অমিশা_ভিলা
#পর্ব_৬
লেখা_ইয়াছিন

সন্ধ্যের পর সময়টা আমার বিরক্তিকর লাগে। এতটাই বিরক্তিকর লাগে যে, আমি মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠি। কখনো এমনও হয়েছে, আমি উঠে গিয়ে দেয়াল ঘড়িটা ছুঁ মেরে নিয়ে এসে সময় বাড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু তাতে কী লাভ? ঘড়ির সময় বাড়িয়ে দিলে সময় চলে যাবে নাকি! তা তো কখনোই সম্ভব নয়। তাই বেজার মুখে বসে থাকি। এ-ছাড়া আমার আর কোনো কাজ নেই। তবে হ্যাঁ, টেলিভিশন দেখা যায়। কিংবা গেম খেলতে পারি। কিন্তু আজকাল সেগুলোতে মন দিতে পারছি না। সারাক্ষণ শুধু একটা ভাবনা মাথায় ঘুরঘুর করে। সেটা হচ্ছে অমিশা, অমিশা আর অমিশা। ঘুরেফিরে ওই একটাই মানুষ। আর তাকে ঘিরে যত রহস্য।

রেবা বেগমের ওখান থেকে চলে আসার পর বসে বসে অপেক্ষা করছিলাম। রাত যখন গভীর হবে, মানে রাত বারোটার পরে আরকি। তখন অমিশা আসবে। প্রথম দিকে মেয়েটাকে খুব ভয় পেতাম। আজকাল মেয়েটাকে আর তার রহস্যগুলোকে বেশ এনজয় করছি। তবে কেন জানি বারবার মনে হচ্ছে, এই রহস্য উদঘাটন করতে গিয়েই আমার মৃত্যু হবে। হয়তো অমিশাই হবে আমার মৃত্যুর কারণ। তবে কেন এসব মনে হচ্ছে তা জানি না। কেবল মনে হচ্ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার এই ভাবনায় একটা কিন্তু থেকে যায়। কিন্তুটা অনেকটা এরকম, মেয়েটা যদি আমাকে মেরেই ফেলবে তবে এতদিন মারলো না কেন? আচ্ছা, মেয়েটা আবার আমার প্রেমে-টেমে পড়েনি তো! ভাবতেই গা রি-রি করে ওঠে। হুহু বাবা! শেষে কিনা ভূত পড়েছে আমার প্রেমে! তবে এমনটা না-ও হতে পারে। হতে পারে অন্য কোনো কারণ আছে যার ফলে অমিশা আমাকে মারছে না। হতে পারে অমিশা আমাকে দিনদিন ক্লু দিচ্ছে। যাতে করে আমি খুনি পর্যন্ত পৌঁছুতে পারি!

আমার একটা পুরনো অভ্যেস আছে। আমার সাথে নতুন কিছু ঘটলে আমি সেটা কাগজে লিখে রাখি। ইদানীং সেটা করা হচ্ছে না। আজ ভেবেছিলাম এই বোরিং সন্ধ্যেবেলা নাহয় সেই কাজটুকু সেরে ফেলি। কিন্তু সেখানেও ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। প্রায় দু’পৃষ্ঠা লিখে ফেলার পর খেয়াল করলাম আমি বারবার একটি কথাই লিখছি। সেটা এরকম, অমিশাকে ভালোবাসি। অমিশাকে ভালোবাসি। অমিশাকে ভালোবাসি।
লেখাগুলো পড়ে নিজে নিজেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। নোট করার কাজ আর এগোল না। অগত্যা লেখাগুলো পুড়িয়ে ফেলে বিছানায় এসে বসেছি সবে। ঠিক তখন খচখচ আওয়াজ শুনতে পেলাম। ব্যাপারটা অদ্ভুত৷ কারণটা বলি।

অমিশা যখন আসে তখন খচখচ শব্দ হয় ঠিক। তবে তা জানালায়; গেটে নয়। আরো কিছু বিষয় আছে। অমিশা আসার আগে আলো নিভে যায়। ঘরের ভেতর ধু-ধু বাতাস বয়৷ ঘরের জিনিসপত্র সব কেঁপে কেঁপে ওঠে। এখন তেমন কিছুই হচ্ছে না। সবচে’ বড়ো কথা হলো, অমিশা আসে রাত বারোটার পর। কিন্তু এখন তো কেবল সন্ধ্যে হলো!

বিছানায় বসে বসে আকাশ পাতাল ভাবছিলাম৷ তখন সাঁই সাঁই করে কয়েকটি গাড়ি বাসার ভেতরে আসার শব্দ শুনতে পেলাম। অদ্ভুত তো! ভূতেরাও কি এবার গাড়ি করে যাতায়াত করছে! টাকা পেল কই? যাহোক, আমি বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে গেলাম। প্রথমে একটা প্রাডো গাড়ি। তার পেছন পেছন আরো চারটি কার। সেগুলোর মডেল আপাতত বলার মতো ধৈর্য নেই। আমি তো ভেবেই অবাক হচ্ছি যে, আজ এতগুলো ভূত একসঙ্গে! তা-ও গাড়ি করে!

প্রাডো গাড়ির ড্রাইভিং সিটে যিনি ছিলেন তিনিই প্রথমে নামলেন। ভূত কি না তা তো জানি না। কারণ অমিশাকে তো মানুষের মতোই মনে হয়। সে-ও তো ভূত। যাহোক, আরো যা দেখলাম। প্রাডো গাড়ির ড্রাইভার নেমে দরজা খুলে দিতেই এক লোক নামল। লোকটা বেশ লম্বা। পরনে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি, পাজামা। তিনি গাড়ি থেকে নেমে হাতের মোবাইলগুলো ড্রাইভারের হাতে ধরিয়ে দিলেন। এরপর এগিয়ে আসতে লাগলেন।

ভদ্রলোক মানে সাদা পাজামা, পাঞ্জাবি পরা লোকটা এগিয়ে আসছিলেন। পেছন পেছন তার ড্রাইভার। বাকি গাড়িগুলো থেকে কেউ বাইরে বেরোয়নি। ভদ্রলোক থমকে দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় ড্রাইভারকে থামিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার পেছন ফিরে গাড়িতে গিয়ে বসল। ভদ্রলোক আবার চলতে শুরু করলেন। কয়েক সেকেন্ড পর টিংটং শব্দ করে কলিং বেল বেজে উঠল। মনে হলো এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠেছে বাড়িটা। চারপাশ এতটাই নির্জন যে, আমি চটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম তার শব্দ খুব স্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছিল। দরজা খুলতেই ভদ্রলোক আমায় বললেন, “সালাম। আমি একজন পথিক। পানির পিপাসা পেয়েছে। এক গ্লাস পানি এনে দিলে বড়ো উপকার হত।”

“আসুন আসুন।” বলে ভেতরে আমন্ত্রণ জানালাম। ভদ্রলোক পায়ের চামড়ার স্যান্ডেল বাইরে রেখেই ভেতরে পা রাখলেন। আমি বললাম জুতো নিয়ে আসতে। তিনি শুনলেন না। তাকে সোফায় বসিয়ে এক গেলাস পানি নিয়ে হাজির হলাম। তিনি পানির গেলাস হাতে নিলেন ঠিকই তবে একফোঁটা পানিও মুখে দিলেন না। গেলাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে আমায় প্রশ্ন করলেন, “তা আপনি জার্নালিস্ট?”

আমি বললাম, “না তো!”

“তবে নিশ্চয়ই ডিটেকটিভ?”

তখনও বললাম, না। আমি ডিটেকটিভ নই। ভদ্রলোক আমার মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে বললেন, “তা হলে? কী করেন আপনি?”

আমি হেসে জবাব দিলাম, “ক্যানাডায় আমার একটা রেস্তোরাঁ আছে। সেটা চালাই। এর বাইরে কিছুই না।”

“ক্যানাডায় রেস্তোরাঁ! বেশ তো! তা দেশে এলেন কেন?” ভদ্রলোক একটা সিগারেট মুখে নিয়ে সেটাতে আগুন দিতে দিতে বললেন।

“জি, আসতাম না। একটা বিপদে পড়ে এসেছি। আমার এক টুকরো জমিতে কে বা কারা যেন কব্জা করেছে। সেটা আমার মায়ের কাবিনের জায়গা। মায়ের শেষ স্মৃতি। সেই স্মৃতিটুকু আঁকড়ে ধরার জন্যই এসেছি।”

তিনি আনমনে ধোঁয়া ফুঁকতে ফুঁকতে বললেন, “তা সমাধান কিছু হলো?”

“না, হয়নি।” আমি বললাম।

“চিন্তা করবেন না। সেই সমাধানটুকু আমি করে দেব। কাল সকালের মধ্যেই আপনার জমি খালি হয়ে যাবে।”

আমি কৃতজ্ঞতা স্বরুপ বললাম, “আপনি করবেন! ক-কিন্তু কেন? এক গ্লাস পানির বিনিময়ে এত বড়ো সাহায্য! কে আপনি বলুন তো?”

তিনি মৃদু হাসলেন। বললেন, “আমি বেকার মানুষ। একসময় পুলিশে ছিলাম। রিটায়ার করেছি বেশ কিছুদিন হলো। এখন হাতে কাজ নেই বলে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াই। কেউ কোনো রকম অসুবিধায় পড়লে তাকে সাহায্য করি। আপনার হেল্পটুকুও আমি করতে চাই। তবে আপনি সেটা হেল্প বলে ভাববেন না। আপনি আমাকে পানি দিয়েছেন তার বিনিময়ে নাহয়…” কিছুক্ষণ ধোঁয়া টেনে বললেন, “আমি চাই কালই আপনি এখান থেকে চলে যান।”

শেষের কথাটা তিনি একটু জোর দিয়ে বললেন। মনে হলো তিনি আমাকে ধমকাচ্ছেন। আমি ইতস্তত করে বললাম, “আমি কালই যাচ্ছি না। এখানে আরো কিছু কাজ আছে। সেগুলো সেরে তারপর যাব।”

তিনি মুখ তুলে তাকালেন। বললেন, “ভূতের ব্যাপারটা তো?”

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “হ্যাঁ, আপনি জানলেন কীভাবে?”

তিনি এস্ট্রে না পেয়ে সিগারেটের উচ্ছিষ্ট অংশ পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দিলেন। আরো একটা সিগারেট মুখে দিয়ে বললেন, “দেখুন মিস্টার আরজু।” একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বললেন, “ভূত-প্রেত বলতে কিছুই নেই। ওসব গুজব। এখানকার মানুষ খুব বোকা স্বভাবের। সেই সঙ্গে ভীতুও। এরা তিলকে তাল বানাতে একটুও ভাবে না। আর কোথাও একটু রহস্যের গন্ধ পেলে তো..” এটুকু বলে থেমে বললেন, “থাক, বাদ দিন। আপনার প্রভলেম আমি সলভ্ করে দিচ্ছি। আপনি কাল চলে যাচ্ছেন।”

আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “না না, কাল তো কোনো মতেই না। আমি আরো কয়েকদিন থাকব এখানে।”

তিনি লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, “আমি বেশি কথা পছন্দ করি না। কাল আমার লোকজন আসবে আপনাকে বিদায় জানাতে। ভালো থাকবেন। হ্যাপি জার্নি।”

ভদ্রলোক প্রস্থান করলেন। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলাম। চোখের পলকে সাঁইসাঁই করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল গাড়িগুলো। দরজা বন্ধ করে ভদ্রলোকের না খাওয়া পানিটুকু নিমিষেই গলায় ঢেলে দিলাম। কিছু বিষয় ঠিক মেলাতে পারছি না। লোকটা আমার সম্পর্কে এতকিছু জানে কীভবে? আমার নাম পর্যন্ত! তা ছাড়া আমি এ-বাড়িতে থাকলে তার সমস্যা কোথায়? আকাশ পাতাল ভেবেও কুল কিনারা পাচ্ছি না। আমার সামনে এখন দু’টো পথ। এক. অমিশা ভিলা’র কথা ভুলে গিয়ে ভালোয় ভালোয় ক্যানাডা চলে যাওয়া। আর দুই. নিজের জীবন বাজি রেখে অমিশা ভিলা’র সকল রহস্য উদঘাটন করা।

রাত বেড়েই চলেছে। এ-বাড়ির নির্জনতা কাঁটার মতো বিঁধছে গায়ে। আমি ভেবেই পাচ্ছি না, ক্যানাডার উন্নত জীবন রেখে এখানে কেন পড়ে আছি আমি? তা-ও যার জন্য পড়ে আছি তাকে ঠিকমতো জানিও না! এসব ভাবতে ভাবতে ব্যাগ গুছাচ্ছিলাম। দেয়াল ঘড়িটা ডংডং করে বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে চোখ তুলে তাকালাম। রাত বারোটা এক মিনিট। ঘরের ভেতর ধু-ধু হাওয়া বইছে। আসবাবপত্রগুলো থরথর করে কাঁপছে। কাচের জানালায় খচখচ শব্দ হচ্ছে। জানালায় উঁকি দিতেই চোখে পড়ল, অন্ধকারে কে যেন পা টেনে টেনে এগিয়ে আসছে। এখন বিদ্যুৎ নেই।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here