অমিশা ভিলা |
#পর্ব_১১_ও_১২
লেখক_মো_ইয়াছিন

দিজা কলকাতার মেয়ে। আমার সাথে ক্যানাডায় পরিচয়। ক্যানাডার অন্টারিও। আমার অতি পছন্দের একটি জায়গা। তবে সেখানে কখনো যাওয়া হয়নি। ছবিতেই দেখেছি কেবল। যদিও চাইলেই যাওয়া যেত। আদতে আমি একটু অলস প্রকৃতির লোক। বাসা থেকে বেরিয়ে রেস্তোরাঁয় যাওয়া আবার রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে সোজা বাসায়। এর বাইরেও যে একটা পৃথিবী আছে তা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। তো একদিন সময় হলো অন্টারিও যাওয়ার। উঁহু, তখনও স্বেচ্ছায় নয়। এক জরুরি কাজে যেতে হচ্ছিল। সেখানেই দেখা হলো দিজার সাথে। দিনটার কথা আজও মনে পড়ে। দৃশ্যটা আজও চোখের সামনে স্মৃতি হয়ে ভাসে। সে-এক অসম্ভব সুখকর স্মৃতি বটে! তবে তা আজ আপনাদের বলছি না। স্মৃতিকথা বলে বলে আপনাদেরকে বিরক্ত করার কোনো রকম ইচ্ছে আজ নেই। যদি কখনো সময় হয় তো পরে বলব।

এবার আসল কথাটা বলি।
এ-যাবৎ যত রকমের ভয়ঙ্কর ঘটনা আমার বা আমাদের সাথে ঘটেছে সে-সব মনে করলে যা নজরে আসে তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাত বারোটা। সেই সময়টাই সবচে’ ভয়ঙ্কর, সবচে’ ভীতিকর। এ-যাবৎ আমরা এটাই জেনেছি যে, রাত বারোটার পর ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যেতে পারে। তবে আজকের ঘটনা একটু আলাদা। এবং একটু অন্যরকম। শুধু গভীর রাতে নয়, দিনের আলোতেও যে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে তা আজকের দিনটা শিক্ষা দেবে আমাদের।

যাহোক, ভোরবেলা অমিশা ভিলা ছেড়ে পালাতে অনেকটা বেগ পেতে হলো। দিজাকে বলে কয়ে, আদর আহ্লাদ করে, বুঝিয়ে সুঝিয়ে তবেই একটুখানি বাগে আনা গেছে। তা-ও পুরোপুরি বাগে আনতে পারিনি। তার একটাই কথা, আমরা এর শেষ দেখে যাব। শত হোক, একদিন না একদিন তো সত্যের জয় হবেই! একদিন না একদিন তো অমিশার ধর্ষক এবং খুনিরা তাদের শাস্তি পাবেই। তবে এসব যে কেবল মুখের কথা, বাস্তব অনেক কঠিন সে-ব্যাপারে দিজা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। যদিও আমি কয়েকবার বোঝাতে চেয়েছি। তবে সফল হইনি। পুনঃপুন ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ হাঁফ ছেড়ে বলেছি, “আচ্ছা, তোমার কথাই হবে। আমরা এর শেষ না দেখে কোত্থাও যাব না।”

আমার ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে দিজার লাগেজ টানতে টানতে যখন অমিশা ভিলা থেকে বেরিয়ে এলাম তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। ঘড়িতে বোধহয় নয়টা বাজে তখন। বাইরে পাহারারত লোকগুলোর কয়েকজন চায়ের দোকানের ব্রেঞ্চে বসে ধোঁয়া উড়তে থাকা গরম চায়ের উষ্ণ স্বাদ নিচ্ছিল। বাকি যে দু’জন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বাড়ি পাহারা দিচ্ছিল তাদের অবস্থা খুব একটা ভালো না। সারা রাত জেগে জেগে পাহারা দিয়েছে। চোখগুলো ছোটো ছোটো হয়ে একদম ভেতরে চলে গেছে। তবুও কোনোমতে চোখের পাতা আলগা করে রেখেছিল। আমরা গেটে বাইরে পা রাখতেই পুরোপুরি সজাগ হয়ে গেল। খেয়াল করলাম, চায়ের দোকানে বসে থাকা বাকি লোকগুলোও ধড়াম করে উঠে দাঁড়াল। তবে এদিকে তাকানোর খুব একটা আগ্রহ দেখাল না। যাতে আমাদের সন্দেহ না হয়।

একটু দূর এসে লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়লাম। যাক বাবা! অন্তত ওই বাড়াটে গুন্ডাদের নজর থেকে সরতে পেরেছি! কিন্তু খানিক বাদেই আমার ধারণা মিথ্যে প্রমাণিত হলো। খেয়াল করলাম, একটা লোক কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে আমাদের ফলো করছে। নাহ্, একটা নয়, দু’টো লোক। আরো বেশি হতে পারে। কী একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ! এদিকে ব্যাগ বইতে বইতে আর লাগেজ টানতে টানতে হাঁফ ধরে যাচ্ছে। দিজা আসক্তিহীনভাবে হাঁটছে। তার দু’চোখে এখনও ঘুম। সম্ভাব্য বিপদ এখনও আঁচ করতে পারেনি সে।

দিজা হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

আমি প্রশ্ন এড়িয়ে বললাম, “আমার হাতটা ধরো তো।” বলতেই দিজা ভ্রু কুঁচকাল। একটু পর এক চিলতে আহ্লাদী হাসি ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে। সে খুবই আনন্দের সাথে গায়ের সাথে গা মিশিয়ে আমার বাঁ হাত ঝাপটে ধরল। মাঝে মাঝে আহ্লাদী দৃষ্টি উঁচু করে আমার চোখের দিকে পিটপিট করে তাকাতে লাগল। আমি তখনও আড়ালে আবডালে পেছনের লোকগুলোকে লক্ষ্য করছি। আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় ডুবে গিয়ে দিজার পাশাপাশি হাঁটছি আর ভাবছি, আর কতক্ষণ এই পথ চলা? আর কতদূর পর্যন্ত চলবে এই উদ্দেশ্যহীন হাঁটা?

জানা নেই। তবে এতক্ষণ পেছনের লোকগুলোর দৃষ্টির আড়ালে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু এভাবে বিপদ সঙ্গে নিয়ে চলা কখনোই ভালো হতে পারে না। যার ফলে হাঁটাহাঁটির অবসান ঘটিয়ে বাঁ দিকের বাড়িটায় ডোরবেল বাজালাম। উপস্থিত আমাদেরকে দেখে বিস্ময়ে রেবা বেগমের চোখদু’টো চঞ্চল হয়ে উঠল। তিনি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। কাঁপা গলায় বললেন, “আ-আপনি!”

আজও রেবা বেগমের চুল ভেজা। ভেজা চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি টপটপ করে পড়ছে। শ্যাম্পুর ঘ্রাণে ভরে গেছে চারপাশ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তিনি এইমাত্র প্রাতস্নান শেষ করে বেরিয়েছেন। তাহলে কি সেই লোক অর্থাৎ অমিশার সৎ বাবা মোতালেব আজ রেবা বেগমের কাছে এসেছেন? প্রশ্নটা আমাকে ভাবিয়ে তুলল বটে। তবে আমি অতোটা গুরুত্ব না দিয়ে রেবা বেগমের দিকে চোখ বুলালাম। তার গায়ের কাপড় এলোমেলো করে পেঁচানো। যতটা বুঝতে পারছি, তিনি বোধহয় শাড়ি পড়তে ব্যস্ত ছিলেন। আর তখনই ডোরবেল বাজিয়েছি। যার ফলে তিনি শাড়িটা দ্রুত গায়ে পেঁচিয়ে দরজা খুলে দিয়েছেন।

আমাদেরকে বসার ঘরে রেখে কিছুটা সময়ের জন্য আড়ালে গেলেন রেবা বেগম। একটু আলগা সময় পেয়ে দিজা আমাকে প্রশ্ন করে ফেলল, “কে ইনি?”

“ইনি রেবা বেগম। অমিশার সৎ বাবার অবৈধ প্রেমিকা।”

“অবৈধ প্রেমিকা?” বলে ভ্রু কুঁচকাল দিজা। আমি আলতো হেসে বললাম, “বুঝলে না তো? বেচারা প্রেম করবে, ভালোবাসবে, রাতে একসাথে শুবে অথচ বিয়ে করবে না। তাই বললাম। তাছাড়া বিয়ের আগে সব প্রেমিকাই তো অবৈধ তাই না?”

দিজা সোফায় বসে থাকা অবস্থায় আমার কাঁধে মাথা রেখে বলল, “তুমিও না! সহজভাবে বললেই পারতে ইনি মোতালেব সাহেবের গার্লফ্রেন্ড।”

“পাকামো করো না তো! সরে বোসো। যেকোনো সময় উনি চলে আসবেন।”

দিজা আমার নাকের ডগায় আঙুল রেখে বলল, “তো? আসতে দাও। দেখুক এসে। আমি তো আর অবৈধ প্রেমিকা নই। আমি তোমার বিয়ে করা বৈধ প্রেমিকা। বুঝলে মিস্টার?”

“আরে! কী করছো তুমি! শার্টের বোতামে হাত দিচ্ছো কেন! আরে! খুলে যাচ্ছে তো!”

দিজা আনমনে আমার শার্টের বোতাম খুলছে আর লাগাচ্ছে। আমার বারণ শুনে বলল, “আমার যা ইচ্ছে করবো তোমার কী?”

“সব সময় বাচ্চামো ভালো লাগে না দিজা।”

“আমার লাগে।” বলে আমার চোখের দিকে তাকাল দিজা। বলল, “আসার পর থেকে এখন অবধি একটিবার আমার দিকে ভালো করে তাকিয়েছো? একটিবারের জন্য জিজ্ঞেস করেছো এতটা পথ পাড়ি দিয়ে হুট করে কেন এসেছি?”

আমি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললাম, “কেন এসেছো?”

দিজা আমর হাত টেনে নিয়ে তার পেটের উপর আস্তে করে চেপে ধরে বলল, “টের পাও?”

মুহূর্তেই আমার ভেতর কতটা কেঁপে উঠল, আমি কতটা বিস্মিত হয়ে দিজার দিকে তাকালাম তা আপনাদের বলতে পারব না। বিপদের অতি সন্নিকটে দাঁড়িয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে রুদ্ধশ্বাসে বসে থাকা আমি ঠিক কতটা স্বস্তি পেয়েছি তা-ও লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে এতটুকু বলি, তখন অজান্তেই আমার চোখে জল চলে এল। আমি দিজার গাল ছুঁয়ে তার চোখ বরাবর দৃষ্টি রেখে বললাম, “সত্যি?”

দিজা তখন মিটিমিটি হাসছে। আমার প্রশ্ন শুনে কোনোরকম হাসি থামিয়ে বলল, “এমনভাবে বলছো মনে হচ্ছে আগে থেকেই জানো তুমি কখনো বাবা হতে পারবে না অথচ আমি তোমাকে সেই অসম্ভব সংবাদটাই দিচ্ছি।”

সঙ্গে সঙ্গে দিজার মুখ চেপে ধরে বললাম, “ফাজিল! চুপ!”

দিজা টিপ্পনী কেটে বলল, “কেন, লজ্জা লাগছে? ইশ! কী লজ্জা রে বাবা! একদম লাল টম্যাটো! হিঃ হি!”

দিজা তখন খুনসুটিতে মত্ত। আমিও কিছুটা সময়ের জন্য সব বিপদ-আপদের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে দিজার সঙ্গ দিচ্ছিলাম। হঠাৎ রেবা বেগমের আগমন আমাদের দু’জনকেই সতর্ক করে দিলো। দিজা একটু দূরে সরে বসল। রেবা বেগম ততক্ষণে পরনের শাড়িটা ঠিক করে নিয়েছেন। তিনি দু’কাপ চা এনে দিলেন। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। যার ফলে খিদেয় পেট চুঁ-চুঁ করছে। তাই চা’টা হাতে নেব ভাবছিলাম। কিন্তু তার আগেই দিজা এমন কান্ড করে বসল যে, আমার চায়ের নেশা সেখানেই দফারফা হয়ে গেল।

রেবা বেগম দু’কাপ চা টি-টেবিলে রেখে শাড়ির আঁচল গুটিয়ে সোফায় বসেছেন মাত্র। দিজা কোনোকিছু না ভেবেই বলে ফেলল, “আপনার বয়ফ্রেন্ড একটা খুনি। জানেন সেটা?”

রেবা বেগম হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। দিজা আবারো বলল, “আপনার বয়ফ্রেন্ড লোভে পড়ে তার নিজের মেয়েকে ধর্ষণ করতে সহযোগিতা করেছে। তারপর নিজ হাতে মেয়েটাকে হত্যা করেছে। একটা মানুষ কতটা জঘন্য হলে এমন কাজ করে বলতে পারেন?”

রেবা বেগম তখনও চুপ। আমি হতবাক হয়ে দিজার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। ভেবেছিলাম এখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে একটা বুদ্ধি বের করে বাইরের লোকগুলোর চোখ ফাঁকি দিয়ে পালাব। কিন্তু দিজা এক নিমিষেই তাতে পানি ঢেলে দিলো। হঠাৎ আড়াল থেকে বেরিয়ে এল লোকটা। মানে মোতালেব, অমিশার সৎ বাবা। সে এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “অনেক কিছু জানেন দেখছি আপনারা! বেশ ভালোরকমভাবে স্পাইং করেছেন বলতে হয়। অথচ এর আগে বারবার মানা করা হয়েছে।” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কী আর করার? এবার যা হবার তা-ই হবে।”

এরপর কতগুলো লোক একসঙ্গে ছুটে এল। একজন আমার কপাল বরাবর পিস্তল তাক করে বলল, “নড়বি না। নড়বি না শালা। একদম গুলি করে দেব।” আমার কলার ধরে হেঁচকা টান দিয়ে বলল, “বলেছিলাম আমি মুখে কথা বলি না। আমি বলি বুলেট দিয়ে। শুনলি না তো আমার কথা? এবার বুঝবি।” বলে দাঁত কটমট করতে লাগল।

এরপর আমার বুকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিলো। আর তারপর দিজার গালে এত জোরে চড় মারল যে দিজা চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আমি তাকে ধরতে যাওয়ার আগেই দু’টো লোক এসে আমাকে শক্ত করে ধরে ফেলল। এরপর আরো একটা লাথি আমার বুকে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল মুহূর্তেই। চোখদু’টো ঝাপসা হতে হতে একসময় চোখের সামনের সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। আমি ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে গেলাম। লোকটা দিজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে…

#পর্ব_১২

রাতে অন্ধকার আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতে দেখেছেন কখনো?
এক ঝটকায় চারপাশ আলোকিত হয়ে আবার অন্ধকার। ঠিক তেমনি কিছু একটা দেখে জ্ঞান ফিরল। হাত-পা বাঁধা থাকায় নড়াচড়া করতে না পেরে অবশেষে শুধু মাথা নাড়িয়ে যতদূর দেখা যায় দেখে নিলাম।
বিশাল বড়ো ঘরের মতো। মাথার উপর ঢেউটিন। চারপাশ খালি। মনে হচ্ছে বিশাল বড়ো গাড়ির গ্যারেজ। আপাতত গাড়ি নেই। কয়েকজন মানুষ আছে। এই লোকগুলোই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আচ্ছা, ওরা আমার সাথে কিছু করে-টরেনি তো?

ঘাড় ঘুরিয়ে, বাঁকিয়ে, উঁচু-নিচু করে যতটুকু দেখলাম, আমার গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। হাত, পায়ের আঙুলগুলো ভালো করে দেখে নিলাম। সিনেমায় দেখেছি এমন কেসে কিডন্যাপাররটা হাত-পায়ের আঙুল কেটে টর্চার করতে সবচে’ বেশি আনন্দ লাভ করে। সে যা-ই হোক, আঙুলগুলোও ঠিকঠাক আছে দেখে বেশ স্বস্তি পেলাম। কিন্তু যখনই দিজার কথা মনে পড়ল তখন আমার ভেতরটা শূন্য হয়ে গেল। চারপাশটা ভালো করে দেখে নিয়ে যা বুঝলাম, দিজা এখানটায় নেই। তা হলে? কোথায় রাখা হয়েছে তাকে? ওঁর সাথে আবার…

ঘেন্নায় গা ঘিনঘিন করে উঠল আমার। ছিঃ! এরা পুরুষ? সত্যিকারের পুরুষ কখনো মেয়েদের সাথে অন্যায় অবিচার করতে পারে? অবশ্য এদের জন্য মেয়ে যা ছেলেও তা। এরা যেকোনো সময় যে কারোর সাথে যা খুশি করে ফেলতে পারে। তাই ভয়ে ভয়ে আরো একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম। নাঃ, কোথাও তো নেই! পেছনের দিকটা দেখে নিয়ে সামনে ফিরে তাকিয়েছি কেবল, একটা লোক পুরো এক বালতি পানি আমার দিকে ছুঁড়ে মারল। কিছু বুঝতে পারার আগেই চেয়ার সহ মাটিতে পড়ে গেলাম। আবার আমাকে টেনে তুলে বসাল।

আমি তখন হাপাচ্ছি। যে লোকটা আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে সে-ই আমার বুকে লাথি মেরেছিল। পরপর দু’টি। আর তাতেই আমার অবস্থা খারাপ। যাকে বলে একেবারে হালুয়া টাইট। আমি ভেবেই অবাক হচ্ছি যে, এই লোকটার গায়ে এত শক্তি! হাতি একটা! সেই হাতিটাই, ইয়ে মানে লোকটাই আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে বাকি লোকদের উদ্দেশ্য করে বলল, “এই হাদা লোকটাকে বাঁচিয়ে রাখার কী দরকার বল তো? শুধু শুধু সময় নষ্ট। একে এক গুলিতে শেষ করে দিয়ে লাশটা পুঁতে ফেললেই তো ল্যাটা চুকে যায়! বশির ভাই কী ভেবে যে একে বাঁচিয়ে রাখার কথা ভাবছে ওফ!”

এতক্ষণে জানতে পারলাম এদেরকে যারা অর্ডার দিচ্ছে তার নাম বশির। তো হাতিটা মানে লোকটা এ-কথা বলার পরপরই সেই সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা রিটায়ার্ড অফিসার এল। বলল, “এতই যদি বুঝতিস তা হলে তুই হতি আমার লিডার আর আমি হতাম তোর চ্যালা। বুঝলি?”

লোকটা সঙ্গে সঙ্গে অপ্রস্তুত হয়ে অফিসারের দিকে তাকাল। ব্যস্ত হয়ে বলল, “ভাই! ইয়ে আমি তা বলতে চাইনি। আমি বলতে চাচ্ছিলাম…”

পুরো কথা বলার আগে বশির ভাই ওরফে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা লোক ওরফে সেই রিটায়ার অফিসার গম্ভীর গলায় বলল, “একটা জিনিস খেয়াল করেছিস? এই ব্যাটা কিন্তু সব জানে। অমিশা রেপ হওয়া, মার্ডার হওয়া, কে এসব করেছে, কে তাকে সাহায্য করেছে সব জানে।”

বাকি লোকগুলো ভাবতে লাগল আর রিটায়ার্ড অফিসার বশির আমার দিকে আঙুল তাক করে বলল, “সব প্রমাণ মিটিয়ে ফেলার পর এতকিছু জেনে গেছে। কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে এতকিছু সম্ভব নয়। এ হয় গোয়েন্দা নাহয় সাংবাদিক।”

আমি সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিয়ে বললাম, “না না, আমি এসবের কিছুই নই। আমি তো ক্যানাডা থেকে এসেছি। আবার সেখানে চলে যাব। আপনারা প্লিজ আমাকে যেতে দিন।”

“হ্যাঁ, দেব। তার আগে আপনি সব প্রমাণ আমার হাতে তুলে দিন।” আমার সামনে ঝুঁকে চোখ বরাবর চোখ রেখে বলল অফিসার বশির।

“কীসের প্রমাণ? আমার কাছে তো কোনো প্রমাণ-টমান নেই! আমি ওসব কোত্থেকে পাব?” আমি বললাম।

“তার মানে আপনি স্পাইং করেননি? ইনভেস্টিগেশন করেননি? এমনি এমনি এত সব তথ্য আপনি জেনে গেছেন?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, এমনটাই হয়েছে।”

“ওঃ! তাহলে কি সব তথ্য আপনি কোনো প্রকার অলৌকিক শক্তির মাধ্যমে জেনেছেন? না কি ভূত আপনাকে বলে দিয়েছে?” তাচ্ছিল্য করে বলল লোকটা।

প্রশ্নটা শুনতেই আমার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। সেইসঙ্গে অমিশার সেই অন্ধকার কালো ছায়াটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। তার সেই কান্নাভেজা কণ্ঠ, সেই চিৎকার, সেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে আসা, সেই ভেজা ভেজা দু’টো চোখ সবকিছুই যেন মনে হলো আমি এখনি দেখলাম, এখনি শুনলাম। ব্যাপারটা ওরা বিশ্বাস করবে কি না কে জানে! তবে আমি সত্যিটাই বললাম। বললাম, “হ্যাঁ, ভূত বলেছে। অমিশার ভূত।”

আমার কথার প্রভাব লোকগুলোর উপর পরল না। বশির বলল, “বুঝেছি, ভূত তাড়াতে হবে। এই, ভূত তাড়ানোর ব্যবস্থা করো তো।”

সঙ্গে সঙ্গে দু’টো লোক বেরিয়ে গেল। মিনিট দু’-এক পর ফিরে এল ড্রিল মেশিন সহ কিছু জিনিসপত্র নিয়ে। একটা চেয়ারও আনল। চেয়ারটা আমার মুখোমুখি বসিয়ে দিতেই অফিসার বশির আয়েশ করে বসল। শুকনো গলায় বলল, “এই জায়গাটা বেশ নির্জন। দূর দূর পর্যন্ত কেউ নেই। এখান থেকে চিৎকার দিলে কেউ শুনবে না। তবে আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাই না। তাই ভালোয় ভালোয় সব প্রমাণ আমাকে দিয়ে দিলেই আমি খুশি হব।”

“বললাম তো আমার কাছে প্রমাণ নেই। আমি কোনো প্রকার ইনভেস্টিগেশন করিনি। সবকিছু অমিশা নিজেই আমাকে বলেছে।” আমি চেঁচিয়ে বললাম।

এরপর যে অত্যাচার ওরা শুরু করল তা বলে বা লিখে বিশ্লেষণ করা যাবে না। তবুও শুনুন, ওই অফিসার বশির ড্রিল মেশিন চালু করে আমার বাঁ হাত বরাবর চালিয়ে দিলো। সে কী যন্ত্রণা! সে কী আত্মচিৎকার! তখন আমি মরে যেতে পারলে বাঁচি। ড্রিল মেশিনের লোহার বিট হাতের একদিক দিয়ে ঢুকিয়ে অন্যদিকে বের করেছে। আমি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলেছি, “সত্যি আমার কাছে প্রমাণ নেই। আমি নির্দোষ। আমাকে ছেড়ে দাও।”

মেশিনটা নামিয়ে রেখে বশির বলল, “আপনি নির্দোষ তা আমরা সবাই জানি। নতুন কিছু বলুন। প্রমাণ কোথায় রেখেছেন সেটা বলুন। এতে অন্তত আপনার প্রাণ বেঁচে যেতে পারে।”

এরপর আমার এতটাই রাগ হলো যে আমি লোকটার মুখে থুতু ছিটিয়ে দিলাম। বললাম, “আর কতবার বললে বিশ্বাস করবে তোমরা? কতবার বলব আমার কাছে প্রমাণ নেই?”

লোকটা প্লাস হাতে তুলে নিল। সেটা দিয়ে আমার ডান হাতের দু’টো নখ উপড়ে ফেলল। কিন্তু এরপরও যখন প্রমাণ দিতে রাজি হলাম না তখন সে বাঁকা হেসে বলল, “ভূতে ধরেছে না? ভূত কী করে তাড়াতে হয় তা আমি ভালো করেই জানি মিস্টার আরজু।”

বলে চুটকি দিতেই দু’টো লোক বেরিয়ে গেল।
খানিক বাদে, তখন আমি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি এমন অবস্থা। চোখদু’টো আপনাআপনি লেগে আসছিল। ঠিক তখন দু’জন লোক টেনে টেনে দিজাকে নিয়ে এল। দিজার পুরো শরীর ভেজা। গায়ের ওড়না নেই। ভেজা কাপড়গুলো শরীরের সাথে একদম লেগে আছে। সে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নিতে নিতে অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। আমি এবার জ্বলে উঠে বললাম, “আমার ওয়াইফের কিছু হলে আমি কাউকে ছেড়ে দেব না বলে দিলাম।”

বশির ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী করবি রে তুই? তোকে ভূতে ধরেছে না? এবার তোর ভূত তাড়াব।” বলেই দিজার দিকে এগিয়ে গেল। আমি চিৎকার দিলাম, “ওঁকে কিছু করবেনে না। ওঁকে ছেড়ে দিন! আপনার যা করার আমার সাথে করুন। ওকে ছেড়ে দিন প্লিজ!”

কে শোনে কার কথা? বশির আমার কথা কানে না নিয়ে দিজার দিকে এগিয়ে গেল। দিজা তখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। এই অবস্থায় সে এমন একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে তা আমার ভাবনার বাইরে ছিল।

রিটায়ার অফিসার বশির দিজার সামনে যেতেই দিজা ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিলো লোকটার গালে! উপস্থিত সবার মুখ হাঁ হয়ে গেল। দিজার এমন কান্ড দেখে অসম্ভব বিপদের মুখে দাঁড়িয়েও আমি হেসে ফেললাম। বাকি লোগুলো দিজাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল, বশির সবাইকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো। দিজার মুখের সামনে মুখ নিয়ে বলল, “আবার মার!”

অবাক করার মতো বিষয় হলো, দিজা আবারো চড় বসিয়ে দিলো লোকটার গালে। আমি এবার শব্দ করে হেসে ফেললাম। কিন্তু রাগে, ক্ষোভে লাল হয়ে যাওয়া দিজার মুখ দেখে আমার হাসি উবে গেল। বশির লোকটা লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিতে নিতে দিজার চুল মুঠোয় ভরে এক টানে তাকে মাটিতে ফেলে দিলো। তখন পৃথিবীর সবচে’ অসহায় মানুষ হয়ে পড়লাম আমি। নিজের স্ত্রীকে আমারই সামনে অন্য একটা লোক অত্যাচার করছে অথচ আমি কিছুই করতে পারছি না! পাপবোধে ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। আমি চেয়ার ভেঙে ছুটে যেতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু পারলাম কই? অতটা জোর আমার গায়ে নেই।

বশির দিজার গালে চড় মারল পরপর তিনবার। আমি চিৎকার দিলাম, “শালা কাপুরুষ! পারলে আমার সামনে আয়!”

কথাটা বশিরের কানে গেল কি না কে জানে! সে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দিজার গায়ের কামিজ ছিঁড়তে লাগল। পুরোটা ছিঁড়ে ফেলার পর আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ভয়ে ভয়ে আবারো চোখ খুলে দেখি লোকটা এবার দিজার কোমড় লক্ষ্য করেছে। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিয়ে বললাম, “বলছি! সব বলছি। সব প্রমাণ দিয়ে দিচ্ছি তোমাদের। তোমরা ওঁকে ছেড়ে দাও।”

লোকটা দিজার গালে চড় মেরে বলল, “তোকে আমি দেখে নেব।”

এরপর আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আর আমি তীব্র ঘৃণা বুকে চেপে রেখে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মাঝবয়েসি লোক। চুল-দাড়িতে পাক ধরেছে। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরায় ভালোই লাগে দেখতে। অথচ এই লোকটাই এত বড়ো ক্রিমিনাল সেটা কে বিশ্বাস করবে!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here