অমিশা ভিলা
#পর্ব_২
লেখা_ইয়াছিন

অন্ধকারে বসে থাকা মেয়েটাকে দেখে আমার সারা শরীরের লোম কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে গেল। ভেতর শুকিয়ে কাঠ। হাত পা থরথর করে কাঁপছিল। চোখ বড়োবড়ো করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, এই বুঝি সেই আতঙ্ক যার কথা লোকে মুখে বলতেও ভয় পায়! এই বুঝি সেই আতঙ্ক যার নাম শুনলেই লোকে ভয়ে আঁতকে উঠে!

হাতের কাছে সুইচবোর্ড ছিল। সুইচ টিপতে যাব ঠিক তখন মেয়েটা চেঁচিয়ে উঠল, “খবরদার! আলো জ্বালাবেন না! আলো আমার সহ্য হয় না। আমি অন্ধকার ভালোবাসি। ঘন অন্ধকার।” বলে নাক দিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস নিল মেয়েটা। নিচু আওয়াজে বলল, “আমাকে অন্ধকারেই থাকতে দিন।”

আমি আর সুইচে হাত দেওয়ার সাহস পেলাম না। তখন কোথা থেকে যেন ধু-ধু বাতাস জানালা ভেদ করে ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে শুরু করল। আমি অন্ধকারে স্পষ্ট দেখেছি, টেবিলের উপর থাকা পানির গ্লাস, জগ, ওয়াড্রোবের উপর থাকা ফুলদানি সবকিছু থরথর করে কাঁপছে। বাইরে থেকে আসা তীব্র হাওয়ায় জানালার পরদা উড়ে উড়ে দূরে যাচ্ছে আবার জানালায় বারি খাচ্ছে। আমি ঢুক গিলে আমতা আমতা করে বললাম, “আ-আপনি এত রাতে এখানে কী করতে এসেছেন?”

মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল। পুরো ঘর অন্ধকার হলেও মেয়েটার ঠোঁট ফাঁক করে বেরিয়ে আসা পরিষ্কার ঝকঝকে দাঁত আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা তার টলটলে চোখজোড়া আমার দৃষ্টি কেড়ে নিল। এক মুহূর্তের জন্য আমি বিভোর হয়ে তাকিয়ে রইলাম মেয়েটার দিকে। পরে মনে হলো, ঠিক এভাবেই বুঝি মেয়েটা মানুষকে নিজের বশে আনে! তারপর মনের আনন্দে বশ করা সেই মানুষটার সর্বনাশ করে! এর আগে ক’জনকে খুন করেছে সে? আমার সাথেই বা কী হতে চলেছে? মেয়েটা কি ধীরে ধীরে আমাকেও বশ করে ফেলবে? কিন্তু এরপর?

“আমার বাসায় এসে আমাকেই বলছেন কী করতে এসেছি?” মেয়েটা বিগলিত হেসে নিচু আওয়াজে বলল। আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। মেয়েটা আবার বলল, “বাসার গেটে নাম ফলকে কী লেখা আছে দেখেননি? অমিশা ভিলা। পড়েননি সেটা?”

প্রশ্ন করে মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি প্রশ্নটা কানে নেইনি। সাড়াও দেইনি। উল্টো ফাঁদ পেতে দাঁড়িয়ে রইলাম। মেয়েটা দৃষ্টি সরালেই আলো জ্বালিয়ে দেব। সে নিজেই বলেছে আলো তার সহ্য হয় না। তার মানে আলো জ্বালালে সে চলে যাবে। এই এক বুদ্ধি মাথায় আসায় আমি বেশ খুশিই হয়েছিলাম। কিন্তু অনেক্ষণ হয়ে গেল মেয়েটা নড়ছে না। দৃষ্টিও সরাচ্ছে না। এমনকি চোখের পাতাও ফেলছে না। আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, যত সময় যাচ্ছে মেয়েটার চোখ ততই উজ্জ্বল হয়ে যাচ্ছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে সে হিংস্র থেকে আরো হিংস্রতর হচ্ছে না তো! পরক্ষণেই মনে হলো, আরে! আমি যেভাবে ফাঁদ পেতে দাঁড়িয়ে আছি। মানে মেয়েটা চোখ সরালেই খপ করে আলো জ্বালিয়ে দেব। ঠিক তেমনিভাবে মেয়েটাও কোনোরকম ফাঁদ পেতে নেই তো? সে-ও কি আমারই মতো সুযোগের অপেক্ষা করছে? চোখ সরালেই উড়ে এসে গলা চেপে ধরবে?

এই ভয়ঙ্কর মুহূর্তে মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। পা ছুঁড়ে পায়ের জুতো একটু দূরে ফেলে দিলাম৷ যা ভেবেছিলাম তা-ই হলো। মেয়েটা সেই উড়ন্ত জুতোর দিকেই তাকাল। সেই সুযোগে আমি সুইচ টিপে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ আলোকিত হয়ে গেল। কিন্তু একি! বিছানায় বসে থাকা মেয়েটা? মেয়েটা কোথায় গেল?

পুরো ঘর খুঁজেও যখন মেয়েটাকে পেলাম না তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঢুকঢুক করে পানি খেয়ে শুতে যাব ঠিক তখন মনে হলো, জানালার পরদাটা অস্বাভাবিকভাবে নড়ছে। কাচের স্লাইড উইন্ডো কে যেন জোর করে বাইরে থেকে খোলার চেষ্টা করছে। সেই সঙ্গে জানালার ওখান থেকে কেমন যেন খচখচ আওয়াজ আসছে। আমি ভয়ে ভয়ে এগোলাম। জানালার পরদার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি বাইরে কিছুটা দূরে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। তবে মানুষটা খুঁড়িয়ে চলছে। এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। আমার কপাল বেয়ে এক ফোঁটা ঘাম মেঝেতে পড়ল। বাড়িটা এতটাই নিঃস্তব্ধ যে, আমি বোধহয় সেই ঘামের ফোঁটা পড়ার “টুপ” শব্দটাও শুনতে পেলাম। দূরে কোথাও বিকট আওয়াজ হলো। ট্রান্সমিটারের গন্ডগোল বোধহয়। বিদ্যুৎ চলে গেল। আমার গায়ে ধাক্কার মতো লাগল। সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে বসে পড়লাম। মেয়েটা। সেই মেয়েটার ছায়া আবারো বিছানার উপর ভেসে উঠল। মেয়েটা রুষ্ট গলায় বলল, “আলো জ্বালাতে মানা করেছিলাম না? আপনি এত অবাধ্য কেন মিস্টার আরজু?”

আমি বাঁ হাতের পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললাম, “এটা আপনার বাসা তা আগে জানতাম না। জানলে কখনো এ-বাড়িতে আসতাম না। আমাকে মারবেন না প্লিজ। আমি কাল সকালেই এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। আপনি বললে এই দেশ ছেড়েই চলে যাব। ক্যানাডায় পাড়ি জমাব চিরতরে। আর কখনো এ-দেশে ফিরব না। কক্ষনো না।”

মেয়েটা এবার ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নামল। পা টেনে টেনে এগিয়ে এসে বাঁ হাত দিয়ে আমার ঘাড়ে আলতো চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, “আমাকে মনে পড়ে?”

এরপর আমার কী হলো জানি না, কেবল এতটুকু মনে আছে, আমি বাধ্য শিশুর মতো কোমল গলায় বললাম, “মনে পড়ার কথা বুঝি? কে আপনি বলুন তো?”

ঠিক তখন চারপাশ থেকে ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে এল। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার পুরো শরীর ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেল। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে ঢলে পড়লাম।

জ্ঞান হারানোর আগে ভেবে রেখেছিলাম যদি কোনোভাবে মেয়েটার হাত থেকে বেঁচে ফিরতে পারি, যদি এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারি তবে কাল ভোর হতেই এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। এরপর যত দ্রুত সম্ভব চলে যাব ক্যানাডায়। মা’র সম্পত্তি যাচ্ছে যাক। প্রাণের চেয়ে স্মৃতি কখনোই বড়ো হতে পারে না। নিজে বেঁচে থাকলে তবেই তো স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরা যাবে!

জ্ঞান ফিরতেই ঘাড়ে, মাথায় টনটনে ব্যথা অনুভব করলাম। আমার পুরো শরীর মেঝেতে পড়ে আছে। মাথাটা দেয়ালের সাথে বাঁকা হয়ে হেলান দেওয়া। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে অনেকটা কষ্ট পোহাতে হলো। সারা শরীর ব্যথা করছে। বিশেষ করে মাথার পেছন দিকটা। অজ্ঞান হয়ে যখন পড়ে গিয়েছিলাম তখন বোধহয় মাথাটা সরাসরি দেয়ালের উপর পড়েছিল।

একি!
চারদিকটা ভালো করে তাকিয়ে দেখে ভেতরটা শুকিয়ে গেল। ঘরটা বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় আলোকিত। তবে কাচের জানালার বাইরে ঘন অন্ধকার। দেয়াল ঘড়িতে এগারোটা বেজে উনষাট মিনিট। রাত এগারোটা! কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম আমি? দ্রুত ছুটে গিয়ে বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করে দেখি তারিখ দেখাচ্ছে ১৩ই সেপ্টেম্বর। তার মানে একটানা বিশ ঘন্টা অজ্ঞান ছিলাম আমি!

ডংডং শব্দ করে দেয়াল ঘড়ি বেজে উঠল। সময় রাত ১২টা। দেয়াল ঘড়িটা বেজে উঠার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চলে গেল। অন্ধকারে ঢেকে গেল চারপাশ। দরজা-জানালা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও এক পশলা হিম শীতল হাওয়া আমার পুরো শরীর ছুঁয়ে গেল। সেই হাওয়া বয়ে চলার শা-শা শব্দের মতো আরো একটা শব্দ শুনতে পেলাম। সেই দারোয়ানের গলার আওয়াজ। “রাইতে সাবধানে থাইকেন।”

শত চেষ্টা করেও ফোনের আলো জ্বালাতে পারলাম না। ফোনটা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেছে। পাওয়ার বাটন চেপে রাখার পরও খুলছে না। লাইটারটাও খুঁজে পাচ্ছি না কোথাও। এ-কেমন গোলকধাঁধায় আটকা পড়লাম আমি!
অন্ধকারে মৃদু হাওয়া যেন আমার কানেকানে বলে গেল, “সে আসছে। হাওয়ার বেগে ছুটে আসছে সে।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here