সবকিছু বিরক্ত লাগছে। বিতৃষ্ণা জন্মাচ্ছে জীবনের প্রতি কেমন জানি। জুবায়ের তাড়া দিল এবারে,

”লেখা দ্রুত চলুন। কিছুক্ষণ পর মাগরিবের আজান দিবে। ভুলে যাবেন না আপনি কি কথা দিয়েছেন।”

জুবায়ের থালা আর বাটি সহ ট্রে-টা হাতে তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগোয়। লেখা নিঃশব্দে তাঁর পিছু যায়।
জুবায়ের এমনিই পিছু ঘুরে একবার। সে হকচকিয়ে যায়। তাঁর চোখদুটো গোলগোল হয়ে গেছে প্রতিক্রিয়া সরূপ। সে শুকনো ঢোক গিলে বলে উঠল,

”জুলেখা, আপনি এভাবে নিচে যাবেন?”

লেখা দাঁড়িয়ে গিয়ে নিজের দিকে তাকায়। মুখটা কিঞ্চিৎ বেঁকিয়ে বলে,

”কেন এভাবে গেলে সমস্যা কি? আমি অন্যসময় টি-শার্ট পড়ি আজ তো থ্রি-পিস পড়েছি। লাগেজে কোনো টি-শার্ট পাইনি। কেমন মানুষ আপনারা? একটা টি-শার্টও দেননি। বাসা থেকে নিয়ে আসতে হবে!”

জুবায়ের হতভম্ব। সে দ্রুত পায়ে উল্টো ঘুরে রুমে ঢুকে গেল লেখাকে পাশ কাটিয়ে। এতক্ষণ লেখা আবায়া বিহীন ছিল সে কিছু মনে করেনি। কেন মনে করবে? মেয়েটা তার স্ত্রী। তাই বলে, মেয়েটা নিচেও চলে যাবে এভাবে?

”ভেতরে আসুন।”

জুবায়েরের স্বর কিয়ৎ রাশভারী। লেখা কপালে ভাঁজ ফেলে মৃদুপায়ে কদম ফেলে।

”দ্রুত। এসে ওড়নাটা পড়ে নিন।”

মুখটা চুপসে লাগেজ থেকে ওড়নাটা বের করে নিল লেখা। পড়তে গিয়েই ঝামেলা বাঁধাল সে। এত বড় ওড়না জীবনে কোনোদিন তাঁর কোনো ড্রেসের সঙ্গে ছিল না। সে কোনোক্রমেই সামলাতে পারছে না। রাগ লাগছে জুবায়েরের। সে নিয়ন্ত্রণ করল ক্রোধ। নিজে ওড়নাটা লেখার হাত থেকে নিয়ে নিল। লেখার অবাক চাহনি দেখে সে বলল,

”আমি পড়িয়ে দিচ্ছি!”

লেখা ছেড়ে দিল ওড়নার কোনা। জুবায়ের লেখার মাথায় ওড়না জড়িয়ে দিতে গিয়ে অবাক হল। তাঁর থেকে বেশি বিরক্ত হল সে।

”আপনার চুল ভেজা কেন এখনো জুলেখা? এতবড় হয়েছেন এখনো ঠিকঠাক করে চুল মুছতে পারেন না। তখন নিজেই বললেন চুল ভেঁজা থাকলে সর্দি লেগে যায় অথচ চুলটা মুছেননি।”

জুবায়েরের স্বর একটু রুক্ষ। লেখা ঠোঁট উল্টে বলল,

”আমি কোনোদিন এভাবে তোয়ালে দিয়ে চুল শুকাই নি। সবসময় হেয়ার ড্রায়ার ইউজ করেছি। আপনার ঘরে তো পাইনি।”

জুবায়ের আলমারির দিকে যেতে যেতে দাঁতে দাঁত ঘর্ষণ করে জবাব দিল,

”স্বাভাবিক, আমি ছেলেমানুষ। আমার ঘরে হেয়ার ড্রায়ার থাকবে না।”

”আপনাদের বাড়িতেও নেই।”

ফেরত আসতে আসতে জুবায়ের বলল,

”আছে। বোনদের।”

”নিয়ে আসুন! আমি চুল শুকিয়ে ফেলি।”

নাক ফুলিয়ে জুবায়ের বলল,

”আপনার মাথায় কোনো ঘিলু নেই জুলেখা। বউয়ের চুল শুকানোর জন্য এখন বোনের ঘরে গিয়ে হেয়ার ড্রায়ার আনব।”

”এই আপনি আমার দায়িত্ব নিয়েছেন! আমি অসুস্থ হলে যে আপনি হেলাফেলা করবেন সেটা আমি দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি।”

কথা শেষ হতেই নিজের হাতে টান অনুভব করল লেখা। জুবায়ের তাঁর হাতের কুনুই ধরে টান দিয়েছে।
সে একটু রেগে গিয়ে বলল,

”কি? কি চাই?”

জুবায়ের শান্ত স্বরে বলল,

”চেয়ারটায় বসুন।”

কয়েক হাত দূরে থাকা চেয়ারটা নির্দেশ করে দেখিয়ে দিল সে।

”কেন?”

”বেশি কথা বলেন আপনি! বসতে বলেছি বসুন!”

মৃদু ধমকে কাজ হল। লেখা বসতেই অনুভব করল তাঁর চুলে কিছুর অস্তিত্ব। জুবায়ের আলত হাতে তোয়ালে দিয়ে তাঁর চুল মুছে দিচ্ছে। হৃদকম্পন মিস করল সে। অদ্ভুত শিহরণে তাঁর তনু-মন শিহরিত এই ক্ষণে। সেই ছোটবেলায় শেষবার মা তাঁর চুল মুছে দিয়েছিল। আর আজ জুবায়ের নামক লোকটা। যে কিনা মাত্র কয়েক ঘন্টা ধরে তাঁর স্বামী! তবে, কি বাবার কথাই ঠিক? সে একদিন আফসোস করবে না! আজ প্রথমদিনেই তাঁর আফসোস বোধ কমতে শুরু করেছে। নিজের ভাবনা মূহুর্তে ছিটকে মস্তিষ্ক থেকে ফেলে দিল সে। একদিনেই কাউকে চেনা যায়না। তার ভেতরটা জানা যায়না। কারো ব্যক্তিত্ব বিচার করা যায়না। তবে, জুবায়েরের ব্যক্তিত্বে বিমোহিত না হয়ে থাকা যেকারো পক্ষেই দুঃসাধ্য। লেখা নিজেও চোখ বন্ধ করে মূহুর্তটা উপভোগ করছে। তাঁর সম্মোহন কারো মিহি স্বরের বর্ষণে ছিন্ন হল।

”আপনাদেরকে নিচে যেতে বলেছে আন্টি!”

লেখা চমকিত চাহনিতে সম্মুখে তাকিয়ে। মেয়েটা তো ভারি মিষ্টি। কণ্ঠটাও কেমন মিহি। জুবায়ের আঁখিকে দেখে ভ্রু কিয়ৎ কুঁচকাল। তাঁর চাহনি খরশাণ। প্রথমেই সে জিজ্ঞেস করল,

”সারাদিন কোথায় ছিলি তুই?”

আঁখি চমকে গেল জুবায়েরের আকস্মিক জেরায়। সে একবার মাথা উচিয়ে সামনে তাকাল। জুবায়েরের হাত তখনো তোয়ালে সমেত লেখার চুলে। চাহনি অবনত করে মিনমিনে স্বরে সে জবাব দিল,

”মাদরাসায়!”

”বাড়িতে অনুষ্ঠান ছিল। তাও তোকে কেন মাদরাসায় যেতে হল!”

কিয়ৎপরিমাণে কম্পিত গলায় বলল,

”পরীক্ষা ছিল।”

এতক্ষণে কথা বলল লেখা,

”ও কে?”

আঁখি জবাব দিল না। জুবায়ের একটুক্ষণ চুপ থেকে জবাবে বলল,

”আমাদের বাড়ির একজন সদস্য!”

জ্ঞাতভঙ্গিতে মাথা দোলায় লেখা। মেয়েটা নিশ্চয়ই জুবায়েরের বোন হবে। তাঁর মাথায় নেই আঁখি এসেই তাঁর কথায় জুবায়েরের মা’কে আন্টি সম্বোধন করেছে। সে তো এখনো এই বাড়ির কোনো সদ্যসকেই ঠিকঠাকভাবে চেনে না। তবে, সে এতটুকু বুঝতে পেরেছে জুবায়ের আর তাঁর বাবা ছাড়া এই বাড়িতে আর কেউই তাঁকে মেনে নিতে পারেনি এখনো। নয়ত নতুন বউকে কেন একবারও কেউ দেখতে আসেনি। সে এ বাড়িতে প্রবেশ করার পরপরই এ ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে। জুবায়ের ব্যতীত আর কারো দর্শণ পায়নি সে। হয়ত জুবায়ের-ও পারেনি মন থেকে মেনে নিতে। যতটুকু সে বুঝতে পেরেছে জুবায়ের ভীষণ বাবাভক্ত। বাবার মন রাখতেই কি তাঁকে মেনে নিয়েছে সে? ঠোঁট বটল তীক্ষ্ণ একফালি বিভৎস যন্ত্রণায় সে।

”ভাইয়া দ্রুত আসুন! আন্টি রেগে যাবে।”

আঁখি কথার ফাঁকে বেশ কয়েকবার লেখার দিকে তীর্যকভাবে তাকাচ্ছে। এটাই তাহলে নতুন বউ। সে এমন কেন? শরীরে ওড়না নেই কেন? চুলগুলো তো বেশি বড় মনে হচ্ছে না। সে পুণোরায় তাকায় লেখার দিকে। কেমন দোষগুণ পরোখপূর্ণ চাহনি। জুবায়েরের নজরে পড়ে যায় ব্যপারটা। সে তৎক্ষনাৎ বলে ওঠে,

”না বলে আর এ ঘরে ঢুকবি না!”

আঁখি চমকে উঠল,

”হ্যঁ?”

”আগেও তো সাবধান করেছি, না বলে ঘরে ঢুকবি না।
শোণ, এখন আরো আগে ঢুকবি না। আমি একা নই আমার স্ত্রীও থাকবে এঘরে। মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা জিনিস থাকে। আশা করি, আমাদের প্রাইভেসি লঙ্ঘন হয় এমনকিছু করবি না। জরুরি থাকলে নক করবি। যা তুই। মা’কে বল আমরা আসছি।”

আঁখি একবার জুবায়ের আর জুলেখার দিকে তাকায়। জুবায়ের লেখার মাথায় তখনো তোয়ালে ঘঁষছে। সে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে নিরবে প্রস্থান করে। লেখা ততক্ষণে বুঝতে পারে আর যাই হোক মেয়েটা জুবায়েরের আপন বোন হতে পারে না। লেখার চুল মুছে সরে দাঁড়িয়েছে জুবায়ের। লেখা যেন তড়িৎগতিতে জুবায়েরের মুখোমুখি হয়। তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করে,

”আপনি তখন বললেন কেন মেয়েটা আপনার বাড়ির সদস্য?”

”সদস্যই তো।”

”তাহলে এভাবে কথা বললেন কেন?”

”একমাত্র আঁখিই এমন হুটহাট না বলে কারো ঘরে ঢুকে পরে। ব্যপারটা শোভন দেখায় না। তাঁকেই ডাক দিতে হয়।”

”মেয়েটা কি আপনার বোন?”

”না!”

পরক্ষণেই জুবায়ের বলল,

”বোনের মতই।”

”ওড়নাটা অনেক বড়। পড়তে সাহায্য করুন তো।”

জুবায়ের তোয়ালেটা রেখে ওড়নাটা হাতে নিল। সে নিজেও গোলমাল পাঁকিয়ে ফেলল।

”আচ্ছা, দেখুন তো লাগেজে সেফটিপিন আছে। ওটা দিয়ে সেট করে দিলে পড়বে না আর৷”

লেখাকে নিজের দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জুবায়ের বলল,

”কি সমস্যা? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

”আপনি সেফটিপিন সম্পর্কেও জানেন? মেয়েদের ব্যপারে দেখছি খুব অভিজ্ঞতা আপনার!”

জুবায়ের চোখ দু’টো সংকুচিত করল,

”বেশি কথা বলেন আপনি জুলেখা। তারমধ্যে নব্বই শতাংশই অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা। আপনি লাগেজে দেখবেন না-কি আমিই দেখব?”

”দেখছি, দেখছি।”

অবশেষে ওড়নাটা লেখার মাথায় সুন্দরকরে পেঁচিয়ে দিল জুবায়ের। উশখুশ করছে লেখা। এদিক-ওদিক টানছে ওড়নাটা। অস্বস্তি লাগছে তাঁর।

”এমন করছেন কেন?”

লেখা মুখটা মিইয়ে জবাব দিল,

”কেমন জানি লাগছে!”

”এর আগে কোনোদিন তো এমন করে ওড়না পড়েননি তাই এমন লাগছে!”

”আপনি কি করে জানলেন আমি কোনোদিন এভাবে ওড়না পড়িনি?”

জুবায়ের কপট হেসে বলল,

”জেনেছি। এখন দ্রুত চলুন। মা ডাকাডাকি শুরু করবে আবার।”

লেখা মাথা নাড়ল। সে দরজার দিকে যাবে তখনই জুবায়ের ডাকল,

”দাঁড়ান!”

জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে কৌতূহল নিয়ে পেছনে ঘুরে তাকায় লেখা। জুবায়ের দু’কদম এগিয়ে লেখার মুখোমুখি দাঁড়ায়। সেই মিষ্টি ঘ্রাণটা লেখার নাসাপথে ভেতরে প্রবেশ করে কেমন অন্যরকম একটা উন্মাদনা সৃষ্টি করছে। এতক্ষণ সে উত্তেজনায় খেয়াল করেনি এই ঘ্রাণটার উপস্থিতি। এখন পাচ্ছে। খুব মোহণীয় ঘ্রাণ।
জুবায়েরের মুখে হাসি। সে কোনো সতর্কবার্তাবিহীণ নিজের দু’হাত উঁচিয়ে লেখার দু’ গালে স্থাপণ করে কপালে সন্তর্পণে চুমু খায়। লেখা চোখের পাতা ঝাপটে
হাঁপানি রোগীর মত নিঃশ্বাস বন্ধ করে চোখ মুঁদে। কেন সে জানে না! চোখের পাতা আর ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। প্রথম স্পর্শ। তাঁর স্বামীর থেকে পাওয়ার স্পর্শ। এমন অনবদ্য অনভূতির সঙ্গে পরিচিতি প্রথম।

”চোখ খুলুন!”

জুবায়েরের কণ্ঠস্বর কর্ণকূহরে আবছাভাবে পৌঁছায়।
সে কম্পিত চোখের পাতা ধীরে খুলে। তাঁর ডান হাতটা ততক্ষণে কপালের মাঝ বরাবর স্থান পেয়েছে। বিস্ময় আর আবেগ চোখেমুখে উপচে পড়ছে। চোখ খুলেই সে বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করে বসল,

”এ-এটা কি হয়েছে?”

জুবায়ের স্বাভাবিক। সে মুচকি হাসে। জবাব দেয়,

”শরীয়ত বৈধ সম্পর্ক আমাদের। আপনি আমার স্ত্রী জুলেখা। এই চুম্বন আপনার প্রাপ্য!”

লেখা কোনো শব্দ উচ্চারণ করল না। জুবায়ের তাঁর মুখশ্রীতে নিজের দৃষ্টি নিবন্ধিত করে রেখেছে। ডান হাতটা এখনো লেখার বাম গালে। সেখানে আদুরে স্পর্শের পাশাপাশি সে ফের শুনতে পেল,

”মাশাল্লাহ! বিশ্বাস করুন, ভীষণ সুন্দর লাগছে এখন আপনাকে!”

লেখা কোনো কথা চেয়েও বলতে পারছে না। কেমন ঘোর ঘোর লাগছে। এই লোকটার মধ্যে কি সম্মোহনী গুন আছে নাকি? কে জানে? হয়ত আছে। নয়ত মাত্র কয়েক ঘন্টায় কি করে এই পুরুষ চরিত্রটির সঙ্গে সে খাপ খাইয়ে গেল? জুবায়ের নিজের ডান হাত সরিয়ে নিল লেখার গাল থেকে। লেখা নিষ্পলক চেয়ে চেয়ে দেখল। এই সামান্য দৃশ্যও কেমন ঘোর লাগিয়ে দিচ্ছে।

”আপনি বের হন আমি আসছি!”

লেখা প্রশ্ন চাহনি নিক্ষেপ করে জুবায়েরের দিকে। সে হেসে ট্রে-টার দিকে দেখায়। প্লেট-বাটি এখনো ট্রেতে রাখা। সেদিক থেকে নেত্রদৃষ্টি সরিয়ে এনে জুবায়েরের দিকে চায় সে।

”এগুলো নিয়েই আসছি। রুমে থাকলে আচ্ছামত মায়ের বকা শুনব।”

”একসাথে বেরোই আসুন!”

জুবায়ের হেসে ট্রেটা হাতে নিয়ে লেখার পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে। লেখা আঁড়চোখে তাকায় জুবায়েরের দিকে। সে নিজের কাজে ভীষণ অবাক হয়। কি অদ্ভুত? কোনোদিনও স্বপ্নেও কল্পনা করেনি মাত্র কয়েক ঘন্টায় কোনো পুরুষের এত কাছাকাছি এসে যাবে সে? সে লোকটার কথা শুনছে, মানছে। অথচ দৈবিক ভাবে তেমন কোনো অস্বস্তি ছাড়াই স্বেচ্ছায় ঘটছে ব্যপারটা। কি ভয়ংকর!

___________________________________

®সামিয়া বিনতে আলম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here